নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন গাধামানব

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন

ডাল দিয়ে ভাত খাই, রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মানুষ আমি ভেজাল হলে'ও আমার লেখাগুলো খাঁটি ।

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

আগন্তুক-১

১৯ শে জুন, ২০১৬ রাত ৩:০৮

এসি আমার সহ্য হয় না। গরীবের ঘরে জন্মানোর অজস্র সমস্যার মধ্যে এটা একটা, এসিতে কিছুক্ষণ থাকার পর হাঁচি আসতে থাকে। পারতপক্ষে এসি রুমে থাকি না, এসি গাড়িতে চড়ি না। অর্থের কৃচ্ছতাসাধনও হয়, শরীরও ভালো থাকে।

জগতের একটা নিয়ম হচ্ছে, আপনি যা চাইবেন ঠিক ওটুকুই আপনি পাবেন না। আমেরিকান প্রকৌশলী মারফি সাহেব এই নিয়মটা অল্প কথায় বলে গেছেন- ‘anything that can go wrong, will go wrong’ আমার সাথেও তাই হল, নতুন শহরে অফিসের কাজে এসেছি, অফিস ম্যানেজার হোটেলে রুম বুক করে রেখেছিল। অবশ্যই এসি রুম। হাঁচি দিতে দিতে তাকে বলেছি, আমার জন্য যত সামান্য আয়োজন করা যায় ততই ভালো। ফেরার পথে সে ‘সামান্য আয়োজন’ করেছে। ট্রেনের আস্ত কেবিন আমার জন্য বুকিং দেয়া হয়েছে। অতি আনন্দের কথা, মারফি সাহেবের সূত্র অনুযায়ী সেই কেবিনও এসিযুক্ত। ম্যানেজার বিদায় হলে আমি রেলওয়ের একজন কর্মচারীকে সবিনয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এসি বন্ধ রাখার কোন ব্যবস্থা আছে কিনা। সে আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল যেন আমি বড়সড় একটা অপরাধ করে ফেলেছি। আমি অপরাধীসুলভ ভঙ্গিতে কাঁচুমাচু করে কেবিনে ঢুকলাম। সাথে একটা কাঁথা থাকলে ভালো হত। ভলভো গাড়িতে শীতার্তদের জন্য কম্বলের ব্যবস্থা থাকে, বাংলাদেশ রেলওয়ে কি সেরকম দয়া দেখাবে? ভয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করলাম না।

বাঁচার তাগিতে মানুষ নানা কাজ করে। ছাত্রজীবনে ‘অধ্যয়ন’ নামক অত্যাচার থেকে বাঁচতে কোমলমতি শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ে। এই ঘুম অপরাধ না, আত্মরক্ষার নামান্তর মাত্র। আমিও সেরকম শীতের অত্যাচার থেকে বাঁচতে ঘুমিয়ে পড়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা করলাম। চেষ্টায় ঈশ্বর মেলে, ঘুম তো সামান্য বিষয়।

চোখ প্রায় লেগে এসেছে, এমন সময় দরজায় শব্দ হল। দেখি একটা মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে, বয়েস সাত কি আট। মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে আটকে গেলাম। সম্মোহনী শক্তির মতো সে চোখ যেন আমাকে অতীতে টেনে নিয়ে গেল।

তখন সবে কলেজে উঠেছি। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের হাওয়া কীভাবে বইতে শুরু করে- তার নানা বর্ণনা ইনিয়ে বিনিয়ে লেখকেরা বইপত্রে লিখে রেখেছেন বটে, কিন্তু আমার কাছে সেসব খুব একটা যথার্থ মনে হয় না। জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘সবাই কবি না, কেউ কেউ কবি’, তেমনি যারা লেখে তারা সবাই লেখক না, কেউ কেউ লেখক। উনাদের তাত্ত্বিক আলাপ বাদ দিয়ে নিজের কথাই বলি। সময়টা বেশ অদ্ভুত ছিল, চারপাশের রঙগুলো যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে লাগল, যেমনটা হয় সস্তা ফোন ফেলে দামী স্মার্টফোন হাতে নিলে, অনেকটা সেরকম। সবকিছু যেন নতুন, সেই নতুনের উপর আমার সদ্য জন্মানো অধিকার। নারীর প্রতি পুরুষের আদি আকর্ষণের নতুন রূপ অন্তরে অনুভূত হল। হিমালয়ের উপর রবির কিরণ পড়লে যেভাবে ঝলমলিয়ে উঠে, জীবনের একটা দিগন্ত যেন সেভাবে আবির্ভূত হল। এলাকার মেয়েরা, যাদের আগে নিতান্ত সাধারণ বলে মনে হত, তাদের ঝাপসা করে দিয়ে যেন একটি চেহারা চোখে আটকে গেল; ক্যামেরায় ফোকাস করার পর অবজেক্টের পেছনে ঝাপসা ব্যাকগ্রাউন্ডের মতো সেই মেয়েরা হারিয়ে গেল। সামনে দিবারাত্রি একটি মুখ, সেই মুখের সারল্যে আমি অভিভূত হলাম, নাকি লাবণ্যের সাগরে হারিয়ে গেলাম তা মনে নেই। তার নাম লুকিয়ে কী লাভ, খোদ রবীন্দ্রনাথ যেখানে ‘শিশির’ নিয়ে শুরু করে শেষমেশ ‘হৈমন্তী’ নামটা বলে ফেলেছিলেন, সেখানে আমি লুকিয়ে কী করবো? তার নাম অণু।

রসায়ন জানতাম, অণু যে জটিল বস্তু, পরমাণুর মতো একক ও সহজ নয়- সেকথা তো বইপত্রেই লেখা আছে। বাস্তবেও তাই দেখলাম। আমাদের পাড়ার আরও দু’জন পাওয়া গেল যারা অণুর পাণিপ্রার্থী। তাদের কাছেও খবর চলে গেল আমি মাঠে নেমেছি। আমার সুনাম ছিল ভালো ছাত্র হিসেবে, সুমনের খ্যাতি এলাকার সবচেয়ে চটপটে ও স্মার্ট ছেলে হিসেবে, তৃতীয়জন আমাদের দেখে সসম্মানে মাঠ ছেড়ে দিল। টিকে রইলাম আমরা দুজন, ফুটবল খেলায় যেমন বিনেপয়সায় দু’দলের সমর্থক জুটে যায়, আমাদেরও তেমন সমর্থক গোষ্ঠী দাঁড়িয়ে গেল। সুমনের এক সমর্থক বন্ধুমহলে রটিয়ে দিল, সুমন নাকি অণুকে গোলাপ দিয়েছে, অণুর সাথে তার ইতিহাস পোক্ত না হয়ে পারেই না। আমার এক সমর্থক পাল্টা রটিয়ে দিল, অণু নাকি সেই গোলাপ ড্রেনে ফেলে দিয়েছে, সুমনের প্রেম এখন ড্রেনের সাগরে- এমন কথাও শোনা গেল। আমি কিংবা সুমন সামনাসামনি কিছু বলতাম না, কিন্তু দুজনের চোখে চুম্বকের বিকর্ষণ সূত্রের সত্যতা প্রতিফলিত হত।

অণু কি এসব টের পেয়েছিল? হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না। সময়টা বেশ বেরসিক ছিল, না ছিল আধুনিক কাল, ফেসবুক মোবাইলের যুগ। না ছিল প্রাচীনকাল, যখন পায়রার পায়ে বেঁধে প্রেমপত্র পাঠানো যেত। রাজনীতিবিদেরা এমন সময়কে বলেন ‘ক্রান্তিকাল’, তারুণ্যের উথাল পাথাল সময়টাতে তাই উজির নাজির মারা ছাড়া আমাদের বিশেষ কর্তব্য ছিল না। আমি পড়াশোনা শিকেয় তুলে অণুকে নিয়ে কী কবিতা লিখলাম, সুমনের বন্ধুর বোনের সাথে অণুর কোন পছন্দের গানের খবর পেয়ে সুমন গলা সাধছে- এই করে দিন কেটে যাচ্ছিল। এর মধ্যে অভাবনীয় ঘটনা ঘটল, যা আগে ভাবা যায় নি তাই তো অভাবনীয়! অণু আমাদের বাড়িতে আসবে এটা কে জানতো?

আমি কী একটা বই পড়ছিলাম- এমন সময় শুনলাম অণু ওর মায়ের সাথে আমাদের বাসায় এসেছে, ড্রয়িংরুমে বসে আছে। মা ওদের সাথে কথা বলছেন। নিজের ঘরে আড়ি পাতার মতো হাস্যকর কিছু নেই, সে কাজটি করে বসলাম। দরজার সাথে কান পেতে রইলাম, যদি অণুর কথা শোনা যায়। হায় দুর্ভাগ্য! অভাগা যেদিকে কান বাড়ায় সেদিকে সাগরের গর্জনও বোধহয় হারিয়ে যায়! নানা বৈষয়িক আলোচনায় কাঙ্ক্ষিত গলাটি শুনতে পেলাম না। শেষমেশ ভাবলাম ঘর থেকে বেরিয়ে যাই, বেরোবার পথে তো অণুকে দেখা যাবে! বুকে ফুঁ দিয়ে বের হলাম, অণুর মাকে সালাম দিলাম, তিনি জবাব দিলেন। কিন্তু অণু যে কিছু বলল না! আমার বাড়ি, অথচ কেউ ভদ্রতা করেও বলল না, একটু বসো, আড্ডা দাও, চা-বিস্কুট খাও। জগতের এই নিঃস্পৃহ রূপ দেখে বাইরে এসে দাঁড়ালাম, খুব মনে করার চেষ্টা করলাম, অণুর মুখে কি আমায় দেখে একটু হাসি ফুটেছিল? নাহ, নিষ্ঠুর স্মৃতিশক্তি প্রতারণা শুরু করল। একবার মনে হল, ওর হাসি দেখেছি, আবার মনে হল ও যেন আমাকে দেখতেই পায় নি।

এই ঘটনা আমার সমর্থকমহলে তুমুল উত্তেজনা সৃষ্টি করল। তারা বুক চিতিয়ে বলতে লাগলো, ‘এবার বোঝা গেল? অণু কী যার তার বাড়িতে যায়? তাও মাকে সাথে করে? একেবারে যে পাকাপাকি পারিবারিক বোঝাপড়া!’ আমার ভক্তকুলের কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে বলে ফেলল, ‘এটা হচ্ছে পাত্র দেখতে যাওয়া। আগেকার দিনে রাজকন্যার স্বয়ম্বর অনুষ্ঠিত হত, রাজকন্যা নিজেই পাত্র বেছে নিত। অণু কী রাজকন্যার চেয়ে কম সুন্দর?’ সুমনের সমর্থকদের চেহারা শুকিয়ে এলো। সুমনের বাড়ির কয়েকশো গজের মধ্যেও অণুকে কোন কালে দেখা গিয়েছে বলে কেউ দাবি করতে এলো না।

এসব কথাবার্তায় আমি যখন সুখে দিন যাপন করছি, সুমন যখন মুখ লুকিয়ে বেড়াচ্ছিল, তখন বিধাতা মুচকি হাসছিলেন। অণুদের বাড়িতে ওর দূর সম্পর্কের এক খালা বেড়াতে এলেন। আকাশ থেকে চিল নেমে এসে যেভাবে মাছ ছোঁ মেরে নিয়ে যায়, সেভাবে নিজের সিঙ্গাপুর প্রবাসী পুত্রের জন্য অণুকে ‘বুকিং’ দিলেন। এতদিন সুমন লুকিয়ে বেড়াচ্ছিল, এবার আমি নিজেকে লুকিয়ে ফেললাম। বাইরে তেমন একটা যাই না। ঘরে স্বেচ্ছাবন্দী জীবন কাটাই, পড়াশোনা হয় না, অবসাদ এবং মাথায় যখন যে শব্দ আসে সেগুলো মিশিয়ে ‘কবিতা’ উৎপাদন করি। এসব কাব্যের না আছে চেহারা, না আছে রূপ। কবিগুরু বাংলা ভাষায় এমন কবিতা প্রসব হচ্ছে জানলে দ্বিতীয়বার মারা যেতেন। এর মধ্যে একদিন সুমন আমার বাসায় এলো। ওর মুখও শুকনো। একই ঝড়ে ঘর হারানো এলাকাবাসীর মধ্যে যে হৃদ্যতা থাকে, সেই অনুভূতি ওর চোখেমুখে। পুরনো শত্রু নয়, দুই ব্যর্থ যোদ্ধা হিসেবে আমাদের আলোচনা হল।

- অণুকে দেখলাম। সুমন নিচু গলায় বলল।
: কেমন আছে ও? আমি জানতে চাইলাম। প্রশ্ন নয়, যেন স্বগতোক্তি।
- কথা তো বলিনি। হাসিখুশিই তো মনে হল। হাতে আংটি দেখলাম।

সেই আংটি কিসের, তা জিজ্ঞেস না করলেও চলে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমার দীর্ঘশ্বাস লক্ষ্য করে সুমন বলল, ‘আসলে তুই-ই ওর যোগ্য ছিলি। আমি তো অযথা ক’দিন ঘুরলাম। তোর মতো ছেলে হারালো মেয়েটা। দুর্ভাগ্য তো ওরই’। দুর্ভাগ্য কার- সেই আলোচনা নিরর্থক। আমি চুপ থাকলাম। অণুকে হারানোর মধ্যে একমাত্র ভালো ঘটনা ঘটল, সুমনের সাথে সম্পর্কের তিক্ততাটা আর রইল না। দু'পক্ষের সমর্থকরা খেলা ভণ্ডুল হলে যেভাবে মাঠ ছেড়ে নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যায়, আমাদের সমর্থকদেরও তাই হল। কিছুদিন পর অণুরা শহর ছেড়ে চলে গেল। লোক মারফত শুনলাম, বিয়েটা সেরে অণু নাকি বিদেশ রপ্তানি হওয়ার অপেক্ষায় আছে। দেখা হলেই সুমন নানাভাবে সান্ত্বনা দিত। দেশের ভালো ইলিশ ও ভালো মেয়ে- কোনটাই দেশের মানুষের কপালে থাকে না, বিদেশ চলে যায়, এরকম কথাবার্তাও বলত। নিস্ফল আস্ফালন ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার ছিল না।

সুমন ইন্টারমিডিয়েট সেরে বাবার ব্যবসা দেখতে লাগলো, আমি চলে গেলাম মেডিকেলে। ক’দিন বাদেই প্রথম যৌবনে প্রেম করার সুবিধে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। দিন কেটে মাস গেলো, মাস পেরিয়ে বছর, কিন্তু কারো সাথে হৃদ্যতা হল না। যে মেয়ের কণ্ঠ সুন্দর, তার কথা শুনে মনে মনে নিজের অজান্তে অণুর দূর থেকে শুনতে পাওয়া গলার সাথে মিলাই, কই, অণুর পরমাণুমাত্রও তো এ গলায় পাইনা! বন্ধুরা যে মেয়ের চোখ সুন্দর বলে দিবারাত্রি সভা-সমিতিতে আলাপ করে বেড়াচ্ছে, সেই চোখ যে অণুর সাথে মেলে না! নতুন কারো সাথে হৃদ্যতা করতে যে হৃদয় দরকার ছিল, সেই হৃদয়টি অজান্তে একজন নিজের সাথে বয়ে বেড়াচ্ছে কোন অজানায়, তা কে জানে! তারচেয়ে ঢের লক্ষ্মী, ঢের সুন্দর অনেকে এসেছে সামনে, কিন্তু সে যে অতুলনীয়! জানি, এই বৃথা তুলনা জীবনের পক্ষে অলাভজনক। কিন্তু ভালোবাসা কি লাভ লোকসান ভেবে কোথাও কোনোকালে জন্মেছে?

জীবন এগিয়ে যায়, স্মৃতি পুরাতন বন্ধুর মতো মানুষকে অনুসরণ করে চলে, কখনোই ছেড়ে যায় না। যে স্মৃতি ছেড়ে চলে যায়, সেটা আদতে মনে রাখবার মতো কিছু ছিলই না। অণুর স্মৃতি মস্তিষ্কের কোন নিউরনে কর্ণওয়ালিসের 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত' করে বসত গড়ে রেখেছিল- সেটা বোঝার সাধ কিংবা সাধ্য কোনটিই আমার ছিল না।

আজ ট্রেনের কামরার দরজায় দাঁড়ানো ছোট্ট মেয়েটির চোখ দেখে সেই স্মৃতি যেন বৃষ্টিভেজা সজীব পাতার মতো জেগে উঠলো। আমার সমগ্র অস্তিত্ব নিঃশব্দে চিৎকার করতে লাগলো, এ যে সেই চোখ! বিধাতার সেই নিপুণ হস্তশিল্পের হুবহু প্রতিলিপি!

(চলবে)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.