নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন গাধামানব

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন

ডাল দিয়ে ভাত খাই, রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মানুষ আমি ভেজাল হলে'ও আমার লেখাগুলো খাঁটি ।

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

নিবেদন

২৯ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৪:২০

শমীকে কয়েকবার ফোন দিলাম, কিন্তু ও রিসিভ করল না।


আজকের অনুষ্ঠানে ওর পারফর্ম করার কথা ছিল। হঠাৎ ডেঙ্গু ধরা পড়ায় ও আর আসছে না, ওর বদলে ঊর্মিকে নৃত্যদলের প্রধান করে দেয়া হল। আজ অবধি শমীকে ছাড়া আমাদের কোন অনুষ্ঠান হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ঊর্মি যে খারাপ নাচে তা নয়, কিন্তু শমীর কোন তুলনা নেই। কত অনুষ্ঠানে ওর নাচের বদৌলতে আমরা পুরষ্কার পেয়েছি তার হিসেব নেই। বাদল ভাই অনুষ্ঠানের প্রধান সংগঠক, শমী বাদ পড়ার পর থেকে তার মেজাজ রীতিমতো খিচড়ে আছে। সবাইকে গালাগাল করে যাচ্ছেন। নতুন মেয়েটা স্টেপে ভুল করল আর বাদল ভাই চেঁচিয়ে উঠলেন, ' বাঞ্চুদ মশা তোমাগো কামড়ায় না ক্যান? ডেঙ্গু তো তোমাদের হওয়া দরকার, ডেঙ্গু হইয়া মইরা যাও, নাচার দরকার নাই।' বাদল ভাইয়ের রাগ নতুন মেয়েটার উপর নাকি মশার উপর, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।


আমি বাদল ভাইয়ের কাছ থেকে দূরে সরে গেলাম। এই মুহূর্তে বাদল ভাইয়ের মুখের কোন লাইসেন্স নেই। লাইসেন্সবিহীন পিস্তলের চেয়েও লাইসেন্সবিহীন মুখ বেশি বিপজ্জনক। আমি গুণহীন মানুষ, এই সংগঠনের স্টেজ পারফর্মেন্সের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। সামান্য লেখালেখির সুবাদে কালেভদ্রে ডাক পড়ে, বাকি সময় আমি একজন দর্শক। কতজন কতকিছু করছে, দেখলেও আনন্দ হয়। শুভ্র’দা যখন তবলা বাজায় তখন অসাধারণভাবে মাথা ঝাঁকায়, জেমসের মতো খ্যাতি না পেলেও তার অন্তরে সঙ্গীতের জন্য যে ভালোবাসা আছে তা অমূল্য। রিহারসেলের সময় কালাম নামের ছেলেটা চা পরিবেশন করে, ওটা আদা চা নাকি লেবু চা আমি আজ পর্যন্ত ধরতে পারিনি, বোধহয় দুটোর মিশ্রণ, দু’তিন কাপ খেলে কেমন যেন নেশা ধরে যায়। কালামকে চা আনতে বললাম। শুভ্র’দাকে দেখলাম এক কোণে মনমরা হয়ে বসে আছেন, সেদিকে এগিয়ে গেলাম।

‘কী খবর দাদা? চুপচাপ কেন?’
‘ধুর মিয়া, ভাল্লাগে না। কেমন জানি সব আউলা ঝাউলা হইয়া গ্যাছে’ শুভ্র’দার গলায় হতাশা।
‘কেন?’
‘কিছুই ঠিকমতো হইতেছে না’
‘শমীর জন্য?’ আমি জানতে চাইলাম।
শুভ্র’দা ষ্টেজের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, ‘মাইয়াডা নাচতে জানে এইটা বড় ব্যাপার না, ও হইতেছে পুরা টিমের আলো, বুঝলা। আইজ কয়দিন ধইরা সবাই লাফালাফি করতাছে কিন্তু আসল নাচ বাইর হইতেছে না। গুরুরা তো হরদম বলে- মা সরস্বতীর বর সবাই পায় না, যে পায় তারে শিল্প কখনো ছাইড়া যায় না। শমী মাইয়াডা অন্য লেভেলের শিল্পী। ও না থাকলে প্রোগ্রাম কেমন হইব কে জানে! যাউকগা, তোমার কী খবর? লেখালেখি কেমন যাইতেছে?’
‘আমার লেখালেখি হচ্ছে তেলাপোকার উড়াউড়ির মতো। বিপদে পড়লে তেলাপোকাও উড়ে, চাপে পড়লে আমিও লিখি। বাদল ভাই ফরমায়েশ দিলে লেখা হয়, এর বেশি না’
‘গতবারের নাটকটা কিন্তু জব্বর লেখছিলা, ভেতরে ছোট ছোট ছন্দময় লাইনগুলা ভালো ছিল, তুমি পারলে নাট্যকাব্য নিয়া কাজ করো’
‘কাব্য লেখার যোগ্যতা আমার নেই শুভ্র’দা, তারচেয়ে কাওরান বাজারে সবজি বেচা ভালো, অন্তত কাব্যের অপমান হবে না’
‘কেন? কাব্য লিখতে কি যোগ্যতা লাগে?’ শুভ্র’দা জিজ্ঞেস করে।
আমি উত্তর দিলাম, ‘মির্জা গালিব বলে গেছেন, কাব্য লিখতে চারটা যোগ্যতা লাগে- মদ্যপান, জুয়াদোষ, হাজতবাস ও প্রেয়সীর পাদুকাঘাত। প্রথম তিনটা নাহয় ব্যবস্থা করা গেল, কিন্তু প্রেয়সীর জুতার বাড়ি তো সবার ভাগ্যে জোটে না শুভ্র’দা!’
শুভ্র’দা হাসতে লাগলেন। আমি বিদায় নিয়ে চলে এলাম।

রাস্তায় প্রচুর গাড়ি। জ্যামে আটকে গাড়িগুলো তারস্বরে চেঁচামেচি করছে। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে লাগলাম। কোথায় যাওয়া যায়? রইসের অফিসে? আমাকে দেখলে অবশ্য রইস খুশি হবে। খুশির কারন সে আমার কাছে হাজার পাঁচেক টাকা পায়। কিন্তু যখন রইস টের পাবে আমি খালি পকেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন সেই বন্ধুদর্শনের আনন্দ ফিকে হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। ওদিকে যাওয়ার প্ল্যান বাদ। আচ্ছা, শমীদের বাড়িতে গেলে কেমন হয়?

আমি শাহবাগ হয়ে ইস্কাটনের দিকে রওনা হলাম। শমীর দাদা বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন, ঢাকায় সুলভ মূল্যে একটা দুর্লভ জায়গা কিনে রেখেছিলেন, দেড়তলা একটা বাড়ি বানিয়েছিলেন। উনার তুলনায় শমীর বাবা মোটামুটি বুদ্ধিহীন মানুষ। সকালে অফিসে যাওয়া এবং বিকেলে বাড়িতে ফেরা ছাড়া আর কোন বৈষয়িক কর্মকাণ্ডে তার কোন আগ্রহ নেই। চারপাশে অজস্র বড় বড় দালানকোঠা উঠছে, ডেভেলপার কোম্পানিগুলো বারবার অফার দিচ্ছে জায়গাটা ছেড়ে দিতে, সেদিকে উনার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। ঢাকার আধুনিকতার মানচিত্রে বেমানানভাবে শমীদের বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। উঁচু দেয়ালের ভেতর গাছপালায় ঢাকা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আমি ঢুকব কিনা ইতস্তত করছি, এমন সময় শমীর বাবা বাড়ির গেটে এসে দাঁড়ালেন। অফিস থেকে ফিরলেন বোধহয়।

‘আরে শফিক! কেমন আছো বাবা?’
‘জি ভালো আছি চাচা। আপনি ভালো আছেন?’
‘আছি। সমস্যা তো হল শমীকে নিয়ে। শুনেছ বোধহয়’
‘এখন কেমন আছে ও?’ আমি জানতে চাইলাম।
আমাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে তিনি বললেন, ‘জ্বর আছে এখনো। ডাক্তার ওষুধপথ্য দিয়েছেন, বেশ কয়েকদিন বিশ্রামে থাকতে হবে মনে হয়। উপরের ঘরে আছে, দেখে আসো। অসুস্থ হবার পর থেকে একা একা মন খারাপ করে আছে। তোমাকে দেখলে খুশি হবে’

প্রাচীন আমলের বাড়ি। বিশাল সিঁড়ি ভেঙ্গে আমি দোতলায় এলাম। গানের শব্দ ভেসে আসছিল, সেই সুর অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম। শমীর রুমের জানালায় দাঁড়িয়ে থমকে গেলাম।

শমী নাচছে।

শরীরে শক্তি নেই বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়ে যেন তাল লয় মিলিয়ে সুরের সাথে একাত্ম হয়ে নাচছে তো নাচছেই। ও যেন অন্য ভুবনে আছে, আশেপাশে ফিরেও তাকাচ্ছে না। একজন শিল্পী গৃহবন্দী হয়েও নিজেকে আটকে রাখতে পারছে না, ভেতরের সত্ত্বাটা নিজেকে মেলে দিচ্ছে, ভেঙ্গে দিচ্ছে প্রতিবন্ধকতার দেয়াল। দেহের গণ্ডি থেকে মনের শক্তি যেন ঠিকরে ঠিকরে বের হয়ে আসছে। ওর চোখ থেকে অবিরত জল গড়িয়ে পড়ছে, কী অদ্ভুত দৃশ্য! লিওনার্দো ভিঞ্চি সাহেব এখানে থাকলে নির্ঘাত অসাধারণ একটা ছবি এঁকে ফেলতেন। আমার সে যোগ্যতা নেই, এই নগণ্য আমার সামনে যেন একজন মহান শিল্পীর শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম অন্ধকারে প্রথম সূর্যালোকের মতো উন্মোচিত হল। এ নৃত্য যেন শিল্পের বেদীতে শিল্পীর একান্ত নিবেদিত শ্রদ্ধার্ঘ । আমি মৃন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সময় ওখানেই থেমে গেল, একপর্যায়ে বিলীন হয়ে যেতে লাগলো ওর অশ্রুজলের ধারায়। এ পবিত্র অশ্রুজল সৃষ্টির, বেদনার, জীবনের চরমতম উপলব্ধির।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.