নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন গাধামানব

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন

ডাল দিয়ে ভাত খাই, রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মানুষ আমি ভেজাল হলে'ও আমার লেখাগুলো খাঁটি ।

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া- সবকিছুর হোক অবসান

০৩ রা জুলাই, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:০৪

শাহবাগ আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আমি মেডিকেলের ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষা দিচ্ছি। দিচ্ছি বলা ঠিক না, অংশগ্রহণ করছি বলা শ্রেয়। পেছনের বেঞ্চে বাস করা ছাত্রদের চোখেমুখে দার্শনিকসুলভ উদারতা কাজ করে, তারা পরীক্ষার হলে অন্যকে নির্দ্বিধায় নিজের সাদা খাতা এগিয়ে দেয়, অন্যের খাতা সাগ্রহে দেখেশুনে নেয়, তখন এদের বক্তব্য থাকে-‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’। পরীক্ষার ফল দেয়ার সময় এই দার্শনিকতা আরেকধাপ উঁচুতে ওঠে। আসন্ন বিপর্যয় অনুধাবন করে এরা বলা শুরু করে, ‘পাশ ফেল নয়, পরীক্ষায় অংশগ্রহনই বড় কথা’। সে হিসেবে আমি পরীক্ষা দিচ্ছিলাম না, মূলত অংশগ্রহণ করছিলাম। আসল কাজ হয়ে পড়েছিল গণজাগরণ মঞ্চে মিছিল করতে করতে যাওয়া এবং সেখানে বসে থাকা। দেশের নানা জায়গায় শাহবাগের আদলে গণজাগরণ মঞ্চ হয়েছে, সুদূর কলকাতা থেকে কবির সুমন গান গাইছেন, ‘ঠিকানা চিনি না আছি শাহবাগে, আমার গীটারও আছে’। দেশ উত্তপ্ত, কাদের মোল্লার ‘ভি সাইন’ দেশকে জাগিয়ে তুলেছে। শাহবাগে মোমবাতি প্রজ্বলন করা হয়েছে, খোদ প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত গণভবনে বসে মোমবাতি জ্বালিয়েছেন, ছেলেবুড়ো সবাই মোমবাতি জ্বালাচ্ছে, কী অদ্ভুত আনন্দ! আমরা কয়েকজন মোমবাতি কিনতে গেলাম, গিয়ে দেখি হঠাৎ করে মোমবাতির দাম গিয়েছে বেড়ে। কী আর করা, অল্প কিছু মোম কেনা হল। তাই দিয়ে মোমবাতি প্রজ্বলন করলাম। মোমের আলোতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়া তরুণ মুখগুলো দেখে ভেবেছিলাম, অন্ধকার দূর হবে নিশ্চয়ই, আলো আসবে একদিন, সে আলো হবে এই মোমের আলোর চেয়ে উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত।

সেই সোনালি দিনগুলোর কথা কেন লিখছি? কারন বাঙালির ইতিহাসে উল্লেখ করার মতো ঘটনা বলতে গেলে একটাই, সেটা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের পর জনতার সংগ্রাম অল্প ক’টি। শাহবাগের গণজাগরণ তার মধ্যে অন্যতম। এই আন্দোলন আইনের সংস্কার কীভাবে করেছে এবং তাতে বিচারের পথ কতটা সুগম হয়েছে- এগুলো শাহবাগ গণজাগরণের গৌণ অর্জন। মুখ্য অর্জনটা ছিল মানুষের জেগে ওঠা, কেন ন্যায়বিচার চাই- সেটা অনুধাবন করা। মিছিল সেরে একদিন ঘেমেটেমে একাকার হয়ে রাস্তার ধারে বসে আছি, এক অনুজ প্রস্তাব করল, ‘কাদের মোল্লাকে পাবলিকের হাতে ছেড়ে দেয়াই ভালো, যা করার পাবলিকই করবে’। আমার এখনো মনে পড়ে, আরেকজন সহযোদ্ধা আমাদের সামনেই তাকে উত্তর দিল, ‘কাদের মোল্লারা যেভাবে খুন-রাহাজানি করেছে, আমরাও যদি সেভাবে এগোই, তাহলে পার্থক্যটা কোথায়? আমরা এজন্য ন্যায়বিচার চাই, প্রতিহিংসা নয়’। তার কথা শুনে আনন্দ পেয়েছিলাম, তরুণ সমাজের এই বোধোদয়ই তো শাহবাগের অর্জন! আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তো পরিমাপযোগ্য, কিন্তু এই উপলব্ধির প্রাপ্তিটা তো অপরিমেয়!

পরবর্তীতে দেশে নানা ঘটনা ঘটেছে। জঙ্গিবাদের উত্থান ধীরে ধীরে ঘটেছে। শুরুতে নাস্তিক কিংবা ব্লগার হত্যা, তারপর ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হত্যা, এক পর্যায়ে দেশী গণ্ডিতে বসবাসকারী বিদেশী নাগরিকের উপর হামলা, তারপর রীতিমতো ডিপ্লোম্যাটিক জোনে ঢুকে কিলিং মিশন। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল মহল ঘটনাগুলোকে যতই উপেক্ষা করে গেছে, ভেতরে ভেতরে জঙ্গিবাদ ততই প্রসার লাভ করেছে। ধর্মের মতো কোমল বিষয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার রীতি পুরাতন, ইসলামের প্রথম দিককার ইতিহাসে বল্লমের আগায় কোরআন বেঁধে বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করানোর ইতিহাস আছে। এখানেও ধর্ম ঢালের কাজ করেছে, অস্ত্রের নয়। রাষ্ট্র প্রথম থেকেই বিষয়গুলোতে জিরো-টলারেন্স না দেখিয়ে বরং লেখকদের সাবধান করেছে, ‘আপনারা স্পর্শকাতর বিষয়ে লিখবেন না’। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাদের লেখা যে বিশাল জনপ্রিয় ছিল, তাও কিন্তু না! ছেলের মৃত্যুতে শোকাহত শিক্ষক পিতা যখন গভীর দুঃখের সাথে বলেছেন, তিনি বিচার চান না, তখন রাষ্ট্রের প্রভাবশালী মহলের উচ্চারণ, ‘তিনিও হত্যাকারীদের আদর্শে বিশ্বাসী, তা না হলে বিচার চাইবেন না কেন?’ হামলাকারীরা দূর থেকে হেসেছে বটে। দায়িত্বশীলের কালক্ষেপণ দায়িত্বজ্ঞানহীনতারই নামান্তর। বারবার এসব হত্যাকান্ড ঘটেছে, আরও বড় কিছুর জন্য রাষ্ট্র সাবধান না হলেও সমাজ প্রস্তুত হয়েছে। প্রতিদিন একই রকম দুঃসংবাদ শুনলে এক পর্যায়ে তা কিছুটা হলেও সহনীয় হয়ে ওঠে, তখন আরও বড় আঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে তার ব্যতিক্রম হয় নি। অনেক বোদ্ধা অনলাইনে লিখছেন, এখন ঐক্যের সময়, ‘পিলিজ’ কাউকে দোষ দেবেন না, আসেন ঐক্যবদ্ধ থাকি। সুন্দর আহ্বান, দোষ দেয়ার কিছু নেই, আসেন বরং আমরা পুরষ্কার দেই। যারা এতদিন এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন, তাদের নিদেনপক্ষে একটা সংবর্ধনা দেই। সেজন্য অবশ্যই ঐক্যের দরকার আছে। আলাদা আলাদাভাবে এতগুলো সংবর্ধনা দেয়া কঠিন হবে, খানিক আগেই লিখেছি, ‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’।

এই বরাহশাবকদের সংবর্ধনা দেয়ার চেয়ে জরুরী বিষয় আমাদের স্মৃতিভ্রষ্টতার চিকিৎসা করা। তনুকে ভুলতে আমাদের সময় লাগেনি, মিতুর হত্যাকাণ্ডে আমরা তনুকে ভুলেছি, এসপি বাবুলকে নিয়ে অথবা মিতুর চরিত্র নিয়ে লাফালাফি করে মূল হত্যাকারীকে খোঁজা কতদূর- সেই আলোচনা থেমে গেছে, গুলশানের ঘটনায় তনু-মিতু থেকে শুরু করে রাজশাহীর রেজাউল স্যার, সবাই এখন পর্দার অন্তরালে। নতুন ইস্যু পেলেই সেটার উপর হিসু করে দিয়ে দায় সেরে ফেলার অদ্ভুত এক ক্ষমতা আমরা অর্জন করেছি। অথচ সবগুলো ঘটনা তো একই সুরে গাঁথা! আইনের শাসন যেখানে নেই, সেখানে একের পর এক এগুলো তো হবেই! বক্তব্য দিয়ে অপরাধ ঠেকানো যায় না, অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হয়, সেই বিচার দৃষ্টান্ত হয়ে রয় সমাজে। গত দশ বছরে জঙ্গিবাদের উত্থানের প্রক্রিয়ায় দেশে যতগুলো হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার ক’টার বিচার হয়েছে আমি জানি না। কেউ জানলে আমায় জানাবেন, ঋদ্ধ হবো। বরং জনগণ যাও দুয়েকটা ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে, সেটাকেও ক্রসফায়ারে ফেলে দেয়া হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এদেশের অনেকেই সেই ক্রসফায়ার সমর্থনও করছেন, বলছেন, ‘এরা কি দুধে ধোঁয়া তুলসীপাতা? এদের মেরে ফেলাই তো ভালো’। এই বোদ্ধাদের আমি শাহবাগ আন্দোলনের সময় আমার অনুজ সহযোদ্ধার কথাগুলো মাথায় রাখতে বলব। কেন বিচার প্রয়োজন, প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসা নয়- এটা না বুঝে লাফানোর মানুষের অভাব নেই।

গুলশানের ঘটনায়ও একই রকমের প্রতিক্রিয়া দেখছি। জঙ্গিবাদের উত্থান ও বিকাশ রোধের জন্যই ন্যায়বিচার দরকার, জীবিত জঙ্গিদের আইনের মুখোমুখি করা দরকার। তা না করে আমরা মাদ্রাসা শিক্ষা ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে আলাপে ব্যস্ত। কেউ কেউ ‘মাদ্রাসা ছাত্রদের এতদিন অযথা দোষ দেয়া হয়েছে’ বলে গান গাইছেন, কেউ কেউ ‘ফর্সা গালে ছোটছোট দাঁড়ি’যুক্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্রদের উপর ক্রাশ খেয়ে কাঁদছেন। মূল সমস্যা ও সমাধানের পথ থেকে দুই পক্ষই দূরে। আমজনতার কান্নাকাটি রাজনীতিতে মূল্যহীন এবং যুক্তিহীন, সে আলাপ থাকুক। কিন্তু খোদ ইমরান এইচ সরকার তার ভেরিফাইড পেইজে সম্প্রতি লিখেছেন-
‘বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের শত্রু এই গাদ্দারদের পরিচয় জানলে প্রকাশ করুন। এদের পরিবারগুলোকেও চিনে রাখা দরকার’

গাদ্দারদের জীবনী জানার অধিকার তার আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু এদের পরিবারকে চিনে রেখে তিনি কি করতে চান? প্রতিহিংসার রাজনীতি? ‘অপরাধকে ঘৃণা করো, অপরাধীকে নয়’ এই কথা কি একেবারেই যুক্তিহীন? তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় পড়ার সময় মাননীয় আদালত কেন বলেন, ‘এই রায় আজকের এই বৃদ্ধের নয়, একাত্তরের সেই যুবকের যে হত্যা ও ধর্ষণে অংশ নিয়েছিলে, সহায়তা করেছিল’। ব্যক্তির প্রতি ক্রোধের বশে আমরা অপরাধটিকে ছাড় দেই, অথচ মূল ফোকাস হওয়া উচিৎ ছিল অপরাধটি, তাহলেই সেই অপরাধ থেকে বের হওয়ার পথ পাওয়া যেত। বারবার ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে অপরাধটির বিষে আক্রান্ত হতে হত না।

আমরা যখন সেই জঙ্গিদের সাবেক ও বর্তমান ছবি দেখে তাদের ঘৃণা করছি, তাদের পরিবারকে খুঁজছি, ঠিক তখনই হয়তো আমাদের আশেপাশে কেউ নিরীহ চেহারার অন্তরালে আগামীতে সেই বিষে আক্রান্ত হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা যখন বারবার বলছি, ওদের ক্রসফায়ারে দেয়া উচিৎ, তখন প্রকারান্তরে আমরাও আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে অস্বীকার করছি। ওরাও তো তাই করে এসেছে! প্রচলিত আইন-বিচার-মূল্যবোধকে অস্বীকার করেই তো ওদের উত্থান! আমরাও যদি আইন ও বিচারের মাধ্যমে সমাজকে সুসংহত না করে বরং প্রতিহিংসার চর্চা করি, তাহলে ক্রিয়ার বিপরীতে প্রতিক্রিয়া চক্রাকারে চলতেই থাকবে, অন্যায় দূর হবে না, উত্তরোত্তর এই প্রক্রিয়ার বলয় আরও শক্তিশালী হবে।

নিজেদের স্বার্থেই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে স্বল্পমেয়াদী কিছু আনন্দ জুটতে পারে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তেমন কোন প্রাপ্তির সম্ভাবনা নেই। জঙ্গিবাদ যেমন একদিনে গজায়নি, তেমনি একে উপড়ানোও একদিনের কাজ নয়। সেজন্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সুদৃঢ় ও বস্তুনিষ্ঠ উদ্যোগ প্রয়োজন, আবেগতাড়িত ব্যক্তিগত অনুভূতির আস্ফালন নয়, যার ভিন্নতর বিস্ফোরণকেই আমরা জঙ্গিবাদ বলে আখ্যায়িত করছি। ওরা যেভাবে মানুষ হত্যা করেছে সেভাবে ওদেরকে হত্যা করার সুযোগ পেলে আপনি কিংবা আমি কি করতাম? আমার মনে হয় পারতাম না। এটাই একজন দুর্ধর্ষ জঙ্গি ও একজন সাধারণ নাগরিকের পার্থক্য। জঙ্গিদের ভেতর যে পশুসত্ত্বা জেগে উঠেছিল, সেই পশুসত্ত্বাকে ধ্বংস না করলে আরও অনেক জঙ্গি জন্মাবে, অনেক মায়ের কোল খালি হবে এই পশুর থাবায়। আজ সন্তানহারা শুধুমাত্র আক্রান্তদের নন, আক্রমণকারীদের মায়েরাও। কোনো মায়ের কোল এই পশুর আক্রমণে খালি হোক- আমরা সেটা চাই না, কখনোই চাই না, কোনভাবেই চাই না।






মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা জুলাই, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৪

বটপাকুড় বলেছেন: আচ্ছা বলেন তো এই প্রতিহিংসা এঁর রাজনীতি কে শুরু করেছিলেন? বলতে কষ্ট হলেও এইটা শুরু করছে আওয়ামী লিগ। ২০০২ এঁর নির্বাচনে উনি হেরে গিয়ে আমেরিকা তে বলছিলেন, বাংলাদেশে তালেবান আছে, আর ওনার ওস্তাদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী তো তো কখন বলেন জঙ্গি আছে কখন বলেন নাই। ভাই বাল যত দিন ক্ষমতায় আছে চিন্তা করেন, দেশে সিরিয়ার খাতায় নাম লেখালো বইলা
আপনার এমবিবিএস শেষ হইলে দেশ থেকে ভাগেন। দূরে কোথায় না যেতে পারলে এত লিস্ট মালদ্বীপে যান। প্রাণ আগে ভাই

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.