নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন গাধামানব

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন

ডাল দিয়ে ভাত খাই, রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মানুষ আমি ভেজাল হলে'ও আমার লেখাগুলো খাঁটি ।

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

মেঘলা বিকেলের গল্প

১৮ ই জুলাই, ২০১৬ বিকাল ৫:২২

অসুস্থ হলে শারীরিক অসুবিধার পাশাপাশি কিছু সামাজিক সুবিধাও পাওয়া যায়। অসুস্থ লোককে কেউ মারতে আসলে বাকিরা ঠেকিয়ে দেয়, ‘ও যে অসুস্থ, ওকে মারিসনে!’ খাওয়ার টেবিলে অন্য সময়ে যার রুচি অরুচি বিবেচ্য হয় না, তার দিকে তাকিয়ে পরিবারের কঠিনতম ব্যক্তিটিও নরম গলায় বলে, ‘খাবার ভালো লাগছে না বুঝি?’ অফিসের সহকর্মীটি বন্ধুর গলায় বলে ওঠে, ‘অতো কাজ করতে হবে না, আমি বাকিটা দেখে দেব। কাল সুস্থ না লাগলে আসবেন না, দরকার হলে দুদিনের ক্যাজুয়াল নিয়ে নেবেন। দুনিয়ার ছুটি জীবদ্দশায় কাজে না লাগিয়ে কী লাভ বলুন? পরপারে এই জমানো ছুটি কোন কাজে আসবে?’

অমিত দু’দিন ধরে শয্যাশায়ী। বেশিকিছু না, সর্দিজ্বর। দুর্বলকে কাবু করতে যক্ষ্মার দরকার নেই, সামান্য জ্বর-কাশিই যথেষ্ট। নিজের দুর্বলতার মাঝে এমন সান্ত্বনা খুঁজে সময় পার করা ছাড়া অমিতের আপাতত কিছু করার নেই। ইদানিং নাকি প্রচুর ডেঙ্গুজ্বর হচ্ছে। অমিতের জ্বরটা ডেঙ্গু কিনা পরীক্ষা করাতে হবে। ততদিন প্যারাসিটামল ও বিশ্রাম। বিছানার কাছে পত্রিকা থাকায় বিশ্রাম হচ্ছে না। চোখ খুলে মনের কাজ অব্যহত থাকলে শারীরিক বিশ্রাম হয়তো সম্ভব, কিন্তু ভেতরের মানুষটার শান্তি কোথায়? বিশ্বজুড়ে হামলা-খুন, দেশের মাটিও তো বিশ্বের বাইরে নয়। এতো অমিতের জ্বর নয় যে শুধু একজন কাতরাবে, কোথায় কত শত লক্ষ মানুষ জীবন মরণ সংকটে আছে, তার হিসেব কোথায়!

দরজায় খুট করে শব্দ হল। পাশের রুমের নাহিদ সাহেব। ইঞ্জিনিয়ার মানুষ, তবে ব্যাংকে চাকরি করেন। হাতে একটা প্যাকেট, ওটা অমিতের সামনে রেখে বসলেন।
- নিন, শুরু করেন।
: কী এটা? অমিত কৌতূহল প্রকাশ করে।
- খুলেই দেখুন।

প্যাকেটের ভেতর থেকে আঙ্গুরের থোকা বের হয়। অমিত হেসে বলে,
- এটা আনার কোন দরকার ছিল?
: বাহ! আপনি কী রোজ রোজ অসুস্থ হন নাকি?
- আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে অসুস্থ হওয়া একটা বিরল আনন্দের ব্যাপার?
: বিরল তো বটেই, চাইলেও তো আর অসুস্থ হওয়া চলে না। স্কুলজীবনে কত যে চাইতাম, অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলেই স্কুল থেকে মুক্তি! অল্প বয়সেই টের পেয়েছি, অসুস্থ হওয়া মানুষের পক্ষে সহজ নয়। অনেকে তো রীতিমতো বগলে রসুনের কোয়া ভরে বসে থাকতো, তাতে নাকি গা গরম হয়। বিরল ব্যাপার না হলে এতো সাধ-সাধনা করতে হয় নাকি? আর আনন্দের ব্যাপার বলছেন, সেটা নির্ভর করে পুরোপুরি নিজের উপর।
- নিজের উপর মানে? মানুষ তার সুখ দুঃখ নিজেই নির্ধারণ করে? অমিত বেশ অবাক হয়।
: সে তো বটেই। ধরেন, আপনি কোথাও যাচ্ছেন। রাস্তায় বৃষ্টি শুরু হল। আপনার কাছে ছাতা নেই, কাছেপিঠে কোথাও দাঁড়াবার মতো আশ্রয়ও নেই। আপনি কী করবেন? দুঃখিত হবেন, নাকি আনন্দিত?

অমিত দ্বিধায় পড়ে যায়। আসলেই তো! কি করা উচিৎ? গলায় দ্বিধা নিয়ে অমিত বলে,
- জানি না। হয়তো দুঃখিতই হবো।
: এটাই হচ্ছে আমাদের সমস্যা, বুঝলেন। যা আমরা নিজেরাই নির্ধারন করতে পারি, তার মধ্যে খারাপটা খুঁজে বের করা আমাদের অভ্যেস। ভিজে যাওয়ার দুঃখটা ছাড়ুন, ভেবে দেখুন তো! ওই নির্জনে বৃষ্টিটা শুধুমাত্র আপনাকে আপন করে নেয়ার জন্য এভাবে ছুটে এলো কিনা! কিংবা কতদিন আপনার বৃষ্টিতে ভেজা হয় না, আজ একটু ভিজলে ক্ষতি কোথায়! দু’হাত মেলে একটু ছুঁয়ে নিন বৃষ্টির জল, সমস্যা কীসের? বাস্তবে কিংবা পর্দায়- ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ তো একেবারে খারাপ জিনিস না, রীতিমতো ব্যবসাসফলও বটে!
- পর্দায় মানে? বুঝলাম না।
: আরে ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ সিনেমার কথা বলছিলাম!

নাহিদ সাহেবের কথা শুনে অমিত হাসতে থাকে। হাস্যরসিক হলেও নাহিদ সাহেব একেবারে অযৌক্তিক বলেননি। আসলেই তো! জীবনে মানুষই তো ঠিক করে সবকিছুর সংজ্ঞা। কোনোকিছু ভালো না মন্দ, তা তো পৃথিবীতে মানুষেরই ঠিক করে দেয়া। আজ যা আইনি, দেখা যাবে কালই নতুন আইনে তা বেআইনি। এক জায়গায় যা সিদ্ধ, অন্যত্র তা বিরুদ্ধ। শাস্ত্রসিদ্ধ মানুষের সঙ্গে যা স্বকীয়া, অন্যত্র হলেই তা পরকীয়া। এই সংজ্ঞাগুলো একজনের সৃষ্ট নয়, একদিনের সৃষ্ট নয়। সময়ের প্রয়োজনে বৃহত্তর কল্যাণের মানসে কেউ হয়তো গড়ে দিয়েছেন একটা কিছু, সময়ের প্রবাহে তার আসন পাকা হয়েছে মাত্র। অমিতের মনে পড়ে যায় গ্রামের সেই বাল্যবিধবা মালতী দিদির কথা, যিনি সামাজিক সংস্কারের কারনে আমৃত্যু বিধবাবেশে সাদাসেদ্ধ খাবার খেয়েছেন। সবার সুখে-দুঃখে পাশে থাকা মানুষটির ভাগ্যে সমাজ বেদনার ডালি সাজিয়ে দিয়েছে, আর তো কিছু নয়। সব রীতিনীতি খারাপ- তা নয়, ভালোর ভিড়ে মন্দগুলো জীবনকে জড়িয়ে রাখে, এটাও তো সত্য। আলো আঁধারের মতোই মানুষের জীবনে এদের বিচরণ। কিংবা অমিতদের পাশের বাড়ির রিনা মেয়েটা। অমন মেধাবী একটা মেয়ে, কত সাধ ছিল ডাক্তারি পড়বার! যখন চান্স পেলো না তখন যে মানুষগুলো একসময় প্রশংসা করত, তারাও যেন দীর্ঘদিনের জমানো গালাগাল বানের জলের মতো বইয়ে দিল। রিনার বাবা-মার চোখে অঝোর ধারা। যে সন্তান বাবা-মায়ের হাসির দিকে তাকিয়ে প্রদীপের আলোয় রাতের পর রাত নির্ঘুম পড়াশোনা করে কাটিয়েছে, সে জন্ম দেয়া মানুষগুলোর চোখের জল সইবে কী করে? পরদিন রিনার লাশ পাওয়া গেল বাড়ির চালের সঙ্গে বাঁধা, টেবিলের চিরকুটে নিজের অপারগতার জন্য বাবা-মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে গিয়েছে সে।

মালতী দিদি কিংবা অভিমানী রিনা- দুজনের কাছে জীবন কেন দুঃখের ভেট পাঠিয়েছিল? নাকি আমাদের সামনে আনন্দের ও বেদনার উপহার সমানভাবেই থাকে, আমরা যা তুলে নিই তাই হয় ভাগ্য? মালতী দিদি যদি সংসারে ফিরে আসতেন, সেই সুখী জীবন তো কারো দয়ার উপকরণ হত না, সে ছিল তার অধিকার। রিনা ডাক্তারি পড়তে পারেনি বটে, কিন্তু ও যে আগামীর কোন বড় বিজ্ঞানী হতে পারত না তা কে বলতে পারে! সমাজ বা পরিস্থিতি অনেক কিছু বলতেই পারে, কিন্তু সেই উত্তাল সাগরের বিপরীতে সত্য-সুন্দরের পথে নিজের দুর্গম অভিযাত্রাই কী জীবন নয়?

নাহিদ সাহেব নিজের রুমে চলে গেছেন, উনার আঙ্গুরের প্যাকেটটা আছে। একটা আঙ্গুর মুখে দিয়ে অমিত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সুস্থ থাকলে এতো কিছু ভাবা হত না, অসুস্থ থাকায় জীবনমুদ্রা দুটো পিঠ সম্পর্কেই ভাবার অবসর হল, নাহিদ সাহেবের কল্যাণে কিঞ্চিৎ ফলাহারও হল। মোবাইলটা হাতে নিতেই অহনার মিসড কল চোখে পড়ল অমিতের। অহনার নম্বরে ডায়াল করল সে।
- জ্বর কমেছে? অহনা জিজ্ঞেস করল, ওর কণ্ঠে উদ্বেগ।
এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবে অমিত? দেহের জ্বর, তা সে যাই হোক, অহনার কণ্ঠ যে ওর মনের জ্বর বাড়িয়ে দেয় অজান্তেই। সেই জ্বরের কথা কি বলা চলে? থার্মোমিটারে যা মাপা চলে না, তার দাবি কোন আদালতে গ্রাহ্য হয়!
: আছি মোটামুটি।
- তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি যদি লজ্জার মাথা খেয়ে তোমার মেসে যদি চলে আসি, খুব বেশি সমস্যা হবে?
: আমার তো সমস্যা নেই। তবে সমাজ ও রাষ্ট্রের সমস্যা হবে বৈকি!
- এমনি বললাম, কিছু মনে করো না। দ্রুত নিজেকে সামনে অহনা বলে। 'ওখানে তোমার খেয়াল রাখছে কেউ?'

হায় নারী! ক'দিন আগে অমিত একটা পত্রিকায় পড়েছিল, মেয়েরা নাকি প্রিয়জনের উদ্বেগে যে আচরণ প্রকাশ করে, সেটা পুরুষ শত চেষ্টা করলেও পারে না। মেয়েদের ভেতরের মাতৃসত্ত্বা জীবনভর তাকে মমতাময়ীর রূপে প্রকাশ করে নানা মঞ্চে। অমিতের এই অসুস্থতায়ও সেই মমতার প্রতিফলন ঘটছে অহনার কণ্ঠে। নাহিদ সাহেবের আনা আঙ্গুরের প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে হেসে অমিত বলল,
- খেয়াল রাখছে। ফলমূল খাচ্ছি। বোধহয় বেশিদিন অসুস্থ থাকা হবে না।
: তাহলে তো ভালোই।
- ভালো আর কোথায়। অসুস্থ থাকলে সবার যেটুকু যত্নআত্তি পাচ্ছি, সুস্থ হলে তো সেটা পাবো না।
: সুস্থ হলে অন্তত তোমায় দেখতে তো পাবো! অহনা সুস্থতার পক্ষে যুক্তি দেখায়।
- সেটা তো এখনো সম্ভব।
: মানে?
- তুমি আসতে না পারো, আমি তো যেতে পারি তোমার কাছে। দুজনে না হয় রিকশায় করে ঘুরলাম। একজন অসুস্থ পুরুষের পাশে একজন সুস্থ নারীর রিকশায় সহাবস্থানে বোধহয় সমাজ বা রাষ্ট্রের তেমন আপত্তি থাকার কথা নয়।
: রিকশায় ঘুরবে? যদি বৃষ্টি নামে?

কথা না বাড়িয়ে অহনাকে বের হতে বলে অমিত। বৃষ্টি আসলে আসুক। দরকার হলে বৃষ্টিতে দুজন একসঙ্গে ভিজবে। ওদের ভালোবাসার ছোঁয়া বৃষ্টির জলে মিশে ছড়িয়ে যাবে এই বিশ্বে। অগণিত মানুষের আবাস এই ধরণীতে নিজের প্রাপ্য সুখ খুঁজে নিতে হয়, না থাকলে গড়ে নিতে হয় পরম মহিমায়, অন্যের ক্ষতি না করে। অমিত শার্ট পড়ে মেস থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকে। আকাশে মেঘ জমেছে, হালকা ঠাণ্ডা বাতাস এসে জুড়িয়ে দিচ্ছে ওর জ্বরতপ্ত দেহটাকে। সেই দেহের ভেতর উষ্ণ হৃদয়ে ভালোবাসা জমা আছে, আকাশের ঐ জমাটবাঁধা মেঘের মতো, হয়তো তারচেয়েও বেশি। অমিত এগিয়ে যায়। আকাশে মেঘ ডাকতে থাকে।

বৃষ্টির খুব বেশি দেরি নেই।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.