নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন গাধামানব

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন

ডাল দিয়ে ভাত খাই, রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মানুষ আমি ভেজাল হলে'ও আমার লেখাগুলো খাঁটি ।

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

অচেনা

৩১ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ১২:০৮

‘জয়ন্ত, ঘুম আসছে?’
‘না স্যার’, জয়ন্ত চোখ ডলতে ডলতে উত্তর দেয়।

নতুন চাকরি, তাও পুলিশের। সিনিয়রের সামনে ভুলত্রুটি করার ব্যাপারে জয়ন্ত সাবধান থাকে, ফ্রিতে পাওয়া চাকরি না, রীতিমতো আড়াই লাখ খরচ করে জয়েন করতে হয়েছে। এমপি সাহেবের সুপারিশ না থাকলে চার-পাঁচ লাখ বেরিয়ে যেত।

‘ঝিমাচ্ছো নাকি? ঝিমানো ভালো, তবু ঘুমিয়ে পড়ো না। ডিউটি ফাঁকি দিয়ে ঝিমানো একটা আর্ট। সবাই এই কাজ পারে না। দীর্ঘদিন চাকরি করলে অভ্যেস হয়ে যায়। ফরিদকে দেখো। মনে হচ্ছে না মনোযোগ দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে? আসলে ব্যাটা ঝিমাচ্ছে। বিশ্বাস না হলে কাছে গিয়ে দেখে আসো’।
জয়ন্ত ফরিদের কাছে হেঁটে গেল। ফরিদ ওর দু’বছর আগে চাকরিতে ঢুকেছে। গভীর রাতে শহরের রাস্তার ধারে নীরব শিকারির মতো ঘাপটি মেরে আছে ওরা। শহরের কেউ অপরাধ করলে তাকে ধরে ফেলা হবে। সেই অপরাধের তাৎক্ষণিক বিচার ও মাশুল আদায় করা হবে। সেই মাশুলের ভাগ ওদের গাড়ি থেকে শুরু করে শহরের অগণিত রাস্তা, শহরের বাইরে আসা-যাওয়ার হাইওয়ের প্রবেশদ্বার সর্বত্র থেকে আসা মাশুলের সাথে মিশবে। তারপর ফাঁড়ি থেকে শুরু করে থানা, জোন এমনকি হেডকোয়ার্টারেও পৌঁছে যাবে সেই মিশ্র অমৃতের ভাগ। বিশাল এই তৎপরতার ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে ওরা শহরের একটা রাস্তায় শিকারের অপেক্ষায় আছে। টানা কাজের ফাঁকে ফরিদ ঝিমাচ্ছে। দুয়েকবার হালকা গলায় ডেকে দেখল জয়ন্ত, সাড়াশব্দ নেই। ফিরে এলো সে গাড়ির কাছে। ল্যামপোস্টের হলুদ আলো ঠিকরে পড়ছে নীল গাড়ির দেয়ালে, গাড়িটাকে দেখে কালো বলে মনে হচ্ছে জয়ন্তের। গাড়ির দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে পোড় খাওয়া দারোগা আফজাল। জয়ন্তকে তিনি বললেন, ‘ঠিক বলেছি না?’
‘জী স্যার’।
‘এই ফরিদই দেখবে নতুন পার্টি পেলে কীভাবে ঘুম ফেলে কাজে নেমে যায়। সবই অভ্যেস। তোমার চাকরির কয়দিন হয়েছে?’
‘সাত মাস স্যার’।
‘তাহলে তো তুমি দুধের বাচ্চা! শিন্নি খাওয়ার অভ্যেস হয়েছে?’

শিন্নি কিংবা অমৃত ছাড়া কিছু হয় না- চাকরিতে ঢোকার সময়ই জয়ন্ত টের পেয়েছে। যা দেয়া যায়, তা নিতে আপত্তি কীসের? সে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে।
‘বেশ বেশ। ভালোই উন্নতি করেছ দেখছি!’ আফজাল দারোগা প্রশংসার সুরে বলে। এর মধ্যে একটা মিনি ট্রাক আসে, পেছনে কলার কাঁদি। ফরিদকে কিছু বলতে হয় না, দিব্যি ঘুম ফেলে সে ড্রাইভারের সাথে দরদাম শুরু করে। গাড়ির কাছে ফিরে এসে জানায়, ড্রাইভার তিনশ দিতে রাজি হয়েছে। আফজালের চোয়াল শক্ত হয়।
‘হারামজাদা একটা! পাঁচশোর নিচে ছাড়বা না!’
ফরিদ ড্রাইভারকে গাড়ি থেকে নামায়। দরদাম না মেলা পর্যন্ত ছাড়ে না। আফজাল সেদিকে তাকিয়ে জয়ন্তকে বলে, ‘তিনশতেই ছেড়ে দিলে আগামীতে আর ভালো রেট পাওয়া যাবে না। দুই নম্বরীর কাজেও দুই নম্বরী করে শালারা’।

জয়ন্ত মাথা নাড়ে। কথায় কথায় ছেলেটার মাথা নাড়া দেখে আফজালের চাকরিজীবনের প্রথম দিককার কথা মনে পড়ে। যে যাই বলুক ভয়ে ভয়ে তাল দিয়ে যাওয়া, যদি কেউ ক্ষেপে যায়? প্রথমদিকে ঘুষ খেতো না আফজাল, সেজন্য দীর্ঘদিন উন্নতি হয়নি তার। ঝামেলার জায়গায় পোস্টিং হতো, খাটুনি শেষে অহেতুক ভোগান্তি। সংসারের টানাটানি আর থানার অশান্তি- দুটো একসাথে প্রকট হয়ে উঠছিল। যখন অমৃত খাওয়া শুরু করল, তারপর দুটোই একসাথে শান্ত হয়ে এলো। সবখানে শান্তি। দুঃখ একটাই, আফজালের মা কখনো তার পাঠানো টাকায় হাত দিতেন না। বিড়বিড় করে বলতেন, ‘গু খাইয়া পুলা পেটে ধরছিলাম, নাইলে এই অবস্থা হয়? আমি না খাইয়া হেগো মানুষ করতে পারলে হ্যারা পারে না ক্যান? হ্যারার পেট কি রাক্ষসের পেট?’ মায়ের এসব প্রশ্নের উত্তর আফজালের কাছে ছিল না। বাড়ন্ত সংসার, জনাকীর্ণ শহর, ছুটন্ত খরচের বহর এবং ক্ষীণকায় বেতন- এই চক্রে পড়ে তাকে বদলাতে হয়েছে। মেয়ে নিশা এখন ভালো স্কুলে পড়ে, সামনে এসএসসি দেবে। বউয়ের গায়ে ভালো গহনা আছে, ঢাকার কাছেই প্লট হয়েছে। বাড়িও হবে, চিন্তার কিছু নেই। আফজালের জীবন এখন নিশ্চিন্ত। জয়ন্তেরও এমন হবে। নদীর স্রোতের অনুকূলে থাকা সব মাছের পরিণতি এক হয়, প্রতিকূলে গেলেই বিপদ।

ফরিদ ইশারায় ডাকে। আফজাল ও জয়ন্ত এগিয়ে যায়। ফরিদের সামনে তিনটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে উগ্র প্রসাধন। খদ্দেরের খোঁজে ঘুরছিল, ফরিদ ধরে ফেলেছে।

‘মতিনের সাথে কথা বলেছ?’ আফজাল ফরিদকে জিজ্ঞেস করে। মতিন এই এলাকার রাতের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। তার হিসেবের মধ্যে থাকলে এদের ধরে রেখে লাভ নেই। মতিন নিজের এলাকার ভাগ বাঁটোয়ারায় কোন ভুল করে না।
‘ফোন করছিলাম স্যার। মতিন এগুলারে চিনে না। এলাকায় নতুন মনে হয়’।

আফজাল মেয়েগুলোর দিকে তাকায়। দুটো মেয়ের বয়স পঁচিশ-ত্রিশ, একটার পনেরো-ষোলো হবে। একেবারেই বাচ্চা মেয়ে। মাটির দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। আফজাল স্পষ্ট বুঝতে পারছে এই মেয়েটা এই লাইনে নতুন। কে জানে হয়তো আজকেই প্রথম রাস্তায় নেমেছে। আফজাল জিজ্ঞেস করে, ‘নাম কী তোমার?’
মেয়েটা ইতস্তত করে। নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। আফজাল দেখতে পায় মেয়েটার পা কাঁপছে। পুলিশের সামনে হয়তো কোনোদিন দাঁড়ায়নি সে। নিরুত্তর মেয়েটার দিকে ফরিদ চেঁচিয়ে উঠে,
‘কথা কস না ক্যান? দিমু চালান দিয়া!’

মেয়েটা বিড়বিড় করে বলে, ‘মারিয়া...’

আফজাল জানে এই নাম নকল। ব্যবসায় নামানোর আগে এরকম চটকদার নাম নিয়ে ফেলে। এই মেয়ের এখনো নতুন নামে অভ্যেস হয় নি। ফরিদ অধৈর্য গলায় আফজালকে জিজ্ঞেস করে,
‘কী করুম স্যার? চালান দিয়া দেই? ঝামেলা রাইখা লাভ নাই’।
বাকি দুটো মেয়ে ফরিদের কাছে দেন-দরবার শুরু করে দেয়। ফরিদ ঘাঘু লোক, পয়সা বের না করে এদের ছাড়বে না। এরা নিজেরাই যদি চালান হয়ে যেতে রাজি হয়, তাহলেও না। ফরিদের হিসাব পয়সায়, এদের চালান দিয়ে তার কী লাভ?

আফজাল মেয়েটার দিকে তাকায়। মেয়েটা এখন কাঁপছে। কতো বয়েস ওর? নিশার কাছাকাছিই হবে হয়তো। এই মেয়েটার এখন স্কুলের পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা, রাত জেগে পড়ার কিংবা বিছানায় শুয়ে স্বপ্ন দেখার কথা। অথচ কী এক দুঃস্বপ্নের মতো সে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! আজ যদি আফজাল মারা যায় তাহলে নিশার কী হবে? সংসার চালাতে না পারলে নিশা কিংবা ওর মায়ের কী হবে? আফজাল ভেবে পায় না। আধপেটা থেকে আফজালের মায়ের মতো বেঁচে থাকবে ওরা? গ্রামে তা পারলেও এই শহরে অকেজো মানুষ যে অচল! একে অন্যকে যেভাবে পারছে ব্যবহার করছে। কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পুলিশের পোশাকে চাঁদা তুলছে, কেউ দেহটাকে প্রসাধনে সাজিয়ে ব্যবহারের জন্য তুলে দিচ্ছে খদ্দেরের কাছে। হঠাৎ করেই আফজালের কাছে এই শহরটাকে খুব নির্মম মনে হল। এই শহর তাকে বিত্ত দিয়েছে, ক্ষমতা দিয়েছে, কিন্তু গভীর রাতের এই মুহূর্তে যে অনিরাপদ অনুভূতি দিয়েছে সেটাই আফজালকে ঘিরে ধরল জালের মতো। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আফজালের বারবার নিশার কথা মনে পড়তে লাগল। নিয়ন আলোয় নিশা যেন নেমে এসেছে মেয়েটার করুণ মুখাবয়বের মাঝে। সেই মুখে সুখী জীবন নেই, আছে ভয়, আছে কান্না, আছে জল, আছে রাতের অন্ধকার।

‘স্যার, কী করুম?’ ফরিদ ফের জিজ্ঞেস করে।
আফজাল উত্তর দেয়, ‘ছেড়ে দাও’।

ফরিদ ও জয়ন্ত খুব অবাক হয়। কিন্তু স্যারের গলা শুনে পাল্টা প্রশ্ন করতে ভয় পায়।

রাতের তৃতীয় প্রহর খুব অদ্ভুত সময়। এই সময়ে নানা রকম বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। ফরিদ ও জয়ন্তের সামনে এরকম একটি বিভ্রাট যেন দেয়াল তুলে দাঁড়িয়েছে। সেই দেয়ালের ওপারে দাঁড়ানো মানুষটা আফজাল দারোগার মতো দেখতে হলেও পুরোপুরি অন্য এক মানুষ, অচেনা এক মানুষ।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ১:০৭

কানিজ রিনা বলেছেন: ++++++++++

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.