নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন গাধামানব

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন

ডাল দিয়ে ভাত খাই, রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মানুষ আমি ভেজাল হলে'ও আমার লেখাগুলো খাঁটি ।

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভবিষ্যৎ

০২ রা আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫১

২১১৬ সালের এক বিকেল।

সুউচ্চ ভবনের ছাদে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হইয়াছে। ছাদ হইলেও তাহার চারিপাশে কাঁচের দেয়াল তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে। বাতাসের অবস্থা বিশেষ সুবিধার নহে। পরিবেশের 'খোলা হাওয়া' এখন ঘোরতর বিপজ্জনক, কয়েকদিন আগে উৎসাহী কতিপয় ছেলেপেলে আদিম কবি রবীন্দ্রনাথের 'তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে' গাহিতে গাহিতে পালহীন নৌকা লইয়া নৌবিহারে গমন করিয়াছিল, যেই না তাহারা অক্সিজেন মুখোশ খুলিয়াছে, অমনি কয়েকজন সংজ্ঞাহীন হইয়া পড়িয়াছে। যাহারা সুস্থ ছিল তাহারা দ্রুত মুখোশ পরিধান করিয়া শ্বাস রক্ষা করিয়াছে। বাতাস বলিয়া পরিবেশে যাহা আছে, তাহা বিষের লঘু প্রবাহমাত্র।

এমন বাতাস হইতে অতিথিদের বাঁচাইবার জন্যেই কাঁচের দেয়াল, তাহার ভেতর অক্সিজেন সরবরাহের কৃত্রিম ব্যবস্থা অতিথিদিগকে স্বস্তি প্রদান করিতেছে। কিন্তু সভাপতি মহোদয় কোথায়? তাহাকে যে কোথাও দেখা যাইতেছে না!

বিলম্বে হইলেও অবশেষে সভাপতি সাহেব আসিলেন। তাহার গায়ের হাফহাতা কালো কোট কেবলমাত্র দলীয় ঐতিহ্য নয় পারিবারিক ইতিহাসেরও সাক্ষ্য দিতেছে। তাহার মরহুম পিতামহ শতবর্ষ পূর্বে এমন কোট পড়িয়াই রাজনীতি করিয়াছেন। পিতামহের রাজনীতি ছিল অত্যন্ত জনকল্যাণমুখী। জনগণের স্বার্থ ছাড়া তিনি কখনো কিছু ভাবেন নাই। দেশের জনগণকে বিদ্যুৎ দিবার প্রয়াসে যাহাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রামপালে বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপিত হইয়াছে, তিনি তাহাদেরই একজন ছিলেন। সেই বিদ্যুতকেন্দ্রে অপরের জমি দখল করিয়া বিক্রয়, পরবর্তীতে কয়লা পরিবহণের বাণিজ্য এবং আনুষঙ্গিক অজস্র কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি বংশের অনাগত অজস্র প্রজন্মের অধঃপাতে যাইবার সুবন্দোবস্ত করিয়া গিয়াছেন। তাহার বংশধরেরা যেহেতু জনগণেরই অংশবিশেষ, কাজেই তাহার এইসব কর্মকাণ্ডকে ‘জনকল্যাণ’ বলিয়া ইতিহাসবিদেরা যাহা লিখিয়াছেন, নিতান্ত মন্দ লেখেন নাই। এই সমস্ত জনকল্যাণ করিবার সময় তাঁহার গায়ে কালো কোট বিরাজ করিয়াছে। মৃত্যুর পরও হয়তো তাহাকে কালো কোট সমেত সমাধিস্থ করা হইত, কিন্তু ধর্মে যে সে নিয়ম নাই! বলা আবশ্যক, তিনি অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ছিলেন। জীবদ্দশায় তিনি অজস্রবার সরকারী খরচে হজ্ব করিয়াছেন এবং দেশের ভালোমন্দ পুরাপুরি খোদার হাতে ছাড়িয়া নিজে আরাম করিয়াছেন, নিতান্ত ধর্মপরায়ণ না হইলে তাহা সম্ভব ছিল না।

আজকের সভার সভাপতি সাহেব তাহারই সুযোগ্য বংশধর। রাজকোষ হইতে শুরু করিয়া জনগণের দেহের প্রতিটা কোষ তাহা বিলক্ষণ জানে। রাজ্যে এমন কোন অর্থকরী কর্ম নাই যাহা সভাপতি সাহেবের স্নেহধন্য না হইয়া টিকিতে পারে। তাহার আগমনে উপস্থিত সভার সভ্য এবং অসভ্যগণ শান্ত হইয়া আসন গ্রহণ করিলেন। পাঠক ভাবিবেন, এইখানে অসভ্য কাহারা! কিছু সাংবাদিক আসিয়াছে। তাহারা অসভ্যের ন্যায় নানা প্রশ্ন করিয়া থাকে, কাজেই এই নামকরণ।

সভা শুরু হইলে এক অসভ্য প্রশ্ন করিল, ‘স্যার, সুন্দরবন বিষয়ে কিছু কথা...’
সভাপতি সাহেব অসভ্যের অসভ্যতায় বিচলিত হইলেন, তাহার মূর্খতায় হতাশ হইলেন। বিরক্ত গলায় বলিলেন, ‘সুন্দরবন লইয়া অনেকেই গত একশ বছরে তাফালিং করিয়াছে, তাহাতে আমাদের হিন্দি চুলটাও আসে-যায় নাই। সম্প্রতি খবর পাইয়াছি, সুন্দরবন নামের একটা সাইনবোর্ড ঐখানে ছিল, তাহা নাকি আর দেখা যাইতেছে না। কেহ চুরি করিয়া থাকিবে বোধহয়। আমরা সেই সাইনবোর্ড অনুসন্ধানের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করিব নিশ্চয়ই’।

এই কথা বলিবামাত্র ‘সভ্য’রা তালি দিয়া সভাকক্ষ মুখরিত করিয়া ফেলিল, কেহ কেহ আশা করিল, সেই কমিটিতে তাহার নামটা থাকিলে বেশ হয়!

আরেক অসভ্য প্রশ্ন করিল, ‘কিন্তু বনটা যে মরুভূমি হইয়া গেল?’
সভাপতি নাকের লোম ছিঁড়িতে বিশেষ অবসর পান না, কতো ব্যস্ততা তাহার। সভায় বসিয়া তিনি সানন্দে লোম ছিঁড়িতে ছিঁড়িতে বলিলেন, ‘এখন যে দেশের লোকজন আরব-আফ্রিকা না যাইয়াও মরুভূমি দেখিবার সৌভাগ্য অর্জন করিতেছে, সেই সাফল্য কি আপনাদের চোখে পড়ে নাই?’
প্রশ্ন আসিল, ‘দেশে বন্য জীবজন্তুও যে সব চলিয়া গিয়াছে নয় মরিয়া গিয়াছে। এই প্রসঙ্গে আপনার মতামত কী?’
সভাপতি বলিলেন, ‘মৃত কারো দোষ বলা ধর্মবিরুদ্ধ, কাজেই মৃত প্রাণীদের লইয়া আমি কিছু বলিব না, কেহ বলিলে তাহা ধর্মদ্রোহিতার আইনে পড়িবে। তবে জীবিত প্রাণীগুলো দেশ ছাড়িয়া দেশদ্রোহীর কাজ করিয়াছে। তাহাদের বিশেষ আইনে বিচারের আওতায় আনা হইবে’।

সভায় ধন্য ধন্য পড়িয়া গেল।

অসভ্যদের সবাই অসভ্য নয়, কেহ কেহ ডাল-রুটি-ঘৃত-মাখন যথাসময়ে পাইয়া সভ্য হইয়াছে। তাহাদের একজন প্রশ্ন করিল, ‘সরকারের এতো উন্নয়নের অনুপ্রেরণা কি?’
প্রশ্ন কমন পড়ায় সভাপতি হৃষ্টচিত্তে বলিলেন, ‘এর কারন, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছিলাম। আগে পাকিস্তানিরা লুটিয়া খাইত, এখন আমরা নিজেরাই লুটিয়া খাইতে পারি। আমাদের মহান নেতাকর্মীগণ সেই শিক্ষা যুগে যুগে লালন পালন ও ধারন করিয়াছেন। আগে দেশে অত্যন্ত স্বল্প পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছিল, আমরা তাহা বৃদ্ধি করিয়াছি। দেশের লোকে দুঃখে পয়সা দিয়া বিষ কিনিয়া খাইত, আমরা নদনদীর পানির বিষমাত্রা বাড়াইয়া এমন স্থানে আনিয়াছি যে, কেহ তাহা খাইলে মরণও হইবে, পয়সাও বাঁচিবে। এমন কোন জায়গা মিলিবে না, যেখানে উন্নতি ও জনকল্যাণ সম্ভব ছিল অথচ আমরা অবহেলা করিয়াছি। আমাদের বিদেশী বন্ধুরা এসব উন্নয়ন কাজে বেকুবের মতো প্রচুর অর্থ লগ্নি করিয়াছে, ইহা কী আমাদের সাফল্য নয়? রামরাজত্বে সর্বত্র জঙ্গল ছিল, আমরা জঙ্গল সাফ করিয়া সভ্যতার আলো আনিয়াছি, কাজেই আমাদের রাজত্ব রামরাজত্বের চেয়ে মহৎতর’।

এক অসভ্য বলিল, ‘তবে কি দেশে কিছুমাত্র মন্দ কাজ হইতেছে না? তাহার দায় কে লইবে?’
সভাপতি সাহেব ইতিহাস জানেন। তাহার পূর্বপুরুষ যেসব শত্রুর উপর দোষ চাপাইয়া শান্তি পাইতেন, তিনিও তাহাদের নাম করিলেন। অসভ্য পুনরায় শুধাইল, ‘তাহারা তো সকলেই মরিয়া গিয়াছে! আপনার দলের কোন প্রতিপক্ষই তো জীবিত নাই!’
সভাপতি সাহেব তৎক্ষণাৎ বলিলেন, ‘তাহাদের সাফল্য তো ঐখানেই! মরিবার পরও তাহারা ভূত হইয়া আমাদের অনিষ্ট করিতে চাহিতেছে। আমরা সেইসব ভূতের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন সংগ্রাম চালাইয়া যাইব। এই লড়াইয়ে আমাদের পাশে জনগণ আছে, সুতরাং আমাদের জয় অনিবার্য’।

সভ্যরা আনন্দে মাথা ঝাঁকাইতে ঝাঁকাইতে তালি দিতে লাগিল, তালির চোটে তাহাদের হাত ফাটিয়া রক্ত পড়িতে পারে, ঝাঁকিতে মাথাও খুলিয়া পড়িতে পারে- এমন আশঙ্কায় সভাপতি সাহেব সভা মুলতবি করিলেন এবং খাদ্য পরিবেশনের আদেশ দিলেন। ব্যক্তিগত সহকারীকে ডাকিয়া কানে কানে বলিয়া দিলেন, যেসব অসভ্য বেগতিক প্রশ্ন করিয়াছে তাহাদের যেন খাবার দেয়া না হয়। কে শোনে কার কথা! ততক্ষণে খাবারের টেবিলে রীতিমতো মারামারি লাগিয়া গিয়াছে, কে সভ্য আর কে অসভ্য খুঁজিয়া পাওয়া দায়!

সভাপতি সাহেব সেদিকে তাকাইয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিলেন। আজকের মতো ঝামেলা শেষ হইল। কাল তাহার অনেক কাজ। বাতাসে অক্সিজেন কমিয়া আসিয়াছে। শতবর্ষ আগে প্রাকৃতিক গ্যাস কমিয়া যাওয়ায় যেইভাবে সিলিন্ডার গ্যাসের বিক্রি বাড়িয়া গিয়াছিল, এখন বাজারে সেইভাবে অক্সিজেনের চাহিদা তৈরি হইয়াছে। ছোট ছোট পুরাতন কোম্পানিকে হটাইয়া নূতন এক বড় কোম্পানির অক্সিজেন বাজারে আসিবে, কাল তাহারই উদ্বোধন।

সভাপতি সাহেব নিতান্ত জনকল্যাণের কথা ভাবিয়াই কোম্পানিটা খুলিয়াছেন।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা আগস্ট, ২০১৬ রাত ৮:১৭

আব্দুল্লাহ্ আল আসিফ বলেছেন: আমি বরং চুপ থাকি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.