নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ডাল দিয়ে ভাত খাই, রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মানুষ আমি ভেজাল হলে'ও আমার লেখাগুলো খাঁটি ।
সুন্দরীরা কাঁদলে কি সৌন্দর্য বেড়ে যায়? হয়তো। আবার চোখে কাজল থাকলে অশ্রুর জলে মাখামাখি হয়ে ভূতুড়ে পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে।
আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে আপুর দিকে তাকিয়ে আছি। একই পদে কর্মরত সহকর্মীরা পরস্পরকে ভাইয়া-আপু বলবার সংস্কৃতি দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানেই চালু আছে, সেই সূত্রে আপু। সুন্দরী এই আপু ভেউ ভেউ করে কাঁদছেন। ভাগ্য ভালো উনার চোখে কাজল নেই, চশমা আছে। চশমার নিচ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। একবার ভাবলাম উনাকে চশমা খুলে কাঁদতে বলি, তাতে উনারও সুবিধে হয়, দর্শকেরও আরাম হয়। ভদ্রতাজনিত কারনে বলা গেল না। ভদ্রতার কৃত্রিম শেকল আমাদের স্বাভাবিক আচরণের অনেক আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। অবশ্য আপু কান্নাকাটির সময় এসব ভদ্রতার রাস্তা মাড়াচ্ছেন না। উনার কণ্ঠে 'আমার চাকরিটা চলে গেল...এখন কী হবে...' কান্নার সুরে সুরে এই গান বাজছে। উনার সঙ্গে আমারও কাঁদা উচিৎ, কারন চাকরি আমারটাও গেছে। আমি নিজের দুঃখ নিয়ে শোকালাপ বাদ দিয়ে উনাকে বলতে লাগলাম, 'আপু শান্ত হন... চাকরি তেমন কোন বিষয় না... জগতের অনেক বিশিষ্টজন বড় বড় কিছু হারিয়ে নিজেরা বড় হয়েছেন, সেই হারানোর ইতিহাস না থাকলে তারা এই সম্ভাবনা নিয়ে নিভৃতেই পড়ে থাকতেন... পিতা এবং স্বামীকে হারিয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়া- সে উদাহরণ তো আমাদের দেশেই আছে!'
আপু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন, কান্নার ফাঁকে বললেন, 'তারা কেউ তো আমার মতো চাকরি হারাননি'
কথা অকাট্য। এ যুগে মানুষ হারানোর চেয়ে চাকরি হারানোর শোক প্রবলতর। আমি সান্ত্বনার থলি লুকিয়ে ফেললাম। হাসিনা-খালেদার কার্ড দিয়ে ট্রাম্প করার পরও কাজ হল না। কাজেই চুপ থাকা কল্যাণকর। অফিসের ক্যাশ সেকশনে যাওয়া যায়। অবশিষ্ট বেতনভাতা কবে পাওয়া যাবে সেই খোঁজ নেয়া।
ক্যাশিয়ার হারুন সাহেব জ্ঞানী মানুষ। অফিসের কার কার আচরণে সমস্যা আছে, সেসব সমস্যার সমাধান কীভাবে হওয়া উচিৎ- এ বিষয়ে হারুন সাহেবের বিশদ জ্ঞান। প্রত্যেকের আড়ালে সেই জ্ঞান বিতরণেও তিনি দক্ষ। অফিসের প্রমীলা সমাজে হারুন সাহেবের কদর আছে। অশান্ত জগতে পিস টিভির যে কদর, অফিসে সিরিয়াল দেখতে না পাওয়া প্রমীলা সমাজে হারুন সাহেবের একই কদর।
গিয়ে দেখি হারুন সাহেব বই পড়ছেন, বইয়ের নাম 'মকছুদুল মুমিন'। আমাকে দেখে ইশারায় বসতে বললেন। আমি বসলাম। একটু পর বই বন্ধ করে তিনি বললেন, 'জরুরী জিনিস পড়ছিলাম, তাই ইশারায় বসতে বললাম। কিছু মনে করেননি তো?'
আমি সবিনয়ে বললাম, 'না না, মনে করার কি আছে! তাছাড়া চাকরি হারানো মানুষের কিছু মনে করতে নেই। তাদের চামড়া পুরু করতে হয়। আমি সেই চেষ্টায় আছি।'
হারুন সাহেব চুকচুক জাতীয় একটা শব্দ করে বললেন, 'আপনাদের খবর শুনলাম। বড়ই দুঃখজনক। জিএম সাহেবের চরিত্রে দোষ আছে, তা নাহলে আপনারা চাকরি হারাতেন না।'
আমি প্রমীলাদের অনুকরণে গলা নামিয়ে বললাম, 'কীসের দোষ বললেন?'
হারুন সাহেব সাগ্রহে বলতে লাগলেন, ‘শোনেন, বসের আকাম কুকামের রেকর্ড সব আমার কাছে। অফিসের মালামাল কেনা থেকে শুরু করে এক্সপোর্টের দুর্নীতি- কোনটা শুনবেন। আসল ব্যাপার আরও গভীরে’, বলে তিনি চোখ টিপ দিলেন।
আমিও পাল্টা চোখ টিপ দেয়ার চেষ্টা করলাম, উনার মতো হল না। হারুন সাহেবের বোধহয় চোখ টিপ দেয়ার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। আমার মতো আনাড়ির চেষ্টা ভালো হল না, তবু চোখ ছোট ছোট করে বললাম ‘সেই গভীর ব্যাপারটা কি?’
হারুন সাহেব গলা আরও নামিয়ে বলতে লাগলেন, ‘নারীঘটিত ব্যাপার। সুন্দরী না হলে বসের মন পাওয়া কঠিন। নতুন কাউকে নিয়োগ দেয়ার সময় সেভাবে দেখেশুনে টিপেটুপে নেবেন। তাই পুরনোদের বাদ দিলেন। দুশ্চরিত্র লোকের কারনে আপনার মতো ভালো মানুষ চাকরি হারাল’।
আমি বললাম, ‘যা বললেন সব সত্যি?’
হারুন সাহেব উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘সত্যি মানে! তিন সত্যি! আমি সত্যি ছাড়া কিছু বলিই না!’
আমি পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালাম। চাকরি হারানোর পর ‘নন-স্মোকিং জোনে’ সিগারেট খাওয়া যেতেই পারে। হারুন সাহেব ফ্যালফ্যাল করে সিগারেটের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সিগারেট খাওয়া...’ আমি উনার কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, ‘নিষেধ, তাই তো? জানি। এখন আমি আর এই অফিসের আইনের আওতায় নেই, সেটা জানেন তো! এখন কিছু কথা বলব, মন দিয়ে শুনবেন। তেড়িবেড়ি করলে থাপ্পড় খাবেন’।
হারুন সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। অফিসের সবচেয়ে সিনিয়র অফিসারদের একজন তিনি, বেতন যাই হোক প্রশাসনিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। অনেক জুনিয়র একজনের কাছে এরকম কথা শোনার প্রস্তুতি তিনি স্বপ্নেও নেননি।
‘আপনার সাথে আমার পুরো কথোপকথন আমার মোবাইলে রেকর্ড করা আছে। এই রেকর্ড আমি চেয়ারম্যান সাহেবকে শোনাতে পারি। তিনি তখন জিএম’কে তলব করবে। জিএম নিজেকে বাঁচাতে আপনার দোষ বের করে আপনাকে বরখাস্ত করবে। আপনি কি বুঝতে পারছেন জিএমের বিরুদ্ধে আপনি যা বলেছেন তার গুরুত্ব কত বড়? আপনার নিজের গলা রেকর্ডে আছে, অস্বীকারের তো রাস্তা নেই। কেমন হবে হারুন সাহেব?’ বলে আমি ভুরু নাচাতে লাগলাম। চোখ টিপ দেয়ার চেয়ে বোধহয় এই চেষ্টা ভাল হল। দেখি হারুন সাহেব ঘামছেন। অফিসের এসি পরিবেশে ঘামা কঠিন ব্যাপার। ওষুধে কাজ হয়েছে।
ফ্যাসফ্যাসে গলায় হারুন সাহেব বললেন, ‘আপনি কি চান?’
আমি শান্ত গলায় বললাম, ‘চিফ ক্যাশিয়ার হিসেবে আপনি অনেক হাঁড়ির খবর রাখেন। আমাদের দুজনের চাকরি গেছে, আমার সঙ্গে যিনি চাকরি হারিয়েছেন তিনি মহিলা মানুষ। জিএমের ব্যাপারে যা বলেছেন তা সত্য হলে উনার চাকরি থাকত। আপনি এখন যা করবেন তা হচ্ছে জিএম’কে বোঝাবেন ঐ ভদ্রমহিলার পারিবারিক অবস্থা খারাপ এবং তিনি কাজে খুব এফিশিয়েন্ট। উনাকে ছাড়া চলবে না। জিএম যেন ফাইনাল অর্ডারে উনার নাম বাদ দেয়। উনার চাকরি রাখতে আপনি জিএমের পায়ে ধরবেন, নাকি হাতে ধরবেন সেটা আপনার ব্যাপার। চিফ ক্যাশিয়ারের কথা যদি উনি না রাখেন, তাহলে আপনারও আর চিফ ক্যাশিয়ার থাকার দরকার নেই। সেই ব্যবস্থা আমি করব। আপনি বুঝতে পেরেছেন?’
‘নিজের চাকরি না বাঁচিয়ে উনার চাকরি চাইছেন কেন?’ হারুন সাহেবের গলার হতভম্ব ভাব তখনো কাটেনি। আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম, ‘সবই চরিত্রের সমস্যা হারুন সাহেব, মেয়েদের কষ্ট আমি আবার দেখতে পারি না। জিএম সাহেবের না, সমস্যা বোধহয় আমারই। আমি খুব খারাপ লোক। যা বলেছি তা যদি না হয় তাহলে বুঝবেন খারাপের গভীরতা কাহাকে বলে, প্রশান্ত মহাসাগরের মারিয়ানা ট্রেঞ্চ সবচেয়ে গভীর জায়গা, আমি তারচেয়েও খারাপ’।
হারুন সাহেবের ঘাম ঝরা অব্যহত আছে। আমি মধুর হাসি দিয়ে হারুন সাহেবকে বললাম, ‘আসি হারুন সাহেব। ভালো থাকবেন’ উত্তরে হারুন সাহেব কী যেন বিড়বিড় করে বললেন, ঠিক বোঝা গেল না। উনার হাতে তখনো ‘মকছুদুল মুমিন’ শোভা পাচ্ছে, সেই হাত বোধহয় একটু কাঁপছেও।
ক্যাশ সেকশন থেকে বেরিয়ে নিজের সেকশনে ফিরে এলাম। ড্রয়ারে একটা ডায়েরি ছিল, সেটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। লবিতে আপুকে দেখলাম শূন্য দৃষ্টি মেলে বসে আছেন। শোক সামলে নেয়ার এই শূন্যতা ঝড়ের পর শান্ত আকাশের মতো। আপুকে বললাম, ‘ছোট ভাইয়ের অনার্স কেমন চলছে?’
‘গত সেমিস্টারে ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট হয়েছে, বেশ ভালোই করছে। এখন কি করবে জানি না। এখন থেকে টিউশনি করাতে হবে বোধহয়’
‘কেন, আপনার বেতনে হয় না?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘এখন থেকে বেতন তো পাবো না, আরেকটা চাকরি কবে পাবো তাও জানি না’।
‘আরেকটা চাকরি লাগবে কেন? ফাইনার অর্ডার দেরী আছে, আপনি বোধহয় এ যাত্রায় বেঁচে যাবেন’।
‘কে বলেছে আপনাকে?’
‘বসের ঘনিষ্ঠ একজন জানিয়েছে’
‘কিন্তু আপনার কী হবে?’
আমি হাসলাম। সে হাসি বর্গমূলের মতো, উত্তর ধনাত্মক কিংবা ঋনাত্মক দুটোই হয়। আপুকে বললাম, ‘আপাতত কাউকে কিছু বলার দরকার নেই, চুপচাপ বাসায় চলে যান। কাল ফোন করে অফিসে শুনে নেবেন ঘটনা সত্য কিনা। অযথা কাঁদলেন সারাদিন, এবার একটু হাসুন’
আপুর চেহারায় যেন খানিকটা রক্তের ছোঁয়া লাগল। মেঘ কেটে যাবার পর উজ্জ্বল আলোর ছটা যেভাবে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে ঠিক সেরকম। আমি অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম। অরিত্রকে ফোন দিলাম। ওর কাছে দুপুরের খাওয়া সারতে হবে। পকেটের টাকা বাঁচাতে আপাতত অরিত্রই সম্বল। মেসজীবনের পুরনো বন্ধু, দুঃসময়ে ফিরিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা নেই। অরিত্র ফোনের আধুনিক ফাংশানগুলোও ভালো বোঝে।
দুপুরে খাওয়ার এক ফাঁকে ওর কাছে জেনে নিতে হবে, মোবাইলে কীভাবে কথা রেকর্ড করতে হয়।
©somewhere in net ltd.