নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন গাধামানব

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন

ডাল দিয়ে ভাত খাই, রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মানুষ আমি ভেজাল হলে'ও আমার লেখাগুলো খাঁটি ।

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

পূর্ণ

২২ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১:২১

- আকাশের অবস্থা দেখেছ?
: হু
- হু মানে?
: মানে গম্ভীর আর কি!
- বাইরে যেতে পারলে বেশ হত।
: সত্যিই যাবে?
- কেন, আপত্তি আছে?
: সীতা লক্ষ্মণরেখা পার করতে চাইলে আমার আপত্তি থাকবে কেন!
- সঙ্গে তো রামকে নিয়েই যাচ্ছি। ভয় কীসের?
আধুনিক যুগে রাম দুর্বল। রাবণেরা ক্ষমতাধর, অস্ত্রধরও বটে। দিনেই তাদের জয়জয়কার, রাতে তো বলাই বাহুল্য। আমি রাম কিংবা রাবণ কিছুই নই, সামান্য গৃহস্বামী মাত্র। মন্দিরের দেবী আদেশ করলে পূজারীর করণীয় তো স্পষ্ট।

অগত্যা গাড়ি বের করতে হল।

- কোথায় যাবে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
: যেদিকে ইচ্ছে নিয়ে যাও। মিলি উত্তর দিল।
- ইচ্ছে তো করে সমুদ্রের দিকে ছুটে যাই।
: কক্সবাজার গেলে তো ভালোই হয়।
- অফিস আছে যে!
: তবে অমন বেয়াড়া ইচ্ছে কেন?
- বসন্তে কোকিলের যা হয়, রাতে আমারও বোধহয় সেরকম হচ্ছে।
: বেশ তো। গান গাও, না করেছে কে!
- ও তো তোমার কাজ। আমি গাইলে পুলিশ আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে জেলে পুরে দেবে।
: আমি গাইলে?
- তুমি বাপু ভার্সিটি কাঁপানো গায়িকা। রাস্তায় আমি এক্সিডেন্ট করে বসলে দুয়েকটা গান গেয়ো, পুলিশ মাফও করে দিতে পারে।
: ফাজলামো ছেড়ে ঠিকমত গাড়ি চালাও।

আমি আদেশ পালনে প্রবৃত্ত হলাম। গাড়ি এগিয়ে চলল। বহুদিন ক্যাম্পাসে যাওয়া হয় না, সেদিকে ঢু মারলে কেমন হয়? গাড়ি ঘুরিয়ে রওনা হলাম। রাস্তা ফাঁকা। মাঝেমধ্যে দুয়েকটা ট্রাক বেরসিকভাবে শহরের শান্ত পথে হর্ন বাজিয়ে অশান্ত ভঙ্গিতে ছুটে চলেছে। কেমন যেন একটা তাড়া, বিরাম নেই সে দ্রুতযানের। কালেভদ্রে দুয়েকটা রিকশা চোখে পড়ে, দিনের বেলায় সাবধানে চলা রিকশাগুলো রাতে যেন ক্লান্ত ভঙ্গিতে দায়সারা গতিতে এগিয়ে চলেছে। পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখি রিকশাওয়ালার হাতে সস্তা বিড়ি। একসময় আমাকেও ও বস্তু খেতে হয়েছে, এখন খাওয়া হয় না, বড়োজোর কালেভদ্রে হেজেস ধরানো হয়। প্রাপ্তিমাত্রই ত্যাগের দাবি নিয়ে আসে, মিলির আগমনে বদ অভ্যেসগুলো ত্যাগ করতে হয়েছে। শূন্য ধোঁয়ার বদলে পূর্ণতা এসেছে জীবনে।

মিলির কথায় সম্বিৎ ফিরে পাই।

: একসময় এই পথ ধরে কত হেঁটে গিয়েছি তাই না!

ক্যাম্পাসের কাছাকাছি চলে এসেছি আমরা। সেই পথ আছে, পথিক দুজনও আছে, বাহনের কারনে হাঁটা যাচ্ছে না। আমি নরম গলায় বললাম,

- হাঁটবে?

মিলি হাসল। সব প্রশ্নের উত্তর দরকার হয় না। গাড়ি রাস্তার পাশে রেখে দুজন হাঁটতে লাগলাম।

- বসন্ত উৎসবের কথা মনে আছে?

আমি জিজ্ঞেস করলাম। মিলি হেসে বলল,

: না থাকার কি আছে। তুমি একগাদা ফুল নিয়ে ঐ ল্যামপোস্টের ধারে দাঁড়িয়ে ছিলে। শাড়ি পড়তে পারতাম না, তাই আসতে দেরী হয়ে গিয়েছিল। ওরে বাবা, তোমার সে কি রাগ!
- রাগ কি সাধে হয়েছিল? খালি পেটে বেকুবের মতো দু'ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকলে বুঝতে।
: খালি পেটে? আমি কত সাধাসাধি করলাম, কিছু খাও, তা তো খেলে না!
- দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকলে বোধহয় ক্ষুধা মরে যায়।
: নাকি আমি না খেয়ে ছিলাম বলে খাওনি?

মিলির কথা ঠিক। আমরা একত্রে যখনই বের হয়েছি, কেউই একা কিছু খাইনি। খেলে দুজন একসঙ্গে। পারলে এক প্লেটে। কি আনন্দের দিনই না কাটিয়েছি!

- ওই চায়ের দোকানটা এখনও আছে!

রাস্তার মোড়ে চায়ের টং দোকানটায় টিমটিমে বাতি জ্বলছে। কত বিকেল ওখানে বসে আড্ডা দিয়েছি, দোকানের অখাদ্য চা খেতে খেতে মিলিকে কত অখাদ্য কবিতা শুনিয়েছি।

: তোমার মনে আছে, ওখানে বসে কত কবিতা শুনিয়েছি তোমায়!

মিলি হাসে।

- থাকবে না কেন! নতুন প্রেমিক ও উঠতি কবি দুটোই ভয়ঙ্কর। মনে না থেকে পারে!
: যাক, তাও এতদিন পর স্বীকার করলে!
- আগে জিজ্ঞেস করলে তখনও বলতাম।
: ভাগ্য ভালো আমার। তখন বয়স কম ছিল, সইতে পারতাম না।
- এখন খুব পারো বুঝি!

মিলি হাসতে হাসতে বলে। আমিও হাসি, প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে অতীতের পটে যা বিন্দু হয়ে জমে, ভবিষ্যতের পাতায় তা আনন্দের মুক্তো হয়ে দেখা দেয়। আমি বলি,

: আমি নাহয় আনাড়ি কবি ছিলাম, তুমি তো পাকা গায়িকা ছিলে। এখন গান গাও না কেন?
- গাই, তবে মনে মনে।
: আমাকে বঞ্চিত করে খুব সুখ পাও, তাই না!
- শুনতে না চাইলে জোর করে শোনাবো?
: বৃষ্টি নেই, তবু মেঘের পরশ আছে। গাইলে বৃষ্টি নামতেও পারে।
- আমি তানসেন নই।
: তুমি আমার মিলি সেন। এবার ধরো।

গাড়িটাকে দৃষ্টিসীমায় রেখে আমরা হাঁটছি। হালকা ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে বোধহয়। মিলি নরম গলায় গাইতে লাগল-

“তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারি যদি মনোভার!
শ্রাবণ বরিষনে একদা গৃহকোণে
দু কথা বলি যদি কাছে তার
তাহাতে আসে যাবে কিবা কার।”

গান শেষ করে আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল মিলি। এক বৃষ্টির বিকেলে চায়ের দোকানে বন্দী দুজনে এক কোণের বেঞ্চে বসে ছিলাম। দোকানে বৃদ্ধ দোকানদার ছাড়া কেউ ছিল না। গুণগুনিয়ে সেদিন গানটা গেয়েছিল মিলি।

- সেই বিকেলের কথা মনে পড়ে?
মিলি মাথা নেড়ে সায় দিল। ওর হাসিমুখটা ঠিক দু'বছর আগের সেই বিকেলের মতোই আছে, রাতের আধো আঁধারে আলোয় একাকার হয়ে তাতে অনন্য মাধুর্য জমেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
- বৃষ্টিতে এককাপ চা খেলে বোধহয় মন্দ হয় না।
: এখানে এসে আমরা চা না খেয়ে ফিরেছি কোনোদিন? তোমার যা স্বভাব!
- দোষ তবে আমার একার?

'তোমার দোষে তোমার গুণে আমিও যে সমভাগী!' বলে গুনগুনিয়ে উঠল মিলি। আমরা দোকানের দিকে রওনা হলাম। মোড়ের মাথা থেকেও গাড়ির দিকে নজর রাখা যায়। বেঞ্চে বসতে বসতে ঢুলুঢুলু দোকানদারকে বললাম, 'দু কাপ চা দিও তো মামা! একটা চিনি ছাড়া' মিলি চায়ে চিনি খায় না। আমার অর্ডার শুনে মিলি হাসল। সে হাসিতে নির্ভরতা আছে। কি সুন্দর সে হাসি! পূর্ণ চাঁদের মতো? চাঁদের তো কলঙ্ক আছে, ওর হাসিতে তাও নেই। আর দশের চোখে মিলি কি এতোটাই সুন্দর, যতটা আমার চোখে? আমি যে চোখে মিলিকে দেখি, সে প্রেমময় দৃষ্টি জগতের কার আছে? আমার দেখা আর সবার দেখা যে সমান নয়!

দোকানদার ঢুলুঢুলু অবস্থায় দু'কাপ চা এনে বলল, 'দুই কাপ একাই খাইবেন? আর লোক কই?'

আমি হাসলাম। মিলিও হাসছে। হাসতে হাসতে মিলি যেন মিলিয়ে যেতে লাগল, আমার সত্ত্বায়, বাদল রাতের মাতাল হাওয়ায়, আকাশের গম্ভীর মেঘের শান্ত গতির আড়ালে, দূর থেকে সুদূরে। রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়িটাও মিলিয়ে গেল রাস্তার স্মৃতিতে, ল্যামপোস্টের আলো গ্রাস করে নিল মুহূর্তটাকে।

দু'কাপ চা হাতে আমি বসে রইলাম এক বুক শূন্যতা নিয়ে। মিলির স্মৃতি দেয়াল তুলে আমাকে ঘিরে রাখল রাতের আঁধারের মতো, শান্ত অথচ কী তীব্র!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.