নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন গাধামানব

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন

ডাল দিয়ে ভাত খাই, রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মানুষ আমি ভেজাল হলে'ও আমার লেখাগুলো খাঁটি ।

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

কোরবানি

১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৫৭


১.

রহমত, ও রহমত!

রহমতের সাড়া পাওয়া যায় না। কলিমুদ্দিন আরও দুয়েকবার ডাক দেয়। কোন উত্তর নেই। রহমত গেল কোথায়? বাজারের চায়ের দোকানে? বিচিত্র না। রহমতের চাষবাসের চেয়ে গল্পগুজবে আগ্রহ বেশি, সাথে একের পর এক বিড়ি। কলিমুদ্দিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রহমতের উদাসীনতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে রহমতের পরিবারের, প্রায়ই আধপেটা থাকে। তারপরই ক্ষতিগ্রস্ত কলিমুদ্দিন। কারন তাদের দুজনেরই একটা করে গরু, নিজের জমি না থাকায় জমি বর্গা নিয়ে দুজন একত্রে চাষবাস করে, ফসলও ভাগাভাগি করে নেয়। রহমত যেদিন মাঠে যায় না, সেদিন কলিমুদ্দিনের কাজ বেড়ে যায়। দিনশেষে দেখা হলে কলিমুদ্দিন যেই না গালাগাল করতে যাবে, তেমনি রহমত লাজুক হাসি দিয়ে বলে বসে, ‘দেখছ কলিমুদ্দি ভাই, বাজারে গিয়া বইলাম, খিয়ালই পাইলাম না কেমনে বেলা ফুরাইয়া গেল।’ কলিমুদ্দিন বিশেষ সুবিধা করতে পারে না, বিশেষ করে যখন রহমতের ছেলে রহিম ওর সাথে থাকে। একরত্তি ছেলে, সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগেই আছে। ওর দিকে তাকালে কলিমুদ্দিন আর কিছু বলতে পারে না। যেদিন বাপ থাকে না, সেদিন রহিমই কলিমুদ্দিনের সাথে মাঠে যায়। ওটুকু শরীরে কাজে হাত লাগাতে চায়। কলিমুদ্দিনের মায়া লাগে। আহারে!

আজও বোধহয় রহমতকে পাওয়া যাবে না। কলিমুদ্দিন রহমতের গোয়ালঘর থেকে গরুর দড়ি খুলতে খুলতে আওয়াজ হাঁকে, ‘ভাবীসাব, গরু লইয়া গেলাম। রহমত আইলে কইয়েন।’ দরজার আড়াল থেকে উত্তর আসে, ‘রহিমরে লইয়া যান লগে, হে বাড়িত থাকলে ত্যক্ত করে। মাঠে কাজকাম শিখুক, বাপের মতো হইলে বড় হইয়া খাইব কি , রহমতের বউয়ের গলার তিক্ততা কলিমুদ্দিনের কাছে চাপা থাকে না। কলিমুদ্দিন আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সংসারের ষোলো আনাই ফাঁকি, রহমত সেই ফাঁকির মধ্যেও ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। স্ত্রী মেনে নিতে বাধ্য হয়তো, কিন্তু মা তো সন্তানের কথা ভাববেই।

রহিম একটা মুড়ির মোয়া হাতে উঠানে দাঁড়িয়ে আছে, গাছের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখছে। কলিমুদ্দিন ডাক দেয়, ‘রহিম, যাবি?’

রহিম সম্বিৎ ফিরে কলিমুদ্দিনের দিকে তাকায়, তারপর হাসিমুখে মাথা নাড়ে। কাছে এসে গরুর দড়ি ধরে কলিমুদ্দিনের পেছন পেছন আসে। কলিমুদ্দিন এই ব্যাপারটা দেখে অবাক হয়, রহমতের গরুটা বেশ তেজী। রহমতের কথাও অনেক সময় শুনতে চায় না, গাইগুই করে। কিন্তু রহিম কাছাকাছি থাকলে গরুটা যেন একটা শান্ত ছোট্ট বাছুর হয়ে যায়।

হাঁটতে হাঁটতে কলিমুদ্দিন জিজ্ঞেস করে, ‘সকালে খাইছিস?’
রহিম হেসে হাতের আধ-খাওয়া নাড়ু দেখায়।
তর বাপ কই?
জানি না।
আইজকা দেখছস?
না।
বাড়ি থাকে না।
হু।
বাজার সদাই করে না?
হু।

মাঠ এসে পড়ে। হালের সঙ্গে গরু জোড়া লাগিয়ে কলিউদ্দিন মাঠে নেমে পড়ে। রহিমকে বলে, ‘তুই ছায়ায় গিয়া বইসা থাক’। রহিম যায় না, হালের সঙ্গে সঙ্গে মাঠে ঘুরে বেড়ায়। মাঝেমধ্যে গরু থেমে যায়, পাথুরে মাটিতে এগোতে চায় না। রহিম গরুর গলায় হাত বুলিয়ে দেয়, আবার চলতে শুরু করে। কলিমুদ্দিন অবাক হয়। সামান্য একটা গরু, সেও কী ভালোবাসা বোঝে?

২.

‘তোমার অভ্যাস বদলাও’, কলিমুদ্দিন হুঁকা টানতে টানতে বলে।
‘কীসের অভ্যাস?’ রহমতের হাতে বিড়ি। মাঠের পাশে বসে কাজের ফাঁকে দুজনের আলাপ চলে।
‘তোমার পোলাডার কথা ভাবো কিছু?’
‘ভাবার কি আছে, বড় হইতাছে, ভালোই তো আছে’ রহমত নিরুদ্বেগ গলায় বলে।
‘কালকেও মাঠে আইছিল পোলাডা। তুমি গতর না খাটাইলে পোলাডা যদি অল্প বয়সে কামে লাইগা যায়, তাইলে তোমার বাইচা থাইকা লাভ কি?’
‘বাঁচার সম্ভাবনা এমনেও কম। কয়েকমাসের কিস্তি বাকি পড়ছে, মহাজনের টাকাও দিবার পারি নাই।’
‘সর্বনাশ!’ কলিমুদ্দিন আঁতকে উঠে।

আগে শুধু মহাজন ছিল, এখন এনজিও’র ক্ষুদ্রঋণ যোগ হয়েছে। আধপেটা কৃষক সব জায়গা থেকেই দু’হাত পেতে সামান্য যা নেয়, বছর ঘুরতে না ঘুরতে তা ফুলেফেঁপে বানের জোয়ারের মতো কৃষকের জীবনকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মহাজন গ্রাম্য ভাষায় খিস্তি আউরাতে থাকে, পাওনা টাকা আদায়ে লাঠিসোটা সবই প্রস্তুত থাকে। এনজিও সাহেবেরা গ্রাম্য ভাষায় না, রীতিমতো শিক্ষিত ভাষায় ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে পুলিশও থাকে। এসব দেখেও কৃষকদের বোধোদয় হয় না। ফের ধানের মওসুম এলে আবার ধার, ক্ষুদ্রঋণ, দাদন। ফসল গোলায় ওঠার আগের মহাজনের কাছে সস্তায় বিক্রি হয়ে যায়, ধারের কিছুটা শোধ হয়। একই চক্র চলতে থাকে বারবার, নিঃস্ব আরও নিঃস্বতর হয়, দরিদ্র দরিদ্রতর হয়, কিন্তু কীভাবে যেন দেশ এগিয়ে যায়। ইলেকশনের সময় মাইকিং হয়, দেশের ‘উন্নয়ন’ হয়েছে। গরীব কৃষক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। উন্নয়ন কী সেটা তারা বোঝে না। ধরে নেয় বিদেশী কিছু একটা হবে, দেশে নতুন এসেছে বোধহয়। গ্রামে থাকার কারনে তারা জিনিসটা দেখতে পাচ্ছে না।

‘কিস্তি শোধের ব্যবস্থা করছ কিছু?’ কলিমুদ্দিন উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চায়।
রহমত বিড়ি টানতে টানতে মাথা নাড়ে। তার দৃষ্টি দূরে, ফসলের মাঠে কৃষকেরা হাল চালাচ্ছে, কেউ ট্রাক্টর। ক’দিন বাদেই বীজতলা আবাদ হবে, সেখান থেকে ধানের চারা সারি বেঁধে লাগানো হবে মাঠে। তরতর করে বেড়ে উঠবে সবুজ ধানগাছ, দুধেল সবুজ রঙের কচি শীষ বের হবে, আস্তে আস্তে সোনালী আভায় ছেয়ে যাবে সেই শীষের ধানগুলো। একসময় সোনার পরশ পুরো ধানগাছে, ধানক্ষেতে, মাঠের পর মাঠে। পাকা ধানের গন্ধে মই মই করবে দিগন্ত বিস্তীর্ণ মাঠ, সেই গন্ধে মিশে যাবে কৃষকের একবুক দীর্ঘশ্বাস। সোনার সে ফসলে তার নোনা ঘাম আছে বিস্তর, কিন্তু অধিকার নেই একবিন্দু।


৩.

রহমত সব ঠিক করে ফেলে।

‘সত্যিই?’ রহমতের বউ বিশ্বাস করতে চায় না।
রহমত হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে।
থালায় ভাতের সাথে ডাল নাড়তে থাকে রহমত। খাওয়া গলা দিয়ে নামে না। ধীর গলায় বলে, ‘আমি একটু গতর খাটাইলে এই দিন দেখন লাগত না’।

রহমতের আফসোস হয়। জমিজমা বিক্রি করে পাশের পাড়ার নেজাম ব্যাপারীর ছেলে বিদেশ গেল। বছর দুয়েকের মধ্যে রমরমা অবস্থা, বাড়িতে দোচালা ঘর, গোয়ালে গোটা দশেক গরু। বিক্রি হওয়া জমি তো কিনেছেই, পুবপাড়ায় আরও কয়েক গণ্ডা জমি রেখেছে। রহমতও যদি তখন চলে যেত! রহমত ভাত মাখতে থাকে।

‘এই ট্যাকা কারে দিবা?’ রহমতের বউ ধরা জিজ্ঞেস করে।

রহমত বুঝতে পারে বউ এখনো ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু আর কীইবা করার আছে?
‘কিস্তির ট্যাকা আগে দিয়া লই, মহাজনরেও কিছু দিতে হইব। ফসল তুললে বাকিডা দিমুনে’
‘কলিমুদ্দিন ভাইয়ের লগে কথা কইছ?’
‘হ, হ্যার অবস্থাও তো ভালো না’
‘আর কারো কাছে কিছু পাওয়া যাইব না?’
‘যার নিজের কিছু নাই, হের কাছে চাইয়া শরম দিয়া লাভ আছে?’
‘আর কিছু করনের নাই?’, বউ রহমতকে মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করে।
রহমত মাথা নাড়ে।

কথা বেশি এগোয় না।

নিরুপায় মানুষের সামনে রাস্তা থাকে না, কথাও থাকে না। ভাগ্যকে মেনে নেয়াই তার একমাত্র পথ।

বিকেলে দু’জন ব্যাপারী আসে। গোয়াল থেকে গরুটাকে টানতে টানতে নিয়ে যায়। রহমতকে টাকা গুণে দেয়। রহিম শুরুতে গোটা ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। যখন বুঝতে পারে তাদের গরু চিরদিনের মতো চলে যাচ্ছে তখন তার কান্না ঠেকায় কে?

পাড়া পড়শিরা ছুটে আসে। রহিমের কান্না থামানো যায় না। যেই প্রাণীটির সাথে তার বেড়ে ওঠা, যাকে সে না খাইয়ে দিলে খায় না, যাকে গোসল করিয়ে দিত সে প্রতিদিন, সে তো কেবল একটা অবলা জীব নয়! রহিমের হাহাকার কেউ বোঝে না, বোঝার কথাও না। গরুটা যেতে চায় না, ব্যাপারীর শক্ত লাঠি নেমে আসে। রহমতের বউ ঠিকরে ঠিকরে কাঁদতে থাকে। রহমত একটা বিড়ি ধরিয়েছিল, কখন সে আগুন থেমে গেছে তার খেয়ালই নেই।

সেদিন রাতে রহিম কিছু খেল না। তার কান্নাও থেমে এলো। রহমত ভাবল, ছেলেমানুষ তো, ঠিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রহিমকে দেখা গেল না।
কলিমুদ্দিনের বাড়ি ছুটে গেল রহমত।
তারপর বাজারে।
মাঠে।

সকাল থেকে রহিমকে কেউ দেখেনি।


৪.

আফজাল ব্যাপারী হিসেবী লোক। তিনজন কামলা রেখেছে সে, গরুর দেখাশোনায় একটুও ব্যত্যয় হতে দিচ্ছে না। বারোমাস গরু কি খেয়েছে, কি করেছে- সেটা দেখার বিষয় না। এখন যতটা চকচকে করে রাখা যায়। দিনরাত খাওয়া আর তেল মালিশ চলছে। যে গরু দেখে খরিদদার যত খুশি হবে, সেই গরুর দাম তত বেশি। সব খরিদদার অবশ্য একরকম না। একশ্রেণীর খরিদদার যেন পাকা কসাই। এসেই গরুর পাছায় থাপ্পড় দিয়ে বলে, ‘এত মণ মাংস হইব’। এদের জ্বালায় গরু বিক্রি কঠিন হয়ে যায়।

আফজাল ব্যাপারী বয়স্ক মজুরটিকে জিজ্ঞেস করে, ‘গরু সব ঠিকঠাক আছে তো?’
‘না ওস্তাদ। নতুন চালানের তিনটা গরুর একটা ডিসটাব দিতাছে’
‘কি হইছে?’
‘খাওন দিছি, কিন্তু হালায় খায় না’
‘ক্ষিদা লাগলে আপনাতেই খাইব। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা।’
‘ ওস্তাদ অতি সত্য কথা বলেছেন।’
‘তোমরা এইখানে আইছ কেন? পেটের জ্বালায়। আমি বেবসা করি কেন? পেটের জ্বালায়। আসল সমস্যা পেট, এইডা না থাকলে দুনিয়া অনেক সহজ হইত।’
‘ওস্তাদের কথাবার্তা অনেক দামী।’
‘ তুমি কি আমারে তেল মালিশ করতেছ?’
‘না ওস্তাদ, কি বলেন!’
‘করতেও পারো। এক কাজ বেশিদিন করলে অভ্যাস হইয়া যায়। একবার এক বেশ্যার সাথে এক লোকের বিবাহ হইল। সেই লোকও যে ফেরেস্তা তা কিন্তু না। বাসর শেষে অভ্যাসবশত সে একশ টাকা বউয়ের হাতে দিল। বউও আগের অভ্যাসমত বিশ টাকা ফেরত দিল। কী বুঝলা?
‘কিছু বুঝি নাই ওস্তাদ’

আফজল ব্যাপারী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এদের সাথে কথা বলে আরাম নাই। এরা সামান্য দিনমজুর, বেতন আর খাওয়া পেলেই খুশি। নতুন খরিদদার আসে, আফজল তার সাথে আলাপ জুড়ে দেয়, বেচাকেনা এগিয়ে চলে।

সবই ঠিকঠাক, কিন্তু সেই নতুন গরুটা মাঝেমধ্যে ক্ষেপে যায়। পিটিয়েও শান্ত করা যায় না। আফজাল ব্যাপারী বেশ ঝামেলায় পড়ে যায়। গরু সামলাবে নাকি বেচাকেনা করবে? এক সময় গরুটা একেবারে শান্ত হয়ে যায়। এক মজুর এসে বলে, ‘ওস্তাদ, এক পুলা গরুর দেখভাল করতেছে। তারপর থাইকা গরু এক্কেরে শান্ত। ওরে কি সরায়া দিমু?’
‘ও কি অন্য কারো রাখালি করে?’
‘মনে হয় না। ভাদাইম্যা পুলা।’
‘থাকুক। ঝামেলা না করলে থাকুক। আর শোন, তোরা যা খাবি তাই খাইতে দে। তয় সাবধান, গরুর বাজারে চোর চোট্টার অভাব নাই। চোখ রাখিস।’
‘আইচ্ছা ওস্তাদ।’

নতুন ছেলেটা আসার পর থেকে গরুটা যেন একেবারে ভালো মানুষ। ছেলেটাও বেশ ভালো, কারো সাথে কোন কথাবার্তা বলে না। আফজাল ছেলেটার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে, কিন্তু ছেলেটা মুখই খোলে না। কেবল হা হু করে। আজব ছেলে!

দামদর ঠিক হয়ে যায়। সেই তেজী গরুটা বেশ চড়া দামে বিক্রি হয়ে যায়। আফজাল ব্যাপারী সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে হিসেব করে, লাভ ভালোই হল। ঈদের আগে আরও কয়েকদিন ব্যবসা চলবে। রাতে খেতে বসে সেই ছোট ছেলেটার খোঁজ করে, কিন্তু গরুটা বিক্রি হবার পর থেকে ছেলেটাকেও আর কেউ দেখতে পায়নি।

৫.

অনিমের বাবা ঘামছেন। সরকারী বড়কর্তা হিসেবে এসি রুমে থাকার অভ্যেস। গরুর হাটে এসি নেই, ফলে ঘামা ছাড়া গতি নেই। গরু আনতে অবশ্য তেমন সমস্যা হয়নি, ব্যাপারীর একটা ছোকরা বাড়ি পর্যন্ত গরু এগিয়ে দিয়েছে। ঘামের কারন ভিন্ন। অনিমের মায়ের মেজাজ খুব চড়া। তার পছন্দ অপছন্দ বোঝা মুশকিল।

ঈদ উপলক্ষ্যে ফ্রিজ কেনা হল। অনিমের বাবা কয়েক দোকান ঘুরে বড়সড় একটা ফ্রিজ কিনে এনেছেন। পুরনো দুটো ফ্রিজ অবশ্য আছে, তবু ঈদে বড় একটা নতুন ফ্রিজ না হলেই নয়। অনিমের মা ফ্রিজ দেখে ভুরু কুঁচকে বলেছে, ‘এইটা কি?’

তিনি হাসিমুখে ব্ললেন, ‘ কেন? নতুন ফ্রিজ।’
‘দেখে তো মনে হচ্ছে একটা আলমারি।’
‘আধুনিক ফ্রিজ তো এইরকমই হয়’, এ কথা বলে অনিমের বাবা ফেঁসে গেলেন। এর পর অনিমের মা দীর্ঘ ভাষণ শুরু করলেন। সচিবালয়ে অজস্র সভা-বৈঠকে নানা লোকের ভাষণ অনিমের বাবা শোনেন, কিন্তু অনিমের মা অতুলনীয়। দীর্ঘ ভাষণে তিনি যা বললেন, তার ভাবার্থ, অনিমের বাবা তাকে আধুনিকতা শেখাচ্ছে কেন? তিনি কি গেঁয়ো? যথাসময়ে যথাস্থানে বিয়ে হলে তিনি এমন সংসারে থাকতেন না, আরও সুখে থাকতেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

অনিমের বাবা তওবা করেছেন তিনি আর একা একা কেনাকাটা করবেন না। অনিমের মাকেই দায়িত্ব দেবেন। গরু কেনার ব্যাপারে সে কথা তুলতেই অনিমের মা চোখ কপাতে তুলে বললেন, ‘আজিব কথাবার্তা! আমি হাটে যাবো? আমাকে কি তোমার বাজারি মেয়েছেলে মনে হয়? ইয়া আল্লা...’ মাতম শুরু হবার আগেই অনিমের বাবা কেটে পড়েন। গরু কিনতে তিনি একাই যেতেন, ড্রাইভার দয়াপরবশ হয়ে অফিস থেকে ফেরার পথে তাকে সঙ্গ দিয়েছে বলে রক্ষা।

এখন গরু অনিমের মায়ের পছন্দ হলেই হয়।

অনিম গেটের কাছে দাঁড়িয়ে গরু দেখে চেঁচাচ্ছে, গরু এগিয়ে দিতে আসা ছেলেটা অনিমেরই বয়সী। তার সাথে একটু আধটু কথা বলছে অনিম। গরুটা একেবারে শান্ত। অনিম ফুলগাছের পাতা ছিঁড়তে গেল, দারোয়ান দৌড়ে এসে বলল, ‘বাবাজী এই পাতা দিয়েন না, আমি খেড় আইনা দিতাছি’। কিছুক্ষণের মধ্যে খড় মাড়ের গামলা চলে এলো। সব ঠিকঠাক। কিন্তু অনিমের মা এখনো উপর থেকে নামেনি। তার বাতের ব্যাথা বাড়লে সিঁড়ি ভাঙ্গতে সমস্যা হয়।

পরদিন সকালে অনিমের মা নামলেন। গরু দেখে যতটা অবাক হলেন, তারচেয়ে বেশি অবাক হলেন সাথে থাকা ছেলেটাকে দেখে।

‘এই নাম কি তোর?’
‘রহিম’
‘তুই রাতেও এখানে ছিলি?’
‘হু’

দারোয়ানকে ডাকালেন। দারোয়ান জানালো, ছেলেটাকে বের করে দিতে চেয়েছিল সে, কিন্তু গরুটা হঠাৎ দড়ি ছিঁড়ে তাকে গুঁতা দিতে আসে। তখন ছেলেটা গরুর গায়ে হাত দিতেই একেবারে শান্ত হয়ে যায়। দারোয়ান বলল, ‘বিবিসাহেবা, এই গরু ম্যালা তেজী। পুলাডারে না রাখলে গরু সামলানো যাইব না’। শুনে তিনি রাজি হয়ে যান, গার্ডরুমের পাশে গ্যারেজে গরু রাখার ব্যবস্থা হল, রহিমও সেখানে থাকা শুরু করল।

অনিমের বাবা শান্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। বাঁচা গেল, গরু নিয়ে তাকে কিছু শুনতে হল না।

সামনেই ঈদ। বাড়িতে উৎসব উৎসব ভাব চলে এসেছে। অনিমের মামা তার ছেলেপেলেসহ চলে এসেছে । অনিমসহ ছেলেপেলে সবাই গরু দেখে, কিন্তু হাত দিতে ভয় পায়। সেই ছোট্ট ছেলেটা ঠিকই গরুকে সময়মত খাওয়ায়। বালতিতে পানি এনে গোসল দেয়, তেল মেখে দেয়। যত্নে গরুটাও দেখতে যেন আরও দর্শনীয় হয়ে উঠছে। যেই দেখে প্রশংসা করে। কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা নয়, একেবারে খাঁটি স্বাস্থ্য গরুটার।

দেখতে দেখতে কোরবানির দিন চলে আসে। নামাজ পড়তে যাবার সময় অনিমের বাবা দেখেন ছেলেটা গরুর গলা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃশ্যটা দেখে অদ্ভুত মনে হল, ঈদের ময়দানে যাবার পথে ব্যাপারটা বুকের ভেতর খচখচ করতে লাগল। তিনি বুঝতে পারলেন না এর কারন কি। ছেলেটা অনিমের বয়সী এজন্যই কি এমন লাগছে? নাকি গরুর গলা ধরে থাকার দৃশ্য শহরে অভাবনীয় বলেই এমন মনে হচ্ছে? তিনি ভেবে পেলেন না। ঠিক করলেন, ছেলেটাকে কোরবানি শেষে বিদায় করার সময় বখশিশের সাথে অনিমের কিছু কাপড়-চোপড়ও দিয়ে দেবেন।

নামাজ শেষে হুজুরকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন তিনি। দারোয়ানসহ আরও লোকজন মিলে গরুটাকে বাঁধল, চার পা একত্রে বেঁধে শক্ত গিঁট দিল। হুজুর যেই না ছুরি চালাতে যাবে অমনি গরু সরে গেল, দড়ি ছিঁড়ে দাঁড়িয়ে যাবার উপক্রম হল। দারোয়ান ডাক দিল, ‘ওই রহিম্যা, এইদিকে আয়! গরুরে সামলা!’

শূন্যদৃষ্টিতে রহিম এগিয়ে গেল। সে গরুর কপালের মাঝখানে হাত দিয়ে ঘষতে লাগল। গ্রামের মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা গরুটির কপালে রহিম হাত বুলালে সে মাঠে শুয়ে পড়ত, রহিম ওর গলা জড়িয়ে বসে থাকত। ঠিক সেভাবে হাত বুলিয়ে দিতেই গরুটি যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শান্ত হয়ে এলো। এবার আরও দ্বিগুণ শক্ত গিঁট দেয়া হল। রহিমের হাত গরুটির কপালে থাকা অবস্থায় হুজুরের মস্ত আকারের ছুরি একটানে রক্তের ফিনকি বইয়ে দিল। রহিমের শূন্য নিথর দৃষ্টির মতো গরুটাও নিথর হয়ে রইল।

বাড়ির ভেতর থেকে নতুন টাকার বাণ্ডিল পকেটে পুরে অনিমের বাবা ড্রয়িংরুমে বসলেন। হুজুরকে শরবত নাস্তা খাইয়ে নতুন টাকা গুণে দিয়ে বিদায় করলেন। রহিমের জন্য কাপড়গুলো আনালেন। একটু বেশি করেই টাকা গুণে রাখলেন। দারোয়ানকে বললেন রহিমকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসার জন্য।

দারোয়ান এসে জানাল, রহিম নেই। আশেপাশে অনেক খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়নি।

অনিমের বাবার বুকে সকালের সেই খচখচে অনুভূতিটা যেন আবার জেগে উঠল, চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই দৃশ্যটি, একটা ছোট্ট ছেলে পরম মমতায় গরুর গলা জড়িয়ে ধরে আছে। দয়াহীন মায়াহীন এই পৃথিবীতে যেন ঐ দুটি প্রাণ ছাড়া আর কেউ নেই, কিছু নেই।




মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:৪৭

রক্তিম দিগন্ত বলেছেন: লেখায় একটা মুগ্ধতার আবেশ জড়িয়ে ছিল। চমৎকার লাগলো পড়তে।
কোরবানীর মানে তো এটাই। মনের পশুত্বকে ঝেড়ে ফেলা। অনিমের বাবা সেটাই উপলব্ধি করেছেন শেষে।

২| ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:০১

কানিজ রিনা বলেছেন: পশুত্ব আর গেল কই বছর বছর কত কুরবানী দিল
অথচ লোক দেখানো কুরবানী হোল বছর গেল ষুগ
গেল পশুত্ব রয়েই গেল। জানোয়ার থেকে জন্তু হোল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.