নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন গাধামানব

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন

ডাল দিয়ে ভাত খাই, রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মানুষ আমি ভেজাল হলে'ও আমার লেখাগুলো খাঁটি ।

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের একটা পুরনো গল্প

১৭ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১২:১০

সময় ১৮৫৪ সাল।

লন্ডনের অলিতে গলিতে কান্নার রোল। প্রতিদিন অজস্র মানুষ মারা যাচ্ছে। মৃত্যুর কারন কলেরা। কেন, কীভাবে এই রোগ হয়- এসব তখনকার বিজ্ঞানীদের অজানা ছিল। ‘রোগের নেপথ্যে জীবাণুর অবদান’ তখনও কেউ জানতেন না, এমনকি কলেরার জীবাণু সম্পর্কেও কারো কোন ধারনা ছিল না। মৃত্যুর সামনে প্রচণ্ড অসহায় লন্ডনবাসী শোকে বেদনায় মুহ্যমান হয়ে দিন কাটাচ্ছিল।

তরুণ সার্জন জন স্নো তখন অপারেশন থিয়েটারে রোগীর উপর চেতনানাশকের ভূমিকা পরীক্ষা করছেন। ইথার কিংবা ক্লোরোফর্ম কত ডোজে দিলে রোগীর চেতনা নাশ হয়, ব্যাথামুক্ত অপারেশন করা যায়- এই নিয়ে দিনরাত কাজ করে চলেছেন। সারাদিনের অজস্র কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে যখন শবযাত্রীর মিছিল দেখেন, তখন স্নো’র চিকিৎসক মন বিষিয়ে ওঠে, মানব মন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কেন মৃত্যুর সামনে মানুষ এভাবে হার মানবে? বাড়ি ফিরে লন্ডনের ম্যাপ হাতে নিয়ে বসলেন তিনি। পুরো শহরের মৃত্যুর হিসেব লিখতে থাকলেন, কোথায় কতজন মরেছে সে হিসেবে শহরকে ভাগ করতে থাকলেন। একসময় স্নো অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, পুরো লন্ডনের তিনটি পানির পাম্পের একটির আশেপাশে মৃত্যুর হার ভয়াবহ রকমের বেশি। পরদিন তিনি সেই এলাকায় ছুটে যান, দেখতে পান মানুষ লাইন ধরে বোতল-বালতি ভরে পানি নিয়ে যাচ্ছে। একদিকে পানির জন্য লাইন, অন্যদিকে মৃত্যুর জন্য লাইন। বেদনার্ত স্নো গাড়ি ঘুরিয়ে চললেন অন্য দুটো পাম্প দেখতে। সে দুটো ছিল শহরের অন্য মাথায়, একটা পাম্প থেকে বিয়ার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে পানি যেত, আরেকটা পাম্প এতোটাই দূরে ছিল যে সেখান থেকে পানি যোগাড় করা অসম্ভব ছিল। স্নো সেই বিয়ার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে খবর নিয়ে মজার একটা খবর পেলেন, এই কারখানার একজন কর্মচারীরও কলেরা হয়নি!

পাম্পের হিসেব ছেড়ে এবার স্নো মন দিলেন বেসরকারি পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে। গোটা লন্ডনে দুটো প্রতিষ্ঠান পানি সরবরাহ করত, সাউথওয়ার্ক-ভক্সহল কোম্পানি এবং ল্যামবেথ কোম্পানি। এদের পানি আহরণের উৎস ছিল টেমস নদী। লন্ডনের সব নালার পানি টেমস নদীর ভাটিতে নেমে যেত, সাউথওয়ার্ক-ভক্সহেল কোম্পানির পানি তোলার পয়েন্ট ছিল সেদিক। আর যেদিক থেকে পানি লন্ডনের দিকে আসত, সেদিকে ছিল ল্যামবেথ কোম্পানির পানি আহরণের ব্যবস্থা। স্নো হিসেব করে দেখলেন, সাউথওয়ার্ক-ভক্সহেল কোম্পানির পানি যারা ব্যবহার করেছে তাদের প্রতি হাজারে কলেরা আক্রান্তের হার ৫ শতাংশ, আর যারা ল্যামবেথ কোম্পানির পানি ব্যবহার করেছে তাদের মধ্যে এই হার ০.৯ শতাংশ।

স্নো বললেন, লন্ডনের বহুল ব্যবহৃত পানির পাম্পটি থেকে কলেরার জীবাণু ছড়াচ্ছে, প্রথমত ঐ পাম্পটি বন্ধ করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত লন্ডনের দূষিত পানি টেমসে গিয়ে মিশছে, ফলে সেই পানি যখন সাউথওয়ার্ক-ভক্সহেল কোম্পানি আহরণ করছে তাতে জীবাণু থেকেই যাচ্ছে। অবিলম্বে সাউথওয়ার্ক-ভক্সহেল কোম্পানির পানি তোলার পয়েন্ট বদলে ফেলা দরকার।

স্নো’র এসব কথা সমকালীন বিজ্ঞানীরা পাত্তা দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। তাদের ভাষ্য ছিল, কলেরা হয় ‘দূষিত বাতাস’ থেকে, পানি নিয়ে নাড়াচাড়া করে কী লাভ! তারা স্নো’র কথা হেসে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতিবিদরা ভাবলেন, শুনেই দেখি সেই ডাক্তারটির কথা! তারা সেই পাম্পটি বন্ধ করে দিলেন, সাউথওয়ার্ক-ভক্সহেল কোম্পানি তাদের পানি তোলার পয়েন্ট সরিয়ে লন্ডন থেকে উজানে নিয়ে গেল।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে লন্ডনে কলেরার প্রাদুর্ভাব বন্ধ হয়ে গেল। অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারের ২০ বছর আগে, যখন জীবাণুটির কথাও কারো জানা ছিল না, সেই অন্ধকার যুগে জন স্নো কেবল হিসেব কষে বলে দিয়েছিলেন কলেরা থেকে বাঁচার উপায়। একজন দুজন রোগীকে সুস্থ করা নয়, জন স্নো সুস্থ করেছিলেন গোটা শহরটাকে। তাঁর দেখানো ‘হিসেব’ বিজ্ঞানের নতুন একটি শাখার জন্ম দেয়, সেই শাখার নামকরণ হয় Epidemiology বা রোগতত্ত্ব, জন স্নো সেই শাখার জনক হিসেবে আজ স্বীকৃত। তাঁর সুপারিশে বন্ধ হয়ে যাওয়া পানির পাম্পটির পাশেই একটা সুদৃশ্য রেস্তোরাঁ আছে, তাঁর নামানুসারে সেই রেস্তোরাঁর নাম রাখা হয়েছে ‘John Snow Pub’, বন্ধুরা কেউ লন্ডন গেলে সেখানে এক চুমুক পানীয় খেতে ভুলবেন না যেন। জন স্নো’র জীবনী নিয়ে অসাধারণ একটা গল্প কিংবা সিনেমা হতে পারত, যেখানে ডাক্তারি পড়তে না পেরে এক সার্জনের সহকারীর কাজ নেয়া কিশোরটির ছবি ফুটে উঠত, কিংবা দেখা যেত সেই ছেলেটি একসময় কীভাবে দুটো রয়েল কলেজের সব পরীক্ষা পাশ করে ফেলল, জানা যেত ব্যস্ততার মাঝেও ফুলের দোকানে কার জন্য ফুল কিনছে এক তরুণ চিকিৎসক, কর্মজীবনে ঘোরতর শত্রু উইলিয়ামকে কীভাবে নিজের সততা ও নিষ্ঠা দিয়ে পরম বন্ধুতে পরিণত করেছিল সে।

আফসোস, সেই গল্প লেখা হবে না, সেই জীবনের সিনেমা চিত্রায়িত হবে না।

তবে বন্ধুরা চাইলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে Tom Hanks অভিনীত Inferno - Movie দেখে নিতে পারেন। মিথোলজিক্যাল কিছু পয়েন্ট ছাড়া সিনেমার মূল বক্তব্য কিন্তু একই রকম। সেই নদী-বিধৌত ইউরোপের পানিতে অজানা জীবাণুর সংক্রমণ, সেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অসহায় চিত্র, জীবাণু ছড়ানো বন্ধের জন্য কিছু মানুষের ছুটে চলে, শেষ অব্দি জীবাণুর বিপরীতে জীবনের জয়- সব মিলে যায় সেই কলেরামুক্তির গল্পের সঙ্গে। সিনেমা শেষে হাততালি বাজে, বক্স অফিসে বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়, বছর শেষে পরিচালক-অভিনেতা এক ঝুলি পুরষ্কার পায়, কিন্তু বাস্তব জগতের আসল নায়কদের গল্পগুলো অজানাই রয়ে যায়।

এই লেখার মাধ্যমে তেমন একটা গল্প জানাবার যৎসামান্য চেষ্টা করা হল।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৩:৫৪

রক্তিম দিগন্ত বলেছেন:
যৎসামান্য চেষ্টা সফল।

অনেক আগে, তখন বোধহয় স্কুলে পড়ি - তখন শুনছিলাম এই ঘটনাটার কথা।
শুনে বলতে গেলে অবাকই হয়েছিলাম।

অবর্জাভেশন এত তীক্ষ্ণ হয় কী করে?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.