নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন গাধামানব

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন

ডাল দিয়ে ভাত খাই, রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মানুষ আমি ভেজাল হলে'ও আমার লেখাগুলো খাঁটি ।

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

মেরীর গল্প অথবা সময়ের প্রতিবিম্ব

১৮ ই নভেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:৪৭

‘মিস ম্যালোন! কোথায় যাচ্ছ তাড়াহুড়া করে?’ হাউসকীপারের প্রশ্ন শুনে মেরী সলজ্জ হেসে বলে, ‘একটু বাজারে যাবো, কিছু কেনাকাটা আছে।’ আসল ব্যাপার ভিন্ন। বাজার থেকে ফেরার পথে ফুলের দোকানে যেতে হবে, একজনকে রঙ-বেরঙের অর্কিড ফুল দেয়ার ইচ্ছে মেরীর। আজ বিকেলে তার সঙ্গে দেখা হবে। তখন যদি ফুল না পাওয়া যায়? একটু আগেই দোকানে বলে রাখতে হবে।

সময় ১৯০৬ সাল।

ব্রিটিশ ভারতে বাংলাভাষী অঞ্চলকে ভাগ করার চেষ্টা চলছে। এই উদ্যোগের নাম দেয়া হয়েছে বঙ্গভঙ্গ। লর্ড কার্জনের আদেশে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হল, পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের ধারনা হল এই ঘটনার পর তাদের শিক্ষা-দীক্ষা, চাকুরি, বাণিজ্যে উন্নতি হবে। পশ্চিমবঙ্গে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে উত্তেজনা দানা বাঁধল, যদি ব্যবসা বাণিজ্যে কলকাতা পিছিয়ে পড়ে তাহলে কী হবে? বুদ্ধিজীবী দার্শনিকরা অবশ্য আর্থিক বিষয়টা নিয়ে তেমন চিন্তিত ছিলেন না, তারা বাংলাকে অখণ্ড ও ঐক্যবদ্ধ অবস্থায় দেখতে চাইলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার বিভাজনে বেদনার্ত হৃদয়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ গান লিখলেন, যা বহুকাল পর বিশ্বের একমাত্র বাংলাভাষী রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়।

মেরীর প্রসঙ্গে আসা যাক। আমেরিকা আসলে দেশান্তরী হওয়া মানুষের দেশ, আজকের ট্রাম্প সাহেব যাই বলুন দেশান্তরী ইউরোপীয়রা তাদের আসল মালিকদের তাড়িয়ে আজকের আমেরিকা প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রতি দশজন আমেরিকানের নয়জনেরই পূর্বপুরুষ নন-আমেরিকান, মূলত ইউরোপ থেকে আসা। মেরী ম্যালোন ছিলেন সেরকমই একজন। আইরিশ বংশোদ্ভূত মেরী রান্না করতে ভালোবাসতেন, রান্না করাটাকেই আমেরিকায় নিজের পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, রাঁধতেনও চমৎকার। ফলে চাকরি খুঁজে পেতে তেমন সমস্যা হয়নি তাঁর। দীর্ঘ একহারা গড়নের মেরী রাঁধুনি হিসেবে যেখানে কাজ করতেন সেখানকার সবাই তাঁর রান্নার ভক্ত ছিলেন, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কিছুদিন পরই সেই খাবার গ্রহণকারীদের অধিকাংশ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে পড়তেন। সমস্যাটা কোথায়- এটা কারো জানা ছিল না। এটা গত শতাব্দীর প্রথমদিকের কথা। বিজ্ঞান আজও কুসংস্কারের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে। তখন অবস্থা কেমন ছিল, সেটা সহজেই অনুমেয়। এসব অসুস্থতার দায় নিরীহ মেরীর উপর এসে পড়ল। মেরীর উপর ভৌতিক প্রভাব আছে- এরকম অজুহাতে তাকে তাড়িয়ে দেয়া হল। মেরী অন্যত্র এসে রাঁধুনির কাজ নিলেন। সেখানেও একই সমস্যা, এগারো জন টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে পড়ল। মেরীকে ‘অসুস্থ’ আখ্যায়িত করে বিদায় দেয়া হল। কিন্তু তার রোগটা কী- সেটা কেউ বলল না। ডাক্তাররাও পরীক্ষা করে কিছু পেলেন না, মেরী একেবারে সুস্থ বলে প্রমাণিত হলেন। তবুও কাজ যে জোটে না! মেরী এবার শহর ছাড়লেন। অন্য শহরে নিজের নাম বদলে রাঁধুনির কাজ নিলেন, ওটা ছাড়া যে আর কিছু ভালো লাগে না! কি আশ্চর্য, সেখানেও লোকে অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগল! দুর্ভাগ্য যেন মেরীকে অদৃশ্যভাবে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল।

ডঃ সোপার নামের একজন গবেষক টাইফয়েড নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অদ্ভুত একটা মিল খুঁজে পান। পরিণত বয়সের একজন আইরিশ মহিলা যেসব জায়গায় কাজ করেছেন টাইফয়েডের হার সেসব জায়গায় বেশি। তিনি খুঁজে খুঁজে মেরীকে বের করলেন। মেরীর ‘হয়তো’ কোন রোগ আছে, তাই এরকম হচ্ছে- এই সংবাদ মেরীকে জানাতেই মেরী ভীত হয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। ডঃ সোপার শত চেষ্টা করেও মেরীকে রক্ত ও মলমূত্র পরীক্ষা করাতে রাজি করাতে পারলেন না। মেরী পালিয়ে গেলেন। আজ এখানে কাল ওখানে তিনি লুকিয়ে বেড়াতে লাগলেন। ততদিনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সারা পৃথিবী যুদ্ধের উত্তাপে তপ্ত। ১৯১৫ সালের এক বিকেল, মেরী পুলিশের কাছে ধরা পড়ে গেলেন। তাকে হাজতে নিয়ে যাওয়া হল। ঐ সময়টাতে ইটালি সবেমাত্র বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করেছে, সেই খবরে উত্তেজিত গণমাধ্যমে মেরীর বন্দীত্বের খবর চাপা পড়ে গেল। রক্ত আর গোলাবারুদের গন্ধে আসক্ত অমানুষে ভরা পৃথিবীর কেউ জানল না, বিনা অপরাধে একজন নারী বন্দী হলেন জেলের চারদেয়ালের মাঝে। তার অপরাধ কী ছিল? প্রবল শক্তিধর আমেরিকা তাকে বন্দী করেছে, কিন্তু তাঁর অপরাধটি বলতে পারেনি। সেই প্রযুক্তি তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। প্রায় এক শতাব্দী পর স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বেরিয়ে আসে, মেরী ছিলেন বিশ্বের প্রথম টাইফয়েড রোগের লক্ষণহীন বাহক(asymptomatic carrier)।

প্রায় ২৩ বছর বন্দীজীবন কাটিয়ে মেরী জেলের ভেতরেই মৃত্যুবরণ করেন, সময় ১৯৩৮ সাল। চিকিৎসক বন্ধুদের মধ্যে যারা বিসিএস প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাদের কাছে সালটা পরিচিত মনে হতে পারে। মেরীর মৃত্যুসাল হিসেবে না, এই সালে একজন বাঙালী ভদ্রলোকের মৃত্যু হয়। তিনি বেশ কিছুকাল বার্মায় ছিলেন, যথাসময়ে ফিরে এসেছিলেন বলে রক্ষা। নইলে আজ বিসিএসের প্রশ্নের আসা দূরের কথা, তার বংশধরেরা রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে ট্রাম্পরূপী বাংলাদেশের কাছে মার খেত। ভাগ্যিস তিনি কলকাতায় ফিরে গিয়েছিলেন! বার্মায় থাকাকালে এই ভদ্রলোক একটি উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলেন, ‘লেখাটা অত্যন্ত নিম্নমানের হয়েছে’ ভেবে ফেলে রেখেছিলেন দীর্ঘকাল। পরবর্তীতে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়।

উপন্যাসটির নাম ‘শ্রীকান্ত’, লেখক ভদ্রলোকের নাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:১৯

মনিরা সুলতানা বলেছেন: ধন্যবাদ চমৎকার লিখেছেন !

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.