নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন গাধামানব

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন

ডাল দিয়ে ভাত খাই, রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মানুষ আমি ভেজাল হলে'ও আমার লেখাগুলো খাঁটি ।

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

সময়ের চিঠিঃ অর্থ, অনর্থ এবং আসল অর্থ

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:২০

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বেশ মজার একটা কাজ করেছেন। তুমি ভাবতে পারো, একদিন সকালে উঠে দেখলে তোমার কাছে যতগুলো পাঁচশ-হাজার টাকার নোট আছে সব বাতিল হয়ে গেছে, কেমন হবে ব্যাপারটা? ঠিক এই কাজটিই করে বসেছেন মোদী সাহেব। কেন? প্রথমটাতে ভেবে পাইনি। পরে ভারতীয় সহকর্মীদের কাছে বিস্তারিত শুনলাম। নাগরিকদের অধিকাংশই ট্যাক্স দেন না, ফলে আয়কর বহির্ভূত কালো টাকায় দেশ ছেয়ে আছে। গরীব লোকের আয় আর কত টাকা, অনেক ভুঁইফোঁড় ধনকুবের আছে যারা কোটি কোটি টাকা ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছে। এসব টাকা চেক বা কার্ড, অর্থাৎ ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন হত তাহলে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার সুযোগ থাকত না। মোদী সাহেব ক্ষমতায় এসে প্রথমে বিনে পয়সায় ব্যাংক একাউন্ট করার ব্যবস্থা করেছেন, দেশের অধিকাংশ লোকের হাতে এটিএম কার্ড পৌঁছে দিয়েছেন। তারপর একদিন হুট করে এই ঘোষণা- পুরনো নোট আর চলবে না, সেগুলোকে ব্যাংক থেকে বদলে নতুন নোট নিতে হবে। তুমি হয়তো ভাবছ, ধনীরা যদি এই সুযোগে প্রচুর টাকা বদলে নেয়? না, সে সুযোগ নেই। যার যার জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নেয়া যাবে, এক পয়সাও বেশি না।

মোদী সাহেবের এই ঘোষণায় ব্যাংকে ব্যাংকে লাইন পড়ে গেল। মানুষ কষ্ট করে নতুন নোট নিতে লাগল, ধনীরা পড়ল বিপাকে। ‘অর্থ অনর্থের মূল’ প্রবাদটি সত্য হয়ে দেখা দিল। কালো টাকার মালিকেরা ফুঁসতে লাগল, আমজনতা ব্যাপারটাকে মিশ্রভাবে নিল। যারা আসল ব্যাপারটা বুঝল তারা মোদী সাহেবকে সমর্থন জানালো, যারা বুঝল না তারা সাময়িক এই কষ্টের জন্য মোদী সাহেবকে গালাগাল করতে লাগল। সবাইকে পুরো ব্যাপারটা বোঝাবার জন্য নির্বাচনের আগে নেতারা যেমন প্রচারসভা করেন মোদী সাহেব ঠিক সেই রকম সভা করে বেড়াতে লাগলেন, মানুষকে বোঝাতে লাগলেন কেন কালো টাকা ঠেকানো জরুরী। দেশের মুষ্টিমেয় কয়েকজন মানুষের হাতে অধিকাংশ সম্পদ কুক্ষিগত- এই সম্পদকে যথাসাধ্য কমিয়ে আনা গেলে আমজনতারই লাভ। আর যত মানুষ ব্যাংকিং ব্যবস্থার আওতায় আসবে, ট্যাক্স দেবে, ততই সরকার জনকল্যাণে অর্থ বরাদ্দ করতে পারবে। এসব বোঝাবার সময় মোদী সাহেব যে ভঙ্গিতে কথা বলেন, সেটার সঙ্গে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর বয়ানের খানিকটা মিল আছে। একটা ‘ম্যাসেজ’ জনতার কাছে পৌঁছাতে হলে জনতার ভাষাতেই সেটা বলতে হয়, নেতার ভাষায় নয়- এটা খুবই শিক্ষণীয় একটা ব্যাপার বলে আমার কাছে মনে হল।

মোদী সাহেবের এই নাটকীয় উদ্যোগকে বিরোধী দলগুলো বিরোধিতা করা তো দূরের কথা, রীতিমতো স্বাগত জানাতে লাগলেন। যেসব নেতাদের পকেট ভর্তি কালো টাকা, তারা গোমড়া মুখে হাততালি দিতে লাগলেন। কিচ্ছুটি করার নেই, পুরো সিস্টেম একেবারে স্বচ্ছ, দু’নম্বরির জায়গাই নেই! অফিসে আদালতে ঘুষ দেয়া নেয়া কমে এলো, টাকা এনে রাখতে তো হবে! ব্যাংকে কালো টাকা জমা দিতে গেলে ধরা খেতে হবে। পুরো ভারত নতুন এক অর্থনীতির দিকে হাঁটতে লাগল। একজন মুখ খুললেন, তিনি অরবিন্দ কেজরিওয়াল, দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী। নিজের ভাষণে তিনি কড়া ভাষায় বললেন, মোদী সাহেবের উচিৎ ছিল এই নিয়ম নিজের উপর প্রয়োগ করা, তারপর দেশের লোকের কালো টাকার লেনদেন বন্ধ করতে বলা। মোদী সাহেবের দল বিজেপির ফান্ডে যে চাঁদা জমা হয়, তার ৭০-৮০ শতাংশই নগদ টাকা, সেই টাকা সাদা না কালো সে হিসেব কোথায়? নিজের দল আম আদমি পার্টির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আম আদমির ৯২ শতাংশ চাঁদা ব্যাংকের মাধ্যমে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় আদায় হয়, বাকি ৮ শতাংশ নগদ আদায় হলেও বৃত্তান্তসহ ব্যাংকে জমা রাখা হয়, ফলে এতে কালো টাকা ঢোকার রাস্তা নেই। মোদী সাহেবের দল যদি কালো টাকা থেকে বের হতে না পারে, তাহলে দেশের কালো টাকা দূর হবে কী করে?’ মোদী সাহেব এক জনসভায় বলেছিলেন, বিয়েশাদিতে খরচ কম করতে। কেজরিওয়াল এই পয়েন্টে নাম ধরে ধরে কোন মন্ত্রীর ছেলেমেয়ের বিয়েতে কত কোটি টাকা খরচ হয়েছে সে হিসেব দিয়ে মোদীকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন, ‘আগে নিজের মন্ত্রীদের ছেলেমেয়ের বিয়ের খরচ কমান, তারপর দেশের লোককে পরামর্শ দিন’।

এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সবাই সবার জায়গা থেকে দেশের কথা ভাবছে, জনগণের কথা ভাবছে। কেউ কাউকে একচুল ছাড় দিচ্ছে না। পরস্পরের সমালোচনা থাকবে, ভালো কাজের মূল্যায়নও থাকবে, এসবের মাঝখানে থাকবে সহনশীলতা। একটি জাতির নেতৃত্বে মানবিক গুণাবলী প্রতিফলিত না হলে সেই জাতির সকল স্তরে বর্বরতা বাড়তে থাকে। আমাদের নীতি নির্ধারকেরা সিনেমা থেকে শুরু করে গরু পর্যন্ত ভারত থেকে আমদানি করেন, মোদী সাহেবের মতো কালো টাকা দূর করবার ব্যবস্থাটা যদি তারা অনুসরণ করতেন, তাহলে হুট করে বাংলাদেশের চেহারাটা বদলে যেত।

এলিফ্যান্ট রোডের স্টার হোটেলে খাবার সময় পুলক’দার সঙ্গে অনেকবার ভ্যাট দেয়া নিয়ে আলাপ করেছি। জিল্লুর ভাই তো রীতিমতো একাধিক রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির মামলা ঠুকে দিতে চেয়েছিলেন। আমরা নাগরিক হিসেবে নানা রকম ট্যাক্স দিতে কার্পণ্য করি, অসাধু ব্যবসায়ীরা এর সুযোগ নেয়, ফলে রাষ্ট্র কোটি কোটি টাকা থেকে বঞ্চিত হয়। অথচ এই টাকা আমাদেরই উন্নয়নে ব্যয় হয়, যখন সরকার টাকা দিতে পারে না তখন আমরা গালাগাল করি, কিন্তু সেই টাকা কোত্থেকে আসবে- সেটা কেউ ভেবে দেখি না। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমরা নিতে প্রস্তুত, দিতে নয়। দেবার সময় হলে হাজারটা ব্যাখ্যা এনে হাজির করি, ‘কেন ট্যাক্স দেব? এই রাষ্ট্র আমাকে কি দিয়েছে?’ স্বাধীন ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে এটুকু কথা বলবার স্বাধীনতা যে আছে- সেটাই কি বেশি নয়? মোদী সাহেবের একটা কথা ছিল এরকম, ‘আমি নরেন্দ্র মোদী দেশের জন্য নিজের সংসার ত্যাগ করেছি, ঘর ছেড়েছি, দরকার হলে জীবনটাও দিয়ে দেব’। তাঁর অনেক কাজই বিতর্কিত, কিন্তু এই কথাটা বিশ্বের সব দেশের মানুষের জন্য প্রযোজ্য। মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা প্রার্থনাসম- এটা তো ধর্মগ্রন্থগুলোও বলে এসেছে। ভেবে দেখো, আমাদের দেশে প্রচুর ‘ধার্মিক’ আছেন, তাদের সিকিভাগও দেশকে ভালবেসে ট্যাক্স দেন কিনা! উত্তরটা তুমি জানো, নতুন করে কিছু বলবার নেই। তুমি হয়তো ভাববে, এসব কথা যে বলছি, আমি নিজে ট্যাক্স দিই তো? তোমায় বলতে দ্বিধা নেই, ডাক্তার হবার পর যেদিন শুনলাম প্রতিটি রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক, তার পরদিনই ট্যাক্স রেজিস্ট্রেশন করে এসেছিলাম। গত দুই কর বৎসর ধরে দিয়ে আসছি, এ বছর দেশের বাইরে থাকলেও আমার আয়কর ঠিকই জমা হয়ে যাবে। যে মাটিতে একদিন ঘুমানোর স্বপ্ন দেখি সে মাটির সঙ্গে নূন্যতম বিশ্বাসঘাতকতাও করতে চাইনে। নিজের আলাপ থাকুক, তোমায় বরং ময়ূরের গল্প বলি। আজ একটা বই কিনে ক্যাম্পাসে ফিরছিলাম। রাস্তার পাশে দেখি একটা ময়ূর দাঁড়িয়ে আছে। এত কাছ থেকে মুক্ত ময়ূর দেখিনি কখনো। কী যে সুন্দর! ছবিতে যেমন পেখম মেলে থাকা ময়ূর দেখি, সেরকম নয়। ওর পেখম কোথায় গেল- ভেবে পেলাম না। মেডিকেল কলেজে আমার রুমমেট ছিল আবদুল গণি, সে পশুপক্ষী বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান রাখে। সে থাকলে হয়তো ময়ূর সম্পর্কে কিছু জানা যেত। ওর কাছেই শুনেছিলাম, মানুষ ছাড়া প্রাণীজগতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নাকি পুরুষ নারীর চেয়ে সুন্দর হয়, দুটো পাখির মধ্যে যেটা সুন্দর- সেটা অবশ্যই পুরুষ হবে। সে হিসেবে পেখমযুক্ত ময়ূর হবে পুরুষ, আমি যেটা দেখলাম সেটা বোধহয় নারী ময়ূর। আমায় দেখে ময়ূরটা উড়ে একটা গাছের ডালে বসল। আমি যদি পাখির ভাষা জানতাম তাহলে ওকে কাছে ডাকতাম, একটু হাত বুলিয়ে দেখতাম। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমরা জয় করবার নেশায় মত্ত না হয়ে জানতে চেষ্টা করলে পৃথিবীটা অন্য রকম হত। পশুপাখিরা একে অন্যকে ভরসা করে, কিন্তু মানুষকে নয়, কারন সে জানে মানুষ প্রাণী হিসেবে নির্মম ও নিষ্ঠুর।

শুধু অর্থনৈতিক অসাম্য দূর করা নয়, আজকের মানুষ থেকে আসল মানুষ হবার যে যাত্রা, আমাদের তথাকথিত সভ্যতাটি সেই পথ থেকে আজও অনেক দূরে। ডিগ্রী-চাকরি-বিত্ত-বৈভব এসবের জন্য কেবল ছুটে চলা নয়, নিজেকে চিনতে পারার মাঝেই জীবনের গূঢ় অর্থ নিহিত। চিরস্থায়ী শান্তির শাশ্বত জীবন হোক তোমার আমার আমাদের সবার চাওয়া। সেটা ঠিক করতে পারলে বাকি সব যুদ্ধ জয় করা বোধহয় সময়ের ব্যাপারমাত্র।

তোমার অনেকটা সময় নিয়ে ফেললাম। একজন গাধার অর্থহীন একটা লেখা পড়ে সময় ধ্বংস করলে, আমায় করলে শব্দের ঋণে আবদ্ধ। এই ঋণ শোধ করব না- এটুকু জানিয়ে বিদায় নিলেম।

ভালো থেকো।
আজ, কাল, প্রতিদিন।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.