নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন গাধামানব

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন

ডাল দিয়ে ভাত খাই, রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মানুষ আমি ভেজাল হলে'ও আমার লেখাগুলো খাঁটি ।

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

সময়ের চিঠি : অসমাপ্ত যুদ্ধ

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:২৮

'হাতের মেশিনগানের শেষ রাউন্ডটিও ফুরিয়ে গেছে। কমল আফসোস করছে, আরও কিছু গুলি পেলে বেশ হত। বাংকার থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে ওরা, এখন গুলি আনতে যাওয়ার মানে নিশ্চিত মৃত্যু। কয়েকহাত দূরে একটা শব্দ হল, একটা এলএমজি মাটিতে পড়ে গেল, ওটা ছিল আনিসের।

একটা গুলি আনিসের পিঠে ছিদ্র করে বেরিয়ে গেছে। আনিস এখন চুপচাপ শুয়ে আছে, ওর চোখ খোলা। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে কমল অসাড় হয়ে পড়ল। চারপাশের গোলাগুলির শব্দ কিছুই ওর মাথায় ঢুকছে না। কিচ্ছু না।'

একটা সময় প্রচুর লেখালেখির সাধ ছিল, কিন্তু লেখক হবার যোগ্যতা ছিল না, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা তো দূরের বিষয়। তখনকার টুকরো কিছু লেখা ডায়রিতে জমে আছে। অধিকাংশই খাপছাড়া। অসম্পূর্ণ। মনে হয় না কোনদিন এসব লেখা পূর্ণতা পাবে। আজ ডায়রি খুঁজতে গিয়ে এটা পেলাম। লেখার সময় নিজেকে কমলের জায়গায় দাঁড় করালে লেখা কঠিন হয়ে পড়ে। আগেরবারও এই অনুভূতি হয়েছে, আজ আবার হল। ডায়রি বন্ধ করলাম।

আমার গল্প তোমার অজানা নয়। আটাশ বছরের জীবনে প্রথমবারের মতো একটা বিজয় দিবসে দেশের বাইরে আছি। শৈশবে বিজয় দিবস এলে পতাকা যোগাড় করতাম। কাগজের পতাকার বাণ্ডিল পাওয়া যেত। দুই থেকে পাঁচ টাকায় এক বাণ্ডিল। এখন বোধহয় দাম বেড়েছে। বাড়বে না কেন? দিনে দিনে বিজয় দিবস উৎসবের রূপ পেয়েছে, আনন্দে হারিয়ে গেছে রক্তের দাগ, অশ্রুসিক্ত স্মৃতি। আগে এক গলিতে মাইক বাজত একটা, এখন বাজে দশটা। সেই কান ঝালাপালা শব্দে আর বর্ণাঢ্য মিছিলে আনিসের মায়ের কান্না নেই, কমলের হারিয়ে যাবার গল্পটি নেই, নেই এলএমজি'র থেমে যাওয়ার অখণ্ড নীরবতায় মিশে থাকা মৃত্যুর গান।

কেন ওরা জীবন দিয়েছিল? তুমি আমি হলে কী বাড়ির নিরাপদ আঙ্গিনা ছেড়ে বেরিয়ে পড়তাম নিশ্চিত মৃত্যুর পথে? ওরা কেন পেরেছিল? এই প্রশ্ন নিজেকে অনেকবার করেছি। কোন জবাব পাইনি। নানা থিওরি দাঁড় করিয়েছি, কিন্তু নিজের কাছেই গোলমেলে লেগেছে সেগুলো। আজকের বাংলাদেশে অর্থ-ক্ষমতা-প্রতিপত্তির লোভে একে অপরের ক্ষতি করতেও লোকে পিছপা হয় না। একাত্তরের যোদ্ধাদের কোন লোভ দিয়ে মৃত্যুর সামনে পাঠানো হয়েছিল? আছে কোন উত্তর?

তাদের সন্তান হিসেবে আমরা এতো নিচে কীভাবে নামলাম?

নিজের ভেতর নীরবতা ভর করে। তুমিও নিশ্চুপ। আমাদের নীরবতায় লজ্জা আছে, আছে অপারগতা। আমরা পারিনি মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করতে, যে বৈষম্যে ভরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম একাত্তরে, আজকের বাংলাদেশে সেই বৈষম্য অনেক গুণে বেড়েছে। পাহাড়ে সমতলে আদিবাসি কিংবা সংখ্যালঘু নামকরণ করে দেশের সমান অধিকারসম্পন্ন নাগরিকদের লুটে নেয়া হচ্ছে, বারবার আঘাত করা হচ্ছে, রাষ্ট্র এসবের মদদ দিচ্ছে সক্রিয়ভাবে। সাঁওতালদের ঘরে আগুন লাগানো, মামলা-হাজত দিয়ে হয়রানি করা- এসব দেখে কী বিশ্বাস করবার যুক্তি আছে এটা সেই বাংলাদেশ, যা একদিন সাম্যের গান গেয়ে লড়েছিল দুর্বৃত্ত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে? ধর্মের ভিত্তিতে জন্মানো ও ধ্বংস হওয়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয়ী যে বাংলাদেশ, সেই দেশে ধর্মের নামে যখন যাকে খুশী মুরতাদ আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে মারার বৈধতা দেয়া হয়, এটা কী একাত্তরের যোদ্ধারা কল্পনায়ও ভাবতে পেরেছিলেন? দেশ টাকা পয়সার হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু অস্বাভাবিক বিষয়টি হচ্ছে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাঙালী জাতির অবনমন হয়েছে এবং হচ্ছে- এটা ঠেকাবার দৃশ্যমান কোন আয়োজন নেই। কে করবে সেই আয়োজন? আওয়ামী লীগ? তোমার তাই মনে হয়? হাসি পায়। মুজিব ভালো করেই জানতেন, এই আওয়ামী লীগের প্রয়োজন একাত্তরেই শেষ, স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নয়, প্রয়োজন জনমুখী সার্বজনীন রাষ্ট্রব্যবস্থা। তিনি চেয়েছিলেন সেরকম একটা কাঠামো দাঁড় করাতে, কিন্তু পারেননি। কেন কীভাবে কী হল- সেই গল্প তুমি জানো, নতুন করে বলবার কিছু নেই। আমি সারারাত ধরে তোমায় লিখতে পারব, তুমি ক্লান্ত চোখে হয়তো পড়েও ফেলবে। কিন্তু তাতে কীইবা লাভ বলো?

বিজয় দিবসের শেষভাগে আমার অসমাপ্ত গল্পটা শেষ করার চেষ্টা করছি। কমল অনড় হয়ে আনিসের লাশের সামনে বসে আছে। এই সময়টাতে কিছু একটা হবে, মনের গহীনে আমরা সবাই আসলে যুক্ত, বিভেদ কেবল বাইরে। মায়ের সঙ্গে সন্তানের, বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর, প্রাণের সঙ্গে প্রাণের- যোগাযোগ থাকবেই। কমলের ভেতরে কে যেন বলে উঠল অস্ত্রটা তুলে নিতে। আনিস বলব? নাকি কমলের ভেতরের মানুষটা? নাকি দুটো আসলে একই? আমি জানি না। আমি শুধু দেখতে পাই কমল এলএমজি'টা তুলে কাঁধে নিল, গুলি করতে লাগল সামনে। কমল কিছু দেখতে পাচ্ছে না, জীবন মৃত্যু কিচ্ছু না। শুধু সে জানে, তাকে গুলি করতে হবে, এগিয়ে যেতে হবে। এলএমজি থেকে অনর্গল গুলি বের হচ্ছে, ফায়ারিং করার উত্তাপে তপ্ত পাইপের স্পর্শে ঝলসে যাচ্ছে কমলের কাঁধ, সেদিকে ওর কিছুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। কমল এগিয়ে যেতে থাকে সামনে, আনিসের যুদ্ধটা তাকে শেষ করতে হবে- এটাই কমলের একমাত্র সত্য।

তোমার আমার সামনে সেই বিস্তীর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রটা পড়ে আছে। যে অসাম্যের স্বনির্ভর সোনার বাংলা গড়ার যুদ্ধ একাত্তরে শুরু হয়েছিল, সেটা আজও শেষ হয়নি। তুমি কিংবা আমি আজ কমলের জায়গায়, আমাদের সামনে হাজারো আনিসের রক্তমাখা বাংলাদেশ। আমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে সেই বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে। সুবিধা নিতে নিতে নয়, যুদ্ধক্ষেত্রে একজন যোদ্ধা নিজের সর্বস্ব দিতে যায়। সেই সর্বস্ব উজাড় করে দেয়ার মানসিকতা থেকে বোকার মতো বাংলার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। পারব না আমরা? তুমিই বলো?

তোমার কানে ফিসফিসিয়ে বলে যাই, পারতে আমাদের হবেই।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.