নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইকবাল সুমন

"ঘোড়ার ডিমের খোঁজে নয়, ডিমওয়ালা-ঘোড়ার খোঁজে...

ইকবাল হোসাইন সুমন

আমি ইকবাল সুমন। মাঝে মাঝে টুকটাক লিখা লিখি করি। এছাড়া কোন কিছু করি না।

ইকবাল হোসাইন সুমন › বিস্তারিত পোস্টঃ

এক মিনিটের গল্প

২৪ শে জুলাই, ২০১৪ সকাল ৮:০৬

বাবা এবং ভালবাসা



জামান সাহেবের মেজাজটা আজ ফুরফুরে। কপালের ধারণকৃত ঘামবিন্দুগুলো অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি না করে বিকেলের খোলা হওয়ায় কেমন যেন স্বস্তিই দিয়ে যাচ্ছে। ৬৬ বছর বয়স থেকে আজ অবধি সাড়ে ৭ বছর উনি বৃদ্ধাশ্রমে আছেন। তিনি সব সময় হাসিখুশি থাকতে ভালবাসেন। ৫৯ জন বৃদ্ধ পুরুষদের মধ্যে সবার বয়স কাছাকাছি হলেও জামান সাহেবের হাসিখুশি চরিত্রের কাছে সবাইকে ম্লানই থাকতে হয়। স্বভাবসুলভ চরিত্রের কারণে বুঝা যায় তিনি কেমন যেন একটা নেতৃত্ব দিচ্ছেন সবাইকে। বৃদ্ধাশ্রমের প্রত্যেকটা মানুষের প্রতিটি হাসিকান্নার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে আছেন তিনি।বৃদ্ধাশ্রমে সাধারণত যারা হাসিখুশি থাকেন তাদের ইতিহাস বলে যে, তারা অনেক বেশী কষ্ট সহ্য করে এখানে এসেছেন। কিন্তু জামান সাহেবের ব্যাপারটা আজ অবধি রহস্যই রয়ে গেল। কেউই জানে না কেন তিনি এখানে এসেছেন, কোথায় থেকে এসেছেন। কিইবা তার ইতিহাস।

বিকেলের সূর্যটা হেলে পড়েছে। জামান সাহেব একটা ইজি চেয়ারে বসে আছেন। ইজি চেয়ারটা জামান সাহেবের বাবাও ব্যবহার করতেন। যে বছর জামান সাহেব বৃদ্ধাশ্রমটিতে এসেছেন সেই বছরই তিনি ইজি চেয়ারটি বাড়ি থেকে আনিয়ে রেখেছেন। হয়ত চেয়ারটিতে বসলে তাকে অতীত নিয়ে ভাবতে হয় না, অতীতেই উনার কাছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসে।

আজ বৃদ্ধাশ্রমের সবাই খুব পুলকিত। তাদের পাশাপাশি জামান সাহেবকেও পুলকিত মনে হচ্ছে। কারণ সামিয়া ম্যাডাম আসতেছে। সামিয়া আহমেদই এই বৃদ্ধাশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। যাবতীয় ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। বৃদ্ধাশ্রমে যারা থাকেন অনেকের ছেলেমেয়েরা তাদের বাবাদের জন্য টাকা পয়সা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সামিয়া আহমেদের কঠোর নিষেধের কারণে সেটি সম্বব হয়নি। সুতরাং বৃদ্ধদের পুরো খরচ সামিয়া আহমেদের ফান্ড থেকে করা হয়। এখানে যারা এসেছেন তাদের মধ্যে কেউ ২ বছর, কেউ ৩ বছর, আবার কেউ এসেছেন ৬-৭ বছরও হয়ে গেছে। কিন্তু এই সামিয়া আহমেদ নামে এই অতি মহীয়সী নারীটির কথা সবাই শুনেই আসছিলেন, দেখার সৌভাগ্য কারো হয়নি। আজ তিনি আসবেন। তার সাথে আর একটা খুশির খবর হল, আজ অতি রহস্য মানব জামান সাহেব তার বৃদ্ধাশ্রমে আসার ইতিহাসটা সবাইকে বলবেন। এখানে এটাই নিয়ম। একেকটা অনুষ্ঠানে একেকজন তাদের ঘটনাবহুল জীবন সম্পর্কে বর্ণনা করেন এবং সবাই মিলে এক সাথে কাঁদেন।

বৃদ্ধাশ্রমের সবাই মিলে আজ ছোট্ট ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। সব জায়গা থেকে মৃদুমন্দ কোলাহল ভেসে আসছে। সবাই তার সবচেয়ে নতুন পোশাকটা পরিধান করেছে। ছিমছাম পরিবেশ। কিন্তু আয়োজনের কোন অংশে কমতি নেই। সন্ধ্যা ৭ টা বাজতে তখনো কিছুক্ষণ বাকি। ছোট্ট একটা স্টেইজের সামনে ৫০ জনের মত মানুষ বসে আছে। প্রত্যেকটা মানুষ যেন তাদের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির জন্য অপেক্ষা করছে। সামিয়া আহমেদ পথেই আছেন, সে খবর সবাই এর আগেই পেয়ে গেছেন।

স্টেইজের ঠিক সামনের দিকটায় একটা বেবি ট্যাক্সি এসে থামল। প্রায় মধ্যবয়স্ক একজন মহিলা এসে নামলো। হাতে ছোট্ট একটা ব্যাগ। পরনে সুতির একটা কাপড়। বয়স ৪০ কি ৪২ হতে পারে। মুখে সদ্যপ্রাপ্ত বয়স্কের ছাপ হলেও স্নিগ্ধ একটা হাসি লেগেই আছে। স্টেইজের সামনের সারীর প্রথমজনকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার পরে সামিয়া আহমেদ বলল, “ আপনি জমির চাচা, না?

জমির রায়হান বলল, “তুমি মা...”

জমির রায়হান ভাবতেই পারেনি যে এই অতি সাদামাটা মানুষটিই তাদের কাঙ্ক্ষিত সামিয়া আহমেদ। জমির রায়হান বৃদ্ধাশ্রমে এসেছেন তিন বছর আগে নিদারুণ এক ট্রাজেডি নিয়ে।

“আমি আপনাদের ‘সামিয়া’”, নির্লিপ্তভাবে একটু হেসে বলল সামিয়া আহমেদ। “আমি আপনাদের সাবাইকে চিনি”।

এভাবে পরপর তিনজনকে পায়ে ধরে সালাম করার পর সামিয়া যখন জামান সাহেবের পা ধরে সালাম করতে চাইল তখন জামান সাহেব তার হাত ধরে পেলল এবং তাকে নিয়ে স্টেইজে থাকা একমাত্র চেয়ারে জোর করে বসিয়ে দিল।

জামান আহমেদ আর তার চেয়ারে ফিরে না এসে বলতে শুরু করল, “আমার ছেলের বয়স তখন ৭ কি ৮। একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “আব্বু, বৃদ্ধাশ্রম মানে কি?”

আমি বললাম, “আমি বৃদ্ধ হয়ে গেলে যেখানে থাকব সেটাকে বৃদ্ধাশ্রম বলে”।

আমার ছেলে বলল, “ঠিক আছে, তাহলে আমিই তোমাকে সেখানে রেখে আসব”।

এই নিয়ে তাকে প্রায় হাসি ঠাট্টা করতাম সে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার আগে পর্যন্ত। অনেক লজ্জা পেত আমার সব সময়ের লাজুক ছেলেটা এবং বলত, “আব্বু এই নিয়ে আমাকে আর লজ্জা দিও না”। একদিন আমার ছেলে বলল যে, সে তার এক সহপাঠিনীকে পচন্দ করে। ধূমধাম করে বিয়ে দিয়ে দিলাম তার। কারণ আমি জানতাম আমার ছেলে কোন ভুল করতে পারে না। আমি আমার যোগ্যতার পুরাটা ব্যবহার করেছি অর্থ উপার্জনে। সেই সুবাধে সম্পদের একটা পাহাড় গড়েছিলাম। আর তার সাথে তো ছিলই আমার অগাত পরিমাণ পৈত্তিক সম্পত্তি।

আমার ছেলের পচন্দের ব্যাপারে আমার ধারনাটি সম্ভবত কিছুটা ভুল ছিল। আমি প্রায় লক্ষ্য করতাম, বিয়ের পর থেকেই আমার নিষ্পাপ ছেলেটার চেহারার মধ্যে কিসের যেন একটা কালো ছায়া নেমে এসেছে। তাদের দুজনের মধ্যে দুই একটা ছোটখাটো ঝগড়াঝাঁটির আওয়াজ শুনতাম। অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কিন্তু স্বভাবসুলভ একটুখানি লাজুক হেসে বলত, “না, আব্বু কিছু হয়নি”। কিন্তু আমি তো বুঝে নিতাম কিছু একটা হয়েছে। এর মধ্যে আমি আমার ছেলেকে আমার সব ধরনের ব্যবসা-পাতি বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। একদিন ঠিক বাসায় ঢুকার আগে আমার কানে এলো,

- আমাদের মধ্যে তোমার বাবা থাকার প্রয়োজন কি। উনি উত্তরার বাসায় চলে গেলে তো হয়। তাছাড়া তো উনি প্রায় তোমার ফুফির বাসায় প্রায় যায়। ওখান থেকে গেলেই তো উনার জন্য সুবিধে।

- তুমি এসব কি বলছ !!! (আমার ছেলের আওয়াজ)

আরও অনেক কথার মধ্যে আমি সেদিন ‘বিদ্ধাশ্রম’ কথাটিও শুনেছিলাম। দুনিয়াটাকে সেদিন অনেক ছোট মনে হয়েছিল। একদিন অনেক রাতে হটাত ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম আমার ছেলে আমার ঠিক পায়ের পাশে গুমিয়ে আছে। মৃদু আলোতে দেখলাম, তার চোখের নীচটায় অশ্রুটা এখনো শুকায়নি। হয়তো জল শুকানোর আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি আস্তে আস্তে উপরের তলায় গেলাম এবং দেখলাম ছেলের রুম ভিতর থেকে লক করা। ছেলের বউ ঘুমাচ্ছে। মনে মনে বললাম, এত জেদ ভাল নয়রে, মা।

অবশেষে যাই চিন্তা করেছিলাম তাই হয়েছিল। কিছুদিন পরে ছেলের নিথর দেহের পাশে সুইসাইট নোট হিসেবে পেয়েছিলাম দুইটা শব্দ, “বাবা এবং ভালবাসা”

ছেলেকে আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করার কিছুদিন পর আমি আমার পৈত্তিক ভিটায় চলে আসি। চলে আসার আগে আমার অর্জিত সকল সম্পত্তি আমার ছেলের বউয়ের নামে উইল করে দিয়ে এসেছিলাম এবং আমার ছেলের বউয়ের জন্য ছোট্ট একটা নোট রেখে এসেছিলাম। তাতে লিখা ছিল, “দেখি কত সম্পদ আর কয়টা বাবার বিনিময়ে তুমি তোমার সবচে প্রিয় মানুষটাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পার। তাও তোমার জন্য অনেক শুভকামনা”

এর ঠিক বছর তিনেক পরে একদিন শেষরাতের দিকে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল, দেখলাম আমার পায়ের কাছে কে যেন বসে বসে কাঁদছে। আলো জ্বালানোর অনেকক্ষণ পরেও চিনতে পারিনি। যখন চিনতে পারলাম দেখলাম, পৃথিবীর সবচে অসহায় দৃষ্টিটা আমার দিকে চেয়ে আছে। বয়সের চেয়েও অনেক বেশী বুড়ো মনে হচ্ছিল তাকে। সারাদিন আমার পৈত্তিক ভিটার এটা ওটা দেখালাম আমার ছেলের বউকে। ছেলের বউয়ের সাথে ওর বাবা এসেছিল। তার কাছে থেকে শুনলাম, আমার ছেলে চলে যাওয়ার পর প্রায় ৪ মাস মানসিকভাবে অসুস্ত হয়ে হাপাতালে ছিল সে। একটু সুস্ত হয়ে আমাকে খোঁজ করে। পরে যখন আমার উইল করা সব সম্পত্তির কথা জানতে পারে। আমার সমস্ত ব্যবসা-পাতির রক্ষণাবেক্ষণ শুরু করে। আমার কেয়ারটেকারের মাধ্যমে আমার সব ধরনের খোঁজ খবর রাখতো। এগুলো অবশ্য আমি পরে শুনেছিলাম। সেদিন আমার ছেলে্র বউ আমাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছিল। আমিও না বলতে পারিনি। কারণ সেদিন আমি আমার ছেলের হুবহু ছায়াটা আমার ছেলের বউয়ের মাঝে দেখেছিলাম। আমার ধারণা আর ভুল হতে পারে না।

আজ ৭ টা বছর যেন আমি আমার বাড়িতেই আছি। আমার ছেলের বউ এই বৃদ্ধাশ্রম সহ মোট ৮ টি বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং এই বৃদ্ধাশ্রমগুলো রক্ষাবেক্ষনের দায়িত্ব নিজেই নিয়েছিল। এখন এগুলো আমিই দেখি। ‘এতোগুলো বৃদ্ধের দায়িত্বটা সামিয়া আর এক বৃদ্ধকে বুঝিয়ে দিল’ বলে জামান আহমেদ নিজেই একটু হেসে উঠল। কিন্তু একটা মানুষও অশ্রু সংবরণ করতে পারল না। এখন দৃষ্টিটা সবার সামিয়ার দিকে। নির্লিপ্ত হয়ে মুখটা কিছুটা নিচু করে বসে ছিল সামিয়া। কিন্তু সামান্য আলোতেও তার চোখের অশ্রুটা চিকচিক করে জ্বলে উঠছিল বারবার এবং যেন চিৎকার করে বলে উঠছে, ‘পৃথিবীর সকল বাবা আমাকে ক্ষমা করো’

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে জুলাই, ২০১৪ সকাল ৯:৫৩

সুমন কর বলেছেন: দেখি কত সম্পদ আর কয়টা বাবার বিনিময়ে তুমি তোমার সবচে প্রিয় মানুষটাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পার। তাও তোমার জন্য অনেক শুভকামনা”


পুরো গল্পটা হৃদয় ছুঁয়ে গেল। অসাধারণ হয়েছে।

২৪ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১:৩৩

ইকবাল হোসাইন সুমন বলেছেন: চেষ্টা করেছি বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে একটা পজিটিভ গল্প উপস্থাপনে। জানি না সার্থকতা কতটুকু।

২| ২৪ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১২:০০

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: সত্যিই হৃদয় ছোঁয়া গল্প।

ধন্যবাদ, ইকবাল হোসাইন।

২৪ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১:৩৫

ইকবাল হোসাইন সুমন বলেছেন: আপনাকে অভিনন্দন।

৩| ২৪ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:৫৪

কলমের কালি শেষ বলেছেন: এসকল হতাশার গল্পগুলো সাধারনত শেষ হয় করুণ স্মৃতি দিয়ে কিন্তু এই গল্পটার শেষটা অনেক ভালো লেগেছে ।

২৪ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৪:২৬

ইকবাল হোসাইন সুমন বলেছেন: কিন্তু কোথায় যেন একটা হাহাকার রয়ে গেছে দেখুন। অন্তত পাঠক হিসেবে আমার তাই মনে হয়েছে। :(

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.