নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইকবাল সুমন

"ঘোড়ার ডিমের খোঁজে নয়, ডিমওয়ালা-ঘোড়ার খোঁজে...

ইকবাল হোসাইন সুমন

আমি ইকবাল সুমন। মাঝে মাঝে টুকটাক লিখা লিখি করি। এছাড়া কোন কিছু করি না।

ইকবাল হোসাইন সুমন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গিনিপিগদের সুখ দুঃখ ( ‪পর্ব-১‬ )

১৭ ই মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৬







এত সকালে ফোন আসার আর টাইম পেল না।



-হেলো

-মামা, আমি রহিম।

-কি রহিম, তোর কি খবর?

-মামা, আপনি ফোন দিতে কইছিলেন।

-ওকে, আমি ১০ মিনিটের মধ্যে বের হচ্ছি।

এটা বলে আমি আবার ১০ সেকেন্ডের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম। খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। এই স্বপ্নটা আমি প্রায় দেখি। দেখছিলাম... আমাদের গ্রামের বাড়ির পাশে সুন্দর একটা রেল ব্রিজ আছে, ওটা থেকে আমি পড়ে যাচ্ছি...



ভয়াবহ একটা শব্দ পেয়ে ঘুম ভাঙল। দেখলাম মোবাইল আওয়াজ করছে। অ্যালার্মের আওয়াজ। অ্যালার্মটা একটু ভিন্ন ধরনের মনে হল। অ্যালার্ম বন্ধ করে খেয়াল হল, রহিম তো আমাকে ফোন দিয়েছিল। তাড়াতাড়ি বাথ রুমে গেলাম। বাথ রুমে গিয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আজকেও কে যেন আমার ব্রাশ দিয়ে ব্রাশ করে ফেলেছে। ব্রাশটি ভিজা। সেলিম ভাই ছাড়া এ কাজ কেউ করার কথা না। ছুটির দিনে প্রায় এই লোক আমার একটা স্যান্ডেল নিয়ে চলে যায়। নিজের একটা, আমার একটা। আমিও আর কি করব, বাধ্য হয়ে আমিও উনার একটা স্যান্ডেল নিয়ে বের হতে হয়। আমার একটা, উনার একটা। কিন্তু মানুষ হিসেবে অসাধারণ একটা মানুষ সেলিম ভাই। যাই হোক, যেহেতু ব্রাশ করার ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে গেলাম, সেহেতু আমার ৫ মিনিট বেঁচে গেল। অতঃপর রহিমের সাথে দেখা করার উদ্দেশে রওয়ানা করলাম।



প্রায় ১ বছর আগে রহিমের সাথে পরিচয়টা হয়েছিল। বয়স ১০ বছরের উপরে হবে না। এর আগে টোকাই ছিল, আর সুযোগ পেলে ভিক্ষা করত। এখন ফুটপাতের একটা চায়ের টঙে কাজ করে। দিনে ১৮০ টাকা, খাওয়া ফ্রি। সপ্তাহে ৪ দিন কাজ করে। ৩ দিন ঘুরে ফিরে আর একটা স্কুলে পড়ে। এখন সে লিখতে এবং পড়তে পারে। স্বাধীনচেতা জীবন। ও হল পৃথিবীর কম বয়সী স্বাবলম্বীদের একজন। পাড়ার বড় ভাইকে বলে ওর কাজটা আমি ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। কারণ ঐ বড় ভাই ফুটপাতের ঐ দোকানটা রাজনৈতিক উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। সুতরাং উনি সেটা ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। দোকানদার প্রথমে রহিমকে চাকুরীটা দিতে রাজী হয়নি। কারণ সপ্তাহে ৪ দিনের কোন চাকুরী হয় না, তাছাড়া ১৮০ টাকাটা রহিমের মত ছোকরার জন্য অনেক বেশীই হয়ে যায়। কিন্তু, জোর যার মুল্লুক তার, তাইই হল। দোকানদার রহিমকে চাকুরীটা দিতে বাধ্য হল। কারণ বড় ভাইয়ের দোকানেই রহিম কাজ করে।



মোটামুটি ১৫ মিনিটের মধ্যে বাসা থেকে বের হয়ে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিলাম। রহিম রবীন্দ্র সরোবরের আশেপাশে আছে। আমার বাসা থেকে রবীন্দ্র সরোবর ২৫ টাকা রিক্সা ভাড়া। পকেটের অবস্থা তেমন ভাল না। চিন্তা করলাম রিক্সা ভাড়া ১৫ টাকা হওয়া পর্যন্ত হাঁটব। তারপর রিক্সায় উঠবো। তাছাড়া ফুটপাত দিয়ে হাটতে ভালই লাগছিল। পথে দেখলাম কিছু মানুষ জটলা হয়ে আছে। গেলাম ঐদিকে কি হয়েছে দেখতে। দেখি, সিটি কর্পোরেশনের লোকজন রাস্তার পাশে নালা থেকে ময়লা তুলতেছে। আর শখানেক মানুষ তা হা করে দেখছে। আমিও কিছুক্ষণ হা করে দেখলাম। তারপর হাঁটা শুরু করলাম।

রবীন্দ্র সরোবর পৌঁছেতে পৌঁছেতে সকাল ১০ টা। পৌঁছে দেখি, রহিম এবং নীলা আগেই পৌঁছে গেছে। আমি জানতাম না নীলা আসবে। তবে সম্প্রতি তার কোন কাজে আর বিস্মিত হই না। যাই হোক, বলতে ভুলে গেছি। নীলা আমার একমাত্র প্রেমিকা। এর আগে আমার ২/৪ জনের সাথে একটু আধটু হাব ভাব ছিল। কিন্তু “যথারীতি প্রেমিকা হইয়া উঠার আগেই তাহারা আমাকে ত্যাগ করিয়া হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিয়া গেছে, তাহাতে আমি নিতান্তই নারাজ হননি। বরং খুশিই হইয়াছিলাম ”।

নীলা হল আমার কাছে রীতিমত একটা বিস্ময়। কারণ তাকে আমার সাথে টিকে থাকার কোন কারণ আমি আজো খুঁজে পাইনি। কারণ হল, পৃথিবী যে দিকে চলে আমি তার উল্টো পথে চলেছি সব সময়। কিন্তু প্রকৃতির দয়ায় কোন রকম অঘটন ছাড়াই আজো টিকে আছি। শুনেছি, মেয়েদের নাকি যে পাত্রে রাখা হয়, সে পাত্রের আকার ধারণ করে। কিন্তু নীলার ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো। তাকে যে আকৃতিরই বস্তু দেয়া হোক না কেন, সে, সে আকৃতিরই একটা পাত্রে রূপ নেবে।



-মামা, আমি আপনারে কইছিলাম না। আমি আপনাকে একদিন খাওয়াবো। আজ আমি আপনারে আর মামীরে খাওয়াবো। (রহিম আমাকে বলে উঠল।)

-তো খাওয়াবি ঠিক আছে। কিন্তু ঘটনা কি?

-মামা, আপনি এর মধ্যে ভুলে গেলেন। (এই বলে রহিম মন খারাপ করার ভাব করল)।

-কি হইছে বল না। (সত্যি আমি কিছুই মনে করতে পারছিলাম না।)

-মামা, আজ আমার জন্মদিন।

সাথে সাথে আমার মনে পড়ল। সকাল বেলাই তো বার্থডে অ্যালার্মটা বেজে উঠেছিল। আমি লক্ষ্য করিনি, আসলে এটা রহিমের বার্থডে এটেনশান অ্যালার্ম ছিল।

গত কয়েক মাস আগে গুলশান লেকের গিয়েছিলাম রহিমকে নিয়ে। ওখানে আমরা ছোট্ট একটা রেস্টুরেন্টে খাচ্ছিলাম। পাশে কিছু কলেজ ছেলে-মেয়ে তাদের এক ফ্রেন্ডের জন্মদিন পালন করছিল চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে।

রহিম আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “ওরা কি করতেছে, মামা?”। আমি বলেছিলাম। এদের মধ্যে একজনের আজ জন্ম দিন। আমি রহিম কে জিজ্ঞাসা করলাম, “তোর জন্মদিন কখন?” । সে বলল, “সেটা তো জানি না মামা”। আমি বললাম, “কে জানে?”। “মা-বাবা জানে। কিন্তু তারা তো মইরা গেছে। আমার কিছু মনে নাই”। আমি একটু মিষ্টি হেসে বললাম, “তোর জন্ম দিন কখন আমি তো জানি”। রহিম খুব ইন্টারেস্টেড হয়ে জানতে চাইল, “কখন মামা?” আমি বললাম, “ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ”।



৪ বছর আগে ২৮ শে ডিসেম্বর নীলার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। সুতরাং মনে রাখার সুবিধার্থে সে একই দিন রহিমেরও জন্মদিন ঘোষণা করেছিলাম। নীলা এই নিয়ে প্রত্যেকবারই মন খারাপ করে কিন্তু কখনো কিছু বলেনা। মন খারাপের কারণটা আমি বুঝি। কারণ ২৮ শে ডিসেম্বরের কথা আমি বরাবরেই ভুলে যাই। প্রায় প্রত্যেকটা মেয়ের ক্ষেত্রেই এই একটা ব্যাপার দেখা যায়, তারা প্রথম দেখা হওয়ার দিনটি বেশী মনে রাখে। প্রথম পরিচয়ের (ফোনে বা অন্য কোন ভাবে) দিনটা কখনই মনে রাখে না। তার একটা ব্যাখ্যা আছে।



নীলাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমাকে রহিম কখন ফোন করল?”

নীলা বলল, “কাল রাতে। তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চাইল। আমাকে বলল তোমাকে যেন না বলি। তাই রাতে তোমাকে কিছু বলিনি”।

তাই, তলে তলে এতটুকু। আমি মুস্কি হাসলাম , নীলাও হাসল।



নীলা অসাধারণ একটা মানুষ। অবশ্য আমি সরাসরি কখনো স্বীকার করিনি। মনের অজান্তেই প্রেম-ভালবাসার নানা পরীক্ষা চালানো হয়ে গেছে তার উপর। সব পরীক্ষায় ১ম শ্রেণীতে পাস করেছে। আমার উপরও হয়তো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। আমিও হয়তো ফেল করিনি। তাই হয়তো আজ ৪ বছর টিকে আছি। নীলার কাছে আমি আমার বাস্তবতাটাকে সব সময় প্রকাশ্য রেখেছি, আবেগটা রেখেছি অনেকটা অপ্রকাশিত। আবেগটা অনেকটা কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করার চেষ্টা করি, কথা মাধ্যমে বা চেহারায় প্রকাশ করে কখনো আবেগটা সেভাবে প্রকাশ করা হয় না।



বেশীর ভাগ মেয়েই এত বাস্তববাদী ছেলেদের পছন্দ করে না। নীলাও প্রথম প্রথম ঠিক এমনিই ছিল। আমার উপর ব্যাপক বিরক্ত ছিল। ও আমার সাথে টিকে যাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। পরে অবশ্য নিজেই সব কন্ট্রোল করে নিয়েছিল। আমাকে ভালই বুঝতে শিখে গেল। আরও শিখে গেল, “প্রেমের ক্ষেত্রে বাস্তবতা-টা প্রথমেই আসে, আবেগ-টা গৌণ আর ভালবাসার ক্ষেত্রে আবেগটাই প্রথমে আসে, বাস্তবতা-টা গৌণ”।



অতঃপর আমাদের প্রেমটাই টিকে গেল। আর ‘প্রেমে’র একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হল ‘ভালবাসা’। সুতরাং একই প্যাকেজে এই ২ টা ব্যাপারই আমাদের মধ্যে আছে। ভালই আছি আমরা। কিন্তু জানি না, ভবিষ্যতে কোন পরিবর্তন বা পরিবর্ধন আসে কিনা। সে পরিবর্তন না পরিবর্ধন কখনোই চাইও না।



-মামা, এদিকে আসেন। (রহিম আমাকে ডাক দিল)

-কি হইছে রহিম?

-বলেন তো , এই ২ টা ছেলে কি খায়?

(একটু দূরে ২ টা ছেলে সিগারেট খাচ্ছিল)

-কেন, সিগারেট খায়।

“না মামা, আপনি পারেন নাই” বলে রহিম একটা বিজয়ের হাসি দিল। “এরা ২ জনেই গাঁজা খায়। আমি গন্ধটা চিনতে পারছি”, রহিম বলল।

-হ্যাঁ, আমিও তো জানি, তোর মিল্লাত মামা আমাকে বলেছে। তুইও নাকি আগে গাঁজা খাইতি? (রহিমকে আমি বললাম)

-না মামা, তেমন না। ব্যাপারীর দোকানের পাশে ভাই-ব্রেদাররা মাঝে মাঝে ২/১ টা তান দিতে দিত।

-কেমন লাগত? (আমি খুব মজা পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম)

-প্রথমে মাথাটা একটা ঘুরানটি দিত। পরে খুব মজা লাগত।

-এখন খাস না?

-না মামা, আল্লার কিরিয়া। এখন খাই না। (আমি খুব ভালভাবে জানতাম। ওর এখন আর কোন বদ অভ্যাস নাই)

-খাসনা কেন?

-আগে গাঁজা খেয়ে মজা পেতাম। এখন এমনিতেই মজা পাই। খাব কেন? (এই বলে রহিম নিজেই খুব মজা পেল। হে...হে... করে হেঁসে উঠল। আমি আর নীলাও হেঁসে উঠলাম)



ইদানীং রহিম পোশাক-আশাকে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। আজ সে জিনস এবং শার্ট পড়েছে এবং তার সাথে কেডস পড়েছে। মাথায় তেল দিয়েছে। তেলের পরিমাণটা এবং জুতার সাইজটা একটু বড় হয়ে গেছে। তারপরেও খারাপ লাগছে না। জিনস এবং শার্টটা গত ঈদে নীলা কিনে দিয়েছিল।



রহিমের জন্মদিন উপলক্ষে ধানমন্ডি লেকের একটা রেস্টুরেন্টে আমরা আমাদের খাওয়া দাওয়া শেষ করতে প্রায় দুপুর ১২ টা বেজে গেল। বিল দেয়ার সময় রহিমকে খুব নার্ভাস মনে হচ্ছিল। তার ধারণা ছিল, আমরা হয়তো বিলটা দিয়ে দেব। এর আগে আমি নীলাকে বলে দিয়েছিলাম, বিলটা রহিমই দেবে।



-মামা, বিলটা কিন্তু আমিই দেব। (রহিম খুব ভয় এবং শঙ্কা মিশ্রিত-ভাবে বলল)

-আজ তোর জন্মদিন। সুতরাং তোর বিল আমরা দেব কেন? (এই বলে নীলা আর আমি মুস্কি মুস্কি হাসিতেছিলাম)



রহিম নিজ হাতে ৩৮০ টাকা পরিশোধ করল। আমি আর নীলা শুধু এটাই দেখছিলাম যে, পৃথিবীর সবটুকু সুখ যেন এই ছোট্ট মুখটার মধ্যে ভাসছে, যেন পৃথিবীটা এই মাত্র সে বিজয় করে এসেছে।



আমি হটাত করে রিক্সা ঠিক করে নীলাসহ রিক্সায় উঠলাম। রহিম কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। সে নিচে দাড়িয়ে রইলআ ফেলফেল করে। দেখলাম, অসহায় নীরব একটা চাহনি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। যে চেহারাটা কিছু মিনিট আগেও পৃথিবীর সবচে সুখময় হাসিমাখা ছিল।



আমি নীলার দিকে তাকিয়ে মুস্কি হাসছিলাম।

-যাবি নাকি আমাদের সাথে? (আমি রহিমকে বললাম)

রহিম কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না।

-তাড়াতাড়ি আমার পাশে আয়। (আমি বললাম)

তার অন্ধকার চেহারাটা আবার আলোকিত হয়ে উঠল। দৌড়ে রিক্সায় উঠে আমার পাশেই বসলো।

এর পরে কি হবে সেটা নীলাই জানে। আমি কিছুই জানি না। তবে এ টুকু ধারণা করছি। ১০ টা ছোট ছোট মোমবাতি আর একটা বার্থ-ডে কেক কিনতে হবে......



(চলবে)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.