নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি ইকবাল সুমন। মাঝে মাঝে টুকটাক লিখা লিখি করি। এছাড়া কোন কিছু করি না।
অনেক রাত হয়ে গেল নিশির বাবার সাথে দেখা করে ফিরতে ফিরতে । নীলাকে তার বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে আমি হেটেই বাসায় যাব। নীলাদের বাড়ির সামনেই রিক্সা থেকে নেমে গেলাম।
-এখন কি বাসায় যাবে , নাকি মাহিন ভাইদের ওখানে যাবে।? নীলা জিজ্ঞাসা করল।
-কেন তোমাকে বললাম না, আপাতত তেমন ব্যস্ততা নাই। বাসায় কয়েকদিন যাব না। মাহিনের বাসায়ই থাকব। তাছাড়া বাসায় তো সেলিম ভাই, ভাবি আছে।
-বাসায় কি তোমার থাকার জায়গার অভাব পড়ে গেছে।কারণ তুমি থাকলে সেলিম ভাই, ভাবি আরও খুশি হবে।
আমি বললাম, “সেটা আমি জানি, কিন্তু পৃথিবীতে কিছু ঘটনা কারণ ছাড়াই হওয়া উচিত, অকারণটাই এখানে কারণ। আমি অকারণেই বাসায় যাচ্ছি না। এই বলে আমি মৃদু হাসলাম,
- “ও” এই বলে নীলাও মৃদু হাসল।
আমি যা-ই করি, নীলা আমাকে কখনো কিছু বলে না। কারণ নীলা খুব ভালভাবেই জানে আমি ওর কথা শুনব না। অনেক দিন আগে আমি নীলাকে একটা কথা বলেছিলাম, “আমি এমন কোন কাজ করব না, যা অন্যের কোন ক্ষতি করবে এবং যা অন্যের ক্ষতি করে না, তা নিজেরও ক্ষতি করে না”
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করতে করতে রাত ১১ টা। ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়ব। বাহিরে অনেক চাঁদের আলো দেখে বারান্দায় আসলাম। কিন্তু আজ চাঁদটা পরিপূর্ণ না, অনেকটা পূর্বাকাশে হেলে পড়ে আছে।পূর্ণিমা হতে আরও ২ থেকে ৩ দিন লাগবে। আমার কেন জানি পূর্ণিমার রাতটা ভাল লাগে না। পূর্ণিমার ১/২ দিন আগে বা পরের রাতটা আমার ভাল লাগে।কেননা, এই সময়ে ঠিক মধ্য রাতেও চাঁদের আলোয় নিজের ছায়াটা দেখা যায়।
অনেকক্ষণ ধরে কোথায় যেন কি একটার অভাব অনুধাবন করছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না ব্যাপারটা কি।
হটাত মনে হল, আমাকে এখনিই বের হতে হবে। মাহিন কে জিজ্ঞাসা করলাম না আমার সাথে বের হবে কিনা। কারণ মাহিনের খুব সকালে উঠতে হবে। বাহিরে কিছুটা ঠাণ্ডা পড়ছে। আমি একটা শাল জড়িয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। রহিমরা ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা জানি না। রহিমের বাসায় গিয়ে দরজা নক করতে ওর মামা দরজা খুলে দিল। জিজ্ঞাসা করলাম, রহিম জেগে আছে কিনা। তার মামা বলল, এই কিচ্ছুক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি তার মামাকে বললাম, তাকে গিয়ে বলেন আমি আসছি। ২ মিনিট পরে রহিম ঘুমাতুর চোখে আমার কাছে আসল।
আমি তাকে বললাম, “চাঁদ দেখতে যাবি?”
হটাত করে রহিমের সব ঘুম যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তার অসাধারণ নিরপরাধ হাসিটা দিয়ে বলল, “যাব মামা”
আমি বললাম, তাহলে ২ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নে। আমি বাহিরে আছি। রহিমের মামী খুব বিরক্ত মুখে আমার দিকে তাকাল। আমি পাত্তা দিলাম না উনার তাকানোকে। কারণ পৃথিবীতে একটা অসাধারণ কাজের বিপরীতে শত কোটি বিরক্তমাখা চেহারা আমার জন্য ব্যাপার না। রহিমের মামাকে বললাম, রাতে আমি রহিমকে দিয়ে যাব।
আমি রহিমকে বললাম, ধানমণ্ডি লেকের দিকে যাবি?
রহিম রাজী হল না, বলল, মামা, ওই দিকে তো প্রায় যাই। ওই দিকে যাব না।
আমি বললাম, তুই তো দিনের বেলা যাস, রাতের বেলা তো যাসনি কখনো। খুব সুন্দর লাগবে, চল আজ।
রহিম তাতেও রাজী হল না।
আমি রহিমকে জিজ্ঞাসা করলাম , তাহলে কই যাবি?।
রহিম অনেকটা সংকোচ নিয়ে বলল, “মামা, হাতির ঝিলটা অনেক সুন্দর”।
আমি চিন্তা করলাম, এই মহুরতে হাতির ঝিল যাওয়ার জন্য তো কোন পাবলিক বাস-ই পাওয়া যাবে না। কি করা যায় মনে মনে চিন্তা করছিলাম। পকেটে CNG ভাড়া দেয়ার মত কোন টাকা নাই।
না, আর কোন উপায় নেই। সেলিম ভাইকে ফোন দিতে হবে।
-হ্যালো, ভাই?
ফোন দেয়ার প্রায় সাথে সাথে সেলিম ভাই ফোন রিসিভ করল।
-ভাই কি শুয়ে পড়েছেন?, আমি সেলিম ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম।
-না, এখনো শুই নি। ফেইজবুক নিয়ে গুঁতাগুঁতি করছিলাম। কি খবর তোমার? আমারে ভালবাসার সাগরে ফেলে দিয়ে তো তুমি উধাও। এই বলে সেলিম ভাই হেসে উঠল।
-এইতো ভাই আছি। একটু বের হন ভাই। অনেকদিন ঘুরতে যাইনি।
-কউ কি মিয়া!!! যখন তোমার ভাবি ছিল না তোমারে request করতে করতে তুমি যাও নাই। এখন তোমার ভাবিরে ফেলাইয়া ক্যামনে বের হই। অপেক্ষা কর দেখি, তোমার ভাবির নাক ডাকার শব্দ পাই কিনা। তোমার সাথে অন্য কেউ যাবে?
-যাবে ভাই, আমার সাথে রহিম আছে। ও চাঁদের আলো দেখতে যাবে।
-ঠিক আছে। সেলিম ভাই বলল।
আমি ফোনটা কানে ধরে থাকলাম।
৩০ সেকেন্ড পরে সেলিম ভাই বলল, “হ তোমার ভাবি ঘুমায়। তুমি ১৫ মিনিট অপেক্ষা কর। আমি আসতেছি। যদি এর মধ্যে তোমার ভাবি ঘুম থেকে উঠে আমাকে না পায়, যাবতীয় দায়িত্ব তোমার”।
১৩ মিনিটের মাথায় সেলিম ভাই গাড়ি নিয়ে হাজির হল।
গাড়িতে বসেই সেলিম ভাই ফরহাদ ভাইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করল। আমি সংক্ষেপে সব বললাম।
সেলিম ভাই এবং ফরহাদ ভাই মূলত ভার্সিটি জীবনের ফ্রেন্ড। ফরহাদ ভাইকে দিয়েই সেলিম ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয়। ফরহাদ ভাইয়ের সাথেই আমি আমার ঢাকার মেস জীবন শুরু করি। ফরহাদ ভাই যখন অফিস থেকে বাসা পেয়ে যায়, তিনি আমাকে তার বাসায় উঠতে অনেক অনুরোধ করেছিলেন। আমি রাজী হইনি। ফরহাদ ভাইয়ের জায়গায় সেলিম ভাই মেসে উঠেছিল। এর আগে সেলিম ভাই ভাবিকে সাথে নিয়ে একটা ফ্লাটে থাকতেন। ভাবির নিজস্ব কিছু সমস্যা থাকার কারণে ভাবিকে সেলিম ভাই কুষ্টিয়া রেখে আসতে হয়েছিল। ভাবিকে রেখে আসার ব্যাপারে আমারও কিছুটা ভূমিকা ছিল। এখন আমার কাছে মনে হয় ভাবি তার নিজস্ব সমস্যাটা অনেকটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন।
-ফরহাদকে আমাদের সাথে উঠিয়ে নেয়ই, কি বল? সেলিম ভাই বলল।
-তাহলে তো ভালই হয় ভাই। আমি বললাম।
-ফোন দিয়ে দেখ তো।
আমি ফরহাদ ভাইকে ৩ বার ফোন দিলাম। তিনি রিসিভ করেনি।
-মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি বললাম।
-রহিম, তুমি চাঁদের বুড়িকে দেখেছো? সেলিম ভাই রহিমকে জিজ্ঞাসা করল।
-অনেকবার দেখেছি মামা। রহিম মৃদু হেসে সেলিম ভাইকে বলল।
-বলতো , চাঁদের বুড়ির হাত কয়টা?
রহিম তো ব্যাপক চিন্তায় পড়ে গেল।
সেলিম ভাই আর আমি হেসে উঠলাম।
দেখলাম, ফরহাদ ভাই এর মধ্যে আমাকে ফোন বেক করেছে।
-হ্যালো, ভাই
-না ভাই, টয়লেটে ছিলাম। এ কারণে তোমার ফোন রিসিভ করতে পারি নাই।
ফরহাদ ভাইয়ের সাথে সেলিম ভাইও একটু কথা বলে নিলো। ফরহাদ ভাই অনেকটা অপারগ হয়ে আমাদের সাথে বের হতে রাজী হল।
কিছুদিন আগে রহিম তার মামা- মামির সাথে হাতিলঝিল বেড়াতে গেছিলো। হাতির ঝিলের লেকের মাঝামাঝি কোথাও কিছু একটার সাথে নাকি ৩ তা বেলুন আটকে ছিল। রহিম এটা দেখেছে। রহিমের মতে বেলুনগুলো পৃথিবীর সবচে সুন্দর বেলুন, অন্য সব বেলুন থেকে আলাদা। এই গল্পটা রহিম আমাকে করেছিল।
আমরা হাতিরঝিল পৌছতে পৌছতে ১২ টা বেজে গেল। সেলিম ভাই, ফরহাদ ভাই আমাদের থেকে বেশ দূরে দাড়িয়ে সিগার খাচ্ছিল। আমাকে রহিম লেকের খুব কাছাকাছি নিয়ে এসে সেই আটকে থাকা বেলুনগুলো দেখাচ্ছে। আসলে বেলুনগুলোকে দেখতে খুব অসাধারণ লাগছিলো। লেকের পাশের লাইটগুলো এবং চাঁদের আলোর সমন্বয়ে অনেকটা চিকচিক করছিল বেলুনগুলো। সাধারণ মানের কিছু বেলুন কিন্তু অনেকটা দূর হওয়াতে রহিমের কাছে বেলুনগুলো অন্য ধরণের মনে হচ্ছিল। সত্যি কথা বলতে কি আমার কাছেও মনে হচ্ছে, বেলুনগুলোর একটা প্রাণ আছে। বাতাসে ঝাপটায় চেষ্টা করছে মুক্তি লাভ করতে, আকাশের দিকে ছুড়ে যেতে। কিন্তু কিসের যেন একটা মায়ায় বেলুনগুলো সেখানেই রয়ে যাচ্ছে বারবার। অনেকগুলো মানুষের জীবনের মত। অনেক কষ্ট হলেও তারা আগের জায়গায় থেকে যেতে চায়, নতুন কোন সুখের দিকে যেতে চায় না। অনেকটা গিনিপিগদের মত। অনেক মানুষ দ্বারা তারা পরীক্ষিত নিরীক্ষিত হয় এবং পরবর্তী পরীক্ষিত নিরীক্ষিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। কোথাও যেতে চায় না। শিকড়টাই যেন তাদের সব।
-তুই ওই বেলুনগুলো সাতরে নিয়ে আসতে পারবি? আমি রহিমকে জিজ্ঞাসা করলাম।
-রহিম অনেকটা সাহসের সাথে বলল, “পারব মামা”।
-তাহলে চল তোকে পানির মধ্যে নামিয়ে দেই। যাইয়া বেলুনগুলো নিয়ে আয়।
-পানি তো অনেক ঠাণ্ডা মামা। অনেকটা ভয়ের সাথে রহিম বলল।
-আরে, তুই ভয় পাবি না, আমিও নামব।
-সত্যি মামা?
- হ্যাঁ সত্যি। তুই সাঁতার জানিস?
-জানি না মানে। আমি তো চন্দ্রিমা উদ্যানের ওই লেকটার মধ্যে সারাদিনই সাঁতার কাটতাম। এখনো মাঝে মাঝে যাই।
-বলস কি!!! আমারে একদিন নিয়ে যাস তো। আমিও তোর সাথে পানিতে নামব।
রহিম আমার দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। চাঁদের আলোতে তার চেহারাটা স্পষ্ট দেখতে পাইনি।
চারদিকে ২/১ জন মানুষের আনাগোনা এখনো আছে। ২/১ টা গাড়িও আমাদের পাশে দিয়ে দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে।
হটাত করে সেলিম ভাই আমাকে ডাকল। বলল, গাড়ির ভিতরে কেক, কোক চানাচুর আছে। ওগুলো বাহির করতে। আমি ওগুলো বের করলাম। দেখলাম, কিছু ওয়ান টাইম গ্লাস ও নিয়ে এসেছে সেলিম ভাই। এ বেচারা অনেক মৌলিক ব্যাপার ভুলে গেলেও এ সব ব্যাপার কখনো ভুলেন না।
আমি আর সেলিম ভাই কথা বলছিলাম। ঐদিকে ফরহাদ ভাই আর রহিম কি নিয়ে যেন কথা বলছিল। তারা আমাদের থেকে একটু দূরে চলে গেল। কিন্তু মৃদু কথা এবং হাসির শব্দ আমাদের কানে আসছিল।
আমি সেলিম ভাইকে বললাম, দেখেন তো ভাই ফরহাদ ভাইকে দেখে কি মনে হচ্ছে উনার মন সামান্যটুকু খারাপ আছে?
সেলিম ভাই একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন।
-তোমার কি মনে হচ্ছে ও খুব তাড়াতাড়ি সব কিছু ঠিক করে নিতে পারবে?
-বলতে পারি না ভাই। একটু সময় নিলে হয়তো দেখবেন সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে।
-নিশির মন পরিবর্তন হওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে?
-প্রায় নাই বললেই চলে। কারণ নিশি কোন কিছু না ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটা আমার মনে হয় না।
সেলিম ভাই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার সিগার ধরাল। আমি ভাইকে বললাম, দেখি নিশির সাথে একটু কথা বলে।
-দেখ, এখনিই কারো সাথে কথা বলা শুরু করে দিয়ে। সেলিম ভাই বলল।
আমি নিশিকে ফোন দিলাম। দেখলাম রিং পড়ছে। ২য় বার কল দেয়ার পর নিশি ধরল।
-কিরে আমাকে পরীক্ষা করিতেছিস আমি কারো সাথে কথা বলতেছি কি না , তাই না? নিশি মৃদু হেসে বলল।
-হ্যাঁ তাই।
-তো এখন তো দেখলি যে আমি কথা বলতেছি না। তো এখন কি বলবি।
-দেখ, তুই কার সাথে কথা বলছিস। এই নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। তোর জীবনের ডিসিশনটা তুই তোর মত করে নিবি এটাই স্বাভাবিক।
-আসলে আমার কথা বলাটাকে তুই বা তোরা যেভাবে নিচ্ছিস, ব্যাপারটা সে রকম না, বিশ্বাস কর। তুই তো জানিস ফরহাদের ব্যাপারটা আব্বু আম্মু সবই জানে। ও আমাদের বাসায়ও কয়েকবার গেছে। কয়েকদিন আগে আমি যখন ফরহাদকে বিয়ে না করার সিদ্ধান্তটা আব্বু-আম্মুকে জানালাম। তারা ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। তারা আমার ব্যাপারে ফরহাদকেই মাইন্ড সেট করে ফেলেছিল। আব্বু-আম্মু সরাসরি আমাকে তেমন কিছু বলেননি। কিন্তু তাদের ব্যাপারটা আমি একটু হলেও বুঝতে পেরেছি। আমি কি করব বল। আমার বারবারই মনে হচ্ছে, আমরা কাপল হিসেবে হ্যাপি হব না।
-শুন, যে মানুষটা যত বেশী দায়িত্বশীল, বাহ্যিক অর্থে তাদের ভালবাসার প্রকাশটা তত কম বা খুব সাদাসিধে হয়, কিন্তু এটার অর্থ এই নয় যে, তার মধ্যে ভালবাসা নেই। এই ধরণের মানুষগুলোর সুপ্ত ভালবাসা জেগে তুলার ক্ষমতা সবার থাকে না।
-তুই তো আমার দিকেই ইঙ্গিত করলি, না?
-তো, তোর দিকে ইঙ্গিত করব না, কার দিকে করব। ফরহাদ ভাইয়ের তো অনেকগুলো প্রেমিকা ছিল না, তাই না?
-তুই কি বাহিরে আছিস, মাঝে মাঝে গাড়ির শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
-হ্যাঁ বাহিরে আছি। আমার সাথে ফরহাদ ভাইও আছে। আমি, সেলিম ভাই, ফরহাদ ভাই আর রহিম।
-রহিম মানে ঐ পিচ্চিটা?
-বাহ! তুই তো অনেক কিছুই জানিস।
-জানব না কেন। ফরহাদ তো পিচ্চিটার কথা প্রায় বলত। ও তো রহিমকে “ছোট বুলেট” ডাকে, ঠিক না?
-হ্যাঁ ঠিক।
-তো তোরা কোথায় ঘুরতে আসলি?
-হাতিরঝিলের দিকে।
আমি নিশির নিশ্বাসের একটা শব্দ শুলাম।
-কিছু বলবি?। আমি নিশিকে জিজ্ঞাসা করলাম।
-“ফরহাদ কি করছে রে”?
আমার কেন জানি নিশির এই শব্দটা অনেক মায়াময় মনে হল। আমি ফরহাদ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। দেখলাম দূরে ফরহাদ ভাই আর রহিম আছে। রহিম ফরহাদ ভাইয়ের গাড়ের উপর বসে আছে, আর ফরহাদ ভাই তাকে নিয়ে হাঁটছে। ফরহাদ ভাই এমনিতে রহিমকে অনেক আদর করে। রহিমও ফরহাদ ভাইকে অনেক পছন্দ করে। দূর থেকে রহিম এবং ফরহাদ ভাইকে দেখে আমার মনটা কেন জানি অন্য ধরণের একটা আবেগে ভরে গেল। আমি তাকিয়ে থাকলাম এক দৃষ্টিতে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভুলেই গেলাম আমি নিশির সাথে কথা বলছিলাম।
-তুই দেখবি ফরহাদ ভাই কি করছে?
- হ্যাঁ বলনা।
-তুই ফেইজবুক লগিন কর। আমি তোকে একটা ছবি পাঠাচ্ছি।
এই বলে আমি আমার মোবাইল নিয়ে ফরহাদ ভাই এবং রহিমের কাছে গেলাম, দেখলাম ফরহাদ ভাই এবং রহিম বেশ মজায় মজে আছে। আমি ফরহাদ ভাইকে দেখে কোন মতেই মিলাতে পারছিলাম না যে, ফরহাদ ভাইয়ের জীবনে কি ঘটতে যাচ্ছে। এটাই হয়তো, মানুষ যখন তার জীবনে বড় কিছু হারাতে শুরু করে তখন ছোট ছোট কিছু খড়-কুড় আঁকড়ে ধরে জীবনটাকে টিকিয়ে রাখে। আজ এই মহুরতে হয়তো রহিম আছে, আমরা আছি, কাল অন্য কেউ থাকবে। এভাবেই চলে যায় তার জীবন, যতদিন মূল ব্যাপারটার রিকাবার না হয়।
আমি ফরহাদ ভাই এবং রহিমের কাছে গিয়ে বললাম, রহিম , আমার দিকে তাকা, আমি তোদের একটা ছবি তুলব।
ফরহাদ ভাই এবং রহিম দুজনেই হাসিমুখে আমার দিকে তাকাল। আমি ছবিটি তুলে সরাসরি নিশির ইনবক্সে চালান করে দিলাম এবং তাকে ইনবক্সে লিখলাম। “ছবিটি ভালমতো দেখবি, আর অনুধাবন করার চেষ্টা করবি। আর কোন কিছু যদি অনুধাবন করতে না পারিস। তাহলে আয়নার সামনে দাঁড়াবি। মনে রাখবি, আয়নার ভিতর দিয়ে যে মানুষটাকে দেখিতেছিস। সে আর কোন মানুষ না, একটা অমানুষ”।
আমি নিশির সাথে আর বেশী কথা বাড়ালাম না।
শুধু শেষের দিকে বললাম। কাল ফরহাদ ভাইয়ের জন্য একটা মেয়ে দেখতে যাব। উনার ফ্যামিলি থেকে দেখা হয়ে গেছে । এখন শুধু ফরহাদ ভাইয়ে পছন্দ হলে ২/১ দিনের মধ্যে আক্দ পড়ায়ে ফেলবে। ফরহাদ ভাইয়ের যে পরিস্থিতি, এ ছাড়া আর মনে হয় কোন উপায় নেই।
আমি আমার ফোনটা বন্ধ করে দিলাম। জানি নিশি ফোন দেবে। নিশির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না।
আমি নিশির সাথে কথা বলতে বলতে একটু দূরে সরে গেছিলাম। এসে দেখি, ফরহাদ ভাই শুধু একটা গামছা পড়া। আমি কি হচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না। রহিম আমাকে বলল, ফরহাদ মামা আমাকে বেলুনগুলো এনে দেবে।
আমি ফরহাদ ভাইকে বললাম, ভাই করছেন কি পানি অনেক ঠাণ্ডা। তাছাড়া এত রাতে পানিতে নামা রিস্ক হয়ে যাবে, এছাড়াও ভাল সাঁতার জানার একটা ব্যাপার আছে। লেকের পানি কিন্তু অনেক গভীর।
সাঁতার কথাটা বলাতে সেলিম ভাই এবং ফরহাদ ভাই দু জনেই হেঁসে উঠল।
সেলিম ভাই বলল, ফরহাদ ইন্টার ভার্সিটি সাঁতারে পরপর ৩ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।
আমি বললাম, তাহলে ভাই আমিও নেমে পড়ি আমারও নামার ইচ্ছে আছে। রহিম বলল আমি নামব।
ফরহাদ ভাই বলল, তোমাদের কাউকে নামতে হবে না। তোমরা একটা কাজ কর। তোমরা দেখ গার্ড বা অন্য কেউ আসে কিনা।
৭ মিনিটের মাথায় ফরহাদ ভাই ২ টা বেলুন দিয়ে লেক থেকে উঠল। বলল, ৩য় বেলুন টা একটা রডের সাথে জোরালো-ভাবে আটকে গিয়েছিল। নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।
ফরহাদ ভাই কুলে আসার সাথে সাথে আমি উনাকে বেলুন সহ কয়েকটা ছবি তুললাম।
এরপর আমরা চারজন পুরুষ মানুষ নিয়ে আমাদের ছোট্ট পার্টি শুরু করলাম।
“ছেলেদের নিজের মত করে একটা রাজ্য আছে। এ রাজ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, মারা-মারি, দুঃখকষ্ট কিছুই নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত না অপজিট মহোদয়ারা এসে না পড়ে। এতে অপজিট মহোদয়াদের কোন দোষ নাই। এটা প্রকৃতির একটা নিয়মেই মধ্যেই পড়ে”।
“শুধুমাত্র ছেলেরা ছেলেরা যখন একসাথে থাকে তখন ছেলেদের মূল পৃথিবীটা প্রকাশিত হয়, এই ব্যাপারটা মেয়েরা কখনোই দেখতে পায় না। কারণ যখনি কোন না কোন মেয়ে এসে পড়ে, ছেলেদের আসল পৃথিবীটা আবার পরিবর্তন হয়ে যায়”।
আমরা আমাদের ছোট খাট পার্টি শেষ করে, রহিমকে তার বাসায় রেখে এসে আমার মাহিনের বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় ৩ টা বেজে গেল।
বেলুনসহ ফরহাদ ভাইয়ের একটা ছবি নিশির ইনবক্সে পাঠিয়ে দিলাম এবং সাথে লিখলাম, “মাঝ রাতে রক্ত সম্পর্কহীন অনাথ ছোট্ট রহিমের জন্য গভীর এক লেক থেকে যে মানুষটা অপ্রয়োজনীয় ২ টা বেলুন নিয়ে এনে দিতে পারে, সেই মানুষটা লক্ষ নিশিকেও ভালবাসার আশ্রয় দেয়ার ক্ষমতা রাখে। তুই তো সে ক্ষেত্রে মাত্র একজন নিশি। হায়রে, তোর জন্য আমার করুণা হয়”।
বিকেল ৩ টার দিকে নিশি আমাকে ফোন করল। বলল, ফরহাদ কি সত্যি বিয়ে করে ফেলবে?
-তো বিয়ে করবে না, কি করবে? তোর জন্য তো আর অপেক্ষা করে লাভ নাই। ভাবিস না দাওয়াত পাবি। ফরহাদ ভাই না হোক, কার্ডটা আমি পৌঁছে দেব।
-তুই আমার সাথে একটু দেখা করতে পারবি?
-তোর সাথে দেখা করে আমার কাজ কি? এখন আমার অনেক কাজ। পরে দেখা করব। আমাকে ফরহাদ ভাইয়ের সাথে থাকতে হবে আজ।
-plz আমার সাথে দেখা কর।
-ok. কোথায় আসতে হবে বল।
নিশির চেহারার মধ্যে আগের সে ভাবটা নেই। বুঝা যাচ্ছে গতকাল ঘুমায়-নি।
বললাম, কিছু বলবি, তাড়াতাড়ি বল।
-বিয়েটা আটকানো যায় না? অনেকটা আকুতি নিয়ে বলল নিশি।
-কি বলতে চাস তুই? এখন অনেক কিছু এগিয়ে গেছে। এখন আর সম্ভব না। কিন্তু এ কথা কেন এখন?
-আমি কিচ্ছু জানি না, আমি কিচ্ছু বলতে পারব না। আমার কিছুই ভাল লাগছে না।
-কি হয়েছে আমাকে খুলে বল।
নিশির চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে।
আমি আবার বললাম, আমাকে খুলে বল তোর কি হয়েছে। তুই ভাবিস না, ফরহাদ ভাই তোর সামনে কখনো আসবে না। তোর যাকে ভাল লাগে তার সাথে জড়িয়ে যা। কোন সমস্যা নাই। গতকাল রাতে তোকে আমি যা বলেছি তা যদি মাইন্ড করে থাকিস তাহলে আমি সরি।
-তুই জানিস রাতে আমি কার সাথে কথা বলতাম? আমি সামিরের সাথে কথা বলতাম। সামিরও আমাকে বারবার বুঝিয়েছে ফরহাদকে না ছাড়তে। আমি শুধু একটা দিক চিন্তা করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। মনে হচ্ছে আমি আর পারলাম না রে।
কান্নার জন্য নিশি কথা বলতে পারছিল না। আমিও কি বলব বুঝতে পারছিলাম না।
-এখন তুই কি করতে চাস? আমি বললাম।
-তুই বিয়েটা বন্ধ কর।
-বিয়ে বন্ধ করলে কি হবে। তুই কি ফরহাদ ভাইকে বিয়ে করবি?
-হ্যাঁ আমি করব।
-তুই সব ভেবে বলছিস তো?
-আমার সব ভাবা হয়ে গেছে। আমি আর পারছি না।
চিন্তা করলাম, "ভালবাসার ব্যাপারে প্রকাশ এবং লুকানো, এই ২ টি ব্যাপার খুব কাছাকাছি।"
সামির হল নিশির কাজিন। একসাথে তারা intermediate পর্যন্ত পড়েছে। সামির এখন US থাকে। আমার সাথেও সামিরের সামান্য যোগাযোগ ছিল। গতকালেই আমি নিশির সাথে সামিরের কথা বলার ব্যাপারটা সামিরের মুখ থেকে শুনতে পেয়েছিলাম। নিশির আসলে মৌলিক কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু ফরহাদ ভাইয়ের কিছু ব্যাপারে তার কনফিউশন ছিল। তাই নিয়েই মূলত এই বড় সমস্যাটা। সামিরই আমাকে সব বলেছিল।
এখন নীলা এবং সেলিম ভাইকে ফোন করতে হবে। খুবেই আর্জেন্ট।
কাজি অফিস থেকে বের হতে হতে আমাদের প্রায় রাত ৯টা বেজে গেল। নিশি খুব নার্ভাস ছিল এই ভেবে যে তার কোন অভিভাবক থাকছেন না বিয়েতে। কিন্তু নিশির সে নিরাশাটা বেশিক্ষণ টিকেনি। নিশির বাবা ও কাজি অফিস এসেছিলেন। নিশি হতবাক হয়েছিল তার বাবাকে দেখে। আমি এবং নীলা গতকাল রাতেই নিশির বাবাকে রাজী করিয়েছিলাম। আমি, নীলা, সেলিম ভাই এবং ভাবি মোটামুটি এ ধরণের একটা ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আইডিয়াটা মূলত নীলার মাথা থেকেই এসেছিল। নিশির বাবা ও এ ব্যাপারে রাগ করতে পারেননি বরং খুশি হয়েছেন এই ভেবে যে, যেহেতু আগে থেকেই ফরহাদের ব্যাপারে তাদের প্রিপারেশান ছিল। মাঝে দিয়ে শুধু মাত্র কিছু সমস্যা হল। নিশি এবং ফরহাদ ভাইয়ের জন্য ব্যাপারটা অনেকটা স্বপ্নের মত ছিল। ঐ সময় তারা বুঝতে পারছিলেন না তারা কি করবেন। আমাদের জীবনে সব কিছু বুঝে করার মত অনেক সময়, সময় থাকে না।
রহিমকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে। আমাদের সবার মধ্যে ফরহাদ ভাই আর রহিম পাঞ্জাবী পড়েছে। সকালে নীলা রহিমকে বলেছিল, “কয়েকদিনের মধ্যে তোমার ফরহাদ মামার বিয়ে হতে পারে”। রহিম নীলাকে জানতে চেয়েছিল, “ বিয়েতে কি সবাই পাঞ্জাবী পড়বে?” নীলা বলেছিল, “পড়বে তো”। রহিম উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলেছিল, “তাহলে কি আমিও পড়ব?”
আসার সময় নীলা রহিমকে পাঞ্জাবী পরিয়েই নিয়ে এসেছে। রহিমের চেহারার দিকে তাকালে সবারই মনে হবে আমাদের মধ্যে আজ রহিমই সবচে বেশী খুশি।
সেলিম ভাই রহিমকে বলল, “ও রহিম তোকেও ফরহাদের সাথে একটা বিয়ে করিয়ে দেই”?
রহিম অনেকটা না বুঝেই লজ্জা পেল। সবাই এক সাথে হেসে উঠল।
মানুষের জীবনের সমীকরণটা মিলে যাওয়াটাই সবচে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। সব সমীকরণ যে যথা সময়ে মিলে যাবে এটা কোন কথা না। সমীকরণ আগে বা পরে যে কোন সময়েই মিলতে পারে। হয়তো নিশি এবং ফরহাদ ভাইয়ের জীবনের সমীকরণটা ২/৪ টা দিন আগেই মিলেই গেল, তারে হয়েছেটা কি?...
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১০ টা। রাতে মাহিন থাকবে না। কাল শুক্রবার। প্লান করে ফেললাম নীলাকে নিয়ে শহরের বাহিরে কোথাও ঘুরে আসব। আমাদের তেমন বের হওয়াই হয় না।
রাতেই নীলাকে ফোন করে বললাম ব্যাপারটা।
নীলা বলল 'কাল ও বের হবে না'।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন?”
নীলা বলল, 'কাল ও সারাদিন ঘুমাবে'।
(চলবে)
©somewhere in net ltd.