নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কেটেছে একেলা বিরহের বেল, আকাশকুসুম-চয়নে। সব পথ এসে মিলে গেল শেষে, তোমার দুখানি নয়নে।

অন্তহীন পথিক

আগ্রহ মোর অধীর অতি—কোথা সে রমণী বীর্যবতী । কোষবিমুক্ত কৃপাণলতা — দারুণ সে , সুন্দর সে উদ্যত বজ্রের রুদ্ররসে , নহে সে ভোগীর লোচনলোভা , ক্ষত্রিয়বাহুর ভীষণ শোভা ।

অন্তহীন পথিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

সেই ছেলেটা আমায় ছুয়ে ফেল..

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৮:২০

তাদের দু-জনের দেখা হয়েছিলো কোন এক মায়াবী সন্ধ্যায়। শীতের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েছিলো মনে লয়।

সব বন্ধুরা মিলে পার্বত্য এলাকার একটা হোটেলের নিচে ক্যাম্প ফায়ারে আগুনের তাপ পোহাচ্ছিল। ছেলেটা সবার ছবি তুলতেছিল। হুট করে তার কি যেন মনে হল, সে ছবি তোলা বন্ধ করে ক্যামেরাটা কাঁধে ফেলে চাঁদর জড়িয়ে পাশের ছোট্ট ঝোপটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। কেউ সে দিকে ফিরেও তাকাল না। কে কতোটুকু মজা করতে পারে সবাই তাই নিয়ে ব্যস্ত। একপা, দুইপা করে ছেলেটা কুয়াশার মাঝে এগিয়ে যেতে লাগলো এবং এক সময় সবার চোখের আড়ালে হারিয়ে গেলো। সবার সাথে থেকে আড্ডা দিয়ে আর যাই হোক, অন্তরের চোখ মেলে নিজের মত করে কিছুই দেখা হয়ে ওঠে না। আর তাই হয়তো এই একা হয়ে যাওয়া।

মেয়েটার আর ভালো লাগছে না হোটেলের এই বদ্ধ রুমে। ঘরেই যদি থাকবো, তাহলে এতো দূরে আসলাম কেন। তাই হয়তো সে একপা দুইপা করে হোটেলের নিচে ফায়ার ক্যাম্পের কাছে এসে দাড়িয়ে সবার মজা করা দেখছিল। তাঁর খুব ইচ্ছে করছিলো মাসুদের সাথে পাশাপাশি দাড়িয়ে ক্যাম্পের মজা উপভোগ করা। খুব ভুল হয়েছে মাসুদকে ঢাকায় রেখে আসা। কিন্তু কি করা, দুইজনের এক সাথে ছুটি কখনই মেলে না। আর এখন তো মিলবেই না। ভার্সিটির শেষ বছর এইটি। আমিও যেমন ওকে সময় দিতে পারিনা, ও নিজেও আমাকে সময় দিতে পারে না। কিন্তু তাতে কি? ভবিষ্যতে আমরা যেন ভালো থাকতে পারি, সুন্দর ভাবে সচ্ছল ভাবে থাকতে পারি, তাঁর জন্যই না আমাদের এখন এতো দূরে থাকা। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা!

ভাবতে ভাবতেই মেয়েটার চোখ পড়ে একটা ছেলের দিকে। আরে আরে ছেলেটা করে কি? সে এই সন্ধ্যা বেলা বনের মাঝে ঢুকে যাচ্ছে কেন? ছেলেটাকে কি আমি চিনি? নাহ, এই ছেলে তো আমাদের সাথে আসে নাই। আমাদের মতই হয়তো ঘুরতে এসেছে। কিন্তু ছেলেটা যাচ্ছে কোথায়? ওর কি এখানে কোন বন্ধু-বান্ধব নাই? ওকে কেউ আটকাচ্ছে না কেন? মেয়েটা টেনশনে ভিতরে ভিতরে ঘেমে যাচ্ছে। তাঁর খুব ইচ্ছে করতেছে ছেলেটাকে আটকাতে। কি যেন অজানা ভয়ে মেয়েটার বুক কেপে কেপে উঠছে। তাঁর খুব ইচ্ছে করছে, ছেলেটাকে একবারের জন্য হলেও পিছন থেকে ডেকে বলে, “এই, তুমি এই শেষ সন্ধ্যায় বনের মাঝে যাচ্ছ কেন?” কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর কিছুই বলা হয়ে উঠলো না! দেখতে দেখতে ছেলেটা কুয়াশার মাঝে হারিয়ে গেলো। মেয়েটার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। সে মন খারাপ একটা ভাব নিয়ে হোটেলে ফিরে এলো।

>> ছেলেটা বসে আছে একটা পড়ে যাওয়া গাছের গুড়ির উপরে। রাত যত নেমে আসছে, ছেলেটার ভালো লাগা ততোই বেড়ে চলেছে। কুয়াশা মানেই একটা বন্দী বন্দী ভাব। গাছের পাতা বন্দী কুয়াশার কাছে। কেমন শুকিয়ে পড়ে যাচ্ছে। কেমন অবাক করা কথা। নিজের বাঁচার প্রয়োজনে সন্তানকে মেরে ফেলছে গাছ গুলো। অথবা উল্টোটাও হতে পারে। মা’কে বাঁচানর জন্য সন্তানেরা তাঁদের জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। ঠিক যেমনটা মানুষ করে। আসলে মানুষ হয়তো কিছুই করে না, প্রকৃতি যা করে অভ্যস্ত তা ই তাঁর মনুষ্য সন্তানকে দিয়ে করায়।

সব কিছুই ভালো লাগছে ছেলেটার। এই যে ঘন কুয়াশার হাতে চাঁদের কড়া জোছনা বন্দী, কেমন ফ্যাঁকাসে দেখাচ্ছে চাঁদের আলোকে, চাঁদ নিজের দীপ্তি হারিয়ে লজ্জায় যেন মুখ দেখাতে পারছে না। তাই হয়তো চাঁদটাকেও ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। ইস কি ক্ষমতা এই কুয়াশার। এক ই প্রকৃতির দান সবাই, অথচ একজনের ক্ষমতা আরেকজনের চেয়ে কত বেশি। এক জন আরেকজনের হাতে কত নিররুপায় ভাবেই না বন্দী। আহারে চাঁদের আলো, তোর জন্য বড়ই মায়া হয়।

মেয়েটার মন খারাপ ভাবটা এখন চিন্তায় পরিনত হয়েছে। এতো রাত হয়ে গেলো, ছেলেটা তো এখনও ফিরল না! সেই কখন থেকে মেয়েটা জানালায় বসে আছে, একবারের জন্য শুধু চা আনতে গিয়েছিলো। সময় লেগেছে দুই মিনিট। এর মাঝেই কি ছেলেটা হোটেলে ঢুকে গেলো? নাহ, হোটেলের সামনের রাস্তাটা অনেক অনেক লম্বা। এতো কম সময়ে সে ঢুকতেই পারবে না। তাহলে? নাকি হোটেলে ঢোকার অন্য কোন দরজা আছে? ভাবতে ভাবতে তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেলো। সে এখন কি করবে? মাসুদকে ফোন দিবে? দিয়ে কি বলবে? অপরিচিত একজন ছেলের জন্য এই মাঝ রাতে তাঁর মন কাঁদছে? কথাটা ভেবেই মেয়েটা চমকে উঠলো। মন কাঁদছে আবার কেমন কথা? কারও জন্য দুশ্চিন্তা করা আর তাঁর ফেরার পথ চেয়ে মন খারাপ করা কি এক ই কথা? সে কে? আমি তো তাকে চিনিও না। হয়তো সে এই এলাকার ই একজন। সবার ছবি তুলতে এসেছিলো। ছবি তোলা শেষ, সন্ধ্যায় বাসা চলে গেছে। না না, তা কি করে হয়? অপরিচিত কাউকে এখানকার বেড়াতে আসা ছেলে মেয়েরা কখনই ছবি তুলতে দিবে না। তাহলে?

এখন রাত কয়টা? কি সর্বনাশ! রাত দুইটা? ঘড়ির দিকে তাকিয়েই মেয়েটার চোখে পানি চলে আসলো। সে আর থাকতে পারল না। মাসুদকে ফোন দিলো। মাসুদকে ফোন দিয়েই সে হাল্কা মিষ্টি কণ্ঠে বলল,
“কি করো তুমি?”
মাসুদ বলল, “কার্ড খেলি বন্ধুদের সাথে। কেন?”
মেয়েটি বলল, “নাহ, এমনিতেই, একা একা ভালো লাগছে না”। মাসুদ বলল। “আমার ও”।
তারপর দুইজন কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ফোন রেখে দিলো। নাহ, মেয়েটি কিছুই বলতে পারলো না মাসুদকে। সে মন খারাপ করে বিছানায় বসে জানালার দিকে এক দৃষ্টিয়ে তাকিয়ে থাকলো। রাত গভীর হতে থাকল, সাথে কুয়াশা, আর তাঁর সাথে, ছেলেটার না ফেরার সম্ভাবনা।

>> হাতের উপরে মাথা রেখেই মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছিলো। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারে নি। ঘুম ভাঙ্গার পরেই সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, সকাল ছয়টা বেজে গেছে। মেয়েটার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। প্রথম তাঁর মনে যে প্রশ্নটা আসলো, “ছেলেটা ফিরেছে তো?” তারপরে সে নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিলো, ফিরেছে নিশ্চয়ই। একটা অপরিচিত জায়গায় রাত বিরাতে ঘোরা যায়, কিন্তু রাত কাটানো যায়না নিশ্চই। কি জানি, হয়তো যায়! যে একলা একলা এমন বনের মাঝে ঢুকে যেতে পারে, তাঁর কাছে অসম্ভব কিছুই নেই।

মেয়েটার মনটা অনেক খারাপ। তাঁর ইচ্ছে করছে না এই মন খারাপ করা ভাবটা কাঁটাতে। কিন্তু একজন অপরিচিত মানুষের জন্য এই মন খারাপ ভাবটা কেন? আচ্ছা, একজন অপরিচিত মানুষের জন্য দুশ্চিন্তা করা কি অন্যায়ের কিছু? মেয়ে মানেই তো মা। গর্ভে ধারণ না করলে কি অন্নের সন্তানকে মাতৃ মমতায় বুকে নিয়ে আদর করা যাবে না? আরেকজনের সন্তানের দুঃখ দেখে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফেলা যাবে না? তাহলে?

এমন ভাবতে ভাবতেই মেয়েটা একটা চাঁদর জড়িয়ে বাইরে বের হল। শীতের সকাল, হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। সবার হাতেই চায়ের মগ। আরাম করে সবাই চা খাচ্ছে। মেয়েটা একপা দুইপা করে হাঁটতে হাঁটতে সামনের রাস্তাটাতে নেমে আসলো। ঘন কুয়াশা হাল্কা হতে শুরু করেছে। তারপরও বেশিদূর দেখা যাচ্ছে না। সে হাঁটতে হাঁটতে যখন রাস্তাটার মাঝামাঝি চলে আসলো, তখন দেখে কাঁধে হাল্কা একটা ব্যাগ নিয়ে একটা লোক দুলতে দুলতে আসছে। চোখে কালো চশমা দেয়া। হাতে ক্যামেরা। মেয়েটার মনের ভিতর যেন আনন্দের একটা বিদ্যুৎ খেলে গেলো। মনে হচ্ছে বুকে চেপে রাখা বিশাল একটা পাথর নেমে গেলো। মনটা কেমন হাল্কা হাল্কা মনে হতে লাগলো মেয়েটার। ইচ্ছে করছে, ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। তারপরে কষে একটা থাপ্পড়।

দেখতে দেখতে ছেলেটা একদম পাশে চলে এলো। মেয়েটা স্বাভাবিক ভাবেই হেঁটে চলে যাচ্ছে সামনের দিকে। তাঁর দৃষ্টি পা থেকে দুই হাত দূরে। একবার শুধু আড় চোখে সে ছেলেটার দিকে তাকাল। দেখে ছেলেটা চোখের চশমা একহাত দিয়ে চোখ থেকে সামান্য একটু নাকের উপর নামিয়ে তাকে দেখছে। মেয়েটা মনে মনে বলল, “বেয়াদব”। হুট করে ছেলেটাকে কেমন যেন পর পর লাগা শুরু হল তাঁর। সে আর কিছুই না ভেবে সামনে এগিয়ে গেলো।

>> ছেলেটা রাতের বেলা প্রকৃতি দেখতে দেখতে কেমন যেন উদাস হয়ে গিয়েছিলো। ইস, কি সুন্দর এই জগত। কত সুন্দর সেখানকার মানুষগুলো। এই বন্ধুত্ব। এই মায়ার বাঁধন, এই সব ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে, একদিন মারা যেতে হবে, ভাবা যায়? সে যেন ভাবতেই পারছে না আর কিছু। নাহ, এমন মন মরা ভাব করে থাকলে চলবে না। যে কয়েকদিন বেঁচে আছি, একটু আনন্দ নিয়েই বেঁচে থাকবো।

ছেলেটা তাঁর ব্যাগ থেকে একটা কাগজের পোটলা বের করলো। সেখানে নানা উপাদান দিয়ে ভরপুর। প্রথমেই সে মাটির একটা চোঙ্গা(পাইপ) বের করলো। সেটার এক মাথা একটু চিকন, আরেক মাথা মোটা। তারপরে বের করলো একটা পাতলা সুতির কাপড়। কাপড়টা দিয়ে সে বেশ আয়েশ করেই পাইপের ভিতরতা পরিষ্কার করলো। তারপরে সে বের করলো একটা ছোট কাঁচি। এরপরে বের করলো কিছু শুকনো গাঁজার ডাল। আর সাথে হালকা শুকনো তামাক পাতা। গাঁজার ডাল থেকে সে নিখুঁত ভাবে ময়লা পরিষ্কার করলো। তারপরে যা অবশিষ্ট থাকলো, তা কাঁচি দিয়ে কুঁচি কুঁচি করে কেটে ফেলল। এবার তামাক পাতার পালা। তামাক পাতা নিতে হবে গাঁজার পরিমাণের ছয় ভাগের এক ভাগ। সেটিও কাঁচি দিয়ে কেটে কুঁচি কুঁচি করা হল। তারপরে দুই পাতাকে এক সাথে ভালো করে মেশানো হল, এবং হাতের তালুতে সব উপাদান নিতে বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে হালকা পিষে নিল সে। তারপরে মাটির পাইপের চিকন প্রান্তটা নিচের দিকে রেখে মাটির তৈরি একটা ছোট মার্বেল দিয়ে মুখটা বন্ধ করে দিলো সে। তারপরে ওই উপাদান গুলোকে পাইপের ভিতর ভরে দিয়ে আঙ্গুল দিয়ে গুঁজে দিলো। এবার শেষ কাজ। সে গেঞ্জিটা থেকে একটু ছোট সাইজের কাপড় কেটে বের করলো, এবং সেটা পাইপের মুখে সুন্দর করে ধরল। এবার সে আরাম করে বসে পড়লো।

পাইপটা দুই হাত দিয়ে এমন করে ধরল, সেটাও একটা দেখার জিনিস। প্রথমে সে পাইপটা বাম হাতের পাঁচ আঙ্গুল দিয়ে ধরল। তারপরে ডান হাত দিয়ে বাম হাতের পাঁচ আঙ্গুল্কে এমন ভাবে চিপে ধরল, যেন কোন বাতাস না ধুকতে পারে। এরপরে সে বাম হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুলের ফোকরের মাঝে মুখ লাগাল, যেই না টান মারতে যাবে, সে মনে মনে বলল, “হায় হায়। আমাকে আগুন দিয়ে দিবে কে”? আগুন দিতে না পারলে এতো কষ্ট তাঁর বিফলে যাবে। তাহলে উপায়? কাছের পাপী বন্ধুদের জন্য তাঁর মনটা হু হু করে উঠলো। ইস, এখন যদি পাশে “.........” থাকতো! যাই হোক কি আর করার, আজকে একটু কষ্টই করতে হবে।

সে উপায় খুঁজতে থাকলো। আগুনের একটা চিকন শিখা পাইপের মাঝে ঢুকাতেই হবে। মোমবাতি? নাহ, মোমের আগুন পাবার জন্য তাকে পাইপ হেলাতে হবে। তাহলে ভিতরের সব পড়ে যাবে। তাহলে? কিছু মোম গলিয়ে কি দেয়া যায়? মশালের মত। নাহ, সাধ নষ্ট হয়ে যাবে। তাহলে?

বিপদ যেখানে উপায় সেখানে। সে তাঁর ব্যাগ থেকে সাইকেলে পাম্প দেয়ার হ্যান্ড পাম্পটা বের করলো। তারপরে সেটা এমন ভাবে নিল, যেন পা দিয়ে পাম্প করা যায়। এবার পাম্পারের পাইপটা রাখল জ্বলন্ত মোমবাতির শিখার পিছনে। তারপরে হালকা পাম্প করে দেখল, কাজ হয়ে গেছে। আগুন বাঁকছে। তাঁর আনন্দ দেখে কে। অনেক সাধনার পরে সে প্রথম টানটা দিলো। ফুসফুস এবং পাকস্থলী ভরে সে ধুয়া নিল। যেহেতু অনেক মোটা, তাই আগুনটা ধরানোর জন্য তাকে এই রকম বেশ কিছু টান দিতে হোল। এই জিনিস শেয়ার না করে খেলে ঠিক কেমন যেন অপূর্ণ অপূর্ণ লাগে। তাই সে প্রকৃতির সাথে শেয়ার করলো।

এর ঠিক দশ মিনিট পরে তাঁর মনে হতে লাগলো, চারপাশের সব কিছু উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে, আর সে নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় তাঁর মুখ ফুটে বেরিয়ে আসলো-
“ কাস ইয়ে রাতো মে, মেরি পাছ মেরি বিবি হোতি,
তো ইয়ে রাত রাত নেহি, মেরি সোহাগ রাত হোতি”

এর পরে আর কিছুই মনে নেই তাঁর।

তাঁর ঘুম ভাঙ্গে পাখির কিচির মিচির শব্দে। সরবনাস...............আমি রাতে এখানেই ছিলাম? তাঁর মাথায় বাজ পড়ে যেন। সে মোবাইলে দেখে একশত এর উপরে মিসকল। ইয়া মাবুদ, আজ খবর আছে। নিশ্চয়ই সবাই হোটেলে অনেক দুশ্চিন্তা করেছে। সে ধুকপুক করে উঠে সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে রওনা দিলো হোটেলের দিকে।

যখন সে হোটেলের সামনের রাস্তায় এসে উঠলো, তখন সে রীতিমতো ভয় ই পেয়ে গেলো। কে এতো সকালে কুয়াশার মাঝে হাঁটছে? পরী না তো? এতো কিউট কোন মানুষ হতে পারে? মাথার চুল হালকা ছোট করে কাটা। পরনে জিন্স আর জামা। সাদা জামার উপরে সে পড়েছে হালকা খয়েরী চাঁদর। চোখে রঙ্গিন চশমা বলে মেয়েটাকে শ্যামলা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটার রুচি আছে। না হলে এতো সকালে কেউ কুয়াশা উপভোগ করার জন্য রাস্তায় বের হয়?

সে ইচ্ছে করেই একটু দ্রুত হেঁটে গেলো মেয়েটার দিকে। কাছে থেকে দেখার জন্য সে আর অপেক্ষা করতে পারছে না। ঠিক যেই মুহূর্তটায় তাঁরা পরস্পরকে অতিক্রম করবে, ছেলেটা চোখের চশমাটা নাকের উপরে একটু নামিয়ে দেখল মেয়েটাকে। কিন্তু চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না সে। কিন্তু একি, মেয়েটার চোখে পানি কেন? সাথে সামান্য বিরক্তি ও আছে। তাহলে কি এই সুন্দর সকাল তাঁর চোখে অনন্দ অশ্রু এনে দিয়েছে, আর আমার তাকে দেখার ভঙ্গি এনে দিয়েছে বিরক্ত? কি জানি, তাই ই হবে হয়তো। ইস, আফসোস। দুইটার কারন ই যদি আমি হতাম। একটা নিশ্বাস ফেলে ছেলেটা হোটেলে ঢুকে গেলো।


>>> সারাটা দিন মেয়েটার অনেক বাজে ভাবে কেটেছে। ছেলেটার সেই বেয়াদবের মত চাহনি, আর গায়ে বাঘের প্রস্রাবের মত গন্ধ একদম ই ভুলতে পারছে না সে। আচ্ছা, মানুষের গায়ে এমন উটকো গন্ধ থাকে কিভাবে? মনে হয় সে রাতে ময়লা কিছুর উপরে শুয়েছিল। অন্ধকারে দেখতে পারে নি। হুম, তাই ই হবে। তবে আর যাই হোক, ছেলেটা বেয়াদব। মানুষের চোখ মিথ্যা বলতে পারে না। এই জন্যই দৃষ্টিহীনদের মিথ্যা বলা সহজ। চোখের পাতাই পড়ে না, সত্য হোক, আর মিথ্যা, তাঁদের চোখ থাকে সব সময়ের জন্যই স্থির।

সন্ধ্যা হতে শুরু করেছে। সাথে কুয়াশার প্রকোপও বাড়তে শুরু করেছে। বাইরে আজ ও ফায়ার ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছে। সবাই জম্পেস আড্ডা দিচ্ছে। মেয়েটা হোটেলের জানালা দিয়ে দেখছে। এর মাঝে একজন আবার গান গাচ্ছে গীটার বাজিয়ে। সবাই গানের তালে তালে হালকা মাথা দুলাচ্ছে। দেখতে ভালোই লাগছে। তাঁর ও খুব ইচ্ছে করছে সেখানে যেতে। কিন্তু যেতে পারছে না। কারন ওই বেয়াদব ছেলেটাও আছে সেখানে। সবার থেকে একটু আলাদা হয়ে সিগারেট খাচ্ছে এবং বেশ আরাম করেই খাচ্ছে। মেয়েটার গা রাগে শিরশির করে উঠলো। এই ছেলের জন্য আমি এতো দুশ্চিন্তা করেছি? সে নিজের যুক্তির কাছে নিজেই পরাজিত হোল, “মমতার কাছে, সন্তানের ব্যবহার নয়, সন্তানের উপস্থিতিই একান্ত কাম্য।”

মেয়েটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে ছেলেটা কি করে। এখন সে যা করছে, তা বেয়াদবির চরম পর্যায়। সে একটা মেয়ের পিছনে বসে মেয়েটার চুলে ফু দিচ্ছে। আর মেয়েটা বারবার রাগি চোখে পিছনে তাকাচ্ছে। কিন্তু ছেলেটার তাতে কোন কিছুই আসছে যাচ্ছে না। হতে পারে মেয়েটা ছেলেটার গার্লফ্রেন্ড। তাহলে আর কি! সব মিটেই গেলো। মাসুদ ও তো............... যাক সে কথা। কিন্তু ঘটনা তা না, মেয়েটা আরেকটা ছেলের হাত ধরে সেই ছেলেটার কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। তাহলে............?? তাহলে আর কিছুই না। ছেলেটা মেয়েটার সাথে বেয়াদবি করছে।

বেয়াদব ছেলে। কিন্তু সে বেয়াদবি করলে আমার কি? নিজেকে প্রশ্ন করেই মেয়েটা চমকে উঠলো। তাঁর এই অনুভূতি অপরিচিত নয়। আর আগেও তাঁর এমন হয়েছিল। জীবনে একবার ই হয়েছিলো। সে ভয় পেয়ে গেলো। নাহ, এখান থেকে সরে আসতেই হবে। মেয়েটা জানালা থেকে সরে আসলো। সে মাসুদকে ফোন দিলো।
হ্যালো মাসুদ?
হু, বল।
কই তুই? কি করিস?
কিছু না রে, কার্ড খেলি। ক্যান?
নাহ, কিছু না। তুই খেল।
ওকে। টাটা।।

মাসুদের উপর মেয়েটার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। মাসুদ কি বুঝতে পারে না, মেয়েটার মন খারাপ। মেয়েটা মাসুদকে ফোন দিলেই বলে সে ব্যস্ত। অথচ তাঁর ব্যস্ততা কার্ড খেলা আর ঘুমানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

মেয়েটা ফোন নিয়ে অপেক্ষা করছে। কিসের জন্য অপেক্ষা! অপেক্ষা মাসুদের ফোনের জন্য। সে না বলল ব্যস্ত। তাহলে সে আবার ফোন দিবে কেন? তাছাড়া সে তো বুঝতেই পারেনি, মেয়েটার মন খারাপ।

এক মিনিট পরে মাসুদের ফোন আসলো।
কিরে মন খারাপ?
নাহ।
তাহলে মন খারাপ করে বসে আছিস কেন?
বাইরে সবাই ফায়ার কাম্পে মজা করছে আর তুই রুমে, ঘটনা কি?
যেতে ইচ্ছে করছে না।
কেন?
এমনি। তুই চলে আয়। একা ভালো লাগে না।
হুর, এখানে থাকতে তো দেখা হয় ই। নতুন যায়গায় গিয়েছিস, সবার সাথে মজা কর। সব কিছু সহজ ভাবে নে। আমি ছাড়াও তো তোর নিজের বলে একটা জীবন আছে, তাই না?
হুম। ওকে তাহলে আমি যাই। টাটা।
ওকে, টাটা ডিয়ার। বাই।

মাসুদ কেমন লোক রে ভাই। বুঝতেই পারলাম না। সে কি বলে এ সব? থাক, তোমাকে বুঝতে হবে না। সব কিছু সবার জন্য নয়। চলো, মেয়েটার কাছে ফিরে যাই।।

>> ইচ্ছে না থাকা সর্তেও মেয়েটা নিচে গেলো। আজ সে পরেছে সাদা জামা। তাঁর উপর কালো একটা চাঁদর। দারুণ দেখাচ্ছে তাকে। সে যখন ফায়ার ক্যাম্পের কাছে গেলো, দেখে ছেলেটা নেই। যাক, ভালোই হয়েছে ভেবে ছেলেটাকে মনে মনে খুঁজতে থাকে সে। দেখে দূরে দাড়িয়ে ছেলেটা প্রস্রাব করছে। ছি, মানুষ এতো বেয়াদব হয়? তাঁর বেয়াদবি চরম পর্যায়ে উঠে গেছে। কারন সে ক্যাম্পের দিকে আসছে আর জিপার লাগাচ্ছে। মনে হয় লাগছে না। তাই সে মনোযোগ দিয়ে নিচে তাকাচ্ছে আর জিপার লাগাতে লাগাতে হালকা পায়ে হেঁটে তাঁদের দিকে আসছে।

মেয়েটা নজর ফেরাল গীটার ওয়ালা গায়কের দিকে, সে সুন্দর একটা গান গাচ্ছে। কেউ ইচ্ছে করেও মুখ বন্ধ রাখতে পারছে না, এতই সুন্দর গানটা-
“ মন ভালো নেই , বারে বারে মনে হয়
তুমি পাশে নেই, ভাবি ধুর ছাই কেন কাটেনা সময় ??
সাতটি রঙ্গে তোমাকে খুঁজে বেড়াই
বৃষ্টি শেষে দেখা না পেলে বড় অভিমান হয়

রাতে কাটে নির্ঘুম, আমি নিশ্চুপ, নিঃস ভেবে যাই
ভালোবাসী তোমায় এতটা...........”।।

গানের তালে তালে সবাই গান করছে। মেয়েটা হুট করে ছেলেটার কথা ভুলে যায় যেন। চোখ বুজে সে মাসুদকে মনে করার চেষ্টা করে। তাঁদের TSC তে আড্ডার কথা মনে করে, এক সাথে হেঁটে হেঁটে পুরান ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় পান খাওয়ার কথা কনে করে। তাঁর মনে হয়, মাসুদ মনে হয় তাঁর পাশেই আছে, সে চোখ খুললেই মাসুদকে দেখতে পারবে। তখন সে চোখ খুলে তাকায়, এবং অবাক হয়ে দেখে, ছেলেটা তাঁর পাশে এসে বসেছে। তাঁর গা শিউরে ওঠে। সে একটু চমকে সরে বসে। তাঁর চমক লাগার মাঝে কিছু একটা হয়তো ছিল। সবাই তাঁদের দিকে এক সাথে ফিরে তাকায়। মেয়েটা না যতটা অবাক হয়েছে, তাঁর চেয়ে হয়তো অনেক বেশি অবাক হয়েছে ছেলেটা। এবার ছেলেটা মুখ খোলে- অনেক মৃদু সরে সে বলে- “এই কি হয়েছে তোমার? ভয় পেয়ছ নাকি”?

বলেই ছেলেটা হাসতে থাকে। বাহ, ছেলেটার হাসিটা তো অনেক সুন্দর! মুগ্ধ হয় মেয়েটা। সে আর কিছুই বলতে পারে না। সবার দিকে তাকিয়ে একটা কোমল হাসি দিয়ে সে উঠে দাঁড়াতে চায়। ছেলেটা বলে, আরে যাচ্ছ কোথায়? বোস, ক্যাম্প ফায়ারের আসল মজা তো এখন শুরু হবে। মেয়েটা যেন কিসের একটা আগ্রহ......কিসের একটা টান অনুভব করে। তাঁর বসতে ইচ্ছে করে ছেলেটার পাশে। সে আর উঠে দাঁড়াতে পারে না।

ক্যাম্প ফায়ারে একটার পরে একটা গান বাজতেই থাকে। সময় কোন দিক দিয়ে পার হয়ে যেতে থাকে কারও যেন কোন খেয়াল নাই। এই সারাটা সময় মেয়েটা ছেলেটাকে দেখতে থাকে। ছেলেটার হাতে চুরির মত একটা ব্রেসলেট। রঙ কচুপাতা। তাঁর মাঝে সাদা রঙের কালি দিয়ে লেখা “Bangladesh”। সুন্দর লাগছে দেখতে। কিন্তু রঙটা সাদা না হয়ে লাল হলে ভালো লাগতো। বাংলাদেশ মানেই নতুন সূর্য। কিন্তু লাল হলে হয়তো ওর হাতে ভালো লাগতো না। নাহ, সাদাই ঠিক আছে। গলায় কালো ফিতা একটা লকেট পরা। আর কিছু কি আছে? হুম, ছেলেটার বাম হাতে বেশ বড় সড় একটা ঘড়ি আছে। সব সময় মনে হয় জুতো পরে থাকে। সব মিলিয়ে খারাপ না, ভালোই লাগছে ছেলেটাকে। স্মার্ট বয়।

>> সেই সকালের পর থেকে ছেলাটার মনটা কেমন জেন উদাস হয়ে আছে। এক দেখাতে প্রেম। এটা কি কোন নাটক নাকি? নাকি কোন গল্পকারের লেখা গল্প। প্রথম দেখায় চোখাচোখি, সেখান থেকে ভাবের আদান প্রদান। তারপর শুরু হোল তাদের প্রেমের কাহিনী। বাস্তবে কি এমন হয় নাকি? হয়েও বা লাভ কি? এত বড় মেয়ে, প্রেম করে না, তা কি করে হয়? হতেও তো পারে। হতে পারে না, we made for each other টাইপ। যাই হক, আগে পরিচিত হতে হবে। তারপরে দেখা যাবে, কোথাকার পানি কোথায় যায়।

ক্যাম্প ফায়ারের কাছে ছেলেটা বসে আছে অনেকক্ষণ ধরে। কাল মেয়েটা এসেছিলো। আজ ও আসবে নিশ্চয়ই। মেয়েটা তো আর ছেলেটার মনের কথা জানে না, তার মত বাউন্ডুলের কাছ থেকে দূরে দূরে সরে থাকবে।

ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরে হোটেলের জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে, সে ফোনে কথা বলছে। কার সাথে কথা বলছে সে? বয়ফ্রেন্ড? নাহ, বাসার কারও সাথে মনে হয়। জীবনে প্রথম কাউকে এক দেখাতেই ভালো লেগেছে, তার বয়ফ্রেন্ড আছে, এটা মেনে নেয়া যায়? হতেই পারে না। কেমন জেন একটা শঙ্কা কাজ করতে থাকে ছেলেটার মনের ভিতরে।

অনেকক্ষণ তো হয়ে গেলো, এখনও কেন আসছে না মেয়েটা। আজকে কি আসবে না সে? ভাবতে ভাবতেই সে বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করে। কিন্তু সে তো মেলা দূর। এতো দূরে এখন আবার যাবে? এর মাঝেই যদি মেয়েটা চলে আসে। তাই ছেলেটা তাড়াহুড়ো করে সামনের ছুটে গেলো। কিন্তু পিছন ফিরেই দেখে মেয়েটা বসে আছে ফায়ার ক্যাম্পের কাছেই। তাকিয়েও আছে তার দিকে। ছি, কি লজ্জা লজ্জা। ছেলেটা আর চোখ মেলাতে পারলো না । মাথা নিচু করে জিপার লাগাতে লাগাতে ফিরে আসলো ক্যাম্পের কাছে।

যা হবার হয়ে গেছে। সেই চিন্তা করে তো আর লাভ নাই। পরে না হয় কোন এক সময় দুঃখিত বলে নিলেই হয়ে যাবে। কিন্তু এখনকার এই মায়াবী সন্ধ্যা কি আর ছেলেটা কোনোদিন পাবে? কালকে রাতেই ফেরত যেতে হবে গন্তব্বে। তাই সকল বাঁধা বিপত্তি পিছনে রেখে ছেলেটা মেয়েটার কাছে গিয়ে বসলো। কাছে মানে একদম পাশে। আরে, মেয়েটা কি করছে? চোখ বন্ধ করে আছে কেন? মুখে আবার হালকা গোলাপি হাসি। সে কি সুখকর কোন কিছু চিন্তা করছে। তাঁর ছেলে বন্ধুটির হাত ধরে হাঁটছে এমন কিছু? হতেও পারে।

হুট করে মেয়েটা চোখ খুলল। তাঁদের চোখ একদম সামনা সামনি। একজন আরেকজনের নিঃশ্বাসের শব্দ পাচ্ছে, এতটাই কাছাকাছি। মেয়েটা মনে হয় ভয় ই পেয়েছে। পাওয়ার ই কথা। কিন্তু ছেলেটার করার কিছুই ছিল না। তাঁর মনে হচ্ছিলো, সে মেয়েটার পাশে না বসলে বোধয় মরেই যাবে। মরার চেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করাই ভালো। সে তাই করেছে। ভদ্র মেয়ে, উঠে চলে যেতে ধরেছিল। মেয়েটা আসলেই ভদ্র, কারন অপরিচিত একটা ছেলের অনুরধ সে রেখেছে, চলে যায় নি। যদি যেত, সবাই নিশ্চয়ই ছেলেটাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখত। অন্ধকারে না জানি কোথায় হাত দিয়েছে। এমন টাইপের অভিযোগ তাঁদের চোখে ধরা পড়তো। কিন্তু এখন সব স্বাভাবিক।

বেশ অনেকক্ষণ হয়ে গেলো, তাঁরা পাশাপাশি বসে আছে। ছেলেটা মেয়েটাকে না দেখার ভান করে সবার সাথে মজা করছিলো। কিন্তু সে অবাক, মেয়েটা তাঁর দিকে একমনে তাকিয়ে আছে কেন? খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে কি? ইস, কেন যে হাতে ব্রেসলেট আর গলায় লকেট পড়ে আছে সে, সেই দুশ্চিন্তায় সে ভিতরে ভিতরে ঘেমে গেছে। নিশ্চয়ই তাকে অনেক বাজে দেখাচ্ছে। ঠিক যখন মেয়েটা একটু অন্য দিকে তাকাচ্ছে, ছেলেটা মুগ্ধ হয়ে মেয়েটাকে দেখছে। কি সুন্দর দেখতেই না মেয়েটি।

এই ভাবে কত সময় যে কেটে গেলো, তারা কেউ ই বুঝতে পারলো না। বোঝার কি কোন উপায় আছে? কারও কাছে থাকলে থাকতেও পারে, কিন্তু আমার কাছে নাই।

রাত প্রায় দশটা।।
সবাই ফায়ার ক্যাম্প থেকে উঠে হোটেলের দিকে রওনা দিচ্ছে। মেয়েটিও যাচ্ছে। হুট করে ছেলেটা পিছন থেকে মেয়েটাকে দেখে বলল,
আমি কি আপনার নাম টা জানতে পারি?
মেয়েটা একটু হেসে বলল, আমার নাম- “অন্বেষা”।
ছেলেটা অবাক হয়ে বলল, “ইয়া, জুলেখা। এতো কঠিন নাম? এর মানে কি?”
মেয়েটা একটু দুশ্চিন্তায় পড়লো, কারন সে নামের মানে জানে না। সে বলল, “আমি আসলে জানি না। নাম আমার মামা রেখেছিলেন। উনি জানেন।”
ছেলেটা মজা করে যাচ্ছেই তো যাচ্ছে, “তো আপনার মামার নাম কি?”
আমার মামার নাম “লিমন”।
উনার নিজের নাম এতো সহজ, আর আপনার নাম এতো কঠিন কেন?
খুব কি কঠিন?
হু, অনেক কঠিন।
তো আপনার নাম কি? বলেই মেয়েটা একটু অবাক হোল। মাত্র কিছুক্ষণের পরিচয়, এর মাঝেই এতো সহজ ভাবে কথা বলছে সে ছেলেটার সাথে। এটা কি ঠিক হচ্ছে?
ছেলেটা বলল, “কি ব্যাপার, কি চিন্তা করছেন?”
নাহ, কিছুই না। তো আপনার নাম বললেন না যে?
আমার নাম অনেক সহজ। আপনি একবার শুনলে সারা জীবন মনে থাকবে এমন টাইপের নাম। “সবুজ”।
বাহ সুন্দর নাম তো।
হুম, বলতে পারেন।

কথা বলতে বলতে তারা একদম হোটেলের সামনে এসে যায়। এখন তাদের পালা যার যার রাস্তায় চলে যাওয়ার। কিন্তু কিসের এক পিছুটানে তাদের যেতে ইচ্ছে করছে না। পায়ের নিচে যেন শিকড় গজিয়েছে তাদের। কিন্তু উপায় নেই। সেই শিকড়ের উপস্থিতি বুঝবার দেবার উপায় আসলেই নাই তাদের। হতে পারে মেয়েটির মাসুদের প্রতি ভালোবাসা, অথবা ছেলেটির চক্ষু লজ্জার ভয়। তারা পরস্পরকে বায় বলে চলে যাচ্ছে।
বেশ কিছুদূর যাবার পরে মেয়েটার ইচ্ছে করলো একটু পিছন ফিরে তাকাতে। কিন্তু তা কি সম্ভব? ঠিক এমন সময় ছেলেটি মেয়েটিকে ডাক দিয়ে বলল, “এই যে কঠিন নামের অধিকারিনি, এই যে শুনছেন?” মেয়েটির কানে মনে হয় এমন মধুর বানী বেশ কিছুদিন না, অনেক দিন হোল প্রবেশ করেনি। সে প্রথমে না শোনার ভান করলো। তারপরে পিছন ফিরে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে বলছেন?”।
জি, আপাকেই বলছি। রাতে আপনার প্ল্যান কি?
কিছুই না। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বো।
আরে, বেড়াতে এসে কেউ ঘুমায়? খাবার পরে হোটেলের ছাদে চলে আসুন। আমরা বন্ধুরা মিলে ফানুস উড়াবো।
বলেই ছেলেটি উত্তরের অপেক্ষা না করে পিছন ফিরে চলে গেলো। মেয়েটি কি বলবে ভেবে পেলো না। আর মেয়েটি যদি না করে দেয়, সেই ভয়ে অপেক্ষা না করেই ছেলেটি চলে গেলো।


মেয়েটি রুমে আসলো ভাবুক মনে। সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কি করবে। তার প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে। আগে খেয়ে নেয়া যাক, পরের টা পরে দেখা যাবে।

ভাত খেতে খেতেই মাসুদের ফোন এলো।
কিরে, কি করিস?
এইতো ভাত খাই।
গুড গার্ল।
তুই কি করিস?
আমি কার্ড খেলি। বলেই মাসুদ সেই একটা হাসি দিল।
তোর কি কার্ড খেলা ছাড়া আর কোন নেই?
আছে তো। আছে না আবার?
কি সেটা শুনি?
এই যে, তোর ফেরার পথ চেয়ে থাকা।
“অন্বেষা” চুপ করে যায়। তার গলায় কি যেন একটা আটকে যায়। ভাত নয়, একে বলে গলায় আবেগ আটকে যাওয়া।
মাসুদ বলে, - কিরে, চুপ করে আছিস যে? কথা বল।
আমি খাচ্ছি রে। পরে কথা বলি?
ওকে। রাতে ফোন দিস। টাটা।

“অন্বেষা” আর ভাত খেতে পারলো না। তার মনের মাঝে বিচ্ছেদের ঝোড় উঠেছে। সে কিছুতেই দুই জনের মাঝে একজনকে বেছে নিতে পারছে না। এটা কিভাবে সম্ভব? মাসুদের সাথে তার পরিচয় দীর্ঘ পাঁচ বছরের। এই পাঁচ বছরে তাঁদের কত মধুর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তারা একজন আরেক জনকে বোঝে। এক কোথায় তাঁদের মাঝে আলাদা বলে আর কিছুই নাই। তারা এক আত্মা দুই দেহ, এমন একটা অবস্থা।

“অন্বেষা” কি করবে তাহলে? তার কাছে দশ তলার ছাদ থেকে লাফ মারা অনেক সহজ মনে হচ্ছে। সে কি সবুজের কাছে গিয়ে বলবে, “ সবুজ তুমি কি আমার হাতটা একটু শক্ত করে ধরবে। চল আমরা ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ি”। কিন্তু সবুজ কেন লাফিয়ে পড়বে? সে তো আমার জন্য পাগল না। আমার মত দুষ্ট বদ মানুষ তো সে না!

নিজের মনের সাথে বোঝা পড়া না করতে পারে সে এক প্রকার নিজের অনিচ্ছায় ছাদে গেলো। সেখানে গিয়ে দেখে হুলুস্থুর কাজ কারবার। সবাই ফানুশ উড়াচ্ছে।

সবুজ এতক্ষণ দম আটকিয়ে বসে ছিল। তার একবার মনে হয়েছিল “অন্বেষা” মনে হয় আসবে না। কিন্তু সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সে চলে এসেছে। কিন্তু একি, “অন্বেষা” কি কেঁদেছে নাকি? তার চোখ ফোলা কেন? কষ্টে সবুজের বুকটা যেন ফেটে গেলো। সে কি করবে এখন। তার কি করা উচিৎ? সে আস্তে আস্তে হেটে “অন্বেষা”র কাছে গেলো। “অন্বেষা”র কাছে গিয়ে বলল, তোমার কি হয়েছে? “অন্বেষা” সবুজের দিকে এক মনে তাকিয়ে আছে। সে ক্ষুর ধার দৃষ্টির রহস্য উন্মোচন করার ক্ষমতা আর যার ই থাকুক, সবুজের নাই।

“অন্বেষা” সবুজকে বলল, তুমি কি একটু আমার সাথে কোন একটা নিরিবিলি পরিবেশে যেতে পারবে? সবুজ কি বলবে বুঝে উঠতে পারলনা। “অন্বেষা” খপ করে সবুজের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকল নিচের তলায়।

সবুজ বলল, “এই“অন্বেষা” কি করছ তুমি? পড়ে যাবো তো!” “অন্বেষা” সবুজের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে তোমাকে আসতে হবে না, তুমি চলে যাও।”

সবুজ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে “অন্বেষা”র দিকে তাকালো। দেখে সে রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। সবুজ তখন বলল, ““অন্বেষা” তুমি যদি আমাকে বল চলো, দশ তলা থেকে লাফিয়ে পড়ি, আমি তোমার হাত ধরে লাফিয়ে পড়বো।” “অন্বেষা” আর কিছুই বলল না, সে অঝোর নয়নে কাঁদতে থাকলো। এমন সময় “অন্বেষা”র ফোনটা বেজে উঠলো। সে যেন দিশা ফিরে পেলো। সে চোখ মুছতে মুছতে সবুজকে বলল, সবুজ আমাকে ক্ষমা করে দিয়। আমি আমার ব্যাবহারের জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।
সবুজ বলল, “বাঁধা কোথায় “অন্বেষা” ”।
তুমি বুঝবে না সবুজ।
বলেই দেখ আমি বুঝি কি না! আমার সাথে তোমার ঘর বাঁধতে সমস্যা কোথায়?
“সবুজ, আমি তোমার সাথে ঘর বাঁধবো কিভাবে বল, আমি যে আরেকজনের সাথে মসজিদ বেঁধে রেখেছি। ঘর ভাঙ্গা যায়, কিন্তু মসজিদ ভাঙ্গা যায়না। সেখানে যে আমার বিধাতার বাস”।
“তুমি মানুষকে বিধাতা বানিয়েছ “অন্বেষা”?”
“নাহ, তুমি ভুল বললে সবুজ, বিধাতা আমার কাছে মানুষ রুপে ধরা দিয়েছে।”
সবুজ বলল, “ বিধাতার কাছে তো চাইলেই পাওয়া যায়, তুমি মুক্তি চাইলে সে কি দিবে না? ”
“সবুজ, বিধাতার কাছে সৃষ্টির মুক্তি আছে, কিন্তু সৃষ্টির কাছে বিধাতার মুক্তি নাই”
“তাহলে তো কথাই চুকে গেলো। তুমি চলে যাও তোমার বিধাতার কাছে”।
“অন্বেণা” বলল, “আমি যে পারছি না।” বলেই সে হু হু করে কেঁদে উঠলো এবং তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ফেলল।
সবুজ বলল, “মন ভাঙ্গা আর মসজিদ ভাঙ্গা তো এক ই কথা, তাই না?”
“অন্বেষা” বলল, “না, সমান কথা না। একটার ভাঙ্গন অদৃশ্য, আরেকটা দৃশ্যমান”।

সবুজ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ ছল ছলে কি না, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। এমন করেই কাটল সারাটা রাত। কেউ আর কোন কথা বলল না। নিসচুপ বিনিদ্রায় কাটল তাঁদের সারাটা রাত। এ যেন জহির রায়হানের “হাজার বছরের সেই রাত”।

এই ভাবেই কেটে গেলো আরও সাতটি বছরের রাত। এই সাত বছরে সবুজ, “অন্বেষা” রাতে ঘুমাতে পারলো কি না বলতে পারবো না। কিন্তু মাসুদ কিন্তু ঘুমাতে পারেনি। “অন্বেষা” বিহীন একলা জীবনের রাত সে কিভাবে কাটাবে?

মাসুদের বন্ধুরা বলেছিল, কিরে তুই কিছুই বললি না? মসুদ শুধু বলেছিল, ““অন্বেষা” আমাকে ভিক্ষুক ভেবে যে করুণার ভিক্ষা দিয়েছ, আমি তাহা দেবীর প্রসাদ ভেবে দু-হাত পেতে নিয়েছি। হোকনা সে প্রসাদ “অন্বেষা”” বিহীন ই একটা জীবন।।”

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.