নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ছন্নছাড়ার আবোল-তাবোল

ইমরান নিলয়

পকেটে কিছু খুচরো স্বপ্ন নিয়ে নিজেকে জানার চেষ্টায় আছি। মাঝে মাঝে শব্দ দিয়ে দাগাদাগি করি। অসামাজিক।

ইমরান নিলয় › বিস্তারিত পোস্টঃ

মনোটোনাস মনোলগ

০২ রা মে, ২০১৭ রাত ৯:২৫

টলতে টলতে নিজের দরজার সামনে যখন এসে দাঁড়ালাম, রাত বাজে দু'টো। চারপাশ সুনসান। সিঁড়িঘরটা অন্ধকার। বাতিটা নষ্ট হয়ে আছে কিছুদিন। প্রতিরাতেই ভাবি পরেরদিন নতুন একটা বাতি লাগিয়ে নেবো। দিনের বেলা বেমালুম ভুলে যাই। এমনই হয়; দিনের আলো ফুটলে অন্ধকারের দাবীটুকু আর মনে থাকে না। অথচ পৃথিবীটা গোল। একই অন্ধকার এখানে ঘুরেফিরে আসে।

কাছেপিঠে কোথাও একটা টিকটিকি জোরালো কণ্ঠে টিক টিক করে উঠলো। কারো কথা সত্য হলে নাকি টিকটিকি এমনটা করে। কিন্তু মাঝরাতে এই টিকটিকিটি পৃথিবীর কোন কথাটাকে সত্য বলে ঘোষণা করছে? কেউতো কিছু বলেইনি। নাকি আমি মনে মনে কিছু বলেছিলাম? টিকটিকি কি মনের কথা বুঝতে পারে? এটা নিয়েতো গবেষণা হওয়া উচিৎ।

আবছা অন্ধকারে চাবি হাতে নিজের দরজা হাতড়ানোর দুঃখে আমার ঘরের দরজাটা বোধহয় নিজে নিজেই খুলে গেলো। চট করে শরীর গলিয়ে দিলাম। দরজাদেরও কি তাহলে প্রাণ থাকে? কে জানে। টিকটিকি-দরজা নিয়ে কিসব ভাবছি। যতসব বাতিল ভাবনা। এরচেয়ে সুন্দর কিছু ভাবা যাক। একটা ঝর্ণার কথা ভাবা যাক। পাহাড় থেকে একটা শীতল ঝর্ণা গড়িয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়ছে সমতলে। তার ভেজা চুলগুলো নদী হয়ে লাজুক প্রেমিকার মতো গা ভাসিয়ে দেয় পৃথিবীর বুকে...

পুরো ঘরজুড়ে একটা কাঁঠালচাপা অন্ধকার। জানালার ফাঁক দিয়ে মেঘলা রোদের মতো নরম আলো ফুটেছে। আজকে পূর্ণিমা! ঘোরের মাঝে কিনা খেয়ালই করলাম না। এই চাঁদপাপের প্রায়শ্চিত্ত কিভাবে করা যায়? চোর নয়, অতিউৎসাহী কোনো প্রতিবেশীর কাছ থেকে নিজেকে লুকানোর উদ্দেশ্যে দরজা আটকে দিলাম। অবশ্য অনর্থক। তারা নিশ্চয়ই এতক্ষণে লুকিয়ে গেছে। শহরে এখন আমরা সবাই সবার কাছ থেকে লুকিয়ে থাকি।

জীবনটা হয়ত একটা লুকোচুরি খেলা যেখানে কেউ কাউকে খুঁজি না আমরা। এমনকি নিজের সাথেও কখনো আচমকা দেখা হয়ে গেলে বড় বিব্রতবোধ করি। অপরাধীর মতো পাশ কাটিয়ে যেতে চাই। আমরা তখন একে অপরকে না দেখার ভান করি।

ঘরটা অন্ধকারই থাকুক। চাঁদের তরল আলো জানালার ফাঁক বেয়ে কালো মেঝেতে গড়িয়ে পড়ছে আর জোছনা খেয়ে খেয়ে অন্ধকারটা রক্তচোষা লালচে মশার মতো টসটস করছে।

কিছুদিন আগে অবশ্য এরকম ছিলো না। বেল বাজলেই ইরা এসে দরজা খুলে দিতো। ফ্লুরোসেন্ট বাতির অত্যাচারে অন্ধকাররা তখন দরজার আড়ালে, স্টোররুমের পেছনে কিংবা বারান্দার গ্রিলের কাছে মন খারাপ করে বসে থাকতো। এখন ইরা নেই, অন্ধকার আছে। ইরার অনুপস্থিতিতে তাই অন্ধকারদের আনন্দে আর বাধা দিলাম না। সোজা বারান্দায় চলে এলাম। পুরো পৃথিবী যেন সাইলেন্ট মুডে চলে গেছে। শুধু দূরের একটা অন্ধ কুকুর ব্যাপারটা ঠিকঠাক বুঝতে না পেরে নাকিসুরে কান্নার মতো করছে। আকাশটা বিষণ্ণ- পূর্ণিমার আকাশে বোধহয় তারা থাকে না।

কতদিন হলো ইরা চলে গেছে? একলক্ষ বছর? কতদিন হলো ইরা নেই? একদিন? নাকি উল্টোটা। এসব নিয়ে আজকাল ভাবতে ইচ্ছে করে না। সব প্রশ্নের যেমন উত্তর হয় না, তেমনি সব উত্তরও সবসময় উত্তর দেয় না, এ কথাটা এতো দিনে আমি জেনে গেছি।

সিগারেটটা জ্বালাতে গিয়ে দেখি আগুন নেই। এ পকেট-ও পকেট হাতড়াই। নেই। আবার হারিয়ে ফেলেছি। লাইটার হারাতাম বলে এখন দিয়াশলাই নিয়ে ঘুরি। তাতে হারানোর ক্ষতি কম। হারানোটাই যখন নিয়তি, তখন কম লোকসানইতো একপ্রকারের লাভ। ঘরের টেবিলের উপর একটা ম্যাচ থাকার কথা। কিন্তু উঠতে ইচ্ছা করছে না।

ইদানিং বড্ড অলস হয়ে গেছি। কোনো কিছু মনে থাকতে চায় না। মাঝে মাঝে মনে হয়- মন আর আমি হয়ত দু'জন ভিন্ন মানুষ, একটা দেহে আটকা পড়ে গেছি। যা মনে রাখতে চাই, মন তা রাখতে চায় না। আর যা কিছু ভুলে থাকতে চাই, মন সেসব ভোলার কথা বেমালুম ভুলে যায়। সেগুলো মনেই থাকে, ঘুমায়, গান গায়, চিৎকার করে; কখনো কখনো করুণ সুর তুলে কাহন বাজায়। আজকে মাথায় এতো কথা আসছে কেন। যদি লিখে রাখা যেতো।

এসব নয়-ছয় ভাবতে ভাবতে অন্ধকার হাতড়ে কখন নিজের রুমে চলে এসেছি খেয়াল করিনি। যখন খেয়াল করলাম, নিজের অজান্তেই চমকে যেতে হলো। একটা অতি পরিচিত গন্ধ এসে নাকে ফুলের মতো টোকা দিচ্ছে। কিছুটা অবাক হলাম।

শোবার ঘরটি ডুবে আছে কাঁচা কদমের গন্ধে। খুব পরিচিত একটা সুবাস। এ গন্ধটা আমার খুব পরিচিত আর পছন্দের। ইরার গায়ে নাক ঘষতে ঘষতে এমনই এক তীব্র সুবাসে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলে অন্ধকারে আমি যখন ওকে মৃদুস্বরে 'মার্গারিটা, মার্গারিটা' বলে ডাকতাম, ও কাঁচের চুড়ির মতো টুংটাং করতো।

এমনকি হতে পারে না- ইরা সন্ধ্যায় ফিরে এসেছে। ওর কাছেওতো একটা চাবি থাকতো। নাকি এ সবই আমার অবচেতনের কারসাজি? আমার মনের একটা অংশ ইরাকে প্রত্যাশা করছে বলেই হয়ত হ্যালুশিনেশন হচ্ছে। মনের ছলনাকে ডোপামিনের আশায় উস্কে দিচ্ছে অবিন্যস্ত নিউরন।

লোভীর মতো কদমগন্ধটি বুকের গভীরে নিয়ে জমা করতে গিয়ে এই রাত্তিরে এক দুপুরঘোরে আমার চোখ বুজে আসে। আহ কি তীব্রতা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। তুমি কি চলে গেছ, মার্গারিটা? নাকি কখনো আসোইনি। যদি চলে গিয়ে থাকো, সুখটুকু তোমার আঁচলে বাঁধা পড়ুক। আর যদি না এসে থাকো, আমার রাতটা একটা স্বপ্ন হোক।

সময়ের সাথে সাথে ঘরের অন্ধকারটা হালকা হয়ে আসছে। অন্ধকারে মূর্তির মতো অন্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। হয়ত কান পেতে খুব যত্ন করে দ্বিতীয় একটা নিঃশ্বাসের শব্দ শোনার চেষ্টা করি। কি অপেক্ষা করছে আমার জন্য? একটি নারীমূর্তি; না কিছু নগ্ন শূন্যতা- আরেকটি রাত?

আচ্ছা যদি এমন হয়- এই মুহূর্তে আমি যা চাইবো সেটাই সত্য হবে, তাহলে কি চাই আমি? আমি কি ইরাকে চাই? কাউকে পেলে কি তাকে পাওয়া সম্ভব? মানুষ কি শুধু হারানোর জন্যই পায়? পাওয়ামাত্রই আবার হারাতে থাকে। আমি আর ইরাও কি একটা সময় পর নিজেদের কাছে ধীরে ধীরে অপরিচিত হয়ে উঠিনি? একই ছাদের নিচে, অথচ দু'জনের মাঝে কী নিঃসীম শতবছরের দূরত্ব। যাকে আমি চিনতাম, সেই ইরা হারিয়ে যাচ্ছিলো দিন দিন। ও যাকে চিনতো, সেই আমিও হারাচ্ছিলাম- নিজেকে ও ইরাকে।

ইরা এখন নেই। কিন্তু আমিতো নীরবে ওর মাঝেই ডুবে আছি। আমাদের আগের সময়গুলোর মতো। ইরা যখন ছিলো- কই আমারতো মাঝে মাঝে ওর কথা মনেই থাকতো না। অফিস থেকে রাত করে ফিরতাম। ফোন দেয়ার ইচ্ছে হতো না।

অথচ এখন কেউ একজন যেন দিন-রাত কানে কানে ফিসফিস করে- ইরা নেই, ইরা নেই। ওর কথা আমার সবসময় মনে পড়ে, ওকে নিয়ে কল্পনা করি। রাস্তায় কখনো চলন্ত বাসে কিংবা ফুটপাতে আমাদের দেখা হয়ে গেলে কি হবে তা কল্পনা করে একটা বেদনাময় পুলক জাগে মনে। আমাকে দেখে ওর ঠোঁটগুলো অস্পষ্টভাবে নড়ে উঠবে। কিছু একটা বলতে গিয়েও হয়ত দ্রুত সামলে নেবে। আমিও অপ্রস্তুত হবো, কথা হাতড়াতে হাতড়াতে হাসার চেষ্টা করবো। আমরা দু'জন দু'জনের জন্য বেদনাবোধ করবো, ঘৃণা নয়। শেষে ইরা হয়ত মুখ নিচু করে ফেলবে। 'ভালো থেকো। আসি'। বাস থেমে গেছে। ও নেমে যাচ্ছে। আমার আছে অনেক কথা বলবার। কিন্তু বলা হয় না, হবে না। কোথায় যেন বিঁধে যায়। ঠিক আগের মতোই। ইরাকে ভালোবাসার কথাটি যেভাবে বলতে চেয়েও বলা হয়ে উঠতো না। বুকের কোথাও কাঁটার মতো বিঁধে যেত।

বাতি জ্বালানোর সুইচে হাত রেখেও থমকে গেলাম। আলোতে আমি কি দেখতে চাই- ইরা বিছানায় বসে আছে কপট গম্ভীর মুখে নাকি সব মনের ভুল, শূন্য বিছানা, খাঁ খাঁ?

মার্গারিটা, তুমি জটিল এক ধাঁধা- জানি তোমাকে পেলেই আবার হারিয়ে ফেলতে হবে। তোমাকে পাওয়া মানেই হারিয়ে ফেলা। আমি কি তোমাকে চাই, মার্গারিটা? নাকি আমি তোমাকে চাই?

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা মে, ২০১৭ রাত ৯:৫৩

রোকসানা লেইস বলেছেন: অন্ধকার আর শূন্যতা কেন যে ভালোবাসাময় হয় থাকাটাই কেমন পানসে হয়ে যায়

০৩ রা মে, ২০১৭ রাত ৩:০৮

ইমরান নিলয় বলেছেন: হুম সেটাই

২| ০২ রা মে, ২০১৭ রাত ৯:৫৮

আনিসা নাসরীন বলেছেন: হারিয়ে যাওয়া মানুষ আর ফিরে আসে না।

ভীষণ ভালো লাগা রেখে গেলাম। শুভ কামনা রইলো।

০৩ রা মে, ২০১৭ রাত ৩:০৮

ইমরান নিলয় বলেছেন: ভীষণ ধন্যবাদ। শুভকামনা আপনার জন্যেও।

৩| ০৭ ই মে, ২০১৭ দুপুর ২:৫৭

হাসান মাহবুব বলেছেন: সুন্দর হইছে লেখাটা।

১১ ই মে, ২০১৭ বিকাল ৫:৪৩

ইমরান নিলয় বলেছেন: সেইটাই। এইজন্যই নামটা এমন। যাতে পুরোপুরি লেখা হয়!

ধন্যবাদ হামা ভাই।

৪| ১৯ শে মে, ২০১৭ সকাল ১০:০১

হাতুড়ে লেখক বলেছেন: এটা মিস করলাম কিভাবে!!! B-)

২১ শে মে, ২০১৭ বিকাল ৪:০৮

ইমরান নিলয় বলেছেন: কারণ মিস করাতে একটা আনন্দ আছে! ;)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.