নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইসতিয়াক অয়নের ব্লগ

হাসন রাজায় কয়, আমি কিছু নয় রে আমি কিছু নয় !

ইসতিয়াক অয়ন

আমি কে ? কেউ না ...

ইসতিয়াক অয়ন › বিস্তারিত পোস্টঃ

হিমুর পাশে তিনটি ছায়াঃ পর্ব (২)

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১:১১

কোটের পকেট থেকে খয়েরী রঙের কালো নকশা-কাটা লাইটার বের হল । আমি লাইটারটা নিয়ে ধীরে-সুস্থ্যে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, ‘লাইটারটা তো বেশ ।’

‘আন্দাজ করুন তো লাইটারের দাম কত ?’



এরকম প্রশ্ন কেউ যখন করে তখন বুঝতে হবে লাইটারের দাম হয় আকাশ ছোঁয়া নয়তো পাতালে পোঁতা । আমি আকাশ ছোঁয়া দামই বললাম, ‘চল্লিশ হাজার ।’



ভদ্রলোক যতটুকু বিস্মিত হবার কথা তার থেকে বেশি বিস্মিত হলেন । আমতা আমতা করে বললেন, ‘তুরস্ক থেকে আমার এক বন্ধু পাঠিয়েছিল । সে কোন এক নিলাম থেকে তুর্কী লিরায় নয়শ’ টাকা দিয়ে কিনেছে । অ্যান্টিক জিনিস । বাংলাদেশি টাকায় চল্লিশ হাজার টাকা । আপনি বুঝলেন কিভাবে ?’



আমি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে আমার বিখ্যাত বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী হাসি হাসলাম । সিগারেটের ধুম্রজালের আড়ালে হাসির ছলনা । খলিল সাহেব দার্শনিক ভঙ্গিতে চোখ টিপে বললেন, ‘ভাইজানের ভিতর পাওয়ার আছে ।’

সাদাত রেহমান বললেন, ‘কি পাওয়ার ?’

‘ভাইজানের সামনে বলব না । পরে আপনাকে বৃত্তান্ত বলব । আপনি আমাদের সাথে দুপুরে চারটা খানা খান ?’

‘জ্বি না । চারটায় আমার ফ্লাইট । আমি হিমু সাহেবের সাথে একান্তে কিছু কথা বলে এখনই চলে যাবো । হিমু সাহেব, আপনি কি আমার সাথে একটু বাইরে বের হতে পারবেন ?’



আমি কিছু বলবার আগেই খলিল সাহেব বললেন, ‘ভাইজানের যাওয়া তো অসম্ভব ব্যাপার । কিছুক্ষন আগে তার প্যারালাইসিস হয়েছে । নীচের দিক অবশ । এখন তারে নিয়ে কিভাবে সলিমুল্লায় যাবো সেই টেনশনে আছি ।’

সাদাত সাহেব চমকে উঠে বললেন, ‘কি বলছেন এসব ?’

‘জ্বি ভাইসাহেব । সত্য কথা বলতেছি । হিমু ভাই কামেল আদমী । তাই এখনো নরমাল আছে । নাহলে সাড়ে সর্বনাশ ছিল ।’

‘কিভাবে হল এইসব ?’

‘দুপুরবেলা বারান্দায় দাঁড়ায়ে আছি । হঠাৎ শুনলাম কচকচায়ে একটা শব্দ হল । তারপরই ‘ধুপ’ । কান পেতে বুঝলাম শব্দ আসতেছে হিমু ভাই’র ঘর থেকে । আমি ঢুকে দেখি ঘটনা ঘটে গেছে । খাট আগে থেকেই নড়বড় করত । সেই খাট ভেঙে পড়েছে । আর হিমু ভাইজান ভাঙা খাটের উপর শুয়ে ছড়া পাঠ করতেছে । সে এক দিগ্‌দারি । অত্যন্ত পীড়ার মধ্যে আছি ভাইসাহেব । মেসের সব দায়-দায়িত্ব আমার ঘাড়ে । চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে যাইতেছি । আপনার কিছু বলার থাকলে এইখানেই বলেন । আমি নিচে গিয়ে খাবারের ইন্তেজাম করি ।’



খলিল সাহেব বেরিয়ে গেলেন । আমি শান্ত ভঙ্গিতে বললাম, ‘সাদাত সাহেব, আপনার ঘাবড়ানোর কিছু নেই । আপনি কি কারনে এসেছেন বলুন ।’



সাদাত সাহেব শান্ত তো হলেনই না বরং ব্যস্ত ভঙ্গিতে তার মোবাইল টেলিফোন বের করে টিপাটিপি করতে শুরু করলেন । তার মোবাইলের মাথায় চাবির রিং এর মত একটা চেইন দিয়ে পুতুল ঝোলানো । সেই পুতুলের জামায় লাল-নীল আলো জ্বলছে নিভছে । স্কুল-কলেজের কিশোরী মেয়েরা এগুলি মোবাইলের সাথে লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায় । সাদাত সাহেবের মত একজন কোট টাই পরা লোকের সাথে এই জিনিস যায় না । আমি বললাম, ‘ভাই, কাকে ফোন করছেন ?’



সাদাত সাহেব প্রশ্নের উত্তর দিলেন না । ওপাশ থেকে কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । মিষ্টি রিনরিনে একটা কন্ঠ । সাদাত সাহেব বলছেন, ‘হ্যালো । কি করছো মা ?... ও আচ্ছা । তোমার নাম কি বলতে পারছে ?... আচ্ছা মা, শামসু কি বাসায় আছে ? ... ওকে ফোনটা একটু ধরে দাও তো, ... প্লিজ মা, খুব জরুরী ।’



তিনি থেমে গেলেন । বোঝাই যাচ্ছে সাদাত সাহেব তার মেয়েকে ফোন করেছেন । শামসুকে সম্ভবত পাওয়া গেছে । ‘হ্যাঁ শামসু । শোনো, একটা হুইল চেয়ার কিনে আনো তো ।... কার জন্য সেটা আমি দেখবো ।... আরে বাবা, আমার জন্যেই । তুমি তাড়াতাড়ি হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করো । ... ঠিকানাটা লেখোঃ ৩২/৪ কলাবাগান, পুলিশ কোয়ার্টারের পাশের গলি । হাশেমুদ্দিন সাহেবের মেস । দোতলা । ... হ্যাঁ । এক ঘন্টার মধ্যে কিনে নিয়ে আসো । আমি এখানেই আছি ।’



সাদাত সাহেব ফোন কেটে দিলেন । ভদ্রলোকের ব্যস্ত ভঙ্গিটা দেখতে ভালো লাগছে । আমার যে আসলে প্যারালাইসিস হয় নি এই বিষয়টা চেপে গেলে কেমন হয় ? বিনা পয়সায় নগদ একটা হুইলচেয়ারও পেয়ে যাচ্ছি । মন্দ কি ? তাছাড়া কেন জানি হুইলচেয়ারে চেপে নগর পরিভ্রমন করতেও ইচ্ছে হচ্ছে । গত মাসে বাদলের সাথে ‘ক্রিমিনাল’স মাইন্ড’ বলে একটা ইংরেজী ছবি দেখেছিলাম যেখানে খুনী থাকে প্যারালাইজড । হুইলচেয়ারে বসেই সে সিরিয়াল কিলিং চালায় । তার বাবা ভিকটিমদের ধরে এনে দেয় আর সে খুন করে । বাদল শেষ দিকে এসে বলল, ‘হিমুদা একটা ব্যাপার খেয়াল করেছো ?’

‘কি ব্যাপার ?’

‘ডিরেক্টর খুনের দৃশ্যগুলোকে পুরোপুরি এভয়েড করে গেছে । এটা তো ঠিক না । আমরা এই ছবি দেখছি কিলিং দেখার জন্য । শুধু থ্রিল দেখতে চাইলে তো আমরা ‘মাসুদ রানা এখন বরিশালে’ ধরনের ছবিই দেখতে পারতাম । ঠিক বলেছি না ?’

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, ‘অবশ্যই ঠিক বলেছিস । ‘মাসুদ রানা এখন বরিশালে’ এই ছবিই আমাদের দেখা উচিত । একই সঙ্গে থ্রিল নেয়া এবং বাংলা চলচ্চিত্রের উন্নয়ন । One stone two birds ।’

‘One stone two birds মানে কি ?’

‘এক ঢিলে দুই পাখি ।’

‘ও আচ্ছা । আর একটা জায়গাতেও সমস্যা আছে সেটা খেয়াল করেছো ?’

আমি পা নাচাতে নাচাতে বললাম, ‘খুনীর একটা ড্যান্স শট-ও নেয়া উচিত ছিল, কি বলিস ? আইটেম সং এর মত । সাব মেশিন গান হাতে নিয়ে পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে খুনীর কুংফু-কারাতে টাইপের নাচ । ব্যাকগ্রাউন্ডে গানঃ



“গাছের ডালে কোকিল ডাকে

ডাল-পালার ফাঁকে ফাঁকে

পারবে না, পারবে না তোমরা মারতে আমাকে

উইমা – উইমা

কুহু –কুহু ।”



‘ইংরেজী ছবিতে বাংলা গান থাকবে কিভাবে ?’

‘কথার কথা বলছি । ড্যান্স শট থাকা উচিত ছিল এটা হচ্ছে আসল কথা ।’

‘যে হুইলচেয়ার থেকে উঠতে পারে না সে ড্যান্স করবে ?’

‘হুইলচেয়ারে বসে বসে খুন করতে পারে, আর নাচতে পারবে না ? এখানে অবশ্যি আরেক কাজও করা যেতে পারে । সাব মেশিনগান হাতে ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দে চারপাশ থেকে গোলাগুলি হচ্ছে আর ব্যাটা হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব গুলি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিচ্ছে । ব্যাকগ্রাউন্ডে চলছে গান ।’

‘হিমুদা । তোমার তো ডিরেক্টর হওয়া উচিত ছিল । অসাধারন আইডিয়া । অসাধারন । স্পিলবার্গের মাথাতেও এই আইডিয়া আসা সম্ভব না ।’



বাদল আমার ফুপাতো ভাই । আমার সব আইডিয়াই বাদলের কাছে অসাধারন বলে মনে হয় । সে সম্ভবত আমাকে মহাপুরুষ ভাবে এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে আমার অলৌকিক ক্ষমতা আছে । যদিও আমি সেটা গোপন রাখতে চেষ্টা করি কারন আমি প্রচার চাই না । আমি মহাপুরুষ । আমি যদি বলি, ‘বাদল গরু যে ঘাস খাচ্ছে এতেই তার সব ক্ষুধা মিটে যাচ্ছে । পুষ্টি পাচ্ছে । ক্যালরি পাচ্ছে । ঘাসে এতো কার্বোহাইড্রেট থাকার পরও আমরা কেন ঘাস খাই না, বলতো ?’



বাদল বলবে, ‘হিমুদা অসাধারন । ঘাস হচ্ছে বাংলাদেশের সবচে এভেইলেবল এবং সমৃদ্ধ শস্য । ভাতের বদলে আমাদের এখন থেকে ঘাসই খেতে হবে । এটাই অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমাদের দেশের সবচে বড় হাতিয়ার হবে ।’ শুধু এইটুকু বলেই সে হাল ছেড়ে দেবে না । নিজেই ঘাস খাওয়ার উদ্যোগ নেবে এবং হয়ত ‘ঘাস-ভক্ষন কমিটি’ নামে কোন সংঘও চালু করে দেবে ।



বাদলকে ঠিক বোকা বলা যাবে না । যে ছেলে মেট্রিক, ইন্টারে সব সাবজেক্টে লেটার মার্কস পেয়ে ঢাকা বোর্ডে দ্বিতীয় হয় এবং অনার্সে ফার্মাসি বিভাগ থেকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ডিগ্রী আনতে পারে তাকে সমাজ বোকা বলতে পারে না । এরা মেধাবী পাগল । আইনস্টাইনের মত মানুষকেও তাস দিয়ে চৌদ্দ তলা বিল্ডিং বানিয়ে এই নিয়ে মাতামাতি করেছেন ।



সাদাত সাহেব বললেন, ‘আপনি কি আমার কাঁধে ভর দিয়ে চেয়ারে উঠে বসতে পারবেন ?’

‘জ্বী না । মেঝেতে বসে থাকতেই ভালো লাগছে ।’



আমার এখন ভদ্রলোককে খানিকটা ভড়কে দিতে ইচ্ছে করছে । কিভাবে ভড়কে দেবো বুঝতে পারছি না । আজকাল মানুষের বিস্মিত হবার ক্ষমতা কমে গেছে । আধুনিকতার চরম উৎকর্ষ বিস্ময়-আবেগ বোধ নষ্ট করে দিচ্ছে । আশ্চর্য ! হঠাৎ যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’ জাতীয় ভাববাদী চিন্তা ভাবনা করছি কেন ?



আমি বেশ ফুরফুরে গলায় বললাম, ‘ভাই, শন পাপড়ির ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখবেন ? ন্যাতানো সমুচা খেয়েছি তো । মুখ তিতে হয়ে আছে । কেন জানি হাতের তালুতে শন পাপড়ি রেখে চেটে চেটে খেতে ইচ্ছে করছে । আপনি শামসু ভাইকে ফোন দিয়ে শন পাপড়িও কিনে আনার কথা বলেন । ছোট গুলা না । মিডিয়াম সাইজেরটা ।’



সাদাত সাহেব অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন । তারপর বললেন, ‘আপনার যে বন্ধু ফরেস্টে চাকরী করে খুলনায়, রফিক সাহেব নাম । আমি তার কাছ থেকে আপনার ঠিকানা পেয়েছি । আপনারা টিকাটুলিতে এক মেসে থাকতেন । উনি অবশ্যি আপনার কাছে না আসার পরামর্শই দিয়েছিলেন । আপনি নাকি ভয়ংকর লোক ।’

‘ভয়ংকর মানে কি ? পিশাচ ধরনের কিছু ? জিঙ্গালু জুমলা ?’

‘জিঙ্গালু’টা আবার কি ?’

‘কথার কথা বললাম আর কি । আলিফ লায়লায় দেখেছিলাম । জাহাজের একচোখা এক জাদুকর । কাচের একটা বোতলের ভিতর দুইটা ভুত বন্দী করে রেখেছিল । শিং-ওয়ালা ভুত । বোতলে টোকা দিলেই ভুত দুইটা চিকন গলায় কান্নাকাটি করে । একটার রঙ হলুদ । আরেকটা সাদা ।’

‘কিসের রঙের কথা বলছেন ?’

‘জ্বি - জিঙ্গালু জুমলার ভুতদের গাত্রবর্ণ । একটা হলুদ ভুত , আরেকটা সাদা ভুত ।’

‘ও আচ্ছা ।’



ভদ্রলোক মনে হচ্ছে বেশ হতাশ । এখন তাকে আর সার্কাস দলের খেলোয়ারের মত লাগছে না । মনে হচ্ছে সে Old man and the sea উপন্যাসের হতাশ বুড়ো । বুড়োর চোখে চুরাশি দিন মাছ না পাওয়ার গাঢ় বেদনা । মাথার চকচকে টাক’টা হচ্ছে বুড়োর নৌকার পাল । আর কপালের ভাঁজগুলো হচ্ছে পালের ওপর দেয়া জোড়াতালি । ‘The sail was patched with flour sacks and, furled, it looked like the flag of permanent defeat’



‘হিমু সাহেব ।’

‘জ্বি ।’

‘স্মিথসোনিয়ানের নাম শুনেছেন ?’

আমি বললাম, ‘ভাই আমি হিস্ট্রির ছাত্র ছিলাম না ।’

‘এটা হিস্ট্রি রিলেটেড কিছু না । এটা আমেরিকার অন্যতম বিখ্যাত একটি মান্থলি রিলিজড ম্যাগাজিন । টাইম কিংবা ইকোনোমিস্টের নাম শুনেছেন হয়তো ।’

‘জ্বি । টাইম ম্যাগাজিনের নাম শুনেছি ।’

‘ঐ ধরনেরই জার্নাল । সায়েন্স, আর্টস, নেচার, হিস্ট্রি এগুলো সব মিলিয়েই জার্নাল । এদেশে যদিও অতটা পপুলার না । তবে বাইরে ততটাই প্রতিপত্তি যতটা কিনা টাইম ম্যাগাজিনের । আর বয়সেও প্রায় বাংলাদেশের সমকালীন বলা যায় । ১৯৭০ এ পাবলিশড হয়েছিল প্রথম ।’

‘ভাই, একটা কথা বলি ?’



সাদাত সাহেব এগিয়ে এসে বললেন, ‘বলুন ।’

আমি বেশ রসিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, ‘ঘুম পাচ্ছে ।’

সাদাত সাহেব বললেন, ‘সরি । ইতিহাস বলাটা আমার উদ্দেশ্য ছিল না । আমি স্মিথসোনিয়ানের ‘পিপল এন্ড কালচার’ বিভাগের সম্পাদক । আপনার কাছে এসেছি জার্নালের একটা রিসার্চ প্রজেক্টের ব্যাপারে সাহায্য চাইতে ।’

‘ভাই, আমি অকৃতি অধম । আপনাকে সাহায্য করার মত পড়াশোনা বা ক্ষমতা কোনটাই আমার নাই । বিদায় ।’

‘আমি শুনেছি আপনি ঢাকা শহরের কিছু পাগলদের নিয়ে মিছিল বের করেছিলেন ?’

‘মিছিল ঠিক না । একটা ব্যাপারে পরীক্ষা করেছিলাম ।’

‘কি ব্যাপারে পরীক্ষা জানতে পারি ?’

‘পারেন । আফ্রিকার জুলু আদিবাসীদের মধ্যে একটা মিথ আছে যে, বছরের প্রথম বৃষ্টিতে ভিজলে পাগলামি দূর হয় । ঈশ্বর বৃষ্টির জলে উন্মাদের মানসিক সমস্যা ধুইয়ে দেন ।’

‘বেশ ইন্টারেস্টিং মিথ তো ! জানতাম না ।’

‘হুঁ । মিথটা যাচাই করার জন্য গত বছরের প্রথম বৃষ্টি নামার সাথে সাথে আমি সকালবেলাই দ্রুত একটা ট্রাক ভাড়া করে ফেললাম । ট্রাকভর্তি কদম ফুল । ট্রাকের মাথার উপরে মাইক ফিট করা । মাইকে বাজছে রবীন্দ্র সঙ্গীত, বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, এসো নীপবনে... ইত্যাদি । কিছু পরিচিত পাগলদের রাস্তা থেকে পিক করে নিলাম । এরা বেশ আগ্রহ নিয়েই ট্রাকের চালায় যোগ দিল । বিকেলের দিকে মগবাজার রেল-ক্রসিং এ ট্রেনের জন্য ট্রাফিক সিগন্যাল পড়ল । ট্রাক দাঁড়িয়ে গেল । অঝরে বৃষ্টি পড়ছে । তখন হঠাৎ আমাদের ট্রাক থেকে মনু মিয়া নামের নয়াটোলার এক ভদ্রবেশী পাগল নেমে একটা কদম ফুল হাতে সন্তর্পনে ট্রাফিক পুলিশের কাছে এগিয়ে গেল । পুলিশটি ছাতা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । মনু মিয়া ধীরে ধীরে ট্রাফিকের মুখের সামনে কদম ফুল নিয়ে গিয়ে বলল, ‘খাও ! কদমা খাও !’ পুলিশ যতই সরে, মনু মিয়া ততই জোর করে, ‘খাও না টিয়া পাখি ! একটা কদমা খাও !’ ট্রাফিক পুলিশ মনু মিয়ার পাগলামি ধরতে পেরেছিল কিনা কে জানে, হঠাৎ করে দেখলাম মনু মিয়া আর ট্রাফিকের মধ্যে ব্যাপক ধস্তাধস্তি । কেহ কারে নাহি ছাড়ে – সমানে সমান । সাথে সাথে অন্য পাগলরাও নেমে পড়ল । কিছু সার্জেন্ট পুলিশ দৌড়ে আসলো । তাদেরকেও পাগল দলের প্যাঁদানি খেয়ে বসে পড়তে হল । কিছুক্ষনের মধ্যেই অবশ্যি পুলিশ ভ্যান চলে আসে । টিয়ারশেল ছুঁড়ে পাগল সমেত আমাকে পাকড়াও করে রমনা থানায় চালান করে দেয় । দৈনিক তৃতীয় আলো পত্রিকার লাস্ট পেজে এসেছিল নিউজটা । যদিও তারা ফলস্ কিছু ইন্টারেস্টিং নিউজ’ও এর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল । তাদের মতে, হিমু ওরফে ইয়োলো কিলার নামের জনৈক হলুদ পাঞ্জাবী পড়া ব্যক্তি ছাত্র শিবিরের কুখ্যাত ক্যাডার । রগ কেটে হলুদ পাঞ্জাবীর পকেটে জমা করা তার শখবিশেষ । তার দলের কমবেশি প্রায় সবার মুখেই লম্বা দাড়ি এবং পরনে পাঞ্জাবী । তাদের পুলিশের উপর দলীয় নির্দেশে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে রাজধানীর পরিবেশ নষ্ট করবার জন্যে । ট্রাকের কদম ফুলের স্থুপের নিচ থেকে নাকি পুলিশ ২০০ রাউন্ড গুলি, কিছু অস্ত্র আর পাঁচটি হাতবোমা উদ্ধার করে । পত্রিকার ভাষাও ছিল বেশ মারদাঙ্গা ।’

‘বলেন কি ? তারপর ?’

‘বাদ দেন । আপনি পাগলদের ব্যাপারে এতো আগ্রহ কেন ? এদের নিয়ে রিসার্চ করতে চান ?’

‘আপনি ঠিকই ধরেছেন । আমি রিসার্চ প্রজেক্টের নেইম থ্রো করে এসেছি । কিন্তু কাজ কিছু এগোতে পারছি না । পাগলরা কথা বলতে রাজি হচ্ছে না ।’

‘পাবনায় চলে যান । এদেশে ঐখানেই সস্তায় ভালো পাগল পাওয়া যায় ।’

‘ভাই, আমি নাম আগে থ্রো করায় ঝামেলায় পড়ে গেছি । আমার আর্টিকেলের নাম হচ্ছে ‘hundred mad men throughout thirteen capitals’ । নিউরোলোজীর উপর ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির প্রভাবের এনালিটিকাল লেখা । হাতে আড়াই মাসের মত সময় আছে । এর মধ্যেই জমা দিতে হবে । যত তাড়াতাড়ি আর সহজে লিখতে পারবো ভেবেছিলাম, আসলে তত সহজ হল না । আমি এখন পর্যন্ত মাত্র দশটি পাগলের সাইকোলোজিকাল প্রোফাইল বানাতে পেরেছি ।’

‘সব পাগলই কি রাজধানী ঢাকার ?’

‘ঢাকার কাউকে এখনো পাই নি । চারজন বেইজিং এর, বাকী ছয়জন অটোয়ার । এজন্যই আসলে আপনার কাছে আসা । এক সপ্তাহের মধ্যে আমি ঢাকার উন্মাদদের মানসিক ধ্যান-ধারনার উপর একটা স্কেচধর্মী লেখা দাঁড় করাতে চাই ।’

‘আপনি তো আজকেই ঢাকা ত্যাগ করছেন । এক সপ্তাহও তো আপনার হাতে নেই ।’

‘তা নেই । আমি চারদিনের মধ্যে মিশর থেকে ফেরার চেষ্টা করবো । ততদিনে আমার মেয়ে রুনি প্রাথমিক লেখাটা সাজাবে । সে লেখালেখির ব্যাপারে বেশ দক্ষ । হয়তো আমার চেয়েও বেশি । নিজের মেয়ে বলে বলছি না । ত্রিশ বছরের সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তার নামে সুপারিশ করতে পারি । ইংরেজী সাহিত্যে তার পি.এইচ.ডি আছে । আপনার কাজ হবে তাকে সাহায্য করা ।’

‘এক কাজ করেন । আপনার আর্টিকেলের নাম পরিবর্তন করে ‘twelve mad men throughout twelve capitals’ রেখে দেন । ঢাকা শহর বাদ । মিশর থেকে আর দুইটা পাগল যোগ করে লিখে দেবেন এদের একজন কাঠমুন্ডুর, আরেকজন থিম্পুর । সত্য-মিথ্যার মিশেল না থাকলে কি আর লেখা জমে ?’

‘আপনি তাহলে কাজটা করতে আগ্রহী না ? একটা ভালো অংকের এমাউন্ট আমি অনারিয়াম হিসেবে ভেবে রেখেছিলাম । আমি ভেবেছিলাম আপনি কাজটা নেবেন । রফিক সাহেব বলছিলেন, আপনি নাকি সবসময়ের কর্মহীন লোক । যে কোন কাজ আপনি বিনা পারিশ্রমিকেই করে দেন ।’



আমি বললাম, ‘রফিক সাহেব কে ?’

সাদাত সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনার বন্ধু রফিক সাহেব ।’



আমি রফিক নামের কাউকে মনে করতে পারলাম না । ছেলেবেলায় হাইস্কুলে আমার সঙ্গে এক রফিক পড়ত । তার একটা দাঁত ছিল ভাঙা । চেহারা ছিল ভীতু-ভীতু । যেন এখনি তাকে মার দেয়া হবে । অংকের স্যার ভুলে টিচার্স রুমে বেত ফেলে এসেছেন বলে প্রহার-কার্য শুরু হতে দেরী হচ্ছে । সেই আতংকে সে অস্থির । আমরা তাকে ডাকতাম দাঁতভাঙা রফিক । ইনি নিশ্চয়ই দাঁতভাঙা রফিকের কথা বলছেন না । তিনি যেই রফিকের কথা বলছেন সে সম্ভবত ফরেস্টে চাকরী করে, থাকে খুলনায় । আমি তবুও পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্য বললাম, ‘ভাই, আপনি কি দাঁতভাঙা রফিকের কথা বলছেন ?’

(চলবে)



=========================================

উৎসর্গঃ



রাজশেখর বসুর বাংলা অভিধানে ‘কুম্ভীলক’ শব্দের অর্থ দেয়া আছে- ‘যে অপরের রচিত সাহিত্য হইতে ভাব ভাষা প্রভৃতি চুরি করিয়া নিজের বলিয়া চালায়’ । সেই হিসেবে কালিদাস-কাশীরাম দাস থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সবাই কুম্ভীলক । উদাহরন, কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ কিংবা রবীন্দ্রনাথের ‘কচ ও দেবযানী’ । একই চরিত্র ঘুরে ফিরে অনেকের লেখায় এসেছে । সবটাই সেই আদিশ্লোক-ছন্দের অনুকরনে, নতুন ছন্দে নয় । তবে, রাজশেখর বসু এঁদেরকে plagiarist মানতে রাজী হন নি । তিনি বলেছেন, এঁরা plagiarist এর ঠিক উল্টোটা । যাঁরা অপরের তৈরী চরিত্র নিয়ে লিখেই খুশি । কবিযশঃপ্রাপ্তি এঁদের কারোরই লক্ষ্য ছিল না ।



এতোসব কথার সারমর্ম একটাই । ‘হিমু’কে নিয়ে লিখবার দায়মুক্তি । ফ্রান্সিসকো মেলজি ‘মোনালিসা’র কপি এঁকেছিলেন । ক্যানভাসের সাইজটা বদলে পুরোটাই কপি করা । সেই ছবি দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম, কিন্তু ক্রিটিকরা এর দাম দেন নি । না দেওয়ারই কথা । সৃজনশীলতা এক, নকল করা অন্য । হিমুর স্রষ্টা আজ নেই । তিনি আজ অন্য কোন ভুবনে । আমি তাঁর পদধূলিকণা । তাঁর মত করে কখনই কেউ লিখতে পারবে না । আমিও পারিনি । পারার ইচ্ছাও নেই । অনেকের এই লেখা দেখে সঙ্গত কারনে খারাপ লাগতেই পারে । তাদের কিছু বলবার নেই । অন্যভুবনের জোছনা-পাগল মানুষটির কাছে দায়বদ্ধতা আছে । অন্যের লেখা ‘হিমুর পাশে তিনটি ছায়া’র উৎসর্গপত্রে তাঁর নামটাই থাকুক ।



কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি—

শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।

মাটির প্রদীপ ছিল; সে কহিল, স্বামী,

আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি॥



পরম শ্রদ্ধাষ্পদেষু, হুমায়ূন আহমেদ ।




===========================================



আগের পর্বের লিংকঃ

হিমুর পাশে তিনটি ছায়াঃ পর্ব (১)

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১:৫০

ভিটামিন সি বলেছেন: ভাইরে, যা লিখেছেন না!!! আমার এতোক্ষন মনে হলো যেন হুমায়ুন আহমেদের লেখাই পড়ছি!!!! অসাধারণ লিখেছেন। আমি পড়বো আপনার প্রতিটি লেখা।

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১১:৪৯

ইসতিয়াক অয়ন বলেছেন: অতটা ভালও হয় নাই ভাই । তবু ভাল লাগল জেনে খুশী হলাম । ধন্যবাদ জানুন :)

২| ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:৩৩

মহামহোপাধ্যায় বলেছেন: চমৎকার হচ্ছে। গত পর্বের চেয়ে এই পর্ব আরও বেশি ভাল লাগল। চলুক :)

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১:৫৭

ইসতিয়াক অয়ন বলেছেন: ধন্যবাদ জানুন মহামহোপাধ্যায় !

৩| ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৫৬

সকাল রয় বলেছেন:
ভাঙা খাটের উপরে ছড়া পাঠ!

ভালো লাগছে। সব পর্ব পড়তে পারলে বেশ লাগবে।
আরো লেখা পড়বারআশায রইলাম।

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৫:১৬

ইসতিয়াক অয়ন বলেছেন: :) :)

৪| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:২০

মোঃ ইসহাক খান বলেছেন: হিমু চরিত্রটিকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস। অভিনব চিন্তা, স্বীকার করতেই হয়।

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৫:২০

ইসতিয়াক অয়ন বলেছেন: হিমু চরিত্রটিকে হিমুরাই বাঁচিয়ে রাখবে । আমার বিশ্বাস :)

৫| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:৪৯

আজ আমি কোথাও যাবো না বলেছেন: আমার কাছে ভালো লাগছে পড়তে। :)

১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৩:০৬

ইসতিয়াক অয়ন বলেছেন: ধন্যবাদ !

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.