নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জুবায়ের সুহান

সুহান সুহান

দ্বিধান্বিত

সুহান সুহান › বিস্তারিত পোস্টঃ

জীবন অফিস বাসা-২

২২ শে এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ২:০৬


শফিক অফিসে এক রকম। বাসায় অন্য রকম। খুব মজাদার কোন চরিত্র সে বাকি জগতের কাছে না। তবে সে একেবারেই অন্য চরিত্র নাইমার কাছে। নাইমার কাছেই তাঁর সব পাগলামি। অফিস থেকে মানুষ বাসায় যায় ক্লান্ত হয়ে। শফিক যায় খুশি হয়ে। নাইমার সাথে সময় কাটাতে তাঁর ভালো লাগে। তাঁর নিজেরই বিয়ে করা বউ। তারপরো একটা আদেখলেপনা তাঁর মধ্যে কাজ করে। এর একটা কারণ হতে পারে যে তাঁর বন্ধু বান্ধব কম। সে মুখচোরা স্বভাবের। সহজে মানুষের সাথে মিশতে পারে না। কিন্তু নাইমার সাথে থাকলে তাঁর অন্য একটা সুইচ অন হয়ে যায়। সবারই হয়তো এই সুইচ থাকে। কিন্তু সবাই হয়তো অন করানোর মত কাউকে পায় না।

ঝড়ের দিন এমনিতেই শফিকের খুব পছন্দ। উদাস উদাস ভাব জাগে তাঁর। জগতের প্রতি মায়া আর তুচ্ছতার অনুভূতি তাঁর একইসাথে খুব তীব্রভাবে হয়। কালো কালো মেঘের দিকে তাকিয়ে সে কোথায় কোথায় চলে যায়। রাস্তায় থেমে থেমে দাঁড়ায় সে। তাঁর মনে হয় সে বেশ কিছুক্ষণ রাস্তার পাশেই বসে থাকে। মেঘগুলো আরো কিছুক্ষণ দেখে। রসকষহীন শহরটার চারপাশটাও আকর্ষণীয় লাগে। ঐ তো ঝড়ের বাতাসের মধ্যে দৌড়ে যাচ্ছে ৫-৬টা ছেলে। শফিকেরও খুব ইচ্ছা করতে থাকে ওঁদের সাথে দৌড়াতে। তখনই মনে পড়ে তাঁর নাইমার কথা। দ্রুত পা চালায়। বাসায় ঢুকেই নাইমা-কে মৃদু স্বরে বলে- “নাইমা, খিচুড়ি ডিম হবে?”
নাইমা ধূলা মুছতে মুছতে বলে- “চুলায় বসিয়েছি।“
সাথে সাথে শফিক ভাওয়াইয়া টানে জোরে গেয়ে ওঠে- “ ও আমার লক্ষী বউ রেএএএএএএএএএএএ!!!”
- আহ!!! কি কর!!! আসিয়া আছে না!!! তোমার কি বুদ্ধি সুদ্ধি নাই। যাও গোসলে যাও।
শফিক একটুও অপ্রস্তুত হয় না।
- ওহো আসিয়া আছে তো!!!
সে আবারো ভাওয়াইয়ার টানে- “ ও আসিয়ারেএএএএএএএএ”
নাইমা তখন অসহায় মুখ করে শফিককে মারতে মারতে বলে- “ এ কোন পাগলের সাথে আমার বিয়ে হইসে। আল্লাহ!!! বদ্ধ উন্মাদ।“
এই মারটুকু খাওয়ার জন্যই শফিকের এত পাগলামি।
অন্য ঘরে দশ বছর বয়স্কা আসিয়া ধূলা মুছতে মুছতে হি হি করে হাসতে থাকে। শফিক এরকম প্রায়ই করে।


চাটুকারিতা একটি শিল্প। এই শিল্প কেউ কেউ জন্মগতভাবে পায়। আবার কেউ কেউ দীর্ঘদিন অনুশীলনের মাধ্যমে এই শিল্প আয়ত্ত্ব করে। তবে জীবনে কম সময়ে তুলনামূলক কম পরিশ্রম করে সমাজের কাছে সফল বলে বিবেচিত হওয়ার ব্রহ্মাস্ত্র এটি। এতে বিনিয়োগ করতে হয় শুধু ‘আত্মা’। আমাদের চারপাশে অসংখ্য আত্মাহীন মানুষ ঘুরে বেড়ায়। এরা কেউ ভূত নয় কিন্তু। রক্ত মাংসের মানুষ। খালি এদের আত্মাটা বিকিয়ে গেছে।

মানুষের চাটুকারিতার অনুশীলনের জায়গা হচ্ছে শিক্ষাজীবন। এখানে আধুনিক উজ্জীবিত ছাত্র-ছাত্রীরা আর কোন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করুক বা না করুক। সিনিয়র ভাই-বোন এবং শিক্ষক শিক্ষিকাদের কিভাবে তৈলমর্দন করতে হয়, তা তাঁরা ভালো মতই জানে। আড়ালে হাসাহাসি, গালি আর সামনে প্রসংসার ফুলঝুরি। এর উপর ভিত্তি করেই জীবনে উন্নতির শিখরে পৌঁছানো। যেখানে পৌঁছালে তাঁকেও একদল তৈলমর্দন করবে। যে মর্দনের সুখে ঝিম চলে আসবে। এভাবেই চাটুকারিতার চক্র চলমান থেকে যায়।

শফিক বরাবরই ‘চাটুকারিতা’ বিষয়ে কাঁচা এবং কিছুটা অবুঝও। যে কথা মন থেকে আসে না সে কথা কিভাবে বিশ্বাসযোগ্যভাবে অন্যের সামনে তুলে ধরা যায়!! আমরা তো সবাই অভিনেতা অভিনেত্রী নই। সৃষ্টিকর্তার তৈরি করা ভুবনে হয়তো এ কথা মানা যায়। কিন্তু মানুষের তৈরি এই সমাজে এই ভাবনা অচল।

ম্যানেজার স্যারের পরে এই ডিপার্টমেন্টে সর্বোচ্চ পদে আছেন নীলা ম্যাডাম। নীলা ম্যাডামের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী কাদের স্যার। কারণ উনি নীলা ম্যাডামের জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও চেয়েছিলেন এসোসিয়েট ম্যানেজার হতে। ম্যানেজার স্যারকে অনেক তৈলমর্দনও করেছিলেন। লাভ হয়নি। যাইহোক!!! অফিসের চাটুকাররা মোটামুটি দুটো দলে দ্বিধান্বিত। নীলা ম্যাডাম আর কাদের স্যার। কারণ কাদের স্যার এসোসিয়েট ম্যানেজার না হোক মালিকপক্ষের সাথে তাঁর চেনা পরিচয় আছে। সেদিক থেকে কিছুটা সমীহ সে ম্যানেজার স্যারের কাছ থেকে পায়। তাই চাটুকার দল থাকে অনিশ্চয়তায়। কাদের স্যার নাকি নীলা ম্যাডাম!!

চাটুকার দল ছাড়া যে গুটিকয়েক মানুষ থাকে তাঁদের মাঝে একজন শফিক আর আরেকজন কামাল। যদিও কামাল মাঝে মাঝে শুধু হেসে হেসেও মানুষকে খুশি করতে পারে। হয়তো এমন কিছু বলল যাতে চাটুকারিতাও হয় না আবার শুনতেও বেশ লাগে। সব কিছুর মধ্যেই কামাল এই সূক্ষ্মতার প্রয়োগ ঘটাতে পারে। এতে সুবিধা অসুবিধা উভয়ই হয়। কারণ কেউই কামালের মনের কথা ধরতে পারে না।

অফিস জায়গাটা এমনিতে খুবই নির্দোষ চেহারার। কিন্তু একেকটা অফিস একেকটা নিজস্ব রাজনীতির চরম ক্ষেত্র। এখানে আওয়ামী লীগ বিএনপি থাকুক বা না থাকুক। অফিস বড় হোক আর ছোট হোক। সেটাকে জীবনের চেয়েও বড় করে দেখার একটা প্রবণতা অফিসের সকল কর্মচারীদের মধ্যে থাকে। শফিক সবার মধ্যেই এই প্রবণতা দেখে। শুধু কামাল ছাড়া। এরকম নির্লিপ্ত ভাব থাকার পেছনে যুক্তি হতে পারে যে কামাল অনেক বড়লোক আর নইলে কামালের অন্য ইনকাম সোর্স আছে। শফিক সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করে না। তাই কামালও কিছু জানায় না। শুধু জানে কামালের বিয়ে শফিকের আগে হয়েছে আর কামালের একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান আছে। সে মাঝে মাঝেই তাঁর ছেলের নানা আচরণের কথা বলে অফিসের মানুষদের হাসায়।

তারপরো অফিস জায়গাটা শফিক ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। এখানে সবাই হাসিখুশি। সবারই খুব গলায় গলায় বন্ধুত্ব। আবার কোথায় জানি একটা বিশাল বড় ফাঁকি। আগে তাঁর মনে হত এটা বোধহয় শুধু মহিলাদের অসুবিধা। কিন্তু না, এটা নারী-পুরুষ সবারই বৈশিষ্ট্য। এই তো রেশমা আপা সাবিহা আপাকে একদম দেখতে পারে না। কিন্তু দেখা হলে এরা একজন আরেকজনকে কোলাকুলি না করে কথা বলতে পারে না। আবার কাদের স্যারের বাঁধাধরা চাটুকার ওরফ ডান হাত আজিজ ভাই। ইনিও খুবই ভালো মানুষ। সবার সাথে মধুর ব্যবহার। কাদের স্যারের শার্ট থেকে শুরু করে জুতা হয়ে মোবাইল ফোন পর্যন্ত সবকিছুর প্রশংসা তিনি প্রতিদিন করেন। আবার মাঝে মাঝে এসে কামাল আর শফিককে শুনিয়ে যায়- ‘কাদের স্যার!! কখন যে কাকে বাঁশ দেয় বুঝা মুশকিল ভাইয়েরা!!’ বলে চলে যায়। শফিক কিছু না বুঝে কামালের দিকে তাকায়। কামাল শফিকের চেহারা দেখে হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যায়। বলে- ‘আজিজ ভাই একটা চিজ বটে!!!’ বলে আবার হাসতে থাকে। শফিক কিছুই বোঝে না।

না বুঝলেও খুব একটা চিন্তিত শফিক হয় না। সে তাঁর মত অফিস করে। কাজ করে। বাসায় যায়। খুব অভাব তাঁর নেই। সে ভালো আছে। কিন্তু হঠাৎ করেই একটা পরিবর্তন আসে অফিসে। অনেকদিন ধরেই একটা কথা শোনা যাচ্ছিল। ম্যানেজার স্যার নাকি বেশীদিন এই ডিপার্টমেন্টে নাই। তাও এই কথা শফিকরা বহুদিন ধরেই শুনে আসছে। কিন্তু খবরটা হঠাৎ করেই আসল। ম্যানেজার স্যার অন্য ডিপার্টমেন্টে শিফট হয়েছেন। খুব জলদিই নতুন ম্যানেজার দেয়া হবে শফিকদের ডিপার্টমেন্টে।

নতুন এই খবর কর্মচারীদের মাঝে নতুন উত্তেজনা তৈরি করল। তাহলে কে হবে নতুন ম্যানেজার? নীলা ম্যাডাম? নাকি বাইরে থেকে হেড হান্টিং-এর মাধ্যমে হবে? অন্য কোম্পানীর সাকসেসফুল ম্যানেজার অনেক টাকার অফার পেয়ে এখানে আসবে। নীলা ম্যডাম একজন পরিশ্রমী কর্মী। বেশীরভাগ মহিলা অফিস করে সংসার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। একমাত্র নীলা ম্যাডামই বোধহয় ভালো লাগা থেকে কাজ করেন। তাঁরও একদল স্তাবক আছেন। কোন মানুষ যদি কখনো বলে যে সে অযথা প্রশংসা পাওয়া পছন্দ করে না, তাহলে ধরে নিতে হবে তিনি বিনয় করছেন বা নিজেকে বোঝাচ্ছেন। নীলা ম্যাডামও এই দলে। কিন্তু তিনি কাউকে বেশী সুযোগ দেন না। প্রশংসা গ্রহণ করেন। কাজ করেন। কাজ করান। ম্যানেজার স্যারের চলে যাওয়ার খবরে চাটুকারদের দল হুমড়ি খেয়ে পড়েছে নীলা ম্যাডামের দ্বারে। অনেকে লুকিয়ে। অনেকে লজ্জা পেয়ে পেয়ে। মাঝে মাঝেই ম্যাডামের রুম থেকে শোনা যায়
- ম্যাডাম!! আমার সবসময়ই মনে হয় আপনিই একজন আদর্শ ম্যানেজার। আগের ম্যানেজার স্যারের সেই ব্যক্তিত্বই ছিল না। সিদ্ধান্ত নেয়ার একটা সহজাত ক্ষমতা আপনার মাঝে আছে।
অথবা
- ম্যাডাম!! আমি সবসময়ই আপনার কাজের ধরন পছন্দ করি। কোন ভুজুং ভাজুং না। শুধু কাজের মধ্যে থাকতে হবে।
অনেকে আবার একটু সরেস।
- ম্যাডাম!!! ম্যানেজার মানেই সবাই টেকো মোটা লোকদের কথা ভাবে। (ইঙ্গিত আগের ম্যানেজার যিনি টেকো এবং কাদের স্যার-কে যিনি টেকো এবং মোটা।) । এইবার আমরা এমন একজন ম্যানেজার পাবো যিনি ড্যাসিং এবং এট্ট্রাক্টিভ। যিনি শুধু রূপে নয় গুণেও অননীয়।
কাদের স্যারের চাটুকার দল কিছুটা সংখ্যায় কমে এসেছে। যারা আছে তাঁরাও লুকিয়ে লুকিয়ে নীলা ম্যাডামের সাথে সাক্ষাত করে আসে নিয়মিত।

সপ্তাহখানেক পরে ডিপার্টমেন্টে চিঠি আসল। নতুন কাউকে আনা হয়নি। ডিপার্টমেন্ট থেকেই নেয়া হয়েছে নতুন ম্যানেজার। তিনি আর কেউ নন। কাদের স্যার।

(চলবে)
পর্ব-১ Click This Link পর্ব ৩ Click This Link

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.