নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জুবায়ের সুহান

সুহান সুহান

দ্বিধান্বিত

সুহান সুহান › বিস্তারিত পোস্টঃ

জীবন অফিস বাসা-৬

২৬ শে মে, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৩৯

১১

অবশেষে নাইমার জেদেরই জয় হল। নাইমার মা-ই নাইমাদের বাসায় এসে উঠল। কিন্তু টানা থাকেন না তিনি। তাঁর নিজেরও সংসার আছে। সপ্তাহখানেক থেকে রান্না বান্না করে গুছিয়ে দিয়ে নিজের বাড়ি গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসেন। শফিকও কিছুটা নিশ্চিন্ত। কিন্তু এক দিকের চিন্তা দূর হয় তো অন্য দিকের চিন্তা আসে। নাইমাকে ডাক্তার দেখাতে হচ্ছে। প্রথমত শফিক ডাক্তারের কাছে যাওয়া একদম পছন্দ করে না। দ্বিতীয়ত, তাঁর ন্যূনতম ধারণাও নেই কোন ডাক্তার ভালো। নানা মানুষ নানা কথা বলে। বরং, যারা ডাক্তার না তাঁদেরই মেডিকেল নলেজ বেশী বলে মনে হল শফিকের। তাঁর উপর বাচ্চা হওয়া নিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দ্বিধান্বিত প্রশ্ন। বাচ্চা কি নরমালে হবে নাকি সিজারে? এই দুই জিনিসের তফাৎ বুঝতেই শফিকের বহু সময় লেগেছে। এই বিশাল বিশাল প্রেক্ষাপট সামলাতে শফিকের অসহায় অবস্থা।

এদিকে নাইমা যখন একা থাকে তখন আশেপাশের মহিলারা আসে। তাঁরা নানা খাবার বানিয়ে নিয়ে আসে নাইমার জন্য। এই সময়ে মেয়েদের মন দ্রবীভূত থাকে। তাঁরা অল্পেই রাগ করে, আবার খুব অল্পে খুশীও হয়। কেউ আচার আনে। কেউ টক ডাল। আবার কেউ কেউ সাধারণ তরকারীই অল্প করে মশলা কম দিয়ে রেঁধে নিয়ে আসে। কত রকমের গল্প হয় তখন!!!

- ভাবী!!! আপনার কি হবে!!! ছেলে না মেয়ে!!!
জবাবে নাইমা হাসে। বলে- “ এখনো তো জানি না ভাবি। পরের মাসের আলট্রাসনোতে জানা যাবে।“
- আপনার কি ইচ্ছা ভাবী!! আমার জিসান যখন হবে তখন তো আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা ছেলে ছেলে করে পাগল। এদিকে আমি তো ভয়ে মরি। যদি মেয়ে হয়!!! জানেন তো ভাবি!!! আমার হাসবেন্ডরা চার ভাই। ও মেঝ। বিয়ে করেছে আবার সবার পরে। সব ভাইদের বাচ্চা আছে। সব কয়টা মেয়ে। বুঝেন অবস্থা!!! সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার হাজবেন্ডও এমন দুষ্টু যে আল্ট্রাসনোর ডাক্তারকে বলেছে ছেলে না মেয়ে কাউকে জানাতে না। শুধু সে জানবে। এদিকে সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করে ‘ছেলে’ না ‘মেয়ে’ । আমি তো কিছুই জানি না। এটা বললেও কেউ বিশ্বাস করে না। এদিকে আপনার ভাই মানে আমার হাজবেন্ড আর কি!! খালি মিটি মিটি হাসে। বাকি সবাই জিজ্ঞেস করে করে হয়রান। তাও সে বলে না। খালি হাসি। এতে করে সবার ধারণা হল আমার মেয়েই হবে। সবারই মুখ ভার। ছেলে হলে কি আর কেউ লুকায়!!! শেষে যখন জিসান হল। কি যে অবস্থা আমার শ্বশুর বাড়ির লোকদের। আমি বলে বোঝাতে পারব না আপনাদের।
বলতে বলতে ভদ্রমহিলার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নাইমা ঔৎসুক্যের সাথে মহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। নিজের ছেলের কথা বলতে গিয়ে মহিলার চোখের তারা যেভাবে জ্বলে উঠছে। তাঁরও কি এরকম হবে!! তাঁর বাচ্চা হলে!! যদিও জিসানের মত দুষ্টু বাচ্চা এই বিল্ডিং এ আর একটাও নেই। মাঝে মাঝেই সে সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে নিচ থেকে উঠে আসতে থাকা লোকদের গায়ে ‘পিশু’ করে দেয়। তাঁর নিশানা অব্যর্থ। এই নিয়ে যে কত হাউকাউ। কারণ এক বাড়ির খুব মান্যগন্য অতিথির উপরেও জিসান তাঁর অস্ত্র তাক করেছিল। বিচার বসল। বিচারের এক পর্যায়ে জিসানের মা বলল- ‘এইটুকু বাচ্চার পিশুতে তো গন্ধ হয় না। ধুলেই ঠিক হয়ে যায়।‘ বিচারে বসা সকলে বুঝতে পারল বিচার করাটা কতটা অর্থহীন হতে যাচ্ছে। তাঁরা কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে নীরব থেকে যে যার বাসায় চলে গেল।

এরকম আরো কত গল্প যে নাইমা প্রতিদিন শোনে। সিজার আর নরমাল এই নিয়ে চিরন্তন তর্ক বিতর্ক তো রয়েছেই। একজন বললেন- ‘আমি আমার অন্তিকা হওয়ার সময়ই বলেছিলাম আমি এত ব্যথা সহ্য করতে পারব না। আমি সিজার করিয়েছি। এত ঝামেলা ভালো লাগে না। পেইন ওঠার অপেক্ষা। নইলে পানি ভাঙ্গার অপেক্ষা। এত তামশা করবো না বলেই সিজার। আপনিও ঝামেলায় যাবেন না। আগেই বলে দিবেন সিজার। আমাদের মা-খালারা এত এত বাচ্চা দিত পশু পাখির মত। আমরা তো আর পশু পাখি না। আর ওইসব একদমই বাজে কথা যে শরীরে ব্যথা থাকে। ফিগার নষ্ট হয়ে যায়। এগুলা বাজে কথা। দেখেন আমাকে!!!”

তিনি ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখালেন সবাইকে।

সবাই উনাকে ভালো করে দেখে। উনার দেহবল্লরীর সৌন্দর্য নিয়ে কারো কোন সন্দেহ দেখা গেল না। তবে উপস্থিত সবারই নিজের নিজের দেহবল্লরীর জন্য আফসোস হতে লাগল।

এভাবেই চলতে থাকল নাইমার গর্ভবতী জীবন। যখন মহিলাগুলো থাকে, গল্প করে তখন ভালোই লাগে। সময়টা কেটে যায়। ওঁরা চলে গেলেই একটু একা একা লাগে। অথচ প্রেগন্যান্সির আগে এরকম লাগত না। এখন শফিককে সব সময় কাছে রাখতে ইচ্ছা করে। মাঝে মাঝেই অফিসে ফোন করে শফিককে বিরক্ত করে। যদিও শফিক বিরক্ত হয় না। কথা বলে শান্ত স্বরে।

মাঝে মাঝেই শরীর ছেড়ে দেয় নাইমার। তখন খুব অসহায় লাগে। মা কাছে থাকলে ডাকে। না থাকলে আসিয়াকে ডাকে। আর বমি!!! এ হচ্ছে তাঁর নিত্য সঙ্গী। একটা বেলা নেই যখন সে বমি করে না। মাঝে মাঝে কান্না চলে আসে নাইমার। এত কষ্ট হয় নাইমার। সবচেয়ে রাগ হয় যখন কেউ বলে- ‘খেতে হবে, বমি করবা আর খাবা।‘ ইচ্ছা হয় বলতে- বমিটা তো আমি করি। আপনি না।

কিন্তু এরকম কিছু নাইমা বলে না।

১২

মাসের প্রথম মীটিং। মীটিং-এ সবাই আছেন। ম্যানেজার কাদের স্যার, নিয়ামুল হাসান, ইয়াসির আহমেদ এবং হোসেন মুহাম্মাদ পাশাপাশি চেয়ারে বসা। কিছুটা দূরে নীলা ম্যডাম। এখনো তিনি এসোসিয়েট ম্যানেজার হিসেবে আছেন। বাকি সবাই এই পাঁচ জনের দিকে মুখ করা।

প্রত্যেক মীটিং এরই কিছু ধরা বাঁধা নিয়ম নীতি থাকে। যেখানে একই কথা বার বার বলা হয়। আবার সেই একই কথা একেক জন নিজের ভাষায় উত্থাপন করে। এবং বলে- “আমি ম্যানেজার স্যারের কথার সাথে একমত। এবং আরো যোগ করতে চাই যে.........।“ প্রত্যেক অফিসের কর্মচারী এ ধরনের নির্যাতনের ভেতর দিয়ে প্রায়শই যেয়ে থাকেন।
যদিও আগের ম্যানেজার স্যার এর সময়ে মীটিং এরকম সভা টাইপের মীটিং ছিল না। স্যার কিছু কথা বলতেন যা অনানুষ্ঠানিকভাবে। নির্দেশাবলী দিতেন নীলা ম্যাডাম। কারো কোন সাজেশান থাকলে সে কথা বলতে পারত।

কাদের স্যার ম্যানেজার হওয়ার পর মীটিং এর ধারা অনেকটা রাজনৈতিক সভার রূপ ধারণ করেছে। কিন্তু আজকের মীটিং এ ভিন্ন কিছু ঘটল। মীটিং এর শেষে সবার দিকে তাকিয়ে নিয়ামুল হাসান বললেন- আশা করি আমরা ভালোভাবে একসাথে কাজ করব। আপনাদের কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন।

সাধারণত এরকম সময়ে কেউ খুব একটা কথা বলে না। মীটিং শেষ, এতেই সবাই আনন্দিত থাকে। কিন্তু আজকে কেউ একজন হাত তুলল- স্যার আমার একটা কথা ছিল।

সামনের সারির অর্থাৎ কাদের স্যার, ইয়াসির আহমেদ, হুসেন মুহাম্মাদ এবং নীলা ম্যাডাম নিজদের চেয়ার ছেড়ে অর্ধেক উঠে দাঁড়িয়েছেন মীটিং শেষ ধরে নিয়ে। শুধু নিয়ামুল হাসান বসা ছিলেন যেহেতু তিনিই মীটিং শেষ করছিলেন। একজন হাত তোলায় সবাই আবার যার যার সিটে বসল। মীটিং এর সাধারণ কর্মচারীরাও বিরক্ত হয়ে দেখতে চাইল কে এই উজবুক!! সবাই অবাক হয়ে দেখল যে হাত তুলেছে সে কামাল। সবাই খুবই অবাক হল। কারণ কামাল কখনো মীটিং-এ কথা বলে না। সে মীটিং এর বাইরে বেশ উচ্ছল এবং রসিক। কিন্তু মীটিং এ কথা বলে না।

সবাই উৎসুক হয়ে বসল। কামাল বলা শুরু করল- সরি স্যার, আপনাদের শেষ সময়ে একটু বিরক্ত করছি। প্রথমে আমি আমাদের নতুন ম্যানেজমেন্ট বডিতে যারা কাজ করছেন তাঁদের ধন্যবাদ জানাতে চাই। নিঃসন্দেহে ভালো কাজ হচ্ছে। আমি শুধু কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাচ্ছিলাম। প্রথম প্রশ্ন - আগের ম্যানেজার স্যার থাকার সময়ে আমরা কিছু কিছু ‘হাই ভ্যালুড’ প্রজেক্ট পেতাম। সেগুলো এখন কেন পাচ্ছি না? দ্বিতীয় প্রশ্ন- কাদের স্যার ম্যানেজার হওয়ার পর আমাদের প্রজেক্ট টিমের লিডার পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তনটা কিসের ভিত্তিতে করা হচ্ছে? যদি এই দুটো প্রশ্নের উত্তর দিতেন।

পুরো মীটিং রুমে পিন পতন নীরবতা। কেউ খুব একটা নড়াচড়াও করছে না। শফিকও পাথর হয়ে বসে আছে। করল কি এটা কামাল!!! সত্যি সত্যি মীটিং এ এইসব কথা তুলে ফেলল? ওঁর কি আর চাকরি থাকবে? এত বড় ভুল করল ছেলেটা?

এদিকে যাদের দিকে প্রশ্ন তুলে ধরা হয়েছে। তাঁরা বেশ হকচকিয়ে গেছে। প্রস্তুত ছিল না তাঁরা এটার জন্য। শুধু নীলা ম্যাডামের ঠোঁটে হাল্কা হাসি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

চার নেতার কাছে এটা একটা চমক। কারণ যে ত্রাস তাঁরা তৈরি করে রেখেছে সেখান থেকে যে কোন আওয়াজ আসতে পারে তা তাঁরা কল্পনা করেননি। তাঁরা ভেবেছিল তাঁরা যেভাবে খুশি সেভাবে অফিস চালাবে। কেউ টুঁ শব্দটি করবে না। কিন্তু তাঁদের হকচকানো ভাবটা বেশীক্ষণ স্থায়ী হল না। অনেকদিন এই খেলা তাঁরা খেলে আসছেন। হঠাৎ দুএকটা গুলতির ঢিল আসলে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিয়ামুল হাসানই শেষমেস হাল ধরলেন। বললেন- আমরা এখন আর আগের মত ‘হাইলি ভ্যালুড’ প্রজেক্ট পাচ্ছি না। পেলেই আপনাদের মধ্যে ডিস্ট্রিবিউট করা হবে। এতে আমাদের কিছু নতুন রুলস রেগুলেসন অ্যাপ্লাই করা হবে। আর প্রজেক্ট লিডার ব্যাপারটাকে আপনারা এভাবে না দেখে আমরা রোস্টারিং এর মত করে ফেলতে চাচ্ছি। একেক সময় টিমের একেক জন লিডার হবে।

প্রত্যুত্তরে কামাল বলল- কিন্তু স্যার, আমরা জানতে পেরেছি ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ‘হাইলি ভ্যালুড’ প্রজেক্ট আমাদের এখানে এসেছে এবং প্রজেক্ট সাবমিটও হয়ে গেছে।

এবার কাদের স্যার গর্জে উঠলেন- আপনি কি বলতে চান আমরা মিথ্যা বলছি!!!!

সবাই চুপ করে আছে। এরকম মীটিং এই অফিসের কেউ কখনো দেখেনি। প্রত্যেকে উৎকণ্ঠা এবং আনন্দের সাথে সবকিছু লক্ষ্য করছে। সবাই কামালের জন্য একটু মায়াও অনুভব করছে। ছেলেটা এইভাবে কুরবানী হয়ে যাচ্ছে। কি যে দরকার ছিল সাপের লেজে পাড়া দেয়ার!!

কিন্তু কামাল একটুও ভয় না পেয়ে বলল- স্যার, হেড অফিসের রিপোর্টে আমি দেখেছি। যেটা এই মাসের রিপোর্ট।

কাদের স্যার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। নিয়ামুল হাসান থামালেন তাঁকে। ইয়াসির আহমেদ এবং হুসেন মুহাম্মাদ চুপ। তাঁরা বড় দুই জনের কথা মত কাজকর্ম করে। কথা বার্তা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁরা থাকেন না। আবারো নিয়ামুল হাসান হাল ধরলেন- দেখুন!! নিশ্চয়ই কোন কমিউনিকেশন গ্যাপ হয়েছে। নইলে আপনি যেটা বলছেন সেটা হওয়ার কথা না। যাইহোক!! আমাদের সবারই অনেক পেন্ডিং কাজ আছে। আজকের মীটিং এখানেই শেষ।

সারা রুমে হাল্কা গুন গুন আওয়াজ। প্রত্যেকেই তাঁর আশেপাশের মানুষের সাথে কথা বলছে। কেউ কেউ এই তথ্য জানত। আবার কেউ কেউ এত ভয়ে থাকত যে এইসব তথ্য কখনো জানার প্রয়োজন মনে করেনি। সবাই ঘুরে ঘুরে কামালকে দেখছে। এতদিন যাকে তাঁরা নিজেদের একজন বলে ভাবত। আজকে তাঁকে যেন এলিয়েন মনে হচ্ছে।

শফিকও কামালের দিকে তাকিয়ে আছে। কামাল কিন্তু তাঁর সেই চিরাচরিত মিটিমিটি হাসি দিচ্ছে।

পর্ব ১ Click This Link পর্ব ২ Click This Link পর্ব ৩ Click This Link পর্ব-৪ Click This Link পর্ব-৫ Click This Link

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.