নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ছাইয়ের নেই আগুনের ভয়

জুলিয়ান সিদ্দিকী

জগতের সব কাজই আমি পারি না। অনেক কাজে অলস হলেও লিখতে কখনও ক্লান্তি বোধ করি না। এতে করে আমার সময়গুলো ভালো কাটে।

জুলিয়ান সিদ্দিকী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্প- চিপ্পুস

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২৭

ডিম ফুটে যেমন বাচ্চা বের হয়ে আসে তেমনই তাদের দৃষ্টি ফুটে লোভ আর লালসার লালা বের হয়ে আসতে থাকে। মেয়েদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে লেপটে থাকা তাদের লালসা সিক্ত দৃষ্টির আলোয়ান থেকে টপটপ ঝরতে থাকে অদৃশ্য রিরংসার তরল বিন্দু। এতে কী যে আনন্দ আর কী যে প্রাপ্তি তা কেবল তারাই বলতে পারবে। পথিক বা দর্শকের বোধে এসব অর্থবহ হয় না কখনোই। দর্শক শুধু দেখতে পায় তাদের বাইরের বখাটেপনাটুকু। তখন কেউ কেউ হয়তো তাদের জন্মদাতা বা গর্ভধারিণীকে শাপশাপান্ত করে। জন্মের দোষ বাপ-মায়ের চরিত্রের দোষ। আর সে সঙ্গে যোগ হয় মনগড়া আরো কিছু অনুষঙ্গ। এতে অবশ্য বখাটেদের জনক-জননীর কিছু যায় আসে না। তারা তাদের সন্তানের কার্যকলাপ দেখে না, শোনে না। হয়তো বা সে সব নিয়ে তারা মাথাও ঘামায় না।
এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে তন্বী রাস্তাটার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গলির মুখে দাঁড়ানো ছেলেগুলোর দিকে একবার আড় চোখে তাকায়। কিন্তু তার কাছে মনে হলো ছেলেগুলো যেন অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশ কিছুটা গম্ভীর। গতকাল পাশের বাড়ির আন্টির মুখে শুনেছে এই ছেলেগুলোর দলের জনি নামের ছেলেটা ইয়াবা কিনতে গিয়ে গতকাল পুলিসের হাতে ধরা পড়েছে। এতেও হয়তো তাদের মন খারাপ হয়ে থাকতে পারে।
সংবাদটা জানার পর তন্বী ভেবেছিল, লোফারগুলোর দলটা বুঝি এবার ভাঙলো। গলির মুখের আড্ডাটাও হয়তো সময় অসময়ে আর দেখা যাবে না। কিন্তু এখন সে ওদের দেখতে পেয়ে নিজের ভাবনার জন্যে নিজেকেই তিরস্কার করছিল বারবার। আর ভাবছিল এসব অপদার্থের মাঝখান দিয়ে আরো কতকাল যে তাকে আসা যাওয়া করতে হবে সেটা ভবিতব্যই জানে। অবশ্য অন্যের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা যেমন শুনেছে তার নিজের ক্ষেত্রে বলতে গেলে তেমন মন্দ কিছু ঘটেনি। কেবল মন্টু বলে একটি ছেলে একবার পেছন থেকে বলে উঠেছিল, দশজনের ভিত্রে না থাকতে পারলে খবর আছে।
যার যেমন স্বভাব। এদের ভদ্রতা বোধ এতটুকুই। তা ছাড়া তাদের মতো মানুষের কাছে ভদ্রতা আশা করাটাও এক রকম বোকামি ছাড়া কিছু নয়। দিনের কথাবার্তার অর্ধেক অংশই যাদের খিস্তি খেউরে ভরা থাকে, ভদ্রোচিত ভাষাটা শিখবার সময়টা কোথায় তাদের? তারপরও বলা যায় তার নিজের সঙ্গে খুব একটা মন্দ আচরণ করেনি ছেলেগুলো। হতে পারে সঙ্গে তার মা থাকে বলেই ছেলেগুলো খানিকটা সংযত থাকে। কিন্তু মায়ের শরীরটা আজ খুব বেশি খারাপ বলে সংগে আসতে পারেননি। ভয় থাকলেও কিছুটা দুঃসাহসে ভর করেই সে বেরিয়ে পড়েছিল ঘর থেকে। ভেবেছিল পুলিসি ঝামেলার কারণে দলটা গলির মুখ থেকে দূরে থাকবে কিছুদিন।
গলির মুখটার দিকে এগোতেই ছেলেগুলো খানিকটা সমীহের সঙ্গে পথটা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ায়। দলের চিপ্পুস নামের হালকা পাতলা ছেলেটি বলল, আরো সুন্দর কইরা গাইতে হইব তন্বী। কালকেরটা তেমন ভালো হয়নাই। ভোটের চিন্তা করবা না।
তন্বীর আরো একটা নাম আছে। সেটা বুচি। মহল্লার সবাই তার এ নামটা জানে। কিন্তু ছেলেটি তাকে বুচি বললো না দেখে অবাক না হয়ে পারে না। অবশ্য চিপ্পুসের ভালো কোনো নাম আছে কিনা জানা নেই তন্বীর। এ ধরনের বখাটেরা গানটান নিয়ে মাথা ঘামায় এমন ব্যাপারগুলো বিশ্বাস হতে চায় না। তবু তন্বীকে দশজনের ভেতর থাকতে হবে কেন? আর তাতে কী লাভ তাদের?
তন্বীর ইচ্ছে হয় একবার জিজ্ঞেস করে তাদের যে, যারা দিনরাত বখাটেপনা করে বেড়ায়, মেয়েদের নানাভাবে উত্যক্ত করে, গানের মর্ম কি তারা বোঝে? কিন্তু তার আগেই বাপ্পি নামের ছেলেটা বলে ওঠে, আমাগো মহল্লার আকবর দেওয়ান বড় ওস্তাদ। তেনার কাছে গিয়া যদি...
কিন্তু তার কথা শেষ না হতেই বাকি সবাই তাকে ঠেলতে ঠেলতে দেয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে ফেলে। তন্বী সেদিকে আর না তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল, কী বলতে চাচ্ছিল ছেলেটি? আর এতে তার দোষেরই বা কী হলো? অবশ্য বাপ্পির মুখ থেকে শুনতে পারলে বোঝা যেত আসলে কী বলতে চাচ্ছিল সে। তবে তাকে ঠেলে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরবার সময় বাকি ছেলেগুলোর মুখে হাসি ছাড়া রাগ বা আক্রোশের চিহ্ন দেখা যায়নি। তাই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইলো না। তবে আকবর দেওয়ানের নামটা কেমন যেন জেঁকে বসে থাকে তার ভাবনার ভেতর।
কোচিঙে আর স্কুলে যাবার সময় ছোট্ট একটা নোকিয়া সেট ব্যবহারের অনুমতি পায় সে। অন্য সময়গুলোতে ফোন ব্যবহার করে না সে। মা ছাড়া সেটার নাম্বার আর কেউ জান না। অথচ তার ক্লাসের মেয়েদের প্রায় সবার হাতেই টাচ মোবাইল সেট আছে। লুবনা বলে একটি মেয়ের আছে আইফোন। তাকে ছাড়া সবার ফেসবুক আর ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট আছে। এ নিয়ে ক্লাসে কোচিঙে অনেক কথা শুনলেও ঘরে ফিরে মাকে কিছুই জানাতে পারে না সে।
এমনিতেই মা খুব ব্যস্ত মানুষ। তা ছাড়া তার বাবার মৃত্যুর পর তাদের গার্মেন্টস ব্যবসার বাকি চার অংশীদার প্রস্তাব দিয়েছিল যে, তাদের শেয়ারটা যেন বাকি চারজনের কাছে বিক্রি করে দেয়। কিন্তু মা সেটা করেননি। অংশীদারীত্বের নিয়ম অনুযায়ী অফিসের কাজ দেখাশুনা, মিটিঙে উপস্থিত থাকা, বায়ারদের সঙ্গে সব রকম যোগাযোগ রাখা কোনোটাতেই সাহস হারাননি তিনি। ইতিহাসে এম.এ পাশ করা মা কাজের ফাকে ফাকে এম.বি.এ ডিগ্রিটাও করে নিয়েছেন। আজকাল শরীরের কারণে অতটা সময় দিতে পারেন না। ফোনে ফোনেই অনেক কাজ করতে হয় তাকে। অথচ ডাক্তার বলে দিয়েছেন বেশি কথা বলা যাবে না। মায়ের পরে ব্যবসা বুঝে নেবে বলে সে কমার্স নিয়ে পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু মা শুনে বলেছিলেন, সাইন্স নিয়ে পড় মেয়ে। ইন্টারের পর সব সাবজেক্টের দরজা খোলা থাকবে।
হাঁটতে হাঁটতে কখন সুমনাদের বাড়ির সামনে চলে এসেছে বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে যায় তন্বী। অতটা পথ সে একা একা চলে এলো? ঘর থেকে বের হলে ভয়ে বুকটা দুরুদুরু করতে থাকতো। বিশেষ করে বখাটেগুলোর কথা ভেবে শরীর হাত পা কাঁপতে আরম্ভ করতো। অথচ আজ তেমন কিছুই মনে হয়নি তার।
দোতলার বারান্দা থেকে তন্বীকে দেখতে পেয়ে সুমনা বলে উঠলো- এই তন্বী, হারি আপ! স্যার কতক্ষণ ধরে ওয়েট করছেন।
গেট খুলে এক ছুটে সুমনাদের বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে তন্বী। স্যার বা অন্য কারো সামনে তাকে বুচি বলে ডাকে না বলে, মনে মনে সুমনাকে ধন্যবাদ জানায় সে।
এমনিতেও তন্বীর গানের টিচার নেই। কারো কাছে গান শেখেনি সে। তবে গান শুনতে খুব ভালোবাসে। খানিকটা গানপাগলীও বলা যেতে পারে। অবসরে কনে হেডফোন লাগিয়ে গান শোনে বলে সময় মতো নাওয়া-খাওয়াও ভুলে গেছে কতদিন। মাস খানেক আগে মা তার নোটবুকটাও আলমারিতে রেখে তালা দিয়ে দিয়েছেন। আর তখন থেকেই গুনগুন করে গান গাওয়ার অভ্যাস বদলে গিয়ে গলা ছেড়ে গাওয়ার আগ্রহ বেড়ে গেছে। সুমনার মা একদিন বাড়ি ছিলেন না। খালি ঘর পেয়ে দুজনেই খুব হল্লা চিল্লা করছিল। তন্বী গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলে সুমনা অবাক হয়ে বলে উঠেছিল- তুই তো দারুণ গাসরে সোনা!
সঙ্গে সঙ্গে সে লজ্জা পেয়ে বলে উঠেছিল, আরে নাহ, কিছুই হয় না!
আমি কিন্তু সিরিয়াস!
যাহ!
তন্বীর বিশ্বাস হয় না কিছুতেই।
সুমনা আরো জোর দিয়ে বলেছিল, মা তো নিজের কানেই শুনলো।
তখনই সুমনার মা এসে বলেছিলেন, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শুনেছি। গানটা শিখলেই পারতিস।
তন্বী কী বলবে? বলেছিল- বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। মা গৃহিণী হয়েও বাবার অবর্তমানে ব্যবসা শিখতে বাধ্য হয়েছেন। আমারও লক্ষ্য ব্যবসা। গানের সুযোগটা কোথায়? তা ছাড়া মা গান-টান তেমন একটা পছন্দ করেন না।
-তোর মা গান-টান পছন্দ করেন না সেটা বুঝলি কী করে?
ছোটবেলা থেকেই মাকে কখনো গুণগুণ করতে দেখিনি। এমন কি বাথরুমেও না। তার ওপর মাস কয়েক হলো আমার এমপি-থ্রি প্লেয়ারটাও নিজের আলমারিতে তালা দিয়ে রেখেছেন।
-তারপরেই গুণগুণ বাদ দিয়ে গলা ছেড়ে গাইতে আরম্ভ করলি?
পাশ থেকে সুমনা ফোড়ন কাটার মতো বলে ওঠে।
-প্রায় সে রকমই।
সুমনা বলল, দিন কয়েক পরে গানের একটা কম্পিটিশান আছে।
-ক্লোজাপোয়ান?
-আরে নাহ। বাউল গান নিয়ে হবে ওটা।
-বাউলগান তো আমি জানি না।
-আগে অডিশানটা দে।
-বাউলগান ছাড়া অডিশান হবে কী করে?
-অমন দু-চারটা বাউল গান সবাই জানে। তুই ও জানিস।
কি বুঝে তন্বী ফিরে তাকিয়েছিল সুমনার মায়ের দিকে। তিনিও বললেন, একবার দিয়ে দেখ না। কতজন তো গানের গ জানে না, তবু নাম লিখিয়ে আসে। তা ছাড়া আমরা যে বলি তোর গলাটা ভালো, সেটারও একটা পরীক্ষা হয়ে যাবে।
তারপর সুমনাই সব করেছিল। নিজের গানের মাস্টার তালিব স্যারের কাছে তালিমের ব্যবস্থা করেছিল। তিনি তাকে বেশ কয়েকটি বাউল গান শিখিয়েছেন। অডিশনের দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছে গেছে তন্বী। সুমনা নিজে বাদ পড়ে গেলেও তন্বীর সঙ্গে লেগে আছে আঠার মতো।
তন্বী আজ এসেছিল ফাইনাল অডিশনের জন্যে প্রস্তুতি নিতে। কিন্তু সুমনার কাছে শুনতে পেলো যে, তালিব স্যারের কোনো এক আত্মীয় মারা গেছেন। তাই আজ তিনি আসবেন না। মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল তন্বীর। আর তা দেখে সুমনা বলল, চল, আমরা নিজেরাই প্র্যাকটিস করি!
-নাহ, ভালো লাগছে না!
-কিছু একটা তো করতেই হবে। এসেছিস তোকে তো এখনই ছেড়ে দিতে পারি না।
তন্বী বলল, একটা কথা!
-কী?
-গলিতে আড্ডা করা ছেলেগুলোর একজন বলছিল এখানে কোথাও নাকি আকবর দেওয়ান বলে খুব ভালো একজন ওস্তাদ আছেন?
সুমনা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তন্বীর দিকে। তারপর বলে, ওসব বাজে ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে যাস কেন?
-আমি বলিনি। ওদের একজন নিজ থেকেই বলল।
-ওরা বললো আর তুই বিশ্বাস করে ফেললি?
তন্বীর অবিশ্বাসের কিছুই ছিল না। ছেলেগুলো তো সময়-গুণে বেপথু। সঠিক রাস্তা পেলে হয়তো শুদ্ধ হয়ে উঠতে পারতো। সুমনা বিশ্বাস করবে না বা উলটো পালটা কিছু মনে করতে পারে ভেবে চিপ্পুসের নামটা চেপে গেল। এমন কি ভোটের ব্যাপারটাও বললো না। শুধু বলল, আমি যেটা জানতে চেয়েছি তুই জানলে বল আর না জানলে না কর!
সুমনা কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, আমি না জানলে কী হলো, একজন আছে তেমন কেউ থাকলে সে অবশ্যই জানবে।
-কে সে?
তন্বীর আগ্রহ যেন দ্বিগুণ হয়ে যায়।
-দাঁড়া, আগে একটা ফোন করে দেখি!
বলেই সুমনা নিজের ফোন থেকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আকবর দেওয়ান বলে কারো কথা জানিস? আমাদের কাছাকাছি কোথাও থাকে। কোথায়? ঠিকানা বলতে পারবি? তুই চিনিস? বাড়িতেই পাওয়া যাব? আচ্ছা। মাকে আগে বলি।
তারপরই ফোন হাতে নিয়ে মা, মা করে ভেতর ঘরের দিকে ছুটে যায় সুমনা। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলল, চল! শুক্লা আমাদের নিয়ে যাবে বলেছে।
তন্বীর হাত ধরে টানে সুমনা।
শুক্লাকে আগে কখনো দেখেনি তন্বী। তবু তার মনে হচ্ছিল কোথাও যেন দেখেছে তাকে। আর সেটা শুক্লাই মনে করিয়ে দিতেই যেন বলল, তুমি তন্বী না? আমার গলা বসে গেছিল বলে আর যেতে পারিনি।
তন্বীর মনে পড়লো। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। অডিশনে ছিলে। তাই তো বলি, তোমাকে দেখেছি বলে মনে হচ্ছিল কেন!
-দেখ, আমি তোমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছি!
সুমনা হঠাৎ তাদের আলাপের মাঝখানেই বলে ওঠে, আকবর দেওয়ান কেমন রে?
-অনেক গুণী ওস্তাদ। দেশের প্রতিটি জেলায় তার দু একটা শিষ্য পাওয়া যাবেই।
বলবার সময় শুক্লার চোখ দুটো কেমন বড় বড় হয়ে উঠেছিল।
-তাহলে তো অনেক বয়স হয়েছে ভদ্রলোকের।
-বয়স হলে কী হবে, ভুল-শুদ্ধটা কি ধরতে পারবেন না। প্রতিটা স্বর তিনি শুনলেই বলে দিতে পারেন।
-না না, আমি তা বলছি না!
হয়তো কথা শেষ হয় না তন্বীর। শুক্লা বলে ওঠে, গুরুর অনেক বিচ্ছেদ আছে, শুনলে মনটা একেবারে গলে যায়। তেমন কয়েকটি গান আমার কাছে আছে।
আকবর দেওয়ানের বাড়ি সুমনাদের বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। কয়েকটা বাড়ি পরেই একতলা সেমি-পাকা বাড়িটা। মানুষটাকে দেখেই কেমন চেনাচেনা মনে হচ্ছিল তন্বীর কাছে। হয়তো আকবর দেওয়ানও তেমন কিছু ভেবেই বলে ওঠেন, তুমি কে গো আম্মা? মুখটা বড় আপনাপন মনে হইতাছে!
তন্বী কিছু বলার আগেই শুক্লা বলে ওঠে, টিভিতে দেখছেন হনে হয়।
-সেইটা না। মাইয়াটারে দেইখ্যা আমার এক ভক্তের কথা মনে পইড়া গেল। ইটালির একটা ভায়োলিন দিছে আমারে। এখনও কিছুই হয় নাই।
সুমনা বলল, ওদের গার্মেন্টস ব্যবসা। বাবার নাম শাহেদুজ্জামান। বছর পাঁচেক আগে গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেছেন।
আকবর দেওয়ান বললেন, ঝিলের পাড়ের শাহেদুজ্জামানও তো পাঁচ বছর আগে মারা গেছে। বাম হাতে ছয়টা আঙ্গুল আছিল।
-উনিই আমার বাবা।
পাশ থেকে হঠাৎ করেই বলে ওঠে তন্বী।
আকবর দেওয়ান উঠে তন্বীর মাথায় হাত রেখে বললেন, দোয়া করি, অনেক বড় হও। তোমার বাপ গান না গাইলেও সুর-তাল ভালো বুঝতো। তোমার সুর-তাল-গলা সবই ঈশ্বরের দান। বাপের রক্তই তোমারে আগাইয়া নিবো। ভয় পাইও না।
হঠাৎ কী যে হয় তন্বীর, ঝুপ করে বসে পড়ে আকবর দেওয়ানের দু পা ছুঁয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, দোয়া করবেন আরো। যদ্দিন বেঁচে আছেন, তদ্দিন যেন আপনার সুনজরে থাকতে পারি।
-পারবা আম্মা! তয়, লোভে পইড়ো না। মাঝে-মধ্যে আইসা আমারে দুই একটা গান শুনাইও। দোষগুলা কাইটা যাবো।
সেদিনের পর থেকেই বদলে যেতে থাকে তন্বী। হিন্দি আর ইংরেজি গানের ভক্ত ঝুঁকে পড়ে বাউল গানের দিকে। তার এমন আকস্মিক পরিবর্তনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন সুমনার গানের টিচার। অদ্ভুত মেয়েটির কণ্ঠে নিজের গান শুনে ভেজা চোখে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন আকবর দেওয়ান। কিন্তু তা বুঝি আর ধরে রাখা যাবে না। তন্বীর মায়ের শারীরিক অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। ফাইনাল অডিশনে টিকে গেলেও যেন খুশি হতে পারে না তন্বী। ভক্ত আর শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলে, মায়ের অসুস্থতার কারণে হয়তো আর আসতে পারবো না। তবু আমার চেষ্টা থাকবে। সবাই দোয়া করবেন।
পরদিন সকালের দিকে বাড়ির সামনে অনেক মানুষের ভীর আর শোরগোল দেখে ঘাবড়ে যায় তন্বী। কেউ কেউ শ্লোগান দিচ্ছিল, কম্পিটিশন থেকে নাম প্রত্যাহার চলবে না। বাদ পড়ার আগ পর্যন্ত গান থামানো চলবে না। একই কথা নানা রঙে ফেস্টুনে লেখা ছিল।
কী করবে ভেবে পায় না তন্বী। সুমনা আর শুক্লাকে ফোন দিয়ে ব্যাপারটা জানালে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তারা চলে আসে। উপস্থিত লোকজনকে শান্ত করতে চেষ্টা করে। শেষটায় তন্বী নিজেই বের হয়ে লোকজনকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে, মাকে নিয়ে বিদেশে যেতে হতে পারে। তা ছাড়া ঘরে অসুস্থ মা রেখে কী করে সে গান গাইবে? গলা দিয়ে গান বের হবে না।
না না।
প্রতিবাদ ওঠে।
ভীর থেকে একজন মাঝ বয়স্কা মহিলা এগিয়ে এসে বলেন, আমি একজন ডাক্তার। আমি জানি তোমার মায়ের অসুখটা কঠিন। তুমি গান বন্ধ করো না। আমি তোমার মায়ের পাশে থাকবো।
তন্বীর ভীষণ কান্না পায়। এবং সত্যি সত্যি কেঁদেও ফেলে। ঠিক তখনই ভীর ঠেলে বাপ্পি এগিয়ে এসে বলে, জানো, টিভিতে তোমার কথা শুইনা চিপ্পুস হালায় বিষ খাইছে। এখন হাসপাতালে আছে। হালায় ওষুধ খাইতে চায় না। কখন মইরা যায় ঠিক নাই।
উপস্থিত সবার মুখ বাপ্পির দিকে ঘুরে যায়। তন্বীকে চুপ থাকতে দেখে সে আবার বলে, আমিও ঠিক করছি গায়ে কেরোসিন ঢাইলা আগুন দিয়া মরমু। আমরা তো খারাপ পোলাপান। ইভটিজার। আমাগো কথারে কী ভ্যালুজ দিতে চায় না!
-কোন হাসপাতালে আছে চিপ্পুস?
-বাপ্পি চোখ মুছে বলে, ঢাকা মেডিক্যালে।
হঠাৎ পেছন দিকে দু কাঁধে দুটো হাতের চাপ অনুভব করে তন্বী। ফিরে তাকিয়ে দেখে তার মা অস্ফুটে বলছেন, যা। হাসপাতালে। ছেলেটাকে বলবি, গান গাইবি।
তন্বী অবাক হয়ে বলে, কিন্তু মা, তোমার ট্রিটমেন্ট?
-ঢাকাতেই এখন সব আছে। তুই ভাবিস না। যা এক্ষুনি!
তন্বী বাপ্পির হাত ধরে বলে, চলো হাসপাতালে।
তাদের পেছন পেছন সুমনা আর শুক্লা সহ আরো কয়েকজন কিশোর-কিশোরী আসে। চার-পাঁচজন বয়স্ক নারী-পুরুষও দেখা যায়।
খবরটা যেন আগেই পৌঁছে গিয়েছিল হাসপাতালে। দুটি টিভি চ্যানেলের রিপোর্টাররাও উপস্থিত হয়েছে তাদের ক্যামেরা আর লোকজন নিয়ে।
হাতে স্যালাইন আর নাকে নল লাগানো চিপ্পুসের বেডের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই তার মুখে হাসি দেখা যায়। তন্বী চিপ্পুসের মাথায় হাত রেখে বলল, এমন করলি কেন ভাই?
-আমরা তো খারাপ ছেলে। ভালো কোনো কাজে আমাদের ডাকে না কেউ। কিন্তু আমরাও তো চাই আমাদের পাড়ার কেউ ভালো কিছু করলে আমাদেরই সুনাম। লেখাপড়া না ছাড়লে তো তোর সমান সমানই থাকতাম।
-স্কুল ছাড়লি কেন? খারাপ হতে তো কেউ বলেনি তোদের। সবই তো বুঝিস, তবু আজেবাজে জিনিস কেন খাস? ভালো হয়ে যেতে পারিস না?
-ভালো তো হতে চাই, কিন্তু বিশ্বাস করে কেউ পাত্তা দিতে চায় না। মিষ্টি কত ভালো বন্ধু ছিল, সেও এখন কথা বলে না।
-তাই মরে যেতে চাস?
-বাপ্পিও মরে যাবে বলেছে। খারাপ হয়ে বেচে থাকার মানে নেই।
-তোদের মরতে তো কেউ বলছে না!
-তাহলে বল, তোরা আর আমাদের ভয় পাবি না! বলতে বলতে তন্বীর একটি হাত ধরে ফেলে চিপ্পুস। তারপর আবার বলে, তাহলে কথা দে, এলিমিনেশনের আগে গানের প্রোগ্রাম থেকে নাম উইথ-ড্র করবি না!
-তা না হয় করলাম।
বলে, তন্বী চিপ্পুসের পাশে বেডের ওপর বসে পড়ে। তারপর গলার স্বর নামিয়ে আবার বলে, কিন্তু তোরা কি গলির মুখে দাঁড়িয়ে ইভ-টিজিং করেই জীবনটা কাটিয়ে দিবি?
-না। তা চাই না।
-তাহলে?
-তুই আমাদের মহল্লার সেই বুচি হয়ে থাক। আকবর দেওয়ানের মতো গানের পাখি হয়ে থাক।
-তাহলে কি তোরা ভালো হয়ে যাবি?
-হ্যাঁ।
-স্কুলে ঠিকমতো যাবি?
-যাবো।
-রাস্তাঘাটে বাঁদরামো করবি না তো?
-করবো না।
-তাহলে সবার সামনে কথা দিলি কিন্তু!
-দিলাম। জনি ছাড়া পাক। সবাই মিলে আবার তোকে কথা দিতে যাবো। আমাদের পাড়ার সম্মানটা রাখিস।
-চেষ্টা করবো।
আহ, কি শান্তি! বলে, চোখ বোঁজে চিপ্পুস।
এই প্রথম তন্বীর মনে হয় যে, চিপ্পুস, বাপ্পি এখনো পুরোপুরি পচে গলে যায়নি। সমাজ আর পরিবার তাদের প্রতি একটু মনোযোগী হলে তারা ঠিক পথেই থাকতো।
মনেমনে সে চিপ্পুসের ভালো নামটা স্মরণ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে না পেরে বলে ওঠে, চিপ্পুস, তোর ভালো নামটা যেন কী ছিল?
হাসতে হাসতে চিপ্পুস বলে- ভালো নামটাই চিপ্পুস!

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:১৬

কথাকথিকেথিকথন বলেছেন:




দারুণ আশা জাগানিয়া গল্প । প্রথমে পড়ে মনেই হয় নি শেষটা এতো সুন্দর হবে, ভেবেছিলাম কোন খারাপ কিছু ঘটবে । শেষে এসে আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলাম ।

অনেক ভাল লাগলো ।

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:২৮

জুলিয়ান সিদ্দিকী বলেছেন: ধন্যবাদ কথাকথিকেথিকথন। ভালো থাকুন সব সময়।

২| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:৪৯

আহমেদ জী এস বলেছেন: জুলিয়ান সিদ্দিকী ,




একটা মেসেজ দিতে চেয়েছেন গল্পে যে মেসেজটা এই ঘুণেধরা প্রজন্মটার বড় প্রয়োজন ।

গল্পটাকে সুন্দর বলতে এতোটুকু দ্বিধা নেই আমার !

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:১১

জুলিয়ান সিদ্দিকী বলেছেন: ধন্যবাদ আহমেদ জী এস।
ম্যাসেজ তো থাকতেই হবে। নাহলে তো তা কেবল গল্পই থেকে যাবে, সমাজের প্রতিনিধি হবে না। কিন্তু য়ামি তো দেখি কেবল এ প্রজন্ম না, আগের বা পরেরটাতেও ঘুণে ধরেছে।

ভালো থাকুন সব সময়।

৩| ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:৫৪

কথায় লিখি বলেছেন: চিপ্পুস...ভালো লাগল।

২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:৩৪

জুলিয়ান সিদ্দিকী বলেছেন: @কথায় লিখি
ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন সব সময়।

৪| ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:২৪

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
গল্পের নায়িকা (তম্বী) তন্বী নামের
বানানটা এমন হবে হয়তো।
গল্প মোটামুটি!!

২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:৫৫

জুলিয়ান সিদ্দিকী বলেছেন: ধন্যবাদ নূর মোহাম্মদ নূরু।
ঠিক করে দিলাম।
ভালো থাকুন সব সময়।

৫| ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৩৭

রুলীয়াশাইন বলেছেন: ভালো নামটাই চিপ্পুস! অনেক সুন্দর

১৩ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১১:২৭

জুলিয়ান সিদ্দিকী বলেছেন: ধন্যবাদ রুলীয়াশাইন।
ভালো থাকুন সবসময়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.