নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলা অামার তৃষ্ণার জল

কয়েস সামী

i m nothing in this huge world...

কয়েস সামী › বিস্তারিত পোস্টঃ

কী ভাবিয়া মনে এ দুটি নয়নে উথলে নয়নবারি- শেষ পর্ব

০৫ ই আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৫



১৫.
রিয়াদের পাগলামীর জন্য এভাবে ধরা খেতে হবে ভাবিনি। জয়ী মেসেজ দিয়ে এক্ষুনি তাদের বাসায় যেতে বলেছে। উফ! এখন কী যে করি! জয়ী নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছে সব। সে যদি জিজ্ঞেস করে- আবীর ভাইয়া, কেন এ কাজটা করলেন, কী জবাব দেব আমি!
-আমি জানি না। আমি এসব করি নি। আর কেউ করতে পারে। আমি করি নি। সত্যি বলছি। আমি করি নি।
এ কথা বলব? নাকি,
-হু। আমি করেছি। বিয়ে ভেঙেছি তোমার। তুমি আমার সাথে খেলবে আর আমি বসে বসে আঙুল চুষবো, এটা ভাবলে কী করে? বিয়ে ভেঙেছি, বেশ করেছি।
এ কথা বলে সব স্বীকার করে ফেলবো?

সব শুনে জয়ী কি আমাকে গালমন্দ করবে? বিয়ে ভেঙেছি বলে যদি কান্নাকাটি শুরু করে! আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে যেন! উফ! স্ট্যা কুল মি. আবীর। স্ট্যা কুল। কাম, হোয়াট মে কাম। আগে তো জয়ীর সামনে যাই। তারপর ভেবে দেখা যাবে।

জয়ী একবার বলেছিল, আমাকে ব্লু জিন্স আর হলুদ টি শার্টে খুব ভাল লাগে। তাহলে জয়ীর ভাল লাগার পোশাকটাই পরা যাক। আর কখন ওর সাথে দেখা হয়, ঠিক নেই। পোশাক পরা হয়ে গেলে নিজেকে আয়নায় দেখে নিলাম এক ফাঁকে। শেভ করার কি দরকার আছে? নাহ! থাক। সময় নষ্ট হবে।

কলিং বেল টিপতেই জয়ী দরজা খুলে দিল।
-আসো, ভেতরে আসো।
জয়ীকে মোটেও উত্তেজিত বলে মনে হচ্ছে না। কী জানি! এটা হয়তো রাগে ফেটে পড়ার পূর্বের অবস্থা।
-বাসার সবাই কোথায়?
-সবাই বাইরে গেছে। শপিং করতে। ফিরতে দেরী হবে।
-ও।
আমি বসলাম। জয়ীও বসল। ঠিক উল্টো দিকের সোফায়। আমার মুখোমুখি।
সামনে রাখা একটা বই হাতে তুলে নিলাম। ন হন্যতে। বইটা আমার পড়া। তবু হাতে নিলাম। প্রয়োজনে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে বইটা।
পিনপতন নিরবতার মধ্যে কী জানি একটা শব্দ খুব জোরে শোনা যাচ্ছে। ধ্বক..ধ্বক...ধ্বক...হৃদপিন্ডের শব্দ কি চাইলেই বন্ধ করা যায়? মাঝে মাঝে ওটা এতো জোরে শব্দ করে কেন? জয়ী কেন চুপ করে বসে আছে? সে কি আমার দিকে তাকিয়ে আছে? বই থেকে চোখ তুলে তাকালে কি তার রক্ত চক্ষু দেখতে পাবো? ওর অদ্ভুত সুন্দর ঐ চোখগুলোর কি রেগে যাবার ক্ষমতা আছে? জয়ী কি কথা খুঁজে পাচ্ছে না? এতো সময় নিচ্ছে কেন? তাড়াতাড়ি বলে ফেললেই তো হয়। দুঃসময়গুলো কেন যে তাড়াতাড়ি যায় না!
-তুমি হয়তো জেনে গেছো আবীর ভাইয়া, খুব শিগ্গির আমার বিয়ে।
জয়ীর কণ্ঠে উত্তেজনার আভাস নাই। আমি কিছুটা ধাতস্থ হতে পারলাম।
-হু, শুনেছি।
-তোমার সাথে আর হয়তো এমন করে দেখা হবে না।
হঠাৎ করেই হৃদপিন্ডের সেই তবলা বাজানো যেন থেমে গেল। পরিবর্তে বুকের ভেতর কী জানি একটা পদার্থ দলা পাকানো শুরু করল। ক্রমশ গলা দিয়ে তা বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। আমি এ অনুভূতির সাথে খুব পরিচিত। গলায় এসে তা আটকে আছে এখন। আমাকে কিন্তু খুব শান্ত থাকতে হবে। কান্নাকাটি জয়ী একদম পছন্দ করে না। জয়ীর মতে, কান্না নাকি পুরুষদের জন্য নয়।
-আজ তোমাকে ডেকে এনেছি আসলে তোমার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার জন্য।
জয়ী তার কথা বলে চলেছে। আমি বই থেকে চোখ তুলে জয়ীর মুখের দিকে তাকালাম। গলায় আটকে থাকা পদার্থটা হঠাৎ যেন বাষ্প হয়ে উড়ে গেল। তার পরিবর্তে এখন সেখানে জায়গা করে নিল এক রাশ অভিমান। বললাম,
-ইজন্ট ইট টু ফানি?
জয়ী চুপ মেরে গেল। আমি বলতে থাকলাম।
-তুমি আমার সাথে এমন কেন করলে? আজ এ সময়ে এসে তোমার কষ্ট হচ্ছে না? তুমি চলে যাচ্ছ বলে আজ তুমি খুব খুশি, তাই না? আমার কথা একটাবার ভেবে দেখেছো?
-তুমিই বল, করার কিছু কি ছিল আমাদের? নাকি আছে?
-নিশ্চয়ই আছে।
-কই? আমি তো কিছুই দেখি না।
-তুমি দেখবে কেন? তুমি কি আমাকে ভালবাস? কখনো কি বলেছো সে কথা?
-ভালবাসার কথা বলতে হয় না, আবীর ভাইয়া। এটা অনুভবের বিষয়।
-না, বলতে হয়। আমি অন্তর্যামী না। না বললে বুঝবো কী করে?
-তুমি আমার কথাবার্তায় বুঝতে পার নি? আমার কাজে বুঝতে পার নি তুমি? তুমি দেখেছো না, আমার সব খুঁটি-নাটি কাজ তোমাকে করতে বলি?
-হু । করতে বলো। আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমাকে ব্যবহার কর তুমি!
-ছি! এটা তুমি ভাবলে কী করে?
-জানি, জানি। আমি সব জানি। মেয়েরা এমন করে ছেলেদের দিয়ে সব কাজ করিয়ে নেয়। সব মেয়েই স্বার্থপর।
-তোমার মনে আছে কি না জানি না। আমি তোমার খাওয়া চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছিলাম।
-সে তুমি ভুল করে দিয়েছিলে।
-না, ওটা ভুল ছিল না। তাছাড়া তোমার পাশাপাশি বসার জন্য আমি ইচ্ছে করে তোমাকে নিয়ে কয়েকবার আমার ফুপুর বাড়ি গিয়েছিলাম।
-তোমাকে এসকর্ট করে নিয়ে যাবার জন্য আর কাউকে পাও নি বলে আমাকে নিয়েছিলে।
-এটাও তোমার ভুল ধারণা। আমি প্রায়ই তোমার সম্পর্কে নানা ধরনের মন্তব্য করেছি, যাতে তুমি বুঝতে পার আমার দুর্বলতার কথা।
-ওগুলো ছিল মন ভুলানো কথা।
-এই সেদিনও আমি একটা বইয়ের জন্য তোমাকে বলেছিলাম।
-আর ঠিক পরদিনই বলে দিলে বইটা লাগবে না, পেয়ে গেছো!
-ওটা মিথ্যে বলেছিলাম। তোমার পরীক্ষা চলছে এটা আগে জানতাম না। যখন জানতে পারলাম, তখন মনে হল বইটা না পেলে শুধু শুধুু পাগলামি করবে তুমি। তাই মিথ্যে কথা বলেছিলাম যাতে তোমার পরীক্ষার ক্ষতি না হয়।

আমার কন্ঠ রোধ হয়ে আসছে। কী এক অদ্ভুত ভাল লাগায় মনটা পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। জয়ী যে আমায় সত্যি ভালবাসে! আমি শুধু শুধু ভুল ভেবেছি। বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জয়ীর দিকে তাকালাম। তার গভীর কালো চোখ দুটি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলাম। তারা তবু পাকা শিকারীর মতো আমাকে আটকে ফেলল। আমি জানি ও চোখে একবার ডুবে গেলে তা থেকে আর ভেসে বেরুবার সুযোগ নাই। আজ জয়ীর সেই গভীর চোখে একরাশ দুঃখ যেন সাতার কেটে বেড়াচ্ছে। সেই দুঃখ ঘোঁচাতে বললাম,
-চল। পালিয়ে যাই এখান থেকে।
-নেবে আমাকে? তাহলে চল। পালাই। যেখানে থাকলে নিজের মনের মানুষটাকে ধরে রাখা যায় না, সেখানে থেকে কী হবে?
-তাড়াতাড়ি কর। সবাই চলে আসার আগেই।
-দাঁড়াও। আমার ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে আসি।

জয়ী ভেতর রুমে চলে গেল। হঠাৎ কী থেকে কী হয়ে গেল! সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে টের পোলাম। না। ভয়ে না। উত্তেজনা আর আনন্দে। জয়ী তাহলে আমাকে সত্যিই ভালবাসে। আমার আগের ধারণাটা মিথ্যে না তবে। আজ থেকে জয়ী তাহলে আমার। আর দেরী করা যাবে না। সুযোগ একবারই আসে। তাড়াতাড়ি রিয়াদকে কল দিলাম।
-শোন্ রিয়াদ। আমার আর জয়ীর জন্য দূরে কোথাও একটা জায়গা দেখ। কয়েকদিন থাকতে হবে। আর শোন্। কাজী অফিসেও যোগাযোগ কর। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমরা ঠিক আধা ঘন্টার মধ্যে তোদের বাসায় আসছি।
জয়ী ফিরে আসল। আমি মোবাইল রেখে দিলাম। জয়ী ঠিক আগের পোশাকেই আছে। হাতে ব্যাগ বা অন্য কিছু নেই। দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সে। চোখ দুটি ছল ছল করছে। বললাম,
-কী হল? তাড়াতাড়ি কর।
-না, আবীর ভাইয়া। আমি পারব না। আমি পারব না এখান থেকে যেতে। আমি গেলে আমার বাবা-মার কী হবে? কী ভাববে তারা বলতো? যে বাবা আমার হুইল চেয়ারে বসার পর থেকে কখনো কোথাও যান নি। তিনি আজ মনের আনন্দে বিয়ের কেনাকাটা করতে বাইরে গেছেন। ফিরে এসে যদি আমাকে না পান। তাহলে কী করবেন তিনি? কতোটা কষ্ট পাবেন ভেবে দেখেছো? আর আমার মা। তিনিও কী সহ্য করতে পারবেন ব্যাপারটা? না আবীর ভাইয়া, এ আমি পারবো না।

এতো শীতল কণ্ঠে জয়ীর মুখ থেকে কথাগুলো বের হল যে আমি ঠিক ঠিক বুঝে নিলাম এ মতামতের আর কোন অন্যথা হবে না। এখানে স্যাকন্ড থটের কোন সুযোগ নেই। আমার মনটাও যেন হঠাৎ করে স্থির ও শীতল হয়ে গেল। জয়ীর এ ঘোষণার পর আর কী বলার থাকতে পারে সেটাই বুঝলাম না। পুরো রুমটা যেন একটা মরা বাড়িতে পরিণত হল কিছুক্ষণের জন্য। অবশেষে জয়ীই নিরবতা ভাঙল।
-আবীর ভাইয়া, ওমন মুখ গোমড়া করে আছ কেন? একটু স্বাভাবিক হও। দাঁড়াও, তোমাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছি। নিয়ে আসি।
জয়ী ভেতরে গিয়ে ডায়রীটা নিয়ে আসল।
-নাও। এই যে পড়।
আমি পডা শুরু করলাম,

ভয় লাগে
ভয় লাগে
কতো যে ক্ষুদ্র আমি
তোমার ঢেউয়ের আঘাতে যদি মরে যাই
আরে না না বলে তুমি আমায় আশ্বাস দাও
আমি একটু একটু করে আবার এগিয়ে যাই
যদি তুমি আমার ভেতরে জলে জলে ভরে দাও
যদি তুমি আমার শরীরে তোমার চিহ্ন রেখে যাও
সমুদ্র, আমি কি তবে মরে যাবো?
নতুন কোনো কি জীবন পাবো?
তোমার বুকে কি সারাজীবন ভেসে বেড়াবো?
নাকি চিহ্ন ধরে কি কেউ আমাদের চিনে ফেলবে!
নাকি চিহ্ন ধরে কেউ আমাদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেবে!
তুমি কোনো উত্তর দাও না
আমিও কোনো উপায় দেখি না
আসলে তো তোমার কোনো উত্তর নেই
আসলে তো আমার কোনো উপায় নেই
নেই তো নেইই
কিছু না ভেবে তাই
আমি একটু একটু করে তোমার দিকে এগিয়ে যাই
ভিজে যাই ভিজে যাই ভিজে যাই
আমরা কেন মুহূর্তে বাঁচতে পারি না ?
আমরা কি মুহূর্তে বাঁচতে পারি না ?
তবুও নিরুত্তর তোমায় দেখে নিরুপায় আমি আবার পিছিয়ে যাই!
আমাদের মাঝখানে তাই আয়না কথা বলে
আমি আয়নার সামনে দাঁড়াই...

-এ তুমি কী লিখেছো জয়ী? সত্যি কি এটা আমাকে নিয়ে?
-হ্যা, তোমাকে নিয়েই। ভাল লেগেছে?
আমার মনটা যে কী এক অদ্ভুত আনন্দে ভরে গেছে তা তো প্রকাশ করার মতো না। আমি শুধু আমার মাথা নাড়লাম। কিছু কিছু আবেগ আছে যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
জয়ীকে বললাম,
-কবিতাটা আমি চাই। দেবে?
-তোমাকে দেবো না তো কাকে দেবো? এটা তো তোমার। এই নাও।
জয়ী কাগজটা ছিঁড়ে আমার হাতে দিল। যেন বা ওর হৃৎপিন্ডটা বুকের ভেতর থেকে খুলে দিয়ে দিল সে।
আমি বললাম,
-জয়ী একটা অনুরোধ ছিল। রাখবে?
-বলেই দেখ?
-আমাকে একবার নাম ধরে ডাকবে?
জয়ী নিশ্চুপ।
আমি আবার বলি,
-আমাকে নাম ধরে ডাকবে? বল না, প্লিজ বল।
জয়ী মাথা নিচু করে বসে আছে। আমি তার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলাম। সোফায় বসে থাকা জয়ীর হাঁটুর একটু উপরে দুহাত রেখে তার অবনত মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-বল, আবীর।
জয়ী মাথাটা যেন আরো নীচু করল। তারপর বলল,
-আ-বী-র।
-আমার দিকে তাকিয়ে বল।
জয়ী তাকাল আমার দিকে। ওর চোখের ভেতর এখন আরেকটা আমি বসে আছি।
-আবার বল, আবীর।
-আবীর।
-আবার বল জয়ী, আবার বল।
-আবীর।
-আমার কেমন জানি লাগছে জয়ী। আবার বল, বল, আবীর আমি তোমাকে ভালবাসি।
জয়ী কোন কথা বলে না। তাই আমি বলে উঠি,
-বল জয়ী, প্লিজ বল। পায়ে পড়ি তোমার!
-আমি তোমাকে ভালবাসি, আবীর।
উফ! আমার যে কেমন লাগছে! ইচ্ছে হচ্ছে এখনই মরে যাই। এ কথা শুনার পর আমার চাওয়া পাওয়ার আর কিচ্ছু নাই।
-বল জয়ী, বল। এবার বল, আবীর আমি তোমার। কেবলই তোমার।
-আমি তোমার, কেবলই তোমার।
আহ! এ কী শুনলাম আমি! এ কী শুনলাম! কতকাল এ কথা শুনার জন্য অপেক্ষা করছি আমি। জয়ী আমাকে বলছে, আমি তোমার। জয়ী আমার। জয়ী কেবলই আমার।

হঠাৎ যেন স্বপ্নভঙ্গ হল আমার।
নাহ! নাহ! জয়ী তো আমার না। জয়ী তো এই কিছুদিন পরেই আরেকজনকে বিয়ে করে তার হয়ে যাবে। জয়ী বিয়ে করছে আরেকজনকে । আর মুখে বলছে সে আমার। এ যে ডাঁহা মিথ্যে কথা। জয়ী মিথ্যেবাদী। জয়ী আমাকে ভালবাসে না। জয়ী কয়েকদিন পরেই আরেকজনের হয়ে যাবে। না। না। এ আমি কিছুতেই হতে দেব না। আমার বুকে এতো ব্যাথা করছে কেন?
-জয়ী, তুমি মিথ্যে কথা বলছো। তোমার মিথ্যে কথা শুনে এই দেখো, এই দেখো এ বুকে কতো ব্যাথা শুরু হয়েছে। তুমি কি এ ব্যাথা টের পাও? না। আমার ব্যথা তুমি টের পাবে কেন? তুমি তো টের পাবে ঐ ডাক্তারের হাতে ব্যথা। ঐ ডাক্তার অ্যাক্সিডেন্ট করলে তুমি তার ব্যাথায় কাতর হবে। আজ যদি আমি আ্যাক্সিডেন্ট করতাম? টের পেতে তুমি? টের পেতে? হয়তো জানতেও পারতে না। তুমি যখন অন্যের হয়ে যাবে, তুমি যখন অন্যের ঘরে চলে যাবে, তখন আর মনে পড়বে আমাকে? না। তোমাকে আর কারো ঘরে আমি যেতে দিব না। আমি তোমাকে আর কারো ঘরণী হতে দিবো না। আমি তোমাকে আমার করেই রাখবো। আমি আজ তোমাকে খুন করবো। খুউউন! হাহাহাহাহা। আজ যদি আমি তোমাকে খুন করি তবে সারা জীবন তুমি আমার থাকবে আমার। হাহাহাহা। তোমার শেষ কথাটাই বলবৎ থাকবে এ পৃথিবীতে। হাহাহাহা।
এক মুহুর্তে জয়ীকে তার ওড়না দিয়ে বেঁধে ফেললাম। সারা ঘর খুঁজে কিছু দড়ি পেলাম। জয়ীর হাত-পাও বেঁধে ফেললাম। হাহাহা। জয়ী এখন বন্দী। জয়ী এখন বন্দী আমার হাতে। ঘটনার আকস্মিকতায় জয়ী এতোক্ষণ চুপ করে ছিল। হঠাৎ কেঁদে উঠল।
-আবীর! তুমি এটা কী করছো আবীর! সবাই চলে আসবে এখন। তুমি একটু শান্ত হও প্লিজ। আমাকে ছাড়ো।
-না, আমি তোমাকে ছাড়বো না। আমি মোটেও ছাড়বো না তোমাকে। তোমাকে আমি ঘৃণা করি। আই হেইট ই্উ, জয়ী। আই হেইট ইউ।
-প্লিজ আবীর। বুঝার চেষ্টা কর, প্লিজ। জন্মই আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমরা দুজন আমাদের ভাগ্যের হাতের পুতুল মাত্র। আমরা যা ভাবছি তা অন্যায়। আমার তোমার প্রেম ও বিয়ে দুটোই নিষিদ্ধ। কেবল নিষিদ্ধ না। আমরা বিয়ে করলে আমাদের বাবা-মাও কষ্ট পাবেন। নিজের আনন্দের জন্য তুমি কি তোমার বাবা-মা কে কষ্ট দিতে পারবে? তুমি আমাকে বিয়ে করলে কি তোমার অসুস্থ মা কষ্ট পাবেন না? আমরা তো অন্যদের মতো নই। তুমি কি পারবে এ সমাজ থেকে বেরিয়ে যেতে? প্লিজ আবীর বুঝার চেষ্টা কর। প্লিজ!

আবার বুকের ভেতর থেকে দলা পাকানো কান্না বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। না। এবার আর আটকে রাখলাম না। আজ আমি যা মন চায় করবো। কান্না পেলে কাঁদবো, হাসি পেলে হাসবো, ঘৃণায় বুকটা ভরে গেলে ঘৃণা করবো, ভালবাসতে চাইলে বাসবো। নিজের অনুভূতি গুলোকে আটকে রাখার মধ্যে কোন বাহাদুরি নেই। তা প্রকাশ করাতেই প্রকৃত আনন্দ।

-কেঁদো না আবীর। তুমি একবার ভেবে দেখো আজ আমরা যেমন করে আমাদের পেলাম, তেমন করে কী আর কেউ পাবে কখনো? না আমাকে কেউ পাবে, না তোমাকে। এই যে আমাদের পাওয়াটুকু, এটাই তো সবচে বড় পাওয়া। আর এই যে তোমার প্রতি আমার বা আমার প্রতি তোমার অনুভূতিগুলো, সারাজীবনই তো তা একরকম থাকবে। একে অন্যের কাছে আসলে এই অনুভূতিটা নাও থাকতে পারে। নানা চাওয়া পাওয়ার হিসেবে অন্যদের মতো আমাদের ভালবাসাও হারিয়ে যেতে পারে চিরতরে। প্লিজ বাবু, একটু স্বাভাবিক হও। আমার বাঁধন খুলে দাও। ওরা চলে আসার সময় হয়েছে।

আমি চোখ মুছতে মুছতে জয়ীর বাঁধন সব খুলে দিলাম। জয়ী আবার ভেতর ঘর থেকে কী জানি একটা কৌটা নিয়ে আসল। জিজ্ঞেস করলাম,
-এটা কী?
-এটা সিঁদুর।
-সিঁদুর দিয়ে কী করবে?
-তুমি আমাকে পরিয়ে দেবে।
আমি বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লাম। জয়ী আমাকে এতো ভালবাসে!
-প্লিজ বাবু, না করো না। কেউ দেখবে না। আমি সাথে সাথে মুছে ফেলবো। কেউ জানবে না ।
আমি সিঁদুরটা আঙুলে লাগালাম। আমার হাত কাঁপছে কেন?
-লাগাও বাবু।
জয়ী মেঝেতে বসে আমার দিকে তার মুখটা বাড়িয়ে দিল।
-না জয়ী। এটা আমার করা ঠিক হবে না। তোমার বিয়ে হবার পর, এ ঘটনা তোমাকে কষ্ট দিতে পারে। থাক। তুমি যে এ আমাকে পরাবার অনুমতি দিয়েছো এটাই আমার কাছে অনেক কিছু।
-লাগাবে না বাবু? আমার কিছু হবে না।
-না জয়ী। এটা থাক।
-তাহলে তোমার হাতটা দাও।
জয়ী হাত বাড়িয়ে দিল।
জয়ীর হাত ধরলাম।
কী উষ্ণ তার হাতের পরশ! এ যেন জয়ীর হাত না। আমার হাতের মুঠোয় যেন জয়ীর হৃদয়। জয়ীর হৃদয়টা আমার। আর কী চাই? আমি আজ জানি, জয়ীর সবটুকু ভালবাসা আমার জন্য। জয়ীর শারীরিক সত্ত্বাটাকে আমার অর দরকার নেই তো! শরীর? সে তো সবারই প্রায় একই রকম থাকে। মনটার মধ্যেই না সব পার্থক্য। আমার আর কিছু চাই না । জয়ীর মনটাই সবকিছু।
এভাবে কতোক্ষণ হাত ধরেছিলাম জানি না। হঠাৎ জয়ী বলে উঠল,
-হায় হায় । সন্ধ্যা হয়ে গেছে দেখছি। ওরা সবাই চলে আসবে। আর না।
এতোক্ষণ আমার সামনেই মেঝেতে বসা ছিল জয়ী। উঠে দাঁড়ালো। আমিও দাঁড়ালাম।
-যাও বাবু। ভাল থেকো।
-যাই তবে।
-আর হ্যা। এক মিনিট।
-কী?
-আর আমার বিয়ে ভাঙার চেষ্টা কর না, বাবু। ও কাজ তোমার সাথে যায় না ঠিক।

মুহুর্তে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। আমি তবে জয়ীর কাছে ধরা পড়ে গেলাম! ছি ছি ছি! জয়ী আমাকে নিয়ে কী ভাবছে কি জানি।
-ভয় পেয়ো না। আমি কিন্তু রাগ করি নি। ব্যাপারটা জানতে পেরেই তোমাকে ডেকে এনেছি। আমার মনে হচ্ছিল, তুমি আমাকে ভুল ভাবছো। তাই ভুল বুঝো না, প্লিজ।
জয়ীর মতো মানুষই হয় না আসলে। আমার এমন কাজেও রেগে যায় নি সে। এজন্যই জয়ীকে আমার এতো ভাল লাগে। জয়ীকে জিজ্ঞেস করলাম,
-কী করে বুঝলে ব্যাপারটা?
-উনি আমাকে মেসেজগুলো পাঠিয়েছিলেন। ওখানে ছোট্ট একটা ভুল ছিল। ওটা দেখেই বুঝেছি।
জয়ীর হাসি আরো বড় হচ্ছে।
আমার অবাক হওয়া বুঝতে পেরে সে বলল,
দাঁড়াও দেখাচ্ছি।
জয়ী তার মোবাইল নিয়ে আসল। ফেসবুকে লগ ইন করে তা আমার হাতে দিল।
পাভেল রহমান আর জয়ীর কথোপকথন।
পাভেল: এই লক্ষী সোনা, তোমার বিয়েটা কবে জানি?
জয়ী: এই তো। সামনেই আশীর্বাদ।
পাভেল: ও। তোমাকে না খুব মিস করব।
জয়ী: আমিও করবো। কিন্তু করার তো কিছু নেই, তাই না?
পাভেল: হ্যা করার তো আসলেই কিচ্ছু নেই। কেন যে দুজন মিলে এতোদিন প্রেম করলাম, এখন সেটাই বুঝি না।
জয়ী: চলো আমরা পালিয়ে যাই।
পাভেল: না গো না। এটা ঠিক হবে না।
জয়ী: তুমি কি আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে? আমার স্পর্শ ভুলে কি করে থাকবে তুমি?
পাভেল: তুমি কি পারবে আবীরকে ছেড়ে থাকতে?

এইটুকু পড়ে হেসে উঠলাম আমি। হা হা হা। জয়ীও হাসছে।
-এটা কে করেছে বলতো?
-রিয়াদ।
-আমিও তাই ভেবেছিলাম। রিয়াদই হবে। বেচারা! আচ্ছা, যাও তবে। ভাল থেকো কিন্তু।
-তুমিও ভাল থেকো জয়ী, খুব ভাল।

তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়ালাম। বিদায়ের সময় ভালবাসার মানুষকে চোখের পানি দেখাতে নেই।
জয়ীদের বাসা থেকে বের হয়ে এলাম আমি। সারা পৃথিবীটা আমার কাছে কেমন জানি অসার মনে হচ্ছে। এ পৃথিবী, এ জীবন, আমার চারপাশের মানুষজন সবকিছুকেই বড় অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে। জয়ীর কবিতার লাইনগুলি মনে পড়ল-
আমরা কি মুহুর্তে মুহুর্তে বাঁচতে পারি না?
আজকের এই কিছুক্ষণ আগের মুহুর্তগুলোর দ্বারাই যদি আমার জীবনটা সম্পূর্ণ হতো। মানুষ যদি মুহুর্তকাল বেঁচে থাকতো! তাহলে তো আমার আর কোন কষ্ট পেতে হতো না। স্বর্গীয় মুহুর্তে জীবন শুরু, স্বর্গীয় মুহুর্তেই শেষ।
মোবাইল বেজে উঠল। নুসরাত।
স্যরি নুসরাত। আমার জীবনে এখন আর কারো প্রয়োজন নেই। কিচ্ছু প্রয়োজন নেই। কলটা কেটে দিলাম।

পাশের কোন বাড়ি থেকে গান ভেসে আসছে,

কী ভাবিয়া মনে
এ দুটি নয়নে উথলে নয়ন বারি
ওগো সজনী
আমার মন মানে না।
মন যে আমারও মানে না। তাকে তবু মানাতে হয়। নয়নে বারি আসে, তাকে তবু আটকে রাখতে হয়! (সমাপ্ত)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.