নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিরব জ্ঞানী

হুমমম......

নিরব জ্ঞানী › বিস্তারিত পোস্টঃ

একজন টাইপিষ্টের মৃত্যু অথবা একজন সাহিত্যিকের জন্ম

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৫০

বশীরুদ্দিন সাহেবের বয়স সাতাত্তরের কাছাকাছি। তাঁর কেবলই মনে হয় আর বেশি দিন তিনি বাঁচবেন না। সে আশাও তিনি করেন না। স্ত্রী গত হয়েছে আজ প্রায় সাত বছর হতে চললো। সহধর্মীনি ছাড়া তিনি যে এখনও বেঁচে আছেন সে এক বিষ্ময়কর ব্যাপার। যে মানুষটি সংসারের প্রতি ছিলেন প্রচন্ড রকম উদাসীন, যে সংসার স্ত্রী দ্বারা পরিচালিত, সেই সংসারে যদি স্ত্রীই আগে পরলোকে গমন করেন তাহলে তার পরিনতি কি ভয়ানক ব্যাপার বশীরুদ্দিন সাহেবকে দেখলে তা কিছুটা অনুমান করা যায়। ছেলের সংসারে থাকতে তাঁর খুব অসুবিধা হচ্ছে এমন নয়। ছেলের বউ, নাতি নাতনী সকলের কাছ থেকেই তিনি আদর যত্ন পেয়ে থাকেন। সংসারের কাজকর্ম সামলাতে সামলাতে বউমার যখন মেজাজ সপ্তমে থাকে তখন কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ পায় ঠিকই। কিন্তু এটাতো মেনে নিতেই হবে। হাজার হোক এটা তাঁর ছেলের সংসার। কিন্তু মন খুলে কথা বলার তো কেউ থাকতে হবে। প্রায়ই তিনি এদের সাথে কথা বলতে চান, কিন্তু তাঁকে সময় দেওয়ার মত সময় কারো নেই! সকলেই প্রচন্ড ব্যাস্ত থাকে। ছেলে ব্যাবসার কাজে বাইরেই সময় দেয় বেশি, ছেলের বউ তো সংসার সামলাতেই ব্যস্ত। আর নাতি নাতনীর কথা বাদ। যতক্ষণ বাসায় থাকে সারাদিন মোবাইল নামক এক শয়তানের বাক্স নিয়ে পড়ে থাকে।

মোবাইল, কম্পিউটার এসব তিনি দুই চোখে দেখতে পারেন না। এইসব যন্ত্রপাতির জন্যেই তাঁর আজ এই অবস্থা। তিনি ছিলেন একজন টাইপ রাইটার। কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি ব্যায় করেছেন হাইকোর্টেরর সামনে। আহা কি দিন ছিল তাঁদের! মোজাম্মেল, হাসান, তরফদার, লল্টু, মোখলেস তারা আজ কে কোথায় আছে? বেঁচে আছে কিনা কে জানে? প্রতিদিন সকালে বাড়ির বাজার সদাই করে দিয়েই তিনি চলে যেতেন হাইকোর্টের সামনে। একটা ছোট টেবিলে টাইপ রাইটারটি রেখে একটা টুলের উপর বসে পরতেন। সকাল বেলাটা কেটে যেত চা খেয়ে আর গল্প করে। খুব কম লোকই আসতো সকালে টাইপ করাতে। খদ্দেরদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সকালের দিকেই বেশি আসতো। এটা সেটা টাইপ করাতো। তাঁরা একটা ক্রমিক ঠিক করে নিয়েছিলেন। প্রথম টাইপ শুরু করতো তরফদার। বয়সে সেই সবার বড় কিনা! বশীরুদ্দিন সাহেব ছিলেন একদম শেষের দিকে, তাই বেশির ভাগ সকালই তাঁর অলস ভাবে কেটে যেত। দুপূরের পর পর ব্যস্ততা বেড়ে যেত । তখন কারো দিকে তাকানোর ফুরসৎ মিলতো না। সকালের অলস হাত তখন পরিণত হতো যন্ত্রে। খট খটাখট খটাখট- আহা কি মধুর শব্দ।

নব্বই এর দশকের শেষের দিকে হঠাৎই তাদের আয় রুজী কমতে থাকে। আগের মতো আর খদ্দের-দের আনাগোনা নেই। এক সকালে হাসান মুখ কালো করে বলল হাইকোর্টের সামনে প্রেসক্লাব মোড়ে কম বয়স্ক এক ছেলে একটা কম্পিউটার কম্পোজের দোকান বসিয়েছে। সেখানে তিনটি কম্পিউটারে টাইপ করা হয়। তারপরের টুকুন ইতিহাস। ধীরে ধীরে সবাই টাইপ মেশিন ছেড়ে কম্পিউটার শেখা শুরু করল। কেউ নিজে দোকান দিল কেউবা অন্যের দোকানে চাকরী নিয়ে চলে গেল। একমাত্র তিনি আর তরফদার অনেক চেষ্টা করেও কম্পিউটার শিখতে পারলেন না। টিভির মত একটা যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে টাইপ তাঁরা করতে পারলেও কম্পিউটার খোলা, মাউস নাড়ানো, এপ্লিকেশন খোলা এসবের কিছুই তাঁরা দুজন আয়ত্ত করতে পারলেন না। ফলে দুজনেই সকাল থেকে টাইপ মেশিন নিয়ে বসে থাকতেন। কোন কোন দিন এক পৃষ্ঠা টাইপ করারও সুযোগ হত না।

বয়স হয়ে যাওয়াতে কাজকর্ম সবই গুটিয়ে নিয়েছিলেন। ছেলেকে বিয়ে সাদি করিয়ে সংসারের হাল ধরিয়ে দিয়ে দুই বুড়োবুড়ির দিনও কেটে যাচ্ছিল ঠিকমত। কিন্তু হঠাৎ একদিন সুস্থসবল মনোয়ারা তাকে একা ফেলে চলে গেলেন। স্ত্রী বিয়োগের দুঃখ তিনি সামলে নিয়েছিলেন ঠিক কিন্তু বড়ই একা হয়ে গেলেন। একা থাকা বড়ই কষ্টকর। সময় যেন পাগলা খরগোশ থেকে হঠ্যাৎ কচ্ছপের গতি পেল। বহু বছর পর তাই খাটের নিচ থেকে একদিন টাইপ মেশিনটা বের করে তিনি তার একাকীত্ব দূর করার চেষ্টা করেন। যা মন চায় তাই টাইপ করেন। এমনি ভাবে ধীরে ধীরে তিনি গল্প, কবিতা বা ছড়া লেখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু কোন দিন এগুলো তিনি কাউকে পড়তে দিতেন না। কবিতা যেমন তেমন হোক, টাইপ তো তিনি করতে পারছেন। খট খটাখট খটাখট।

একদিন তার ছেলের এক বন্ধু বাড়িতে এসেছিল দাওয়াতে। ছেলের ছোট বেলার বন্ধু তারেক। চেহারাটা তার মনে আছে কিঞ্চিৎ। ছোটবেলায় প্রায়ই তাঁদের বাড়িতে আসতো। অনেকটা দায়িত্ববোধ থেকেই বন্ধুর বুড়ো বাপকে দেখতে তাঁর রুমে আসে। টেবিলের উপর কাগজের স্তুপে অসংখ্য কবিতা, গল্পের ছড়াছড়ি দেখে তারেকের বিষ্ময় আর কাটে না। পরবর্তীতে তিনি জানতে পারেন তারেক কোন একটি পত্রিকার সাহিত্য পাতার সম্পাদক। এর পর থেকে তারেক প্রায়ই আসতো তাঁর কাছে। তাঁর টাইপ করা কাগজগুলো নেড়ে চেড়ে দেখতো। কোন কোন দিন সাথে করে নিয়েও যেত। মাঝে মাঝে পত্রিকায় তাঁর ছাপানো কবিতা দেখিয়ে বলতো বশীর কাকা, আপনার এই কবিতাটি ছাপালাম। দেখে বশীরুদ্দিন যেমন খুশি হতেন তেমন লজ্জাও পেতেন। একদিন তারেক খুব করে ধরল –‘কাকা, এবার একটা উপন্যাস লিখা শুরু করেন’।

‘নারে পাগল। আমি কি আর এসব লিখতে পারি?’

‘পারবেন কাকা, আপনিই পারবেন’।

তারেকের উৎসাহেই একদিন তিনি একটা উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলেন। প্রতিদিন দুপূর সময়টা তিনি বেছে নিতেন টাইপ করার জন্য। বিরামহীন ভাবে তাঁর হাত ঘুরে বেড়াতো পুরোন টাইপ মেশিনে। খট খটাখট খটাখট। কোনদিন দুই ঘন্টা, কোনদিন তিন ঘন্টা- টানা দুবছর।
ইদানিং তার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। সকাল থেকে প্রচন্ড দুর্বল লাগছে। উপন্যাসটা তিনি প্রায় শেষ করে এনেছেন, আর কয়েক পৃষ্ঠা বাকি। অনেকটা অভ্যাস বশেই তিনি কাঁপা কাঁপা হাতে টাইপ মেশিনটা নিয়ে বসলেন।

***

শায়লা মাত্র কাজ কর্ম শেষ করে শ্বশুরকে খাইয়ে নিজের রুমে এসে বিছানায় গা-টা এলিয়ে দিল। এটা তার প্রাত্যাহিক রুটিন। খাওয়া দাওয়া শেষ করে তার একটু না ঘুমালেই নয়। শ্বশুরকে খাইয়ে দিলে পরে তিনি এক মরার টাইপ মেশিন নিয়ে বসেন। বিচ্ছিরি খট খট শব্দে আগে তার ঘুম আসতো না। কিন্তু এখন তার গা সওয়া হয়ে গেছে। বরং টাইপ মেশিনের খটখট শব্দটা নিয়মিত একটা সুরের মতো বাজতে থাকে। সেটা শুনতে শুনতে সে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু আজকের দিনটা একটু অন্য রকম লাগছে কেন? কি যেন একটা নেই নেই। এটা সেটা ভাবতে ভাবতে তার চোখটা প্রায় লেগে যাচ্ছিল এমন সময় সে চমকে উঠে। তাইতো, বাবার ঘর থেকে কোন শব্দ আসছেনা কেন? বাবা কি ঘুমিয়ে গেলেন। এমনটাতো কোনদিন হয়নি। অনেকটা চিন্তিত হয়ে সে শ্বশুরের ঘরে উঁকি দেয়। নিজের অজান্তেই তার বুক চিড়ে একটা আর্তনাদ বেড়িয়ে আসে-‘বাবা......’।

***

বছর খানেক পরঃ

সকালের রোদ গায়ে মেখে তরুন ঔপন্যাসিক তারেক রেহমান বসে আছেন তার বাড়ির বারান্দায়। টেবিলের ওপাশে বসে আছে দেশের এক বিখ্যাত পত্রিকার সাংবাদিক যিনি এসেছেন তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে।

সাংবাদিকঃ ভাইয়া আমরা কি শুরু করতে পারি?

তারেকঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

সাংবাদিকঃ এই বছরের একুশে বই মেলায় অনেক তরুন ঔপন্যাসিকের বই বেড়িয়েছে। তাদের ভিতরে আপনার বই সর্বোচ্চ বিক্রয় হয়েছে। এ সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কি?

তারেকঃ আসলে আমি বেশ ক’বছর যাবৎ লিখালিখি করে আসছি। এটা হয়তোবা আমার প্রতি আমার পাঠকদের ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ।

সাংবাদিকঃ ‘জীবন থেকে নেওয়া’ এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই খুব জীবন্ত। মনে হয় আসলেই জীবন থেকে নেওয়া। আপনি এত নিঁখুত ভাবে কি করে বর্ণনা করলেন?

তারেকঃ আসলে এখানেই লেখকের ক্ষমতা বা কৃতিত্ব।

সাংবাদিকঃ প্রধান চরিত্রের পাশাপাশি অপর একটি চরিত্র এই উপন্যাসে বার বার উঠে এসেছে। বশীর, একজন টাইপিষ্ট। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার চরিত্র ঘটনায় প্রভাব ফেলার মত। এ সম্পর্কে কিছু বলুন।

তারেকঃ ইয়ে... মানে... আসলে...

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:১৩

দীপংকর চন্দ বলেছেন: একজন টাইপিষ্টের মৃত্যু অথবা একজন সাহিত্যিকের জন্ম বিষাদ সৃষ্টি করলো।

অনিঃশেষ শুভকামনা জানবেন।

ভালো থাকবেন। সবসময়।

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ ভোর ৬:২৫

নিরব জ্ঞানী বলেছেন: ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনিও ভাল থাকবেন।

(মাঝে মাঝে লিখার চেষ্টা করি। কিন্তু কেন যেন পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারি না। লেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। :(

কিন্তু দু একটি মন্তব্য বা লেখা ভাল লাগা অনেক অনুপ্রেরণা দেয়। :) )

২| ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ ভোর ৬:২৬

নিরব জ্ঞানী বলেছেন: অগ্নিপাখিকে ধন্যবাদ লিখাটি ভাল লাগার জন্যে :)

৩| ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৫৬

জাহাঙ্গীর.আলম বলেছেন: খটাখট খটাখটই হয়ত জীবনের সায়ন্থ সঙ্গীত ৷নস্টালজিকতার ব্যাপ্তিতে দ্রুত লয় ও শব্দসংখ্যা পূর্ব নির্ধারিত সীমিত লাগল ৷ সমাপ্তিও খানিকটা অনুমেয় ৷
তবে প্রকাশে পরিচ্ছন্নতাবোধ ভাবার মতন ৷

০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:৩১

নিরব জ্ঞানী বলেছেন: মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ ভাইয়া। আসলে খুবই কম লিখি। লিখার চেয়ে পড়তেই আনন্দ পাই বেশি। আপনাদের মন্তব্য লিখার অনুপ্রেরণা যোগায়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.