নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

culture and heritage activiti

কাজী চপল

সংষ্কৃতিকর্মী

কাজী চপল › বিস্তারিত পোস্টঃ

লালন মরলো জল পিপাসায়

১৯ শে মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১:৫৮

ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধক ফকির লালন শাহ ।

লালনকে ক্রমাগত অনুসরণ করতে গেলে এক ধরনের আধ্যাত্মিক মনোভাব তৈরী হয়। অচিন গায়ের অচেনা মানুষ ফকির লালনের পুরো জীবনটাই রহস্যময়। মানুষের প্রথাগত বিশ্বাস, ধর্মমত, প্রেম-প্রার্থনা এবং জীবনের নিগূঢ় পথ পরিক্রমা ঘুরে ঘুরে লালনের গান বয়ে যায় মানবতার ধারায়। তার জীবন সবার মত নয়, তিনি বাস করেন চেনা-অচেনার মাঝামাঝি বন্দরে। লালনকে তাই একদিক থেকে দেখা যায় না, তাকে দেখতে হয় নানান দিক থেকে। সুফিবাদ, বৈষ্ণব সহজিয়া, তান্ত্রিকতা সহ বেশ কিছু দর্শনের সমন্বয়ে প্রবাহিত নদীতে লালন মূলত একাকী রয়ে যায়। নিজের ভিতরে বাস করেন দয়াময়-নিজের ভিতর মজে যায় লালন।

উপমহাদেশে যে বিখ্যাত আধ্যাত্মিক ব্যাক্তিগন মানুষের মাঝে আধ্যাত্মিকতার পরম উপলব্ধি ছড়িয়েছেন যুগে যুগে। সমাজ সংস্কৃতির দিক নির্দেশনা দিয়েছেন তারা বলিষ্ঠভাবে। বাবা হযরত আলাউদ্দিন কালী আল সাবেরী, বাবা আমীর শাহ, বাবা হযরত আল্লাহফ জামী, বাবা নিজাম উদ্দিন আওলিয়া, বাবা মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি, বাবা ফরিদ উদ্দিন, দাতা গঞ্জে বকস, বাবা শেখ ফরিদ, বাবা হযরত বু আলী, বাবা বায়োজীদ বোস্তামী, বাবা আমীর খসরু, শ্রী গৌরাঙ্গ, শ্রী শ্রী নিতাই গৌর, ইমাম গাজ্জালী শমসে তাবরীজ, বুললে শাহ, হাফেজ সিরাজী, মনসুর আল হাল্লাহ, বাবা হযরত কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাজী সহ আরও অসংখ্য সুফি ও আধ্যাত্বিক সাধকগণ যুগে যুগে আলো ছড়িছেন।

তাদেরই উত্তরসূরী বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধক, বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ, তার গানে নিজস্ব দর্শনের বৈশিষ্ট পাই, যা মানবমুক্তির এক নতুনত্তর ধারা হিসেবে সমুজ্জল।
view this link

সময়ের কাল ধরে প্রায় দুই শত বছরের অধিক পূর্বে নিতান্তাই সাধারণ এক অজো পাড়া গাঁয়ের কুটিরে বসে যে মানুষটি সৃষ্টি করেছেন আত্মদর্শন ও মানবতাবাদী এরকম অসংখ্য পদ আর উপহার দিয়েছেন নতুন এক আধ্যাত্বিকতার ও আত্মদর্শনের জগত, তিনি ফকির লালন। পরম তত্ত্বের সন্ধানী লালন ছেউড়িয়ার আখড়াতেই প্রকাশ করেছিলেন তার ঐশি জ্ঞানের দিব্যবানী।

লালনকে অনুসন্ধান করতে গেলে তথ্য উপাত্তের অভাবের যে বিপদে পড়ি আমরা, তা থেকে উত্তরণ ঘটে গুরু শিষ্যের প্রেমভক্তির পরম্পরায়। যা প্রবাহিত হয়ে চলে যুগ যুগান্তরে, দেশ বিদেশের হাজার হাজার ভক্তের কাছে লালন আজো এক রহস্যময় সাধক পুরুষের নাম যিনি শুন্যকে ধারণ করেছেন। শতবছর আগে ১৮৮০ সালের ১৭ই অক্টোবর দেহত্যাগী লালনের একজোড়া গুরুশিষ্যকে ধরে বর্তমানে নেমে এলেই জীবিত বাউলের দেখা মেলে। লালনের ভাবদর্শন গুরুশিষ্য ও পরম্পরায় প্রবাহিত। সে কারনেই গুরুশিষ্যের কার্যকলাপ, তাদের আত্মগত বিশ্বাস, সাধন-ভজন এবং লালনের পদাবলীর মধ্যেই লুকিয়ে আছে লালন দর্শনের নিগূঢ় তত্ত্ব এবং বাউলিয়ানার বিষয় বৃত্তান্ত।

পরম স্বত্ত্বার প্রশস্তি গাইতে গাইতে শুরু হয় বাউল সম্প্রদায়ের আসর সাধুসঙ্গ। প্রার্থনার মাধ্যমে স্রষ্টার কাছে তার আর্জি পেশ করেন। প্রার্থনামূলক অজস্র বাস্তব সঙ্গীতে লালন সাইজীর জ্ঞানের গভীরতা ও সৃষ্টিকর্তার প্রকৃত ও বাস্তব ক্ষমতার অবস্থানেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
দেহতত্বই বাউল সম্প্রদায়ের মূলভিত্তি। দেহই সকল রহস্যের মূল। দেহকে দেখার অর্থ দেহকে পাঠ করা বা আত্মদর্শন করা। আপনাকে জানার মাধ্যমে পরম সত্ত্বার অস্তিত্ব জানা যায়। লালন পরমাত্মকে উপলব্ধি করেছেন আপন অস্তিত্বের মধ্যে এবং বিশ্বাস করেছেন, অস্তিত্বের রহস্য গভীর ভাবে ও একনিষ্ঠভাবে দেখলে, পাঠ করলে ও আত্মদর্শন করলে অচেনার সাথে সংযোগ হতে পারে। তাই সত্য জানা ও পাওয়ার মাঝখানে একমাত্র দেহকেই অবলম্বন করেছেন পরম প্রাপ্তির উদ্দেশ্য সাধনের জন্য।
সাঁইজী লালনের সঙ্গীতে ধর্মীয় সাধনার মূল ধ্যানতত্ত্বে শ্বাস-প্রশ্বাস বা দমের উপর গুরুত্ব রয়েছে। লালন বলেন – ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে…..
দেহে যতক্ষন শ্বাস-প্রশ্বাস ততক্ষন আঁশ বলে একাট প্রবাদ রয়েছে। হাওয়া বা দম বন্ধ হলেই তা মৃত। বাউল সম্প্রদায় হাওয়ার গতিধারা নিয়ন্ত্রনের জন্য যোগ সাধনা ও সার্বক্ষনিক ধ্যানের উপাদান হিসেবে আপন সত্ত্বার রকম ও প্রকারের উপর সর্বদা সচেতন। বাউল নিজস্ব অবস্থানে অবলোকন করে হাওয়া নামক অস্থির পোষা পাখিটিকে। এই হাওয়াই হল মনের চলাচলের পথ। সাধকের দেহমন, হাওয়া ও আত্মতত্ত্বকে জ্ঞানের উপাদান হিসেবে না জেনে ভজন সাধন বৃথা। মন আদৌ ধ্যানে ও জ্ঞানে থাকতে চায় না। তাই লালনের অমিয় বাণীতে সাধক পায় অস্থির দেহ মনের সাধনার শক্তি।

সাঁইজি লালনের সঙ্গীত, সংস্কৃতি ও সাহিত্যে মানুষের ধর্ম, সম্প্রদায় ও স্রষ্টার নানাবিধ শব্দে বা নামে পরিচয় এবং আবেগ আপ্লুত হয়ে বাহ্যিক দৃষ্টিতে রচিত হয়নি।
লালন সর্বযুগের ও সর্বকালের মানুষের জন্য তত্ত্বের রুপরেখা অবলোকন করে পদ রচনা করেছেন। তার আধ্যাত্মবাদে কোন ভেদ জ্ঞান নেই। তিনি বলতে চেয়েছেন- এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে যেদিন হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ খৃষ্টান জাতি গোত্র নাহি রবে।

view this link

মানুষের ভেদ সৃষ্টি, ধর্ম সৃষ্টি, সম্প্রদায় সৃষ্টি ও স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকে বিভিন্ন নামের বিড়ম্বনা লালন অত্যন্ত দুরদর্শিতার সাথে বর্ণনা করেছেন তার গানে। আল্লাহ, হরি, ভগবান, ঈশ্বর শব্দগুলো শুধু মুখে উচ্চারণ করে আল্লাত্ব অর্জন হয়না। একই মানুষ শুধু ভেদ জ্ঞানে বন্দী হয়ে আমিত্বের জালে ভিন্নতর। অত্যন্ত স্বার্থপর ভাবে মানুষ শুধু আগুন, বাতাস, পানি, মাটি ও ধর্মকেই ভাগ বাটোয়ারা করেনি, স্রষ্টা ও সৃষ্টির সীমানাকে পৃথক করে আমিত্বের শক্তিকে দানবে রুপান্তরিত করেছে। বাউল ধর্ম এই ভেদ জ্ঞানের অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত। আমিত্বের স্থান বাউল ধর্মে নেই। লালনের সুর মরমী সঙ্গীতে সাধকের সাধনার জন্য ভাব তৈরীতে আশ্চর্য ফলদায়ক। লালন মুক্তির রহস্য উদ্ধার করে উপমা রুপক ও ভাবের ভাষাতেই পদ রচনা করেছেন। যেমন- তিন পাগলে হল মিলন। লোভ, দ্বেষ মোহ হল তিন পাগলে তার এই পাগলের সহবস্থানেই দেহে সৃষ্টি সংস্কার। অস্তিত্ত্বের আঁধার নিভিয়ে দেবার জন্য এই তিন পাগল সর্বদা ব্যস্ত। সাঁইজি লালন তাই এই অজ্ঞানী, অধ্যানী ও বিকার দেহমনের পাগলদের নিকট না যাওয়ার জন্য সাধনা করেছেন। রিপু ইন্দ্রিয় বশবর্তী হয়েই অস্তিত্ত্বে সমর্পিত হয় সকল কর্মে ও ধর্মে। ধ্যানের উপকরণ না থাকায় আপন অস্তিত্ত্ব আহত হচ্ছে রিপু ইন্দ্রিয়ের নিকট। আল্লাহ জাগ্রত হচ্ছে না আর অবিকল জাতের সাথে এ রকম না হওয়ার তৈরী হচ্ছে অজাত বেজাত। পাগলের স্বভাব, আচারণ ও ব্যবহার সম্পূর্ণ আসক্তির মধ্যে বন্দী। তাই সবার আগে ইন্দ্রিয় দ্বার দিয়েই খালি বা শূন্য করতে হবে দেহ মনের সংস্কার। তবেই মিলবে আপন ঈশ্বর, ভগবান বা আল্লাহকে। তাইতো সাঁইজির আকুল আকুতি মিলন হবে কত দিনে…..
সকল লোক সমাজেই তত্ত্বগত প্রার্থনায় আপনার খবর কোথায় তা জানতে চায়। মনের মানুষের সঙ্গে মিলন ঘটবে কবে এ প্রশ্ন সবার। মনের মানুষের সংজ্ঞা কি এবং মিলন হবে কতদিনে এর রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করেছেন বাউল সম্রাট তার পদগুলিতে।
মনের মানুষের সঙ্গে মিলন ঘটানোর জন্যই সাধকের সব সাধন ভজন। সৃষ্টিকর্তার সকল শক্তি যেমন পরিপূর্ণ জ্ঞানাকারে নবী ও আলেমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে বার বার। মানুষ তত্ত্বই মূল হিসেবে বিবেচনা করেছেন লালন। মানুষ যেমন সৃষ্টির রহস্য তেমনি স্রষ্টাও সৃষ্টির রহস্য মানুষের মধ্যেই মানুষ রুপে অবতার, সাঁই বিরাজ করেন ত্রিভুবনে। লালন পরিপূর্ণ ভাবে স্রষ্টা ও সৃষ্টিতে দূরত্ব না রেখে সাধন ভজনের বলে পরমতত্তের গুনাবলিতে মানুষকেই মনের মানুষ হিসেবে তুলনা করেছেন এবং মানুষেরই জয়গান করেছেন মুক্তি ও নাজাতের উপায় অবলম্বন হিসেবে।
তার গানে রয়েছে… যখন ঐ রুপ স্বরণ হয়, থাকেনা লোক লজ্জার ভয়
অধীন লালন ভেবে বলে সদয়, ও প্রেম যে করে সে জানে…..
লালনের মতে শাস্ত্রের চেয়ে সত্য বড়, আচার অনুষ্ঠান ও বিধি বিধানের চেয়ে মানুষ বড়। আত্মসত্ত্বার মাঝেই নিহিত মানুষ রতন, আলেক সাঁই। পরমাত্মার স্বরুপ সেই অসীম আলেক সাঁইকে খুঁজে পেতে হবে সসীম মানুষের মধ্যে। লালন সাঁইজির রচিত পদ বা সঙ্গীতে সুর, ছন্দ, পদ ইত্যাদি। নানাবিধ বিন্যাসের প্রকৃত ও আলংকারিক সংযোগ সৃষ্টি হয়েছে আত্মদর্শনের কারণে। অস্তিত্ববোধই লালনের সঙ্গীতের মৌলিক রহস্য। তাই লালনের সঙ্গীতে লালনের নিজস্ব উপলব্ধিই মহান দিকদর্শন হিসেবে সাধকের সাধনার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। আপনাকে জানার রহস্যই লালনের সঙ্গীতের আহবান। এসব কিছু চিন্তা করলে বলা যায় যে লালনের অসাধারন সঙ্গীতগুলো মানুষের মধ্যে আত্মদর্শনের সাধ সৃষ্টিতে অনেক বড় ও কার্যকর ভূমিকা রাখে। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে মরমী সঙ্গীতে মানুষের প্রকৃত রহস্য উৎঘাটনের চেষ্টার কারনেই। লালন একাই সকলের হয়ে উপলব্ধির বানী প্রদান করেছেন স্বত্ত্বার আদি রহস্যর দর্শনে। চেষ্টা করেছেন জাতি, ধর্মের উর্ধ্বে উঠে মানুষকে সৃষ্টিকর্তার কাছাকাছি পৌঁছানোর উপায় প্রদর্শনের।
১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর বাংলা ১২৯৭ সনের ১লা কার্তিক ছেউড়িয়ার আখড়াবাড়ীর এই গানের পাখিটা চিরদিনের জন্য পালিয়ে গেল ইহজগতের মায়া থেকে। মুখে ছিল তার রচিত শেষ গানের শেষ বুলি – পার কর হে দয়াল চাঁদ আমারে….. / ক্ষম হে অপরাধ আমার এ ভব কারাগারে ...

সহায়ক গ্রন্থ-
বাংলা একাডেমী ফোকলোর সংকলন
সাইঁজির দৈন্য গান- ফরহাদ মাজহার
লালন সাইঁ ও উত্তর সূরী – আবুল আহসান চৌধুরী
সাধক কবি লালন : কাল উত্তরকালে – ম মনিরুজ্জামান
লালন গীতি সমগ্র – ওয়াকিল আহমদ

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.