নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১৯৮৮ সালে বিএল কলেজে ভর্তি হবার পর পরিচয় হয় মুক্তিদির সাথে, কড়া মেজাজের দর্শনের অধ্যাপক যাকে দেখলে ছাত্ররা দুর থেকেই হয়ে যেত শান্তশিষ্ট । একজন মানুয়ের প্রভাব যে এত ব্যাপক আর ব্যক্ত্বিত্ব যে এত বিশাল হয় তা জেনে ছিলাম তাকে দেখে। তারপর পরিচয় হয় কায়কোবাদ স্যারের সাথে। কঠিন ব্যাক্ত্বিত্বের মুক্তিদির বাসায় প্রতিনিয়ত যে সাংস্কৃতিক আড্ডা হয় তাতেও সামিল হয়ে গেলাম একদিন। শত শত নয় বলা যায় হাজার হাজার রবীন্দ্রসঙ্গীত কোরাস গেয়ে আর নানান কবিদের কবিতা আবৃত্তি করে কেটে যেত দিmukti majumder homeন। কোন উপলক্ষ্যই বাদ যেত না। ১৯৯০ সালে শান্তিদেব ঘোষ খুলনায় এলে আমরা কল্যাণী দল তাশের দেশ নাটক করেছিলাম মুক্তিদিরই নির্দেশনায়। রাজার চরিত্রে আমার অভিনয় দিদি খুব পছন্দ করেছিলেন।
দেশের সকল ধরনের পরবে গান নাচ আবৃত্তি আর নাটক করা তথন আমাদের নিত্যকর্ম, মুক্তিদি মানে অধ্যাপিকা মুক্তি মজুমদার ছিলেন আমাদের শিক্ষক আমাদের মধ্যমণি। আর কায়কোবাদ স্যার তার লাইব্রেরী থেকে মাঝে মধ্যে উকি দিতেন পছন্দ হলে এসে বসতেন আমাদের পাশে। কোন শব্দ বা ভাষা নিয়ে বিভ্রান্তি হলে অধ্যাপক কায়কোবাদ স্যার সমাধান দিতেন। স্যার দিদির বিশাল লা্ইব্রেরীতে আমাদের প্রবেশাধিকার ছিল আপন জনের মত, কোন ধরনের বই পড়তে হবে তার উপদেশও দিতেন। দেদারসে নেশাগ্রস্থের মত সে সব বই আমরা পড়তে নিতাম। কি পড়লাম তা অনেক সময় বলতেও হত। কাজী মোতাহার হোসেনের সংস্কৃতি কথা আর মুজতবা আলি, রবীন্দ্রনাথ হয়ে যে পড়া শুরু হয় স্যার দিদির হাত ধরে তা বহমান হয়ে চলেছে আজও।
মহেশ্বর পাশার মজুমদাররা এক সময় জমিদার ছিল শুনেছি, দিদির সাথে গেছিও সে বিশাল বাড়িতে কয়েকবার। সে বাসায় রাজশাহী থেকে ছুটিতে সুব্রত মামা এসেছিলেন, তার মেয়ে ছোট্ট এক আনন্দকে আবিষ্কার করে বিস্মিত হয়েছিলাম তার কন্ঠের রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে। অপুমামাকেও মনে পড়ে আজ। মজুমদার বাড়ির মেয়ে মুক্তি মজুমদার ছিলেন আমাদের চোখে পরিপূর্ণ প্রগাঢ় ব্যক্ত্বিত্বের একজন আদর্শ শিক্ষক। দুর থেকে তাকে মনে হত খুব কঠোর কিন্তু আদতে তিনি ছিলেন শিশুর মত সরল। সাহিত্য সঙ্গীতে তার ছিল অগাধ পান্ডিত্য। কথায় কাজে বাক্যে চলনে পড়ায় উচ্চারণে বিচ্যুতি হলে সংশোধন করে দিতেন। তার সংস্পর্শে এসে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হত।
একবার হেমন্তে নবান্ন উৎসবের গানের মহড়ায় মুক্তিদি শেখাচ্ছিলেন আমরা কাটি ধান .. এ রকম একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত, মহড়ার মাঝে বেঁকে বসলেন মৃত্যুঞ্জয় হালদার আমাদের মৃত্যুনদা। এ গান আমাদের জন্য নয় কারণ বিল ডাকাতিযায় তখন ধান হত না লোনা জলের কারণে। গত দশ বছর আমাদের ধান হয়না, এ গান আমার জন্য নয় বলেছিলেন মৃত্যুmukti-majumder-hনদা। দিদি গান পরিবর্তন করলেন এবং কি যে বিমুঢ় হয়েছিলেন আর শিশুর মত ছলছল চোখে উঠে গেছিলেন ঘরে। ফিরে এসে ধরলেন আজি রক্ত নিশি ভোরে এ কি এ শুনি ওরে… গানটা যে কি দীপ্তময় ভঙ্গী আর উচ্চারণে তিনি গেয়েছিলেন, আমরাও কোরাসে ভাসিয়ে নিয়েছিলাম কল্যাণীকে সেদিন। (অধ্যাপক মো: কায়কোবাদ এবং অধ্যাপক মুক্তি মজুমদারের বাসভবনের নাম ছিল কল্যাণী) চোখে ভেসে আছে এখনও সে দৃশ্য।
আমি, মাধব রুদ্র, মৃত্যুঞ্জয় হালদার, সুদেবদা, স্বপন ঘোষাল, শংকরদা, অলোকদা, রানিদি, দীপাদি, তপন, সাগরিকা, মঞ্জুদি, সীমা, তারেখ সহ আরো অনেকে ছিলাম সেসব দিনগুলোতে। আর ছিল ছোট্ট কাওসার। কাওসারকে আমরা ডাকতাম গোপাল কাওসার বলে। মুক্তিদিকে ঘিরে আমাদের সে কি উন্মাদনা। গান, মহড়া বা অনুষ্ঠান শেষে মায়ের মত পরম মমতায় নানা ধরনের খাবার খেয়ে কেটে যেত বেলা। তার সংস্পর্শে যারা এসেছে আর যারা তার ছাত্র ছিল তারা বলতে পারবেন মুক্তিদির ছোয়ায় কেমন করে বদলে গেছে তাদের ভাবনার জগত। মানুষ গড়ার এক মহান কারিগর ছিলেন তিনি।
সে মুক্তিদি চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে গত ১২ নভেম্বর, আসলে কি তিনি গেছেন? না তিনি যাননি, তিনিতো রয়ে গেছেন আমাদের মস্তিস্কের স্নায়ুতে, আমার চেতনায়, যাবতীয় মূল্যবোধে। সংস্কৃতিচর্চার যে মোহ তিনি বুনে গেছেন হৃদয়ে আমার, তাকে নিয়ে বেঁচে থাকি এ তমসা ঘন দিবস রজনীতে।
©somewhere in net ltd.