নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলা তথা ভারতবর্ষের গণসংস্কৃতি আন্দোলনে হেমাঙ্গ বিশ্বাস একটি অবিস্মরণীয় নাম। গণনাট্য আন্দোলনে ছোট-বড় অগণিত গীতিকার-সুরকার একসময় তাদের গান চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে হেমাঙ্গ বিশ্বাস ছিলেন একজন প্রথম সারির স্রষ্টা।
বিগত চল্লিশ দশক থেকে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি তার কলম এবং কণ্ঠ নিয়ে অম্লান ছিলেন। সঙ্গীত পরিবেশনের ক্ষেত্রেও তার চিন্তা সবসময় শুধু সংগ্রামী জনতাকে সামনে রেখেছে।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সর্বত্র পরিচয় একজন সঙ্গীত শিল্পী, গীতিকার, সুরস্রষ্টা এবং এই বাংলায় গণসঙ্গীতের অন্যতম পুরোধা হিসেবে। এই সব নানাবিধ পরিচয়ের অন্তরালে গুপ্ত থেকে গেছে একজন কবির প্রতিমূর্তি। তার প্রত্যেকটি ছন্দোবদ্ধ লেখা যেমন সুরে, সঙ্গীতে, মূর্ছনায় মনপাখির বুকে আগুন ধরানো একেকটি গান হয়ে উঠেছে তেমনি হয়েছে একেকটি কালজয়ী কবিতা। অনেক বড় বড় কবির কবিতাও অনেক সময় তার সুররসিক লেখার কাছে যেন ম্লান মনে হয়। হিরোশিমায় আনবিক বোমা ফেলার বিরুদ্ধে তার কবিত্বময় উচ্চারণ-
-সুদূর প্রশান্তের বুকে/ হিরোশিমা দ্বীপের আমি শঙ্খচিল/ আমার দু ডানায় ঢেউয়ের দোলা/ আমার দু’চোখে নীল শুধু নীল
বাংলা গণসংগীত আর হেমাঙ্গ বিশ্বাস অভিন্ন নাম, পরস্পর সমান্তরাল। গোটা জীবনটাই তিনি বিলিয়ে দিয়েছেন সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে। অবিচল নিষ্ঠা, সাহস, ত্যাগ-তিতিক্ষায় আশার গান তিনি শুনিয়েছেন, সংগ্রামের বাণী তুলে ধরেছেন। দুর্ভিক্ষ-মহামারি হেমাঙ্গ বিশ্বাসের অন্তরে জাগিয়েছে মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ।
১৩১৯ সনের ২৭ অগ্রহায়ণ তথা ১৪ ডিসেম্বর ১৯১২ সালে বৃহত্তর সিলেটের বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার মিরাশী গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। হবিগঞ্জ হাইস্কুল থেকে পাশ করার পর তিনি শ্রীহট্ট মুরারিচাঁদ কলেজে ভর্তি হন । সেখানে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন । তিনি ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন । ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে কারাবন্দী থাকাকালে তিনি যক্ষারোগে আক্রান্ত হন। তারপর যাদবপুর হাসপাতালে কিছুকাল চিকিৎসাধীন থাকেন এবং সেই কারণে তিনি মুক্তি পান । ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তেলেঙ্গানা আন্দোলনের সময়ে তিনি গ্রেফতার হন এবং তিন বছর বন্দী থাকেন ।
১৯৩৮-৩৯ খ্রিস্টাব্দে বিনয় রায়, নিরঞ্জন সেন, দেবব্রত বিশ্বাস প্রমুখের সাথে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আই.পি.টি.এ গঠন করেন । পঞ্চাশের দশকে এই সংঘের শেষ অবধি তিনি এর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন ।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বাংলার প্রগতিশীল লেখক শিল্পীদের আমন্ত্রনে তিনি প্রথম কলকাতায় আসেন সঙ্গীত পরিবেশন করতে । ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর উদ্যোগে এবং জ্যোতিপ্রকাশ আগরওয়ালের সহযোগিতায় সিলেট গণনাট্য সংঘ তৈরি হয় । স্বাধীনতার আগে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের গানের সুরকারদের মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রধান । সেই সময়ে তাঁর গান তোমার কাস্তেটারে দিও জোরে শান, কিষাণ ভাই তোর সোনার ধানে বর্গী নামে প্রভৃতি আসাম ও বাংলায় সাড়া ফেলেছিল । আসামে তাঁর সহযোগি ছিলেন বিনোদবিহারী চক্রবর্তী, সাহিত্যিক অশোকবিজয় রাহা, সেতারবাদক কুমুদ গোস্বামী প্রভৃতি । ১৯৫৬ সালে চিনে যান চিকিৎসার জন্য। আড়াই বছর থাকেন এবং খুব কাছ থেকে দেখেন চিনের সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ১৯৬১ সালে স্থায়ীভাবে চলে আসেন কোলকাতা এবং সেই সময়েই চাকরিনেন সোভিয়েত কনস্যুলেটের সোভিয়েত দেশ পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরে। কাজ করার সময় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতপার্থক্য হলে তিনি কাজ ত্যাগ করেন । চিন - ভারত মৈত্রীর ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল । দুবার তিনি চিনে গিয়েছিলেন । চিনা ভাষায় তাঁর অনেক গান আছে ।
১৯৭১ সালে মাস সিঙ্গার্স নামে নিজের দল গঠন করে জীবনের শেষ দিকেও তিনি গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে বেরিয়েছেন । তিনি কল্লোল, তীর, লাললণ্ঠন প্রভৃতি নাটকের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন । লাললন্ঠন নাটকে তিনি বিভিন্ন চিনা সুর ব্যবহার করেছিলেন ।
তাঁর রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য : শঙ্খচিলের গান, জন হেনরীর গান, মাউন্টব্যাটেন মঙ্গলকাব্য, বাঁচব বাঁচব রে আমরা, মশাল জ্বালো, সেলাম চাচা, আমি যে দেখেছি সেই দেশ....
©somewhere in net ltd.