নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বঙ্গজিৎ দত্তকে বলা হয় বাংলাদেশের রূপসজ্জাকরদের গুরু
হুবহু চরিত্রের মতো অভিনয়শিল্পী পাওয়া প্রায় অসম্ভব। গল্পের চরিত্রটির সঙ্গে অভিনয়শিল্পীর বাহ্যিক দূরত্ব কমানোর কাজটাই হলো মেকআপ বা রূপসজ্জা। অন্যভাবে বললে, অভিনেতার ঘাটতি পূরণ করা। যাঁরা এ কাজ করেন তাঁরা মেকআপ আর্টিস্ট বা রূপসজ্জাকর। শিল্প নির্দেশকের কাজের আওতায়ও পড়ে মেকআপ। গল্পের চরিত্রটির স্থান, সময়, পোশাক, মানসিকতা ও শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে অভিনেতার কী কী মেকআপ করতে হবে। থিয়েটারেরে এই গুরুত্বপুর্ণ মহান দায়িত্ব আমৃত্যু পালন করে গেছেন থিয়েটার দরদী গুণী রূপসজ্জাকর বঙ্গজিৎ দত্ত।
বঙ্গজীৎ দত্ত জন্ম ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ ঢাকার ঠাটারী বাজার। ছোট বেলা থেকেই সাংস্কৃতিক আবহে বড়বঙ্গজিৎ দত্ত হয়েছেন। তার বাবা সুরেশ দত্ত ছিলেন একজন জাঁদরেল অভিনেতা, নিদের্শক, সংগঠক এবং একজন রূপসজ্জা শিল্পী । তার ছোট বোন গীতা দত্ত ছিলেন তৎকালীন প্রায় একমাত্র মহিলা অভিনেত্রী যিনি দাপটের সঙ্গে নিয়মিত অভিনয় করেছেন। ছোট বেলায় স্কুলে কবিতা আবৃত্তি ও নাটকে অভিনয় করতেন। নবাবপুর প্রিয়নাথ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন এবং কোলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং ইংরেজীতে স্নাতক ও স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর রূপসজ্জায় প্রশিক্ষন নেন পাশা-পাশি কোলকাতায় একটি হোমিওপ্যাথি কলেজ থেকে হোমিওপ্যাথিতে ডিগ্রি লাভ করেন। এতদসত্তেও এই সব পেশায় না এসে এন্টি-করাপশন ডিপার্টমেন্টে চাকুরীতে নিযুক্ত হন। কিন্তু এই পেশা ভালো না লাগার কারনে ইস্তফা দিয়ে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। তিনি রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়, পোগজ স্কুল এবং ঢাকার নবকুমার ইনিস্টিটিউটে শিক্ষক হিসেবে ১৯৫৫ থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কাল পর্যন্ত নিযুক্ত ছিলেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শাঁখারীবাজারের বাড়িটা বেদখল হয়ে যায়। পরিবারের সবাইকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ভারতে, বিপর্যস্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন সুরেশ দত্ত। পরিবারে হাল ধরে বঙ্গজিৎ দত্ত। পাকিস্তান এন্টি করাপশন ডিপার্টমেন্টে কর্মরত থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য আদান প্রদান করতে থাকেন। স্বাধীনতা অর্জিত হল- যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশেও থেমে থাকেনি নাট্যচর্চা। তরুণ নাট্যকর্মীরা তখন দেশ গঠনের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয় নাটক, সঙ্গে থাকেন বঙ্গজিৎ দত্ত। রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল ও নবকুমার ইন্সটিটিউটে শিক্ষকতার পাশাপাশি নাটকের একনিষ্ঠ কর্মী তিনি। নাটক লিখছেন, অভিনয় করছেন, সংগঠেনর সক্রিয় কর্মী, মেকআপ করছেন- সবই করতেন একাধারে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন যার ফলে দেশ ও দেশের সংস্কৃতি তাকে অতন্ত্য মমতায় বেধে রেখেছিলেন। যে কারনে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন থিয়েটার র্চচায় নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং তার পূর্ব অভিজ্ঞতা রূপসজ্জাকে কাজে লাগান। এবং পেশা হিসেবে রূপসজ্জাকে পুরোপুরীভাবে বেছে নেয়। পাশা-পাশি তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাও চালিয়ে যান তবে তা মূলত জনসেবা বা দাতব্য সেবা হিসেবে ছিলো।
তিনি নাটকের মানুষের কাছে বঙ্গজীৎদা, বঙ্গদা বা শুধু দাদা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন সবার কাছে অত্যন্ত প্রিয় মানুষ। সদালাপি, মিষ্টভাষী এবং রসিক বটে। ছোট বড় সকলের সাথেই ছিলো বন্ধুত্বপূর্ন সর্ম্পক। এমন কোন অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিলেন না যে তার হাতের স্পর্শ না পেয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রী হয়ে উঠেছেন। তার হাতের স্পর্শ পেয়েই যেন সত্যিকার অর্থে চরিত্রটি জীবন্ত হয়ে উঠতো এবং শিল্পী তার অভিনয় শৈলী দিয়ে চরিত্রটি যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন বলে সকলে মনে করতেন। আর সে কারনেই তিনি পেয়েছেন সমস্ত নাট্যাঙ্গনের মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।
পেয়েছেন নাট্যচক্র সম্মাননা, লোকনাট্য দলের সম্মাননা, বহুরুপী সম্মাননা, চতুরঙ্গ সম্মাননা, নাগরিক-নাট্য-সম্প্রদায় সম্মাননা, ঢাকা ড্রামা সম্মাননা, বাচসাস পুরস্কার সহ অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কার। আমৃত্যু তিনি থিয়েটারের সঙ্গে থেকে রূপসজ্জাকার হিসেবে বাচঁতে চেয়েছিলেন। আর তাই তো মৃত্যুর এক ঘন্টা পুর্বেও তাঁর প্রিয় রূপসজ্জা পেশার সঙ্গে ছিলেন এবং তার আত্মার আত্মীয় নাটকের মানুষের সঙ্গে কাটিয়ে গেছেন। তার সুযোগ্য পুত্র শুভাশিষ দত্ত তন্ময় দাদা ও বাবার আদর্শকে মাথায় নিয়ে একই পেশায় নিজেকে নিযুক্ত রেখেছে।
২০০০ সলের ১ নভেম্বর রাত ১১টা ১৫ মিনিটে তার জীবন নাটকের যবনিকাপাত ঘটে। পৃথিবীর এই রঙ্গশালা থেকে তিনি বিদায় নেন। এই গুণী শিল্পীর প্রয়াণ দিবসে মিডিয়া খবরের পক্ষ থেকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
©somewhere in net ltd.