নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

\"তোমার সাথে মিলব আমি ঠিক বেঠিকের বাহিরে\"

লাবিব ফয়সাল

ভালোমানুষ হওয়ার কোন ঝঞ্ঝাট নেই, তাই আমি নিতান্ত ভালোমানুষ...

লাবিব ফয়সাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

লাল সাইকেল (গল্প)

২৭ শে আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৪:১১

মানুষ অাকৃতির স্মৃতিস্তম্ভের দিকে তাকিয়ে আছে ছেলেটি। বয়স চার বা পাঁচ। পাশেই বসা মা, মুখটা বেশ আনমনা। কিছুটা কৌতহল নিয়েই জিজ্ঞেস করলো ছেলেটি- ‘মা, এই মানুষটি কে?..’ মা তার ছেলের কাছ থেকে হঠাৎ প্রশ্ন শুনে চিন্তার অপরিচিত জগত থেকে এক রকম তাড়াহুড়ো করেই ফিরে এলেন। একটা করুণ আর্তনাদের হাসি দিয়েই বলতে শুরু করলেন,
‘এরা সবাই বীর। আর বীরেদের কাজ হলো রাজাদের খুশি করতে অন্য দেশ জয় করে আনা।’
মাও বুঝতে পেরেছে, তার ছেলে এমন উত্তরের কোন অর্থই খুঁজে পায়নি। তাই তো মায়ের কথা শুনতে শুনতেই তার লাল রঙের খেলনা পিস্তলটি দিয়ে আবার আগের মতই খেলতে শুরু করে দিয়েছে সে, যেন পৃথিবীতে সে আর তার খেলনা পিস্তল ছাড়া কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। মা এসব দেখে কেমন একটা অপরিচিত মুচকি হাসি দিলেন। একটা ২৫ পয়সার কয়েনের শব্দেই মায়ের অন্যমনষ্কতা ভাঙল। পয়সাটি তাদের সামনে রাখা থালা থেকে কিছুটা দুরে গিয়ে পড়েছে। প্রতিদিন নামজের ওয়াক্তে মা-ছেলে এই মসজিদটার সামনে এসে বসে। সারা দিনে যা পায়, তাতেই তারা অনেক খুশি। সিরিয়াতে থাকার সময় বাবা ট্রাক চালাতেন। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তুরস্কের শরনার্থী শিবিরেই তাদের ঠাই। বাবা কোন কাজ না পাওয়ায়, মা-ই ছেলের একবেলা খাবার যোগাতে এক রকম সকল পিছুটান ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়েছেন রাস্তায়। আর মসজিদের সামনে পেতে রাখা থালাই যেন তাদের একবেলা খাবারের উৎস। তবে এখন আর চোখের সামনে আত্মীয়-স্বজনদের মরতে দেখতে হয় না বলে মাঝে মাঝেই আল্লার কাছে শুকরিয়া জানান তারা।
তু্রস্কের রাস্তায় কিছুটা তারাতারিই সন্ধ্যা নামে। সন্ধ্যার নিস্তব্ধতাকে সাথে নিয়েই মা-ছেলে হেঁটে চলেছে। পৃথিবী যেন তাদেরকে কিছুটা অনুগ্রহ করেই এত সুন্দর নিশ্চিন্ত জীবন দিয়েছেন। তাই সারা দিনের ক্লান্তি, ক্ষুধা আর অপ্রাপ্তির কোন ছাপই যেন এই প্রাপ্তিকে ছাপিয়ে উঠতে পারছে না। তাদের তুরস্কে আসার প্রায় দুই বছরের মত হলো। অস্থায়ী সাদা রঙের তাবুতে কিভাবে এতগুলো দিন পার হয়ে গেল, ভাবতেই যেন কেমন লাগে। মায়ের মন আজ কিছুটা খারাপ। ছেলে লাল সাইকেলের বায়না ধরেছে। এই বায়নাটা অবশ্য অনেক পুরনো। মাঝে মাঝেই ঘুম থেকে উঠে বলে আমার লাল সাইকেল কোথায়। আম্মু ফুপুকে বলো না, আমার জন্য একটা লাল সাইকেল নিয়ে আসতে। ফুফু অবশ্য কথা দিয়েছেন কানাডা থেকে নতুন লাল সাইকেল কিনে দেবেন। তিনি কানাডা প্রবাসী। তার ইচ্ছা, ভাইও সেখানে চলে যাক। কিন্তু মানুষের চাওয়া পাওয়ার অধিকারও যে মাঝে মাঝে বন্দুকের নলের সামনে হারিয়ে যেতে পারে, তা এই পরিবারটির মতো আরো আড়াই লক্ষ পরিবার জানে। ছেলের এমন আর্তনাদ যেন ক্ষুধার রাজ্যে আকাশ কুসুম কল্পনা।
মা, ছেলের ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেও কষ্টে মুখটা লুকিয়ে নিলেন। ছেলের সামনে কান্নার যেন শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট থাকতে দেয়নি কোন একটা অদ্ভুত কারণ। আজ সেপ্টেম্বরের দুই তারিখ। মা আজ অনেক ভোরবেলায় উঠেছেন। কাপড়ের ব্যাগ দুটি রাতেই গুছিয়ে রেখেছিলেন যাতে সকালে আর সময় নষ্ট না হয়। ছেলেকেও সাজিয়ে দিয়েছেন। লাল গেঞ্জি আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। এটাতে তাকে অনেক ভালো মানায়। মায়ের সবকিছু গুছিয়ে নিতে নিতে কেমন একটা ক্লান্ত ভাব চলে এসেছে মুখে। কিন্তু তার মাঝে একটা অনন্ত স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো অনুভূতি কাজ করছে আজ। ছেলেকে সাজিয়ে দিয়ে ব্যাগ দুটি হাতে নিতেই ছেলের জিজ্ঞাসা- ‘মা আমরা কোথায় যাচ্ছি..’। জগতের সকল সুখ মিশ্রিত হাসি দিয়ে মা বললেন, আজ আমরা এই ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাচ্ছি। যাচ্ছি অনেক অনেক দূরে। যেখানে আমাদেরকে কেউ রিফিউজি বলবে না। যেখানে আমরা আর কখনো ভিক্ষা করবো না। আমরা যেখানে তিন বেলা খাবো। আর যেখানে আমরা মানুষ হয়ে থাকবো।
ছেলেটি কিছুটা উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘মা, ওখানে কি আমার লাল সাইকেল আছে..?’। মা হয়তোবা ছেলের প্রশ্নের চেয়ে এই নতুন করে সকল কিছু ফিরে পাওয়াটাকে অনেক বৃহৎ মনে করেই আর জবাব দিলেন না। কিছুটা তাড়াহুড়ো করেই বললেন- ‘বাবা, নৌকা ছাড়ার সময় হয়ে গিয়েছে। তারাতারি যেতে হবে আমাদের। না হলে আমাদের ছেড়েই চলে যাবে ওরা।’
ছেলেটির এক হাতে লাল রঙের খেলনা পিস্তল আর অন্য হাত মায়ের বাম হাতটিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। তারা হেটে চলেছে সকল হতাশাকে আর মরীচিকা মাড়িয়েই। ছেলেটির সাইকেলের স্বপ্ন পুরন হয়েছে আজ। ফুপু কানাডা থেকে এসেছেন। সাথে একটি লাল রঙের ছোট সাইকেল। দাঁড়িয়ে আছেন তারা। ছেলেটি তাদের সামনে। কিন্তু ছেলেটি কেন জানি হাসিমাখা মুখেই উপুড় হয়ে পরে আছে। সমুদ্রের নোনা পানি মুখটাকে আলতোভাবে রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছে বার বার। কিন্তু সে কেন জানি নিস্তব্ধ । হয়তোবা কিছুটা অভিমানই করেছে এই সাম্রাজ্যবাদী নিষ্টুর পৃথিবীর উপর।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.