নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি কেহ নই।

শরীফ আজাদ

আমি সব, আমি সবাই, আমিই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। আমি নীরবতা, আমিই কোলাহল। আমি অনুভূতিহীন, আমিই সকল অনুভূতি! আমিই তুমি।

শরীফ আজাদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অনুবাদ গল্পঃ সিগন্যাল

১৬ ই জুলাই, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১৯



সিমিয়ন ইভানভ ছিলো একজন রেলওয়ে লাইনম্যান। রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে এক পথে গেলে দশ মাইল দূরে তাঁর কুটির, অন্য আরেক পথে গেলে বারো মাইল। প্রায় চার মাইল দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো একটা সুতার মিল। গত বছর খোলা হয়েছিলো মিলটা। মিলের লম্বা কালো চিমনিটা জঙ্গলের পেছন থেকে নিজের মাথাটা উঁচিয়ে রেখেছিলো।আশেপাশে বাসস্থান বলতে ছিলো শুধু অন্যান্য লাইনম্যানদের দূরবর্তী কুটিরগুলো।

সিমিয়ন ইভানভের স্বাস্থ্য একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। নয় বছর আগে, ঠিক যুদ্ধের মাঝখানে সে একজন অফিসারের ভৃত্য হিসেবে কাজ করতো। সেখানে সে রোদে পুড়েছে, ঠাণ্ডায় জমেছে, প্রচণ্ড ক্ষুধায় তাঁর মৃতপ্রায় অবস্থা হয়েছে। প্রতিদিন তাঁকে জোরপূর্বক চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মাইলের মার্চ করতে হতো — কি গরম, কি ঠাণ্ডা, কি বৃষ্টি, কি রোদ! কোন বাছবিচার ছিলো না। বুলেটগুলো তাঁর আশেপাশে শোঁ শোঁ করে অনেক ঘুরেছে, কিন্তু, ঈশ্বরের কৃপা! একটাও তাঁকে ভেদ করেনি।

সিমিয়নের রেজিমেন্ট একবার কিছুদিনের জন্যে ফায়ারিং লাইনে ছিলো। পুরো একটা সপ্তাহ তুর্কিস্থানীদের সাথে তাঁদের খণ্ড যুদ্ধ চলছিলো, দুই শত্রু দলের মাঝখানে ছিলো শুধু একটা গভীর গিরিখাত; আর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হচ্ছিলো অবিরাম ক্রস-ফায়ার। দিনে তিনবার সিমিয়ন একটা বাষ্পীয় সামোভার আর তাঁর অফিসারের খাবার রান্নাঘর থেকে গিরিখাত পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যেতো। তখন বুলেটগুলো তাঁর কানের কাছে গুনগুন করেছে, পাথরের গায়ে ভয়ঙ্কর ঝনঝন আওয়াজে আঘাত হেনেছে। মাঝে মাঝে সিমিয়ন আতঙ্কে কেঁদে ফেলতো, কিন্তু তারপরও সে হাল ছাড়েনি। অফিসাররা তাঁর উপর অনেক খুশি ছিলো, কারণ সে তাঁদের জন্যে সবসময় তৈরি করে রাখতো গরম গরম চা।

কোন রকম অঙ্গহানি ছাড়াই সে যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছিলো, কিন্তু বাতজ্বর তাঁকে বিকল করে দিয়েছিলো। তারপর থেকে সে একটুও আক্ষেপ অনুভব করেনি। বাড়ি গিয়ে দেখেছিলো তাঁর বুড়ো বাবা আর চার বছর বয়সী ছেলেটা মরে গেছে। সিমিয়ন তাঁর স্ত্রীর সাথে একলা পড়ে রইলো। বাচ্চা-কাচ্চা জন্ম দেয়ার ব্যাপারে তাঁরা তেমন কিছুই করতে পারলো না। বাতজ্বরে আক্রান্ত হাত-পা নিয়ে হাল চালানোটা বড্ড কঠিন! তাঁরা আর গ্রামেও থাকতে পারছিলো না, সুতরাং ভাগ্যান্বেষণে নতুন নতুন জায়গায় তাঁরা ঘুরে বেড়াতে লাগলো। মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা খেরসন আর ধনচিনায় কিছুদিন অবস্থান করেছিলো, কিন্তু কোথাও সৌভাগ্যের কোন সন্ধান পেলো না। পরে স্ত্রীটা কাজে বেরিয়ে পড়লো, আর সিমিয়ন ভাগ্যের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে থাকলো বিভিন্ন জায়গায়। সিমিয়ন একবার একটা ইঞ্জিনে চড়ে বসেছিলো, একটা স্টেশনে এসে স্টেশন-মাস্টারের চেহারাটা তাঁর পরিচিত মনে হচ্ছিলো। সিমিয়ন স্টেশন-মাস্টারের দিকে তাকিয়ে রইলো, স্টেশন-মাস্টারও সিমিয়নের দিকে তাকিয়ে রইলো, তাঁরা একে অপরকে চিনতে পেরেছিলো। লোকটা ছিলো সিমিয়নের রেজিমেন্টের একজন অফিসার।

“তুমি ইভানভ না?” সে বললো।

“জী, মহামান্য।”

“তুমি এখানে এলে কি করে?”

সিমিয়ন তাঁকে সব খুলে বললো।

“তো, তুমি যাচ্ছ কোথায়?”

“আপনাকে বলতে পারবোনা, স্যার।”

“বেকুব! ‘আপনাকে বলতে পারবো না’ মানে কি?”

“আমি বলতে চাচ্ছি, মহামান্য, আমার যাওয়ার কোন জায়গা নেই। আমাকে কাজের খোঁজে হন্য হয়ে ঘুরতে হয়।”

স্টেশন-মাস্টার তাঁর দিকে তাকালো, ভাবলো কিছুক্ষণ, তারপর বললো, “দেখো, বন্ধু, স্টেশনের এখানে কিছুদিন থেকে যাও। মনে হচ্ছে, তুমি বিবাহিত। তোমার বউ কোথায়?”

“হ্যাঁ, মহামান্য, আমি বিবাহিত। আমার স্ত্রী কুরস্কে একজন বণিকের সাথে কাজ করছে।”

“আচ্ছা, চিঠি লিখে তাঁকে আসতে বলো। আমি তাঁর জন্যে একটা ফ্রি পাসের ব্যবস্থা করবো। এখানে লাইনম্যানের একটা পোস্ট খালি আছে। আমি তোমার জন্যে চিফের সাথে কথা বলবো।”

“আমি মহামান্যের কাছে খুব কৃতজ্ঞ থাকবো।” সিমিয়ন উত্তর দিলো।

সে ষ্টেশনে থেকে গেলো। সেখানে রান্নাঘরের কাজকর্মে সহযোগিতা করা, লাকড়ি কাটা, ইয়ার্ডটাকে পরিচ্ছন্ন রাখা এবং প্লাটফর্ম ঝাড়ু দেওয়ার কাজে সে কিছুদিন নিযুক্ত ছিলো। সপ্তাহ দুই পরে তাঁর স্ত্রী এসে পৌঁছালো। সিমিয়ন একটা ঠেলা গাড়িতে করে চলে গেলো তাঁর কুটিরে। কুটিরটা ছিলো নতুন আর উষ্ণ, পর্যাপ্ত লাকড়ি ছিলো সেখানে। একটা ছোট্ট সবজির বাগান ছিলো, পূর্ববর্তী লাইনম্যানদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি, আর রেলওয়ের বেড়িবাঁধের ওপাশে ছিলো প্রায় এক একর চাষের জমি। সিমিয়নের মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। সে অল্পবিস্তর চাষাবাদ করার কথা চিন্তা করতে শুরু করলো। একটা গাভী আর একটা ঘোড়া কেনার কথাও ভাবলো।

সিমিয়নকে সকল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেওয়া হলো — একটা সবুজ পতাকা, কয়েকটা লন্ঠন, একটা ভেপু, হাতুড়ী, নাট খোলার রেঞ্চ, একটা শাবল, কোদাল, ঝাঁটা, কিছু হুড়কা আর পেরেক; ট্রেনের নিয়মকানুন আর সময়সূচীর দুইটা বইও তাঁকে দেয়া হলো। প্রথম দিকে সিমিয়নের রাতে ঘুম আসতো না। সে পুরো সময়সূচীটা হৃদয় দিয়ে মুখস্থ করে নিলো। একটা ট্রেন আসার দুই ঘণ্টা আগে সে তাঁর সেকশনের উপরে চলে যেতো, বেঞ্চের উপরে বসে দেখতো এবং শুনতো রেলের পাতগুলো কাঁপছে কিনা অথবা ট্রেনের গমগম শব্দ শোনা যাচ্ছে কিনা। এমনকি সে ট্রেনের নিয়মকানুনগুলোও হৃদয় দিয়ে মুখস্থ করে নিয়েছিলো, যদিও তাঁকে পড়তে গেলে একটা একটা শব্দ বানান করে পড়তে হতো।

গ্রীষ্মকাল। কাজের তেমন চাপ নেই। সরানোর মত কোন তুষার নেই, তাছাড়া ঐ লাইনে ট্রেনও আসতো কম। সিমিয়ন দিনে দুইবার তাঁর এলাকাটা চক্কর মেরে আসতো, লাইনটা পরখ করতো, এখানে সেখানে নাটগুলো টাইট দিতো, লাইনের লেভেলটা ঠিক রাখতো, পানির পাইপগুলোকে দেখতো, তারপর বাড়িতে নিজের কাজে ফিরে যেতো। শুধু একটা অসুবিধা ছিলো —যেকোন কিছু করতে গেলেই, তা যত ছোট কাজই হোক না কেন, তাঁকে ইন্সপেক্টরের অনুমতি নিতে হতো। তেমন কিছুই করার নেই বলে সিমিয়ন আর তাঁর স্ত্রী একটা সময় একঘেয়েমি অনুভব করা শুরু করলো।

দু’মাস পার হলো। সিমিয়ন তাঁর প্রতিবেশী লাইনম্যানদের সাথে পরিচিত হওয়া শুরু করলো। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলো খুবই বুড়ো, কর্তৃপক্ষ সবসময়ই তাঁকে অবসর দিতে চাইতো। লোকটা তাঁর কুটির থেকে কদাচিৎ বের হতো। তাঁর স্ত্রী তাঁর সব কাজ করে দিতো। স্টেশনের পাশেই থাকতো আরেক লাইনম্যান, বয়সে যুবা, পাতলা শরীর, কিন্তু পেশীবহুল। তাঁর সাথে সিমিয়নের প্রথম দেখা হয়েছিলো কুটিরগুলোর মাঝমাঝি লাইনের উপর। সিমিয়ন মাথার হ্যাট খুলে তাঁকে প্রণাম করেছিলো, “তোমার সুস্বাস্থ্য কামনা করি, প্রতিবেশী” সে বললো।

প্রতিবেশীটা তাঁর দিকে আড় চোখে তাকাল। “কেমন আছো তুমি?” সে উত্তর দিল; তারপর ঘুরে চলে গেলো।

পরে তাঁদের স্ত্রীদের মধ্যে সাক্ষাত হলো। সিমিয়নের স্ত্রী পুরো একটা দিন প্রতিবেশীর বাড়িতেই ছিলো, কিন্তু প্রতিবেশী মহিলাও তেমন কথা বললো না।

এক উপলক্ষে সিমিয়ন একবার মহিলাকে বললোঃ “যুবতী, তোমার স্বামী তো কথাবার্তা তেমন একটা বলে না।”

মহিলা প্রথমে কিছুই বললো না, তারপর উত্তর দিল, “কিন্তু তাঁর কি আছে কথা বলার? সবারই নিজ নিজ কাজ থাকে। আপনি আপনার পথে যান, ভালো থাকবেন।”

যাইহোক, মাস খানেক পরে তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হলো। সিমিয়ন ভ্যাসিলির সাথে লাইনে যেতো, পাইপের ধারে বসতো, তামাক টানতো, আর জীবন নিয়ে কথাবার্তা বলতো। তাঁদের আলাপচারিতার বেশীরভাগ সময়টাই ভ্যাসিলি চুপ থাকতো, কিন্তু সিমিয়ন তাঁর নিজের গ্রাম আর যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্প করতো।

“ঐসব দিনগুলোতে আমার বিন্দু পরিমাণ আক্ষেপও ছিলো না,” সে বলতো, “উপরওয়ালা জানেন, আমি বেশীদিন বাঁচতে পারিনি। ঈশ্বর আমার কপালে সুখ রাখেননি, কিন্তু ঈশ্বর যা চায়, তাই তো হয়। সেটাই হয়, বন্ধু ভ্যাসিলি স্টিপেনিচ।”

ভ্যাসিলি স্টিপেনিচ রেলের একটা পাতে পাইপটা ঠুকে ছাইগুলো ফেললো, উঠে দাঁড়িয়ে বললোঃ “আমাদের জীবনে ভাগ্য আমাদের পেছনে লেগে থাকে না, লেগে থাকে মানুষ। পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে হিংস্র আর কোন প্রাণী নেই। নেকড়ের মাংশ নেকড়ে খায় না, কিন্তু মানুষ তৎক্ষণাৎ মানুষকে গিলে ফেলে।”

“আহা, বন্ধু, এই কথা বলো না। নেকড়ে অবশ্যই নেকড়ের মাংশ খায়।”

“কথাগুলো আমার মনে এসেছে এবং আমি বলেছি। ঐ একই কথা, মানুষের চেয়ে হিংস্র প্রাণী আর নেই। মানুষের পাপ আর লোভ যদি না থাকতো, তাহলে হয়তো বেঁচে থাকাটা সম্ভব হতো। দেখো, সবাই কিভাবে তোমাকে কামড়ে খাওয়ার চেষ্টা করে।”

সিমিয়ন একটু চিন্তা করে বললো, “জানি না, ভাই, হয়তো তুমি যা বলছো তাই ঠিক, হয়তো সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা।”

ভ্যাসিলি বললো, “এবং হয়তো, তোমার সাথে কথা বলাটাই আমার সময়ের অপচয়। সব মন্দ জিনিসকে ঈশ্বরের উপর ছেড়ে দিয়ে, বসে বসে ভুগার মানে, ভাই, মানুষ হওয়া না, জানোয়ার হওয়া। আমার এইটুকুই বলার আছে।” বিদায় না জানিয়েই সে চলে গেলো।
সিমিয়নও উঠে দাঁড়ালো। “প্রতিবেশী,” সে ডাকলো, “তুমি এমন রেগে যাও কেন?” কিন্তু তাঁর প্রতিবেশী ঘুরে তাকাল না, নিজের পথ ধরে চলে যেতে লাগলো, যেমন যাচ্ছিলো।

যেতে যেতে মোড়ে অদৃশ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত সিমিয়ন তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলো। বাড়ি গিয়ে স্ত্রীকে বললো, “আরিনা, আমাদের প্রতিবেশীটা একটা দুষ্ট লোক, মানুষ না।”

যাইহোক, তাঁদের মধ্যে কোন প্রকার ঝগড়াঝাঁটি হলো না। আবারো তাঁদের দেখা হলো এবং সে একই বিষয়বস্তু নিয়ে আলাপ হলো।
“আহ বন্ধু, যদি মানুষ এমন না হতো, তাহলে আমাদেরকে আজকে এই কুড়ে ঘরে মাথা গুঁজে পড়ে থাকতে হতো না,” ভ্যাসিলি একদিন বললো।

“আর যদি এমন হয় যে আমরা এই কুড়ে ঘরে মাথা গুঁজে আছি? ব্যাপারটা খুব একটা খারাপ না। তুমি চাইলে এগুলোতেই বাঁচতে পারো।”

“বাঁচতে পারি, অবশ্যই! বাহ, তুমি......তোমার বয়স হয়েছে, কিন্তু জীবনে তেমন কিছুই দেখোনি, তেমন কিছু শিখোওনি। এখানে ওখানে, একটা কুড়ে ঘরে গরিবের বেঁচে থাকা, এটা কেমন জীবন? আর ওদিকে নরখাদকরা তোমাকে গিলে খাচ্ছে। চুষে নিচ্ছে তোমার জীবনের রক্ত, আর তুমি যখন বুড়ো হবে, তাঁরা শুয়োরকে যেভাবে ভুষি খাওয়ায়, সেই ভুষির মতই তোমাকে ছুড়ে ফেলে দিবে। কয় টাকা পাও বেতন?”

“খুব বেশী না, ভ্যাসিলি স্টিপেনিচ—বারো রুবেল।”

“আর আমি, সাড়ে তেরো রুবেল। কেন? কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী আমাদের প্রত্যকেই পনের রুবেল করে পাওয়ার কথা। তুমি বারো রুবেল পাবে নাকি সাড়ে তেরো রুবেল পাবে, সেটার সিদ্ধান্ত কে নেয়? জিজ্ঞেস করো নিজেকে! আর তুমি বল, একটা মানুষ এই কয় টাকায় বাঁচতে পারে? তোমার বোঝার কথা যে এখানে প্রশ্নটা দেড় রুবেল কিংবা তিন রুবেল নিয়ে নয় — প্রত্যেকে পনের রুবেল করে পেলেই বা কি! গত মাসে আমি ষ্টেশনে ছিলাম। ডিরেক্টর আমার পাশে দিয়ে গেল, আমি দেখলাম। তাঁর একটা আলাদা গাড়ি ছিলো। সেটা থেকে বের হয়ে প্লাটফর্মে উপরে দাঁড়ালো.........আমি এখানে আর বেশীদিন থাকবো না; চলে যাবো একদিকে, যেদিকে মন চায়, নাক বরাবর হাঁটা শুরু করবো।”

“কিন্তু যাবে কোথায় স্টিপেনিচ? যাওয়ার আগে যথেষ্ট পরিমাণ রেখে যেও। এখানে তোমার একটা বাড়ি আছে, উষ্ণতা আছে, এক খণ্ড জমি আছে। তোমার বউ একজন শ্রমিক।”

“জমি! তোমাকে দেখাবো আমার জমি। একটা পাতাও নাই জমিতে—কিছুই নাই। বসন্তের সময় কিছু বাঁধাকপি লাগিয়েছিলাম। তখন ইন্সপেক্টর এসেছিল। সে বললোঃ ‘একি? তুমি রিপোর্ট করোনি কেন? অনুমতি ছাড়া এসব লাগিয়েছ কেন? এগুলো সব মূল সহ উপরে ফেলে দাও।’ সে ছিলো মাতাল। অন্য সময় হলে সে কিছুই বলতো না, কিন্তু তখন ব্যাপারটা তাঁর গায়ে লাগলো। তিন রুবেল জরিমানা!...”

ভ্যাসিলি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো, পাইপ টানছিলো, তারপর আস্তে করে বললো, “আরেকটু হলেই আমি তাঁকে সেরে ফেলতাম।”

“তোমার মাথা গরম।”

“না, আমার মাথা মোটেও গরম না, কিন্তু আমি সত্য বলি এবং ভাবি। হ্যাঁ, আমি তাঁকে ছেড়ে দেবো না। আমি চিফের কাছে অভিযোগ করবো। তারপর দেখবো কি হয়!” এবং ভ্যাসিলি সত্যিই চিফের কাছে অভিযোগ করলো।

চিফ একবার লাইন পরিদর্শনে এসেছিলো। তিনদিন পর সেন্ট পিটারসবাগ থেকে বিশিষ্ট লোকজন এই লাইনের উপর দিয়ে যাবে। তাঁরা একটা অনুসন্ধান চালাতে আসবে, সুতরাং তাঁর আগেই সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখাটা জরুরী। পাথরের নুড়ি বিছানো হলো, লেভেলটা ঠিক করা হলো, স্লিপারসগুলো সতর্কতার সাথে পরখ করে দেখা হলো, নাটগুলো টাইট দেয়া হলো, সাইনপোস্টগুলো রং করা হলো আর লেবেল ক্রসিং এর উপর হলুদ বালি ছিটিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হলো। পাশের কুটিরের মহিলাটা তাঁর বুড়ো স্বামীকে জঙ্গলে পাঠিয়ে দিলো। পুরো সপ্তাহটা সিমিয়ন কাজ করলো। সবকিছু ঠিকঠাক করলো, তাঁর কাফতানটা ঠিক করলো, পিতলের প্লেটটা ঝেড়ে মুছে চকচকা করলো। ভ্যাসিলিও অনেক পরিশ্রম করেছিলো। চিফ একটা ট্রলিতে করে আসলো, চারজন শ্রমিক হ্যান্ডেলগুলো ধরে রেখেছিলো, আর বাকীরা ছয়টা চাকা ঘুরাচ্ছিল। ট্রলিটা ঘণ্টায় বিশ কিলোমিটার বেগে চলছিলো। কিচমিচ আওয়াজে চাকাগুলো এগুচ্ছিলো। এটা সিমিয়নের কুটিরে যখন পৌঁছাল, সিমিয়ন দৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে সিপাহীর ভঙ্গিতে রিপোর্ট করলো। দেখে মনে হলো সবকিছুই ঠিকঠাক।

“তুমি কি এখানে অনেকদিন ধরে আছো?” চিফ জিজ্ঞেস করলো।

“২রা মে থেকে আছি, মহামান্য।”

“আচ্ছা, ধন্যবাদ। আর ১৬৪ নম্বর কুটিরে কে থাকে?”

ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (সে চিফের সাথে ট্রলিতে করে এসেছে) উত্তর দিলোঃ “ভ্যাসিলি স্পিরিদভ।”

“স্পিরিদভ, স্পিরিদভ......আহ! এই লোকের বিরুদ্ধেই কি তুমি গত বছর অভিযোগ ঠুকেছিলে?”

“হ্যাঁ, এই লোকই।”

“আচ্ছা, আমরা ভ্যাসিলিস্পিরিদভকে দেখবো। যাও!” শ্রমিকরা হ্যান্ডেলগুলো শুইয়ে রাখলো আর ট্রলিটা পথ থেকে নেমে গেলো। সিমিয়ন এটা দেখলো, আর ভাবলো, “আমার প্রতিবেশী আর তাঁদের মাঝে আজকে একটা ঝামেলা বাঁধবে নিশ্চয়ই।”
ঘণ্টা দুই পরে সে লাইনের উপর দিয়ে কাউকে হেঁটে আসতে দেখলো। তাঁর মাথায় সাদা রঙ্গের কি একটা দেখা যাচ্ছিলো। সিমিয়ন আরেকটু মনযোগ দিয়ে দেখা শুরু করলো। এটা ভ্যাসিলি। তাঁর হাতে একটা লাঠি, কাঁধে একটা ছোট পোঁটলা, আর মুখে একটা রুমাল বাঁধা।

“যাচ্ছ কোথায় তুমি?” সিমিয়ন চিৎকার করলো।

ভ্যাসিলি একেবারে নিকটে চলে আসলো। তাঁর চেহারাটা ফেকাশে, চকের মত সাদা, আর চোখে ছিলো একটা হিংস্র চাহনি। প্রায় রুদ্ধশ্বাসে সে বিড়বিড় করে বললোঃ “শহরে যাচ্ছি—মস্কোতে—হেড অফিসে।”

“হেড অফিস? আহ, মনে হচ্ছে, তুমি অভিযোগ করতে যাচ্ছ। ছেড়ে দাও! ভ্যাসিলি স্টিপেনিচ, বাদ দাও।”

“না, বন্ধু, আমি ভুলতে পারবো না। অনেক দেরি হয়ে গেছে। দেখো! সে আমাকে মুখে মেরেছে, রক্ত বেরুচ্ছে। যতদিন বাঁচবো এই জিনিস আমি ভুলতে পারবো না। আমি এমনি এমনি ছেড়ে দেবো না!”

সিমিয়ন তাঁর হাতটা ধরে ফেললো। “ছেড়ে দাও, স্টিপেনিচ। আমি তোমার ভালোর জন্যে বলছি। তুমি পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারবে না...।”

“উন্নতি! আমি জানি আমি উন্নতি করতে পারব না। ভাগ্য নিয়ে তুমি ঠিক কথাই বলেছিলে। আমার না করাই উচিত হবে, কিন্তু কাউকে না কাউকে তো সত্যের পক্ষে দাঁড়াতেই হবে।”

“কিন্তু ঘটনাটা ঘটলো কিভাবে?”

“কিভাবে? সবকিছু সে ঘেঁটে দেখেছে। ট্রলি থেকে নেমে কুটিরের ভিতরে দেখেছে। আমি আগেভাগেই জানতাম সে খুব কট্টর হবে, তাই আমি সবিকছুই ঠিকঠাক করে রেখেছিলাম। আমি অভিযোগ করার পরপরই সে আমার ওখানে যাচ্ছিল। সে চিৎকার করে বললঃ ‘এখন সরকারী তদন্ত হবে, আর তুমি সবজির বাগান নিয়ে অভিযোগ করেছ। ব্যাক্তিগত কাউন্সিলররা আসছে, আর তুমি আমাকে সামান্য বাঁধাকপি নিয়ে রাগিয়েছ!’ আমি ধৈর্য হারিয়ে কিছু একটা বলে ফেললাম — তেমন কিছু না। কিন্তু সে ক্ষুদ্ধ হয়ে গেল। এবং আমাকে সে মুখে মেরে বসলো। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম, কিছুই করলাম না, যেন সে ভুল কিছু করেনি। তাঁরা চলে গেল। আমি নিজের মধ্যে ফিরলাম। মুখটা ধুয়ে চলে আসলাম।”

“কুটিরের কি হবে?”

“আমার বউ থাকবে সেখানে। সে সবকিছু দেখাশোনা করবে। তাঁদের রাস্তা নিয়ে ভেবো না।”

ভ্যাসিলি উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলে নিলো। “বিদায়, ইভানভ, জানি না অফিসে আমার কথা শোনার মত কেউ থাকবে কিনা।”

“নিশ্চয়ই তুমি হেঁটেই চলে যাচ্ছ না?”

“স্টেশনে গিয়ে একটা মালবাহী ট্রেনে উঠার চেষ্টা করবো। কাল সকালের মধ্যে মস্কোতে থাকবো।”

দুই প্রতিবেশী একে অপরকে বিদায় জানালো। ভ্যাসিলি কিছুদিনের জন্যে হাওয়া হয়ে গেলো। তাঁর স্ত্রী দিন-রাত কাজ করতে লাগলো। সে নির্ঘুম অপেক্ষা করতো তাঁর স্বামীর জন্যে। তৃতীয় দিন কমিশন এসে পোঁছাল। একটা ইঞ্জিন, একটা ভ্যান আর দুইটা প্রথম শ্রেণীর গাড়ি। কিন্তু ভ্যাসিলি তখনো লাপাত্তা। সিমিয়নের সাথে ভ্যাসিলির স্ত্রীর দেখা হলো চতুর্থ দিন। কাঁদতে কাঁদতে তাঁর মুখটা ফুলে উঠেছিলো, চোখগুলো ছিলো রক্ত লাল।

“তোমার স্বামী কি ফিরেছে?”, সিমিয়ন জিজ্ঞেস করলো। মহিলা উত্তরে শুধু হাত দিয়ে একটা অঙ্গভঙ্গি করলো, কিছুই না বলে চলে গেল।

******

সিমিয়ন কচি নলখাগড়া দিয়ে বাঁশি বানানোর কৌশলটা শিখে নিয়েছে। সে বৃন্তের কেন্দ্রটা পুড়িয়ে সেটার গায়ে প্রয়োজন মত ছিদ্র করে নিতো, এক প্রান্তে মুখ লাগানোর জায়গাটা করে নিতো, সেখানে ফু দিয়ে এতো ভালো করে বাজাতো যেন এই বাঁশিতে প্রায় যে কোন সুরই তোলা সম্ভব। অবসর সময়ে সে বেশ কয়েকটা বাঁশি বানিয়ে সেগুলো শহরের বাজারে মালগাড়ির ব্রেকম্যানদের কাছে পাঠাতো। প্রতিটা বাঁশির জন্যে সে দুই কপেক করে পেতো। কমিশন পরিদর্শনের পরের দিন, সে তাঁর স্ত্রীকে ঘরে রেখে সকাল ছয়টার ট্রেনটা ধরতে গেলো, তাঁর আগে জঙ্গলে দিকে গেলো কিছু বাঁশ কেটে আনতে। সে তাঁর সেকশনের শেষ প্রান্তে চলে গেল — এখানে এসে লাইনটা একটা বড় ধরণের মোড় নিয়েছে— বেড়িবাঁধ ধরে জঙ্গলে ঢুকে একেবারে পর্বতের পাদদেশে গিয়ে ঠেকেছে। প্রায় আধা মাইল দূরে ছিলো একটা বড় জলাভূমি, যেটার চারপাশে তাঁর বাঁশি বানানোর চমৎকার নলখাগড়া গজিয়ে ছিলো। সে পুরো এক আঁটি নলখাগড়া কেটে নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলো। সূর্যটা ইতোমধ্যে নিচে নেমে গেছে, গভীর নিস্তব্ধতায় কেবল পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছিলো, আর তাঁর পায়ের নিচে দলিত হওয়া মরা কাঠের কড়মড় আওয়াজ।দ্রুত হেঁটে আসার সময়, তাঁর মনে হলো সে লোহায় লোহায় আঘাতের ঝনঝন শব্দ শুনতে পেয়েছে; সে তাঁর হাঁটার গতি দিগুণ করে দিলো। তাঁর সেকশনে কোন মেরামতের কাজ চলছিলো না। তাহলে এটা কি ছিলো? সে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো, রেলওয়ের উঁচু বাঁধটা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে; বাঁধের উপরে একজন লোক হাঁটু গেড়ে বসে লাইনের মাঝখানে ব্যস্তভাবে কি যেন একটা করছে। সিমিয়ন নিরবে হামাগুড়ি দিয়ে তাঁর দিকে এগুতে লাগলো। সে ভাবলো কেউ হয়তো রেলের নাটগুলোর পেছনে লেগেছে। সে দেখলো যে একটা লোক উঠে দাঁড়ালো, হাতে একটা শাবল। লোকটা রেলের একটা পাত আলগা করে ফেলেছে, পাতটা এখনই এক পাশে সরে যাবে। দেখে সিমিয়নের চোখগুলো ঘোলা হয়ে গেলো, সে চিৎকার করতে চেয়েও পারলো না। এটা ভ্যাসিলি! সিমিয়ন হুড়মুড় করে উপরে উঠলো, আর ভ্যাসিলি হাতে শাবল আর রেঞ্চটা নিয়ে গোত্তা মেরে অপর পাশে চলে গেলো।

“ভ্যাসিলি স্টিপেনিচ! বন্ধু আমার, ফিরে আসো! শাবলটা দাও আমায়। আমরা রেলের পাতটা আগের মত করে দেবো, কেউ জানবে না। ফিরে আসো। এরকম পাপ কর্ম করো না!”

ভ্যাসিলি ফিরে তাকালো না, বনের মধ্যে হারিয়ে গেলো।

সিমিয়ন বিচ্ছিন্ন রেল পাতটার সামনে এসে দাঁড়ালো। হাত থেকে বাঁশের আঁটিটা নিচে ফেলে রাখলো। একটা ট্রেন এখনো আসার বাকী; কোন মালবাহী নয়, বরং যাত্রীবাহী ট্রেন। আর এখন তাঁর কাছে এমন কিছু নেই যা দিয়ে সে ট্রেনটা থামাতে পারে, কোন পতাকাও নেই। সে খালি হাতে রেলের পাতটাও প্রতিস্থাপন করতে পারবে না। তাঁর এখন দৌড়ানো উচিত, কিছু যন্ত্রপাতির জন্যে কুটিরের দিকে দৌড়ানোটা পুরোপুরি জরুরী হয়ে পড়েছে। “ঈশ্বর সহায় হও!” সে বিড়বিড় করে বললো।

সিমিয়ন তাঁর কুটিরের দিকে দৌড়ানো শুরু করলো। তাঁর দম শেষ হয়ে এলো, তবুও সে দৌড়াচ্ছে, পড়ে যাচ্ছে যখন তখন। তাঁর কুটির আর কয়েকশ ফুট বাকী, এর বেশী হবে না, তখনই দূর থেকে তাঁর কানে সাইরেনের আওয়াজ ভেসে আসলো—সকাল ছয়টা! সাত নম্বর ট্রেনটা আসার আর মাত্র দুই মিনিট বাকী। “ওহ, ঈশ্বর, নিষ্পাপ আত্মাগুলোর উপর দয়া করো!” সিমিয়ন তাঁর মনের চোখে দেখতে পেলো, ইঞ্জিনের বাম চাকাটা গিয়ে আঘাত করছে আলগা রেল পাতটাকে, একটা কাঁপুনি, কাত হচ্ছে ট্রেনটা, ছিন্নভিন্ন হয়ে স্লিপারগুলো কুচিকুচি হয়ে যাচ্ছে — আর ঠিক সেখানে, সেখানেই একটা বড় বাঁক আর সত্তর ফুট উঁচু একটা বাঁধ, সেখান থেকে ইঞ্জিনটা উল্টেপাল্টে গড়িয়ে পড়ছে— আর তৃতীয় শ্রেণীর বগিগুলো বস্তাবন্দী হয়ে যাচ্ছে... ছোট বাচ্চাগুলো...সবাই এখন ট্রেনে বসে আছে, এত বড় বিপদের কথা কল্পনাও করতে পারছে না। “ওহ, ঈশ্বর! বলে দাও আমি কি করব!...না, দৌড়ে কুটিরে গিয়ে আবার সময়মত ফিরে আসাটা একেবারেই অসম্ভব।”

সিমিয়ন কুটিরের দিকে দৌড়ানো বন্ধ করে দিলো, উল্টা ঘুরে আগের চেয়ে আরও দ্রুত গতিতে দৌড়ানো শুরু করলো। সে যন্ত্রের মত অন্ধভাবে দৌড়াতে লাগলো; কি হতে যাচ্ছে সে কিছু বুঝতে পারছিলো না। সে দৌড়ে আগের জায়গায় গেল; সেখানে তাঁর ফেলে রাখা বাঁশগুলো স্তূপ হয়ে পড়েছিলো। নুয়ে একটা বাঁশ হাতে নিল, কিন্তু কেন নিল সে নিজেও জানে না, সামনের দিকে দৌড়াতে লাগলো। তাঁর মনে হলো ট্রেনটা ইতিমধ্যেই চলে এসেছে। দূর থেকে হুইশেলের আওয়াজ কানে আসলো, সে রেলের পাতে কাঁপুনির আওয়াজও শুনতে পেল; কিন্তু তাঁর শরীরে আর কুলাচ্ছিল না, দৌড়ে আর সামনে এগুতে পারছিলো না। বিপদজনক সেই জায়গাটা থেকে ছয়শ ফুট দূরে সে একটা খজের কাছে আসলো। তারপর তাঁর মাথায় হঠাৎ বিজলি চমকানোর মত করে একটা বুদ্ধি উদয় হলো। মাথার ক্যাপটা খুলে সেখান থেকে একটা সুতি রুমাল বের করলো, পায়ের বুটের উপরের অংশ থেকে একটা ছুরি বের করে বুকে ক্রস এঁকে বিড়বিড় করে বললো, “ঈশ্বর দয়া করো!”

সে তাঁর বাম হাতে কনুইয়ের উপরে ছুরিটা বসিয়ে দিলো; ফিনকি দিয়ে উষ্ণ রক্তের স্রোত বেরুতে লাগলো। রুমালটা সে রক্তে ভিজিয়ে চুপচুপে করলো, রুমালটাকে বাঁশের আগায় বেঁধে একটা পতাকা বানালো, লাল পতাকা।

দাঁড়িয়ে সে পতাকাটা নাড়াতে লাগলো। ট্রেনটা ইতিমধ্যেই দৃষ্টিগোচর হয়ে গেছে। চালক তাঁকে দেখতে পাবে না—এত কাছ থেকে, আর এত ভারী একটা ট্রেন ছয়শ ফুটের মধ্যে থামানো সম্ভব না।

এদিকে রক্তের স্রোত বয়েই যাচ্ছে। সিমিয়ন ক্ষত জায়গায় হাত দিয়ে রক্ত থামানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছে না। স্পষ্টত সে তাঁর হাতে গভীর ক্ষত করে ফেলেছে। তাঁর মাথা দুলতে শুরু করেছে, চোখের সামনে কালো কালো বিন্দু নাচতে শুরু করেছে, এবং তারপর সবকিছুই অন্ধকার। কানে একটা আওয়াজ বেজে যাচ্ছে। সে আর ট্রেনটা দেখতে পাচ্ছে না, কিংবা কোন শব্দও শুনতে পাচ্ছে না। শুধুমাত্র একটা চিন্তায় সে আবেশিত ছিলো। “আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না। আমি পড়ে যাবো, পতাকাটাও পড়ে যাবে। ট্রেনটা আমার উপর দিয়ে যাবে। আমায় বাঁচাও, ও ঈশ্বর!”

তাঁর সামনে সবকিছু কালো হয়ে এলো, তাঁর মনটা শূন্য হয়ে গেলো, এবং তাঁর হাত থেকে পতাকাটা পড়ে গেল; কিন্তু রক্তে রঞ্জিত কাপড়টা মাটিতে পড়লো না। একটা হাত এটাকে ধরে ফেললো এবং ধেয়ে আসা ট্রেনটাকে উদ্দ্যেশ্য করে কাপড়টা উঁচিয়ে ধরলো। ইঞ্জিনিয়ার এটাকে দেখলো, দেখে ট্রেনের রেগুলেটর বন্ধ করে দিলো। ট্রেনটা ধীরে দাঁড়িয়ে পড়লো।

মানুষজন লাফিয়ে বগি থেকে নেমে একসাথে জড়ো হলো। তাঁরা দেখলো পথে একজন লোক অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, সারা শরীর রক্তে ভেজা, আর আরেকজন লোক একটা বাঁশের আগায় বাঁধা রক্তে রঞ্জিত একটা কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ভ্যাসিলি সবার দিকে ঘুরে তাকালো। তারপর, মাথাটা নিচু করে বললোঃ “আমাকে বেঁধে ফেলো। আমি রেলের একটা পাত বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছি।”

মূলঃ দ্যা সিগন্যাল — সিয়েভলদ গারশিন
অনুবাদঃ শরিফুল ইসলাম (শরীফ আজাদ)
জুলাই ১৬, ২০১৬

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে জুলাই, ২০১৬ সকাল ১১:২৯

পুলহ বলেছেন: মূল ঘটনাটা তো গল্পের ২য় অংশেই মনে হোল। ভালো লেগেছে
অনুবাদকর্ম চলুক।
শুভকামনা ভাই!

২৪ শে জুলাই, ২০১৬ দুপুর ২:৪০

শরীফ আজাদ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। অনুবাদ চলবে। সাথে থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.