নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মাদিহা মৌ

মাদিহা মৌ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অন্তলীণ

২৮ শে মে, ২০১৬ রাত ৯:০১

টুপটুপ করে বৃষ্টি পড়ছে সকাল থেকে। অবিরামভাবে। জঘন্য আবহাওয়া! জানালার পাশে বসে কালো আকাশটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সামিনা চৌধুরী। এমনিতেই তিনি নতুন বাসাটায় এসে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যে নেই। বাসাটা কেমন যেন পরিত্যক্ত পরিত্যক্ত লাগে। তাঁর মেয়েটা এত গোছগাছ করে রাখে তবুও ভালো লাগেনা এই বাসায়। কি যেন একটা সমস্যা আছে বাসাটায়!

কলিংবেলের শব্দে ঘোর কাটলো। সন্ধ্যা হয়েছে সেই কখন! নিশ্চয়ই আফসা এসেছে। এত লক্ষী মেয়ে তাঁর। এটুকু বয়সেই ঘরদোর সামলে স্কুলে যায়, ক্লাস করে, পড়াশোনা করে।
কী আর করবে? মা অসুস্থ আর বাবা থাকে প্রবাসে। সে ছাড়া মাকে দেখাশোনা করার মত কেউই নেই।
'তুমি জানালার পাশে বসে আছো?' ঘরে ঢুকেই অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো আফসা।
'বৃষ্টিতে ভেজা রাজবাড়ি দেখছি।' মৃদু হেসে বললেন সামিনা চৌধুরী।
'ওই অভিশপ্ত বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকার দরকার নাই! এসো খাবে।'
'রাজবাড়ি হলেই কি অভিশপ্ত হতে হবেরে মা?' হাসছেন তিনি।
মুখ ঘুরিয়ে রাজবাড়ির দিকে তাকালেন তিনি। প্রথমেই দৃষ্টি কাড়ে এর সুবিশাল সিঁড়ির ধাপগুলো। সিঁড়িগুলো অর্ধচন্দ্রাকার। দু’পাশে দুটি পাথরের সাদা ময়ুর পেখম তুলে দাঁড়িয়ে আছে প্রহরীর মত। প্রকান্ড রাজবাড়ি বলতে যা বোঝায় এটা তা নয়। আজকালকার ছোটখাট ডুপ্লেক্স বাড়িগুলির সমান। কিন্তু শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, যে কেউই বাড়িটার দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকাবে। একসময় ভিতরে নাকি অনেক প্রাচীন সামগ্রী ছিল। কিন্তু রাজবাড়ির বর্তমান মালিকেরা একে একে সব বিক্রি করে দিয়েছে। রাজবাড়ির পাশেই রানির বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে স্বগৌরবে। যদিও এর ইট-সুরকি ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে।

'এই রাজবাড়ির একটা কাহিনী আছে, জানিস?' রাতে খেয়ে এসে মেয়েকে বললেন সামিনা চৌধুরী।
'কী কাহিনী?' আগ্রহ নিয়েই জিজ্ঞেস করল আফসা। একটু আগের সেই আগ্রাসী মনোভাবটা এখন আর নেই। নড়েচড়ে বসে বসে গল্প বলতে শুরু করলো তিনি।
'রাজবাড়ির নাম প্রতাপ শাহ রাজবাড়ি-সেটা তো তুই জানিসই। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে কোন হিন্দু জমিদারের বাড়ি। কিন্তু বাড়িটা বানিয়েছিল এক মুসলিম পরিবার। আকন্দ পরিবার। এই এলাকায় তাদের বেশ নাম-ডাক ছিল। তাদের একটা শুধু একটাই দোষ ছিল। আর তা হলো তাদের অসম্ভব বদমেজাজ। নিজেদের কথা থেকে তাদেরকে এক চুলও নড়ানো যেত না। একারনেই তো এই বাড়িটা হাতছাড়া হয়েছিল!' থামলেন সামিনা চৌধুরী।
'কীভাবে হাতছাড়া হলো, মা?'
'তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলছিল। আকন্দ পরিবারের বড় ছেলে সোলায়মান আকন্দ সেই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রতাপ শাহ ছিল এই বাড়ির সাধারণ কেয়ারটেকার।'
'তারপর?'
'বাঙ্গালী মুসলিমদের উপর ব্রিটিশদের এমনিতেই ক্ষোভ ছিল। তার উপর এরা আবার ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে করছিল। তাই ওদের উপর আধিপত্য বজায় রাখতে এই বাড়ি ও বাড়ির আশেপাশের সমস্ত জায়গার উপর ৫০ টাকা কর আরোপ করল।'
'মাত্র ৫০ টাকা?' অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল আফসা।
'তখনকার সময়ে এই ৫০ টাকাই অনেক অনেক বেশি ছিল।' হেসে বলল সামিনা চৌধুরী।
'তারপর কী হল?'
'আকন্দরা এই ৫০ টাকা দিতে রাজি হল না। ওই যে, ওদের একরোখা স্বভাব! ওইদিকে প্রতাপ শাহ করল কী, কোত্থেকে যেন ৫০ টাকা জোগাড় করে ফেলল। আর সে যেহেতু হিন্দু, ব্রিটিশরা এই বাড়ির মালিকানা তাকে দিয়ে দিল। আর আকন্দদের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করল।'
'প্রতাপশাহ তো দারুণ নিমকহারাম! যে তাকে আশ্রয় দিল তার বুকেই ছুরি মারলো!' তিক্ত কন্ঠে বলল আফসা।
'হুম! ঠিকই বলেছিস। এরপর কী হলো জানিস? আকন্দদের ছোট ছেলেটা মাস দুয়েক পর কেন যেন এই বাড়িতে এসেছিল।' থামলেন সামিনা চৌধুরী।
গলাটা শুকিয়ে গেছে। বেডসাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা তুলে নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলেন। 'এরপর ছেলেটা বেমালুম গায়ের হয়ে গেল।'
থেমে থেমে লাইনটা শেষ করল তিনি।
'গায়েব হল মানে? কীভাবে গায়েব হল?' আফসার গলায় নিখাদ বিস্ময়।
'সেটা কেউ জানে না।' মাথা নাড়লেন সামিনা চৌধুরী। 'তখন এই বাড়ির চারপাশে ঘন জঙ্গল ছিল। খানাখন্দে ভরা ছিল। আশেপাশে আর কোন বসতি ছিল না। ধারণা করা হয় ছেলেটা কোন একটা জলায় ডুবে মরে গেছে। কারণ তন্নতন্ন করে খুঁজেও তাকে কোথাও পাওয়া যায়নি . . .'
কথা শেষ হবার আগেই দমকা বাতাসে জানালার কপাটটি বাড়ি খেল। চমকে উঠল মা-মেয়ে। গল্পে এতটাই তন্ময় হয়েছিল যে বাইরে ঝড়ের আলামত চোখেই পড়েনি।
'অনেক রাত হয়েছে! শুয়ে পড়! সকালে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, মনে আছে তো?' আটমাসের অন্তঃসত্ত্বা মাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আফসা নিজেও শুতে গেল।

দুইমাস পর...
সামিনা চৌধুরীর ঘর এখন আর নীরব নেই। ঘরটি এখন সর্বদাই নবজাতকের কান্নায় প্রতিধ্বনিত হয়ে থাকে। নবজাতকের নাম রাখা হলো আফিফ। আফসা স্কুলে না গিয়ে সারাদিনই পড়ে থাকে ভাইকে নিয়ে। ভাইয়ের প্রতি তার ভালোবাসার কোন কমতি নেই।

কিন্তু কেন যেন এই বাচ্চাটা একা থাকলেই তারস্বরে চিৎকার করে উঠে! আবার মাঝেমধ্যে সামনে মা অথবা বোন থাকলেও চিৎকার করে কাঁদে। যতক্ষণ না পর্যন্ত কেউ তাকে কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে কাঁদতেই থাকে।

সামিনা চৌধুরী বুঝতে পারছেন না ছেলেটা এত কাঁদে কেন। ডাক্তার দেখিয়ে এনেছেন সেদিন,-কিছুই ধরতে পারেনি ডাক্তাররা। শুধু বলেছে, 'মনে হয় ভয় পেয়ে কাঁদে। ওকে স্বাভাবিক হবার সময় দিন। আর এই সময়টুকুতে ওকে একা রাখবেন না!'

এক দুপুরে সামনের রুমে আফিফকে নিয়ে শুয়ে আছেন সামিনা। আফসা স্কুলে। হঠাৎ যে কখন ঘুমিয়ে পড়লেন জানেন না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল উনার। পাশে তাকিয়ে দেখে আফিফ ঘুমাচ্ছে। বেকায়দায় শোয়াতে হালকা নাক ডাকছে। প্রকৃতিতে শুনশান নীরবতা। একটা পাখিও ডাকছে না। এরকম নীরব হওয়ার কারণটা কী?

শুয়ে শুয়ে ভাবছেন তিনি। ছেলের গায়ের উপর একটা হাত ফেলে রেখেছে আলতো করে। হঠাৎ শো শো বাতাস বয়ে গেল। শ্যাওলা পচা গন্ধ এসে যেন ঝাপটা মারলো সামিনা চৌধুরীর নাকে-মুখে। তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসলেন তিনি। তক্ষুনি বিছানার পাশে একটা কালো ছায়ামত দেখলেন। ছায়াটা তড়িৎবেগে ভেসে সামিনার ছোট্ট আফিফের সামনে এসে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইল। তারপর বেমালুম উধাও। সাথে সাথেই ঘুম ভেঙে গেল আফিফের, চিৎকার করে উঠল। যেন ছায়াটা আফিফের শরীরের ভিতরেই ঢুকে গেছে।

পরের ছয়টা মাসে আরো ৩-৪ বার বিভিন্ন সময়ে এরকম ঘটতে দেখলেন সামিনা। আফিফ দিনদিন আরো রুগ্ন হয়ে যাচ্ছে। অসুস্থতা যেন ওর পিছুই ছাড়ছে না। এক ভোরে অস্বাভাবিক চিৎকার শুনে ঘুম ভাংলো সামিনা চৌধুরীর। আফিফের কপালের দিকে তাকিয়ে উনার চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেছে! লম্বা একটা দগদগে কাটা দাগ সেখানে। যেন শক্ত কিছুর সাথে আঘাতের কারণে মাথা ফেটে গেছে। কিন্তু এটা কীভাবে হলো তা ভাববার অবকাশ পেলেন না সামিনা চৌধুরী। দৌড়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন বাবুকে। কোন ব্যাখ্যা দিতে পারল না ডাক্তাররা।

উনার কাছে মনে হচ্ছে এই বাসাটায় কিছু একটা আছে। কী আছে তা তিনি বলতে পারবেন না, কিন্তু কিছু যে একটা আছে তা একদম নিশ্চিত। এখানে আর বেশিদিন থাকার সাহস পেলেন না। ছেড়ে দিলেন বাসাটা।

এরপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। আফিফ এখন সুস্থ এবং স্বাভাবিক। কপালের দাগটাও এখন আর নেই। আগের
বাসাটা ছেড়ে দেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই দাগটা মুছে যায় আফিফের কপাল থেকে।

আফিফ একদিন বন্ধুদের সাথে চালতা চুরি করতে রাজবাড়িতে ঢুকলো। বাড়ির আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেকগুলো
চালতা গাছ। বেশি পরিমাণ চালতা সংগ্রহের জন্য তার বন্ধুরা একেকজন একেক দিকে গেল।

অ্যাডভেঞ্চারের আশায় চালতা চুরি করতে এলেও আফিফের চালতার প্রতি কোন লোভ নেই। ওর বন্ধুরা চালতা পাড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর সে দাঁড়িয়ে আছে ক্ষুদ্রাকৃতির রাজবাড়িটার প্রকান্ড সিড়ির সামনে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে পেখমমেলা সাদা ময়ূর দুটি।

সদর দরজাটা বন্ধ। রাজবাড়ির বর্তমান মালিকেরা এখানে থাকে না। কালেভদ্রে আসে। এই বাড়িতে নাকি একসময় অনেক মূল্যবান তৈজসপত্র ছিল। এখনো আছে কিনা জানে না আফিফ। বাড়ির ভিতরটা কেমন-তা দেখার প্রচন্ড কৌতূহল হচ্ছে তার।

খুঁজতে খুঁজতে নিচতলার শিকভাঙ্গা একটা জানালা পেয়ে গেল। উত্তেজিত হয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল আফিফ।
ঘরের ভিতরে আবছা আলো।
পরিস্কারভাবে দেখা যায় না কিছুই। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করল আফিফ। মোবাইল ফোনের স্বল্প আলোয়
সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া শুরু করল।
এঘর ওঘর ঘুরে দেখার মত কিছুই খুঁজে পেল না। হয়তো এখনকার মালিকেরা সেসব জিনিস বিক্রি করে দিয়েছে। ভাবতে ভাবতে আরেকটা বড় ঘরে ঢুকতে পা বাড়ালো আফিফ। কিছু একটার সাথে পা বেঁধে হুমড়ি খেল। সাথে সাথেই হাঁচড়েপাচড়ে উঠে দাঁড়াল। কিসের সাথে হোচট খেয়েছে দেখতে গিয়ে ওর চোখ কপালে উঠল। মেঝেতে কার্পেটের এক কোনা উল্টে আছে। সেখানকার একটা আলগা কাঠে পা লাগার কারনেই পড়ে গিয়েছিল সে।
ইট পাথরের বিল্ডিংয়ের মেঝেতে কাঠের আলগা পাত থাকবে কী কারণে? সেটাও আবার কার্পেট দিয়ে ঢাকা? গুপ্তপথ নাকি? মনে মনে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল আফিফ। বসে এক হাত দিয়ে কার্পেটটা আরেকটু সরিয়ে দিল। ঠিকই ভেবেছিল! একটা আলগা কাঠ মেঝের সাথে সমান করে বসানো। উপরে একটা আংটাও আছে টেনে তোলার জন্য। আফিফ দুই হাতে কাঠটা টেনে সরালো। যা ভেবেছিল তাই ই। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে।

অতি সন্তপর্ণে সিঁড়ির ধাপে পা রাখল সে। মুঠোফোনটা শক্ত করে ধরে রেখেছে এক হাত দিয়ে।
কয়েকধাপ নামতেই খুট করে শব্দ শুনতে পেল। উপর থেকে এসেছে শব্দটা। ঝট করে ঘাড় ফিরালো আফিফ। কাঠের
আলগা পাতটা সিঁড়িমুখকে ঢেকে ফেলেছে। সাথে সাথে একটা গা শিরশিরানো অনুভূতি হলো ওর।

সেলারে কালিগোলা অন্ধকার।
মোবাইলের আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছোট্ট ঘরটা দেখছে ও। অদ্ভুত সব জিনিসপত্রে ঠাসা ঘরটা। ফাঁসিকাষ্ঠ, শূল আরো অনেক অত্যাচারের যন্ত্র। সবগুলি চেনে না আফিফ। এসব দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। তাছাড়া কেন যেন মনে হচ্ছে,
তার দিকে কেউ নজর রাখছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কেউ তাকিয়ে আছে!

বেরিয়ে আসার জন্য সিঁড়ি বেয়ে উঠতে যাবে, এমন সময় চোখে পড়ল জিনিসটা! একটা প্রমাণ সাইজের রয়েল বেঙ্গল
টাইগারের মূর্তি। ফ্লাশলাইটের আলোয় মূর্তিটার রুপালি রংটা চকচক করছে। রুপালি রঙের বাঘ! বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল আফিফ। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল মূর্তিটার কাছে। এত নিঁখুতভাবে যে মূর্তি বানানো সম্ভব, তা বিশ্বাসই হচ্ছে না আফিফের। ওর মনে হচ্ছে, যেকোন মূহুর্তে নড়ে উঠতে পারে মূর্তিটা।
ওটার শরীরে, মুখে, গোঁফে আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখল। তাকে আরো অবাক করে দিয়ে মূর্তিটার পেটের কাছ দিয়ে দরজার মত কপাট খুলে গেল!
মূর্তিটা নিরেট নয়, ভিতরের দিকটা ফাঁপা। তাতে ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেলতেই জমে গেল সে! একটা নরকঙ্কাল পড়ে আছে বাঘের পেটের দিকটায়। কোটরবিহীন খুলিটা দাঁতমুখ খিচিয়ে যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে!

তার দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু না, সে তা করতে পারছে না। পা দুটোতে যেন শিকড় গজিয়েছে! একদৃষ্টিতে রুপালি বাঘের পেটে পড়ে থাকা কঙ্কালটাকে দেখছে। হঠাৎই একটা কালো ছায়াকে দেখল বাঘের পেটের ভিতর থেকে উঠে আসতে। ধোয়াটা বাতাসে ভাসতে ভাসতে এসে ঢুকে পড়ল শরীরের ভিতর।

সবকিছুই এখন ঘোলাটে মনে হচ্ছে আফিফের। যেন এই দুনিয়ায় নেই সে! অন্য কোথাও বিচরণ করছে!

দৃশ্যপট বদলে গেছে। মা কেন যেন বকছে আফিফকে। কান পেতে রান্নাঘরে থাকা মায়ের বকবকানি শোনার চেষ্টা করল সে। বুঝতে পারল ঠোঁট চোষার জন্য বকছে মা। জন্মের পর থেকে অদ্ভুত এক বদ অভ্যাস তার। কোন কাজ না থাকলে বসে বসে নিজের ঠোঁট চোষে। শত চেষ্টা করেও এই বদ অভ্যাসটা ছাড়তে পারছে না।
'ঠোঁট চুষে চুষে নিচের সারির দাঁতের বারোটা বাজাচ্ছো তুমি!' বকতে বকতেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মা। মাকে দেখে চমকে উঠল আফিফ! হায়! এই মহিলা কে! একে তো কখনো দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না! কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে চাইল। কিন্তু তার আগেই মহিলা হাত ধরে টেনে আয়নার সামনে নিয়ে এল তাকে।
'দেখ আয়নায় নিজের চোখে দেখ!' তীব্র গলায় চেঁচিয়ে উঠল মহিলা।

আয়নার দিকে তাকিয়ে আরেক দফা চমকে উঠল আফিফ। এটা কার প্রতিবিম্ব দেখছে সে? একে তো সে চেনে না! কপালে এত বড় একটা কাটা দাগ। এই দাগ কোত্থেকে এল?
হতভম্ব ভাবটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না তার। ঝাড়া দিয়ে কাঁধ থেকে মায়ের হাতটা সরিয়ে দিল। এখন আর অবাক লাগছে না। এসব কি আবোলতাবোল ভাবছে? এই মহিলাই তো তার মা। সারাদিন খালি বকে। কাঁদতে কাঁদতে রাজবাড়িতে চলে এল সে। এটা তাদেরই বাড়ি ছিল। মাত্র দুমাস আগে তাদের এই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।

রাজবাড়ির ভিতরে না ঢুকে সবার চোখ এড়িয়ে কী করে মাটির নিচের ঘরে যেতে হয় তা ভাল করেই জানা আছে তার। গতবছর বড় দাদাকে এভাবেই ঢুকতে দেখেছে। ময়ূরের পিছনে একটা ঝোপ আছে। ওটা সরিয়ে দিতেই একটা ফোকর বেরিয়ে পড়ল। তা দিয়েই সেলারে ঢুকে পড়ল। বাঘটার ভিতরে ঢুকে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকবে। যাতে কেউ তাকে খুঁজে না পায়। তারপর রাগ কমলে বাড়ি যাবে।

কিন্তু রাগ কমার পর আর কিছুতেই মূর্তিটার দরজা খুলতে পারল না সে। কাঁদতে কাঁদতে একটা সময় মূর্তিটার ভিতরেই ঘুমিয়ে পড়ে।
একটা ঝাঁকি খেয়ে আচ্ছন্নতা থেকে বর্তমানে ফিরে এল আফিফ। কী হয়েছে বা এখানে কী করে এল কিছুই বুঝতে পারছে না। বাইরে বন্ধুদেরও কোন সাড়া পাচ্ছে না। সন্ধ্যাও প্রায় নেমে এসেছে। সেলার থেকে বেরিয়ে বাসায় গেল।
বাসায় ঢুকতেই মায়ের সাথে দেখা হল ওর। খাবার নিয়ে বসে আছেন। সারাদিন এভাবে উধাও থাকার জন্য সাথে কিছু বকাঝকাও তৈরি রেখেছিলেন, ওকে দেখেই চমকে গেলেন সামিনা চৌধুরী।
'তোর কপালে কী হয়েছে?' জবাবে হাসলো আফিফ।
'ও কিছুনা! পড়ে গিয়ে কেটে গেছে!'
এই বলে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসল আফিফ। খাওয়ার পর আর মায়ের সাথে আর তেমন একটা কথা বলে নি। নিজ ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে গেল।

রাতের বেলা সামিনা আফিফের গায়ে কাঁথা তুলে দিতে এসে দেখে, ছেলেটা অদ্ভুত ভঙ্গীতে নিচের ঠোঁট চুষছে!
.
.
.
.
গল্পটা ২০১৫ বইমেলায় প্রকাশিত বিসর্গ গল্প সংকলন বইটিতে ছিল।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে মে, ২০১৬ সকাল ১০:০২

হাসান মাহবুব বলেছেন: অননুমেয় এবং টুইস্টেড! পাঠকের চিন্তা ধাক্কা খাবে। বাস্তব আর ফ্যান্টাসির চমৎকার রহস্যপুর্ণ সমন্বয়। শেষ হলেও রেশ থাকে।

২৯ শে মে, ২০১৬ বিকাল ৪:৪৮

মাদিহা মৌ বলেছেন: ইসসসসস! এত প্রশংসা করছেন! ভেসে যাচ্ছি! লেখার প্রশংসাটুকু সত্যিই খুব আনন্দ এনে দেয়।
ধন্যবাদ ভাইয়া। :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.