নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মাদিহা মৌ

মাদিহা মৌ › বিস্তারিত পোস্টঃ

রক্তাক্ত সূর্যোদয়

২৩ শে জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫১

১.
রৌদ্রজ্জ্বল দুপুর।
পাঁচ ব্যাটারির রেডিওতে রেডিও পাকিস্তান টিউন করা হয়েছে। তাতে ইয়াহিয়ার ভাষণ চলছে। সে ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের বৈঠক মুলতবি ঘোষণা করেছে।
নব ঘুরিয়ে রেডিও বন্ধ করে দিল জাফর। এইসব রাজনৈতিক ব্যাপারে মাথা ব্যথা নেই তার। অনেকক্ষণ ধরেই বুড়ি ঘ্যানঘ্যান করছে বাজারে যাওয়ার জন্য। ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়ল সে।
জাফরের বাবা - মা কেউ নেই। এই বুড়ির কাছেই মানুষ হয়েছে। এতিমখানা থেকে আনা হয়েছিল জাফরকে। বুড়িরও দুই কূলে কেউই নেই। দুইজনেই তাদের সংসার।
বাজারের দিকে যেতে যেতে সে দেখে আশেপাশের দোকানে অসম্ভব ভিড়! সবাই ঘরের জন্য কেনাকাটা করছে। ঘটনা কি! গ্যাঞ্জাম লাগল নাকি কোন? ধুর! এত কিছু ভাবনা চিন্তা করে কি হবে? ভিড় ঠেলে বুড়ির লিখে দেওয়া লিস্ট থেকে সদাই কিনল জাফর।
"দৈনিক পাকিস্তান" অফিস এর সামনে এসে রিকশা থেমে গেছে। এত ভিড় যে কোন গাড়িই চলতে পারছে না। লোকে বলাবলি করছে শেখ মুজিব নাকি প্রেস কনফারেন্স ডেকেছেন। বিরক্ত হয়ে রিকশাওয়ালাকে রিকশা ঘুরিয়ে নিতে বলল জাফর। অন্য রাস্তা ধরে বাসায় ফেরার পথে এক জায়গায় পাকিস্তানী পতাকা আর জিন্নাহর ছবি পুড়তে দেখলো। চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছে,
"ইয়াহিয়ার বুকে লাথি মারো,
সোনার বাংলা স্বাধীন করো!"
বাসায় গিয়ে ঢুকতেই বুড়ি বলল, ‘শুনছোস? ৭ তারিখে শেখ মুজিব রেসকোর্স ময়দানে গনজমাতের ঘোষণা দিছে!’
‘তাতে তোমার কি?’ খেঁকিয়ে উঠল জাফর।
‘তুমি তোমার চাল চিনি বুঝে নাও! দেশ নিয়ে তোমাকে আমাকে মাথা ঘামাতে হবে না! আর তোমার যদি এতই মাথা ঘামাতে ইচ্ছা করে, নিজে নিজে মাথা ঘামাও! আমাকে বলতে আসবে না! এইসব ঝামেলার জন্য আমার পাকিস্তান যাওয়া দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে! কবে যে যেতে পারবো কে জানে!’
জাফরের চিৎকার চেঁচামেচি শুনেও কিছুই বলল না সাহেরা বেগম। 'পোলাডা কেমুন জানি হইয়া যাইতাছে দিন দিন! কি একটা বিহারী মাইয়ার লগে প্রেম করে - টয়েটা নাম! নামের কি বাহার! এই মাইয়ার লগে প্রেম করার পর থেইকাই পোলাডা বদলাইয়া গেল। মাইয়া নাকি তাকে জেনেভা নিয়া যাইব! সেখানেই থাইকা যাইব!' বিড়বিড় করে নিজেকেই শোনাচ্ছেন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সাহেরা। যে একাকিত্ব দূর করার জন্য এই ছেলেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করলেন - সেই ছেলেই তাকে একা ফেলে চলে যেতে চায়! মনে মনে বিহারী মেয়েটাকে অভিশাপ দেন তিনি। বিহারীরা আজীবনই বাঙালীদের শত্রু!
বুড়ির চেহারা দেখেই জাফর বুঝতে পারলো সে টয়েটার মুন্ডুপাত করছে। উপরে উপরে যতই জিদ দেখাক না কেন, জাফর বুড়িকে এই মরার দেশে ফেলে রাখবে না। টয়েটা বলেছে জেনেভা গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব জাফরকে চাকরীর ব্যাবস্থা করে দিবে। টয়োটার বাবার অনেক প্রতিপত্তি। চাইলেই তিনি অনেক কিছু করতে পারবেন! তার সাহায্যেই জাফর এখন পশ্চিম পাকিস্তানে যাবে। সেখানে টয়েটা অপেক্ষা করছে ওর জন্য ।
টয়েটার কথা ভাবতেই মন আনন্দে ভরে উঠল জাফরের। লম্বা একহারা গড়ন মেয়েটার। দুধে আলতায় মেশানো গায়ের রং। কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল। চোখগুলো টানাটানা। ঘন কালো চোখের পল্লব। আর ভূবন ভোলানো এক হাসি! ওই হাসি দেখেই প্রেমে পড়েছিল জাফর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের দুই ব্যাচ নিচের ছাত্রী ছিল টয়েটা। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম দেখা, সেখান থেকেই ধীরে ধীরে প্রেম।
অনেকদিন হলো কথা হয় না ওর সাথে। পাশের বাসা থেকে একটা ট্রাংকল বুক করল জাফর।
২.
আজকের দিনে বাসায় বসে থাকা খুব কাজের কিছু হবে না। জাফর রেসকোর্স ময়দানে যাবার জন্য ঘর থেকে বের হলো। যদিও এইসব বক্তৃতা টক্তৃতার ব্যাপারে তার কোন আগ্রহ নেই। সে শুধু যাচ্ছে কেমন মানুষ হয় জনসভায় সেটা দেখতে। সাহেরা বেগম এসে বলল, ‘আমারেও নিয়া যাবি? আমি শেখের বক্তৃতা শুনবার চাই।’
‘মেয়েমানুষ জনসভায় যাবে নাকি! ঘরে বসে রেডিওতে ভাষণ শুনবে!’
উত্তরের অপেক্ষা না করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল জাফর।
পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের মত মানুষের ঢল নেমেছে রেসকোর্স ময়দানে। এত মানুষ! এরা সবাই স্বাধীনতা চায়! চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছে,
"স্বাধীনতা, নাকি অধীনতা?
স্বাধীনতা! স্বাধীনতা!!"
ভাষণ চলছে। এত মানুষের সমুদ্রে বঙ্গবন্ধুর তীব্র শ্লেষ বজ্রকন্ঠের ভাষণ ছাড়া আর কিছু নেই। মাথার উপর দিয়ে শ্যাওলা রঙের হেলিকপ্টার উড়ছে। হয়ত সাধারণ মানুষদের ভয় দেখাতে চায়! কিন্ত বিশাল জনসমুদ্রের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই! তারা মুজিবের প্রত্যেকটা শব্দ শুনছে মনোযোগ দিয়ে!
বাসায় ফিরতেই সাহেরা বেগম চেপে ধরল জাফরকে!
‘ভাষণে কি কইল শেখ?’
‘কেন? তুমি রেডিওতে শোননি?’
‘ভাষণের পুরোডা সময় স্বাধীন বাংলা বেতারে কোন আওয়াজই আছিল না!’
উত্তেজিত গলায় বললেন সাহেরা। ‘শেখের বক্তৃতা রিলে করবার জইন্য কর্মীরা রেডিই আছিল। শেষ মুহূর্তে মার্শাল অথোরিটি বক্তৃতা প্রচার করতে দ্যায় না। রাইগা-মাইগা ইস্টিশনের কর্মীরা হাত গুটাইয়া বইল! বক্তৃতা রিলে কইরতে না দিলে অন্য কোন অনুষ্ঠানই হইতে পারব না!’
‘তোমাকে এসব খবর কে বলল?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল জাফর।
‘লতিফের সাথে দেখা হইল একটু আগে! ও ই কইল।’
লতিফ একসময় জাফরদের পড়শী ছিল। রেডিওতে কাজ করে।
‘এত কথায় কাম নাই! শেখ সাহেব কি কইল, ক!’
‘ধুর! কি সব আবদার যে করো তুমি!’ বিরক্ত গলা জাফরের।
‘লগে নিয়া গেলে তো এই ঝামেলা হইত না! নে শুরু কর!’
বলতে শুরু করার পর জাফর অবাক হয়ে লক্ষ করল, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অধিকাংশ পয়েন্টগুলোই তার মনে আছে! বঙ্গবন্ধুর মত গমগমে গলা তো আর তার নয় - সে তার নিজের মত করে বলছে। আর বুড়ি তন্ময় হয়ে শুনছে সেই ভাষণ!
পরদিন সে আবারো পাশের বাসায় গেল। উদ্দেশ্য টয়োটাকে ট্রাংকল বুক করবে। কারণ আগেরবার পাওয়া যায়নি ওকে। কিছুক্ষণ বাদেই মুখ ভোঁতা করে ফিরে এলো সে। শেখ মুজিব তার গতকালের ভাষণে দেশের বাইরে ট্রাংকল নিষিদ্ধ করেছিলেন। সেই সাথে আরো অনেক বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। আজ সেসবের বাস্তবায়ন হচ্ছে। নিজে নিজেই গজগজ করতে লাগল জাফর। এসব গ্যাঞ্জামের জন্য কতদিন ধরে তার ময়না পাখিটার সাথে কথা বলতে পারছে না! কল্পনায় সে চলে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে! যেখনে অগুনিত বিকাল কাটিয়েছে টয়েটার হাতে হাত রেখে।

৩.
রেডিওটা কেন যেন কাজ করছে না। টয়েটার সাথে ফোনেও কোন ভাবেই যোগাযোগ করতে পারছে না জাফর। অবশ্য জাফর জানে, টিকেট কনফার্ম হলে তা ডাকযোগে বাসায় পৌছে যাবে। অতএব চিন্তার কোন কারণ নেই। বুড়ির ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে খবরের কাগজ কিনে এনেছে। কিছু করার নেই, তাই বসে বসে "দৈনিক পাকিস্তানের" পাতা উল্টাচ্ছে। অনেক গরম খবর পাতায় পাতায়। তারমধ্যে দুইটা খবর বিশেষভাবে নজর কাড়লো তার।
একটা হলো "দৈনিক পাকিস্তান" এর সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন "সিতারা-ই-খিদমত" ও "সিতারা-ই-ইমতিয়াজ" খেতাব বর্জন করেছেন। সেই সাথে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, মুনীর চৌধুরী, শেখ মোশাররফ হোসেন তাদের নিজেদের খেতাব বর্জন করেছেন!
জাফর বুঝতে পারছে না এত সম্মানজনক খেতাব তারা কেন বর্জন করেছেন! কী লাভ এতে?
দ্বিতীয় খবরটি সে পড়ল দাঁত কিড়মিড় করতে করতে। সেটা ছিল,
‘কোন বাঙালী প্লেনের টিকেট পাচ্ছে না, অথচ বিপুল সংখ্যক অবাঙালী রোজই প্লেনে করে বাংলাদেশে ছেড়ে যাচ্ছে!’
খবরের কাগজটা ছুঁড়ে ফেলল জাফর, এসব কী হচ্ছে? কেন হচ্ছে? একটু সুখের খোঁজে এদেশ ছাড়তে চাচ্ছে সে। তাও কী করতে পারবে না?
পাড়ার টংএর দোকানে অনেকদিন পর বসল জাফর। আরো কিছু তরুণ আড্ডা দিচ্ছে সেখানে। কড়া লিকার দিয়ে এক কাপ চা অর্ডার করে জাফরও বসল ওদের সাথে। ওদের আলোচনা কানে আসছে তার। কথার সারমর্ম এই ছিল যে, ইয়াহিয়া, মুজিব, ভুট্টো বৈঠক করছে। দেশের সর্বশ্রেণীর লোক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সি.এস.পি, ঈ.পি.সি.এস...সবাই নিজ পেশার ব্যানারে মিটিং করছে । জয়দেবপুরে মিলিটারি পাবলিকের উপর গুলি করেছে। টঙ্গী নারায়ণগঞ্জে তার প্রতিবাদ হচ্ছে।
এতসব আলাপ আলোচনার মধ্যে কিছু কথা বাজতে লাগল জাফরের কানে – মিরপুরে, চট্টগ্রামে, পার্বতিপুর, সৈয়দপুরে বাঙালী-বিহারী খুনোখুনি-রক্তারক্তি হচ্ছে। সেনাবাহিনী বিহারীদের উষ্কানী আর সাপোর্ট দিচ্ছে। এদেশে বাস করে তারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পক্ষে থেকে অমানুষিক নৃশংসতার বাঙালীদের নির্যাতন, নিপীড়ন ও হত্যাকান্ডে অংশ নিচ্ছে।
বিহারীরা কি সত্যিই এত খারাপ? টয়েটাও কি ওদের মত? ওকে তো এত খারাপ মনে হয়নি তার! এখন কী করা উচিৎ? কী করবে সে?

৪.
‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নাকি কাওকে কিছু না কইয়া চইলা গেছে?’
জাফরকে খাবার বেড়ে দিতে দিতে বললেন সাহেরা বেগম। অন্যান্য দিন হলে ‘তোমার এতকিছু জানার কী দরকার?’ বলে খেঁকিয়ে উঠত জাফর। আজ কিছুই বলল না। মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে বলল, ‘সম্ভবত। কোন কোন এলাকায় নাকি আর্মিও নেমে গেছে।’
‘কস কী!’ আর্মির কথা শুনে আঁতকে উঠলো সাহেরা বেগম। ‘আমরার কী হইবে বাবা? বাঙালীগর কী হইব?’
জাফর এবারও কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল,
‘জানিনা মা!’ অনেকদিন পর জাফর সাহেরা বেগমকে মা বলে ডাকল, ‘খেয়ে শুয়ে পড়ো তুমি।‘
বলে আর বসল না। প্লেট ভর্তি ভাতে হাত ধুয়ে উঠে গেল।
মাঝরাতে ঠাঠা শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল জাফরের। অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে সেই শব্দ। বুকটা কেঁপে উঠল তার। রাইফেলের শব্দ যে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেন যেন মনে হচ্ছে শব্দগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে আসছে। বন্ধুদের কথা ভেবে শঙ্কিত হল জাফর।
সারারাত ধরে চলল গোলাগুলির শব্দ। জাফর সাহেরা বেগমের সাথে বসে রাতটা কাটিয়ে দিল। ভোরের আলো ফুঁটতেই বাইরে বেরুল সে। আশেপাশের সব বাড়ির মানুষও একজন দুজন করে বেরুচ্ছে। কেউই ঘুমাতে পারেনি সারারাত। পাশের বাসার দিকে এগোল জাফর। বন্ধুদের খবর নিতে হবে। ওদের বাসার সবাই ভয়ে জড়সড় হয়ে হলঘরে বসে রেডিও শুনছে। টেলিফোন নাকি ডেড। রাতের খবর জানতে ওদের সাথে রেডিও শুনতে বসে পড়ল জাফর। কারফিউ জারি করা হয়েছে দেশে।
পরেরদিন সকাল নয়টায় কারফিউ তুলে নেয়ার ঘোষণা দেয়া হল রেডিওতে। ঘোষণা শুনেই বাসা থেকে বের হল জাফর। দুইদিন ধরে গোলাগুলি হয়েছে। রিকশা নিয়ে ইকবাল হলের দিকে রওনা দিল সে। বন্ধু রাশেদ ওখানে। কী অবস্থা ওদের, জানতে হবে।
পিজি হাসপাতালের সামনে দিয়ে যাচ্ছে রিকশাওয়ালা। হাসপাতাল পেরিয়ে শহীদ মিনারের সামনে যেতেই জাফর স্তব্ধ হয়ে গেল! রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়ে দিয়েছে। তার চোখেও অবিশ্বাস। ক্রমাগত শেলিং করে শহীদ মিনারের স্তম্ভগুলো গোলার আঘাতে উড়িয়ে দিয়েছে তারা! সারারাস্তায় শ’খানেক ধ্বংসলীলা দেখলেও চোখে পানি আসেনি জাফরের। এবার এল। তার বাবা যে ভাষা সৈনিক ছিলেন!
বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ধ্বংসলীলার চুড়ান্ত দেখল জাফর। মধুর ক্যান্টিন পুড়ে ছাই। মধুদা মরে পড়ে আছে।
হলের দিকে এগিয়ে গেল সে। হলের উঠানে বিস্তর জায়গা জুড়ে আলগা মাটি। বোঝাই যাচ্ছে এখানে গর্ত করে কোন কিছু মাটি চাপা দিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই কোন কিছুটা যে কি তা ভাবতে গিয়ে গা শিউরে উঠল জাফরের।
এর ওর কাছে ছুটা ছুটা অনেক খবরই শুনলেন সাহেরা বেগম। জাফর বাসায় এসে দেখল বুড়ি আপনমনেই কথা বলছে।
‘সারাডা শহর পুড়াইয়া ছাড়খার কইরে ফেলছে!’
জুনের কোন এক ভোরে ডাকপিয়ন জাফরকে একটা বাদামী মোড়কের পার্সেল দিয়ে গেল। জাফর অবাক হয়ে দেখল, তাতে তার পাসপোর্ট আর ভিসা রাখা আছে। এই পার্সেল দিয়েই প্রমাণ হলো টয়েটা অন্যান্য বিহারীদের মত নৃশংস নয়! বুক থেকে পাথর নেমে যাওয়ায় চোখ মুখ তার আনন্দে ঝলমল করতে লাগল। সেদিন সকাল নটার আগেই আরেকবার দরজার কড়া নাড়লো কেউ। জাফর দরজা খুলে। দেখল চুল-দাড়ির দঙ্গল মুখে নিয়ে তার বাল্য বন্ধু তাহের দাড়িয়ে।

৫.
তাহেরের বাড়ি বরিশাল। ২৬’শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে তার তরুণ প্রাণ জেগে উঠল। দেশকে রক্ষা করার জন্য দৃঢ় সংকল্পে আবদ্ধ সে। একরাতে তাই বাবা মা আর সদ্য বিবাহিতা নুপুরকে কিছু না জানিয়ে গেরিলা ট্রেনিং নিতে চলে গেল। ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলের অধীনে ট্রেনিং নিল তাহের। ট্রেনিং শেষে বরিশালেই কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেয়ার পর তার দায়িত্ব পড়ে চাঁদপুরে।
"মিশন ভায়া চাঁদপুর টু ঢাকা"
কিছু অস্ত্র সাপ্লাই দিয়ে ঢাকা থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজপত্র আনতে বলা হল তাকে। সাথে যাবে সদ্য ডাক্তারি পাশ করা ফয়সাল। যাবার আগের রাতে তার কেন যেন মনে হলো, এই যে যাচ্ছে আর ফিরতে পারবে না। তাই সে গৌরনদী গেল মস্ত ঝুঁকি নিয়ে। সেখানে তার শ্বশুড়বাড়ি। নুপুর নাকি এখন ঐ বাড়িতে।
মাঝ রাতের একটু পরে গিয়ে পৌঁছুল নুপুরদের বাড়ি। নুপুরের শোবার ঘরের জানালায় টোকা দিয়ে ফিসফিস করে ওর নাম ধরে ডাকল। ঘুমজড়ানো চোখে জানালা খুলে কুপির আলোয় তাহেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে গেল সে। হুড়োহুড়ি করে দরজা খুলতে যেতে উদ্যত হলো। তাহের জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে খপ করে ওর হাতখানা ধরল। চাপা গলায় বলল, ‘হৈচৈ করো না বৌ! রাতের অন্ধকার থাকতে থাকতেই আমাকে ফিরে যেতে হবে। আমি শুধু তোমাকে একটু দেখতে আসছি।’
নুপুর তারচেয়ে চাপা গলায় বলল, ‘এই জানালায় একটা শিক খোলা যায়। আমি শিকটা খুলে দিচ্ছি, আপনি ভিতরে আসেন।’
কিছুটা কসরৎ করে তাহের ঘরে ঢুকতে সক্ষম হল। এই ফাকে নুপুর খাবারের ব্যবস্থা করে ফেলেছে। ধবধবে সাদা ভাতের সাথে মুরগীর মাংস আর পেয়াজ। একটা বাটিতে খানিকটা ডালও আছে। খাবার দেখে মনে পড়ল প্রচন্ড খিদে পেয়েছে ওর। হাত ধুয়ে গোগ্রাসে গিলতে লাগল তাহের। প্রত্যেকটা গ্রাস মুখে নেয়ার পর ওর মনে হচ্ছে যেন অমৃতের স্বাদ নিচ্ছে। ক্যাম্পের খাবার খেতে খেতে সুস্বাদের অস্তিত্বের কথা ভুলতে বসেছিল প্রায়।
গালে হাত দিয়ে তাহেরের খাওয়া দেখছে নুপুর। লোকটা কি আরাম করেই না খাচ্ছে! দেখতেই ভালো লাগছে তার! এতদিন লজ্জা সংকোচে মানুষটাকে কাছে থেকে দেখা হয়নি তার। আজ সুযোগ পেয়ে চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কতদিন শেইভ করে না কে জানে! কুপির আলোয় মানুষটাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।
খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ কথাবার্তা চললো ওদের।
‘এবার ফিরতে হবে’
বলে উঠে দাড়ালো তাহের।
‘তুমি এখানেই থেকো। ঘর ছেড়ে বের হয়ো না। তোমাদের শহরটা মোটামুটি নিরাপদ। আর .......’
থেমে গেল তাহের। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে নুপুর। ‘আর ধরে নাও আমি আর ফিরব না। এই শেষ দেখা। প্রতিজ্ঞা করেছি জীবন দিয়ে হলেও আমরা দেশকে স্বাধীন করব! আসি!"
নুপুর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
‘আমি নদীর ঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দেই?’
‘না!’
মাথা নাড়ালো তাহের।
‘ধরা পড়ে গেলে তখন কী হবে?’
‘আপনিই না বললেন এই এলাকা শত্রুমুক্ত?’
ব্যগ্র কন্ঠে বলল নুপুর।
'তবুও, ঝুঁকি নেবার কী দরকার? আমি যাচ্ছি, তুমি সাবধানে থেকো।’
‘আসুন!’
চোখ বন্ধ করে ফেলল নুপুর। ‘আমি অপেক্ষায় থাকব!’
বন্ধ চোখের দুপাশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে ওর।
তাহের ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

৬.
চাঁদপুর পৌছে নাহার নামের এক মেয়ের শ্বশুড়বাড়িতে গেল ওরা। মেয়েটা ফয়সালের সাথে একই কলেজে ডাক্তারি পড়েছে।
ঘরে ঢুকে আগে কাঁধে করে বয়ে আনা চটের বস্তা লুকানোর ব্যবস্থা করতে বলল তাহের। ওতে গোলাবারুদ আর গ্রেনেড আছে। এগুলো এখানে পৌছে দেওয়াই ছিল ওদের মিশন।
সবে ভোরের আলো ফুটছে। রাতেই আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। তাই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ওরা। ঘুম ভেঙে তাহের দেখতে পেল ফয়সাল নাহারের সাথে গল্প করছে। সেও গল্পে যোগ দিল।
গল্প আসলে নাহারই বলছে।
' . . . স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য আমি এবং আমার স্বামী ২৫শে মার্চ ঢাকা থেকে চলে এসেছি। এখানে এসে আগে এখানকার স্থানীয় সরকারে যোগ দিয়েছি। কয়েকদিন পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১২০৪ সাব-
সেক্টরের অধীনে জহিরুল হক পাঠানের নেতৃত্বাধীন মধুমতী কোম্পানিতে আমি মেডিকেল কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করি। এই অঞ্চলের সেক্টর কমান্ডার হল মেজর এটিএম হায়দার।'
একটু থামল নাহার। ফয়সাল কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে চাইলে, নাহার একটা হাত তুলে থামিয়ে দিল তাকে। বলল,
'আমি শেষ করে নেই।' এরপর আবার বলতে শুরু করলো।
'এপ্রিলের শুরুতে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের ওলিপুর গ্রামের প্রশিক্ষণ শিবিরে আমি অস্ত্র চালনা এবং আত্মরক্ষা কৌশলের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে গিয়েছি। কী যে কষ্ট সেখানে থাকা খাওয়ার!'
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেয়েটা।
'তখন আমি অধিকাংশ সময় নৌকায় করে সাথী যোদ্ধাদের সেবা শুশ্রূষা করেছি। ঘুরে ঘুরে বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালীর ১১টি অঞ্চলে আহত মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করতে গিয়েছি। ফলে এই ভয়াবহ সংকটের দিনে অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং কষ্টকর ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি আমরা। একটা ঘটনার কথা মনে পড়লে এখনো আমার গা শিউরে উঠে!
'
সত্যি সত্যিই কেঁপে উঠল সে। ভয়াবহ সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চোখ ভিজে এসেছে তার্।
'হাজীগঞ্জের অফিস চিতোষী এলাকায় একটি বিদ্যালয়ে পাক সেনাদের ঘাঁটি ছিল। আমি তখন নৌকায়, দূরে ছিলাম। আমার কাছে কমান্ডার জহিরুল হক পাঠান খবর পাঠালেন যে, ঐ বিদ্যালয়ে পাক সেনারা বেশ কিছু মহিলাকে আটকে রেখেছে এবং তাদের উপরে পাশবিক নির্যাতন করেছে। খবর পেয়ে আমি রওয়ানা দিলাম। পাঠান বাহিনী ইতিমধ্যে পাক বাহিনীর ঐ ঘাঁটি আক্রমণ করে৷ দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চলার পর পাকিস্তানি সেনারা কিছু লাশ এবং কিছু মহিলাকে সেখানে রেখে পালিয়ে যায়। আমি সেই বিদ্যালয়ের ভেতরে গিয়ে দেখলাম, ১২ থেকে ১৩ টি মহিলা। পাক সেনাদের পাশবিক অত্যাচারের প্রতিটি চিহ্ন তাদের গায়ে৷ তারা সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় . . . '
থেমে গেল নাহার্। আত্মসংবরণ করতে কষ্ট হচ্ছে তার্। কিছুক্ষণ পর খানিকটা ধাতস্থ হয়ে নিজেই শুরু করল সে।
'অই অবস্থায় আমার কিছু কাপড়-চোপড়, আমাদের সাথীদের কাপড়-চোপড় এবং আশেপাশের মানুষদের সহায়তায় তাদেরকে কাপড় দিয়ে জড়িয়ে ফেলি। এরপর প্রাথমিক চিকিৎসা দিই। আমি যে নৌকায় থাকতাম এবং বিভিন্ন জায়গায় যেতাম, সেই নৌকায় করে তাদের নিয়ে আসি। সেসময় আমার কাছেও খুব বেশি ওষুধ-পত্র ছিল না। তবু সেসব দিয়েই তাদের চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলি। পরে তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে তাদের পৌঁছে দেই।'
নাহারদের বাসায় মার্চ এপ্রিলের সমস্ত সংবাদপত্র আছে। নাহারের শ্বশুড়ের সরকারী চাকরী। সংবাদপত্র পেতে তাদের কোন সমস্যা হয়নি। তাহের ওগুলো নিয়ে পড়তে শুরু করল। কিছু কিছু খবর পড়ে তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে।
যেমন: পাকিস্তান টাইমসে বলা হয়েছে, ‘শান্তিপ্রিয় বেসামরিক নাগরিকদের যেসব সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী হয়রানী করেছিল তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হয়, তা সাফল্যের সাথে সমাপ্ত হয়েছে।’
খবর পড়ে মন মেজাজ দুটোই খারাপ হয়ে গেছে তাহেরের।
সবচেয়ে কষ্ট লাগছে, চীন আর আমেরিকার মত দুইটা শক্তিশালী দেশ পাকিস্তানকে সমর্থন জানিয়েছে- এটা জেনে।
বিকালের দিকে এক বিদেশী সাংবাদিক এসে উপস্থিত হলো। এর নাম অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। তিনি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কুমিল্লার একটি সার্কিট হাউজে ছিলেন। তাকে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি সম্পর্কে পজেটিভ নিউজ করতে আনা হয় । কিন্তু তিনি মিলিটারিদের নৃশংসতা দেখে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছেন। রাস্তায় তাকে উদভ্রান্তভাবে হাঁটতে দেখে নাহারের স্বামী বাসায় নিয়ে এসেছে।
কিছুটা ধাতস্থ হয়ে কথা বলতে শুরু করলেন সাংবাদিক। তাহের, ফয়সাল, নাহার ওদের সবার কাছে আলাদা আলাদাভাবে দেশের অবস্থা জানতে চাইলেন। কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।
সাম্পানে চড়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিল তাহের আর ফয়সাল। মেঘনা পেরিয়ে সাম্পান বুড়িগঙ্গায় ঢুকল রাত তিনটায়। সাম্পানের চালকের সাথে আলাপ আলোচনা করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারল ওরা।
নদীতে নাকি কিছু লাশ পাওয়া গেছে যেগুলোর গায়ে বিন্দুমাত্র রক্ত নেই। শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত শরীর থেকে নিয়ে নেওয়ায় মৃত্যুবরন করেছে তারা। রক্ত কেন দরকার ওদের? এত এত রক্ত দিয়ে কী করছে ওরা? প্রশ্ন চোখে ফয়সালের দিকে তাকালো তাহের।
ফয়সাল বলল,
‘মনে হয় ওদের যেসব পাকিসৈন্যরা গেরিলাদের আক্রমণে আহত হয়, তাদের জন্য রক্ত লাগে।’
'হতে পারে' মাথা ঝাকিয়ে সায় দিল তাহের।

৭.
‘কিরে বাসায় ঢুকতে দিবি না?’ মৃদু হেসে বলল তাহের।
‘আয়! আয়!’
দরজা ছেড়ে দাঁড়ায় জাফর। ঢাকার কাজ শেষ হতেই ফয়সাল তার মায়ের বাসায় গেছে। জাফরের কথা মনে পড়তে জাফরের বাসায় চলে এসেছে তাহের।
‘খিদে পেয়েছে মা! খাবারের ব্যবস্থা করো!’ সাহেরা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল সে।
‘বুড়িকে ভাত-ডাল বসাতে বলেছি।' গামছাটা এগিয়ে দিতে দিতে বলে জাফর। 'তুই দাড়ি কামিয়ে গোসল করে নে! পুরা বনমানুষ হয়ে গেছিস দেখছি!’
'তুই এখনো মা'কে বুড়ি ডাকিস? মা ডাকতে কি কষ্ট হয়?' চোখ রাঙ্গিয়ে জিজ্ঞেস করে তাহের।
'মা ডাকবো কোন দুঃখে? সে তো আর আমার মা নয়।' বুড়ির দিকে পিছন ফিরে মুচকি হেসে চোখ টিপে দিল জাফর।
তাহেরও হাসল। বুড়ি ডাকুক আর যাইই ডাকুক- এই মমতাময়ী মহিলা কে যে জাফর কতটা ভালোবাসে, তাহের সেটা ভালোই জানে। কিন্তু সাহেরা বেগম সম্ভবত জানেন না। কারণ তিনি মুখ কালো করে রান্নাঘরের চলে গেছেন। সেদিকে তাকিয়ে দুই বন্ধু একসাথে হেসে উঠল।
গোসলে যাবার আগে হাতের কাগজের বান্ডিলটা জাফরের দিকে বাড়িয়ে ধরলো তাহের। বলল,
‘যত্ন করে রাখ!’
‘কি এগুলো?’
‘সারাদেশে কতটি ব্রিজ আছে, আর সেই ব্রিজের ঠিক কোন জায়গায় কী পরিমাণ এক্সপ্লোসিভ বেঁধে বোমা ফাটালে সহজে ব্রিজ ভাংবে কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি কম হবে আর পরে মেরামত খরচ কম পড়বে - তার তালিকা!’
‘তুই মুক্তিবাহিনীর সদস্য?’ চোখ বড় বড় করে বলল জাফর।
‘গোসলটা সেরে আসি।’ বলে আর দাঁড়ালো না তাহের।
খেতে খেতে অনেক গল্প করল দুই বন্ধুতে। আসলে গল্প বলল তাহের।
ট্রেনিং এর গল্প,
মিশনের গল্প,
নাহারের গল্প,
অ্যান্থনির গল্প,
সবার গল্প।
কিছুক্ষণ বাদেই ঝিমাতে শুরু করল সে। ওকে ঘুমাতে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল জাফর।
জাফরের দুই হাতে দুইটা জিনিস। একহাতে করাচি যাবার পাসপোর্ট-ভিসা। অপর হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা। তাহেরের প্যান্টের গোপন পকেটে ছিল ওটা। সবুজের বুকে টকটকে লাল গোলাকার সূর্য, তার মধ্যে হলুদ রঙের পূর্ব বাংলার মানচিত্র।
একবার পতাকার দিকে আর একবার বাদামী মোড়কে ঢাকা তার স্বপ্নের দিকে তাকাচ্ছে সে। চোখ তুলে টেবিলে রাখা তাহেরের স্টেনগানের দিকে তাকালো একবার। আশ্চর্য এক দোলাচলে ভুগছে।
তাহের ঘরে ঢুকে বলল, ‘আমি যাচ্ছি রে দোস্ত। রাতের মধ্যেই পৌঁছাতে হবে আমাকে।’
স্টেনগানটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগোল তাহের।
‘দাঁড়া তাহের! আমিও যাব তোর সাথে!’
একটু মুচকি হেসে পিছন ফিরলো তাহের।
সাহেরা বেগম দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। চোখে পানি টলমল করছে। মুখে হাসি। তার খুব ইচ্ছে ছিল, জাফর যুদ্ধে যাবে। দেশকে হানাদারদের হাত থেকে রক্ষা করে দেশের মাটিতেই থেকে যাবে। কোন বিহারী শত্রুর আঁচল ধরে সোনার বাংলা ছেড়ে যাবে না। আজ তার ইচ্ছেটা পূর্ণ হলো। কিন্তু জাফরকে নিজের কাছছাড়া করতেও বড্ড কষ্ট হচ্ছে।
ঝাপসা চোখে সাহেরা বেগম জাফরকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলেন। ছেলেটা তাকে জড়িয়ে ধরে বলছে,
'আমি স্বাধীনতা আনতে যাচ্ছি, মা! আমি শান্তি আনতে যাচ্ছি!'
ছেলেটা চলে যাচ্ছে। কেন যেন ছেলেকে বিদায় জানাতে পারলেন না তিনি। তার গলা থেকে কোন শব্দ বের হল না। বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

৮.
দুই বন্ধুতে সদরঘাট যাচ্ছে। চিপা গলি দিয়ে চলছে রিকশা। দূরে ভারি রাস্তায় ভারি লরির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। রিকশা থামিয়ে নিজের কোমরে কি যেন খুঁজতে শুরু করল তাহের।
‘কি খুঁজছিস?’
কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল জাফর।
‘গ্রেনেড! মিলিটারির এই ট্রাকটা যে আজ এই পথে যাবে - জানতাম। শুধু সময়টা জানতাম না!’
‘প্ল্যান ছাড়াই হিট করবি?’
‘মাঝে মাঝে আমরা এইরকম সুযোগ পেলে প্ল্যান ছাড়াই অ্যাকশনে যাই।’ বলল তাহের।
‘কিন্তু এতে অনেকসময় ঝুঁকি থেকে যায়। তাই এই অ্যাকশনগুলো হয় আত্নঘাতি।"
‘পেয়েছিস গ্রেনেড?’
আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল জাফর।
‘দে, আমাকে দে! আমি হিট করে আসি!’
‘কি বলছিস! তুই পারবি নাকি!’
‘পারবো দোস্ত! তুই শিখিয়ে দে আমাকে!’
‘কিন্ত এটা যে আত্নঘাতি....’
‘সেইজন্যই তো আমি যাব!’
তাহেরকে থামিয়ে দেয় জাফর।
‘আমি মরলে খুব বেশি ক্ষতি হবে না। কিন্তু তুই মরলে অনেক ক্ষতি। তুই একজন ট্রেনিং প্রাপ্ত গেরিলা। তুই বেঁচে থাকলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মিশনে যেতে পারবি। তাছাড়া তুই এখন মরে গেলে আমার আর মুক্তিযোদ্ধা হওয়া হবে নারে!’
‘আচ্ছা থাম থাম! পিন খুলে ঠিক এক সেকেন্ড পর ছুঁড়ে মারবি। লক্ষভ্রষ্ট না হলে কোন ভয় নেই। নির্ভয়ে চলে আসবি এখানে।‘
‘আচ্ছা আসব। আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না। জানিসই তো আমার নিশানা অব্যর্থ! স্কুলে ডার্ট ছোঁড়া প্রতিযোগিতায় কখনো সেকেন্ড হইনাই!’
হাসল জাফর।
অন্ধকারে তার দাঁতগুলো ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। বন্ধুকে অনুপ্রেরণা দিতে তার সাথে সাথে হাসলো তাহেরও।
খানিক পরেই মিলিটারি লরিটায় দাউদাউ করে আগুন ধরে গেল। এত চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যেও তাহের একটা চিৎকার আলাদা করতে পারল। বুকটায় চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভব করছে তাহের।
তেলের ট্যাংক ব্লাস্ট হওয়ায় আগুনের লেলিহান শিখা থেকে ছিটকে রাস্তার পাশে পড়ল জাফর। সারা শরীরে আগুন ধরে গেছে। কিছুক্ষণ আগেও অসহ্য ব্যথা অনুভব করছিল। কিন্ত এখন আর কিছুই অনুভব করতে পারছে না সে। অনুভূতি শুন্য হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে একজনের কথাই মনে আসছে ওর।
‘আহহারে! বুড়িটা এবার সত্যি সত্যি একা হয়ে গেল!’
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ওর বুক চিরে।
আগুনের তেজ কমে এল ধীরে ধীরে। ধিকিধিকি জ্বলছে। পূর্বদিকের আকাশ টা লালচে আভায় ছেয়ে আছে। খানিকবাদেই রক্তাক্ত সূর্যোদয়ে আলোকিত হবে বাংলাদেশ।

তথ্যসূত্রঃ
১. দ্য রেইপ অফ বাংলাদেশ
২. মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
৩. জোছনা ও জননীর গল্প
৪. একাত্তরের দিনগুলি।
বি:দ্র: গল্পে চাঁদপুরের অংশটুকু সম্পূর্ণ সত্যি। পাঠান বাহিনীতে থেকে আমার বড়চাচা তাহের পাঠান যুদ্ধ করেছিলেন।


গল্পটি রহস্যপত্রিকা মার্চ ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত।

ব্লগে আগেও একবার গল্পটি পোস্ট করেছিলাম। আমার আইডির প্রথম পোস্ট ছিল এটি। তখন নতুন বলে অনেকেই হয়তো আমার লেখা পড়েনি। গল্পটি আমার খুব প্রিয় তাই।আবার পোস্ট করলাম। আশা করি, যারা পড়বেন - তারা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন। :)

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে জুন, ২০১৬ সকাল ৯:৩৫

বঙ্গভূমির রঙ্গমেলায় বলেছেন:
গল্পে মুক্তিযুদ্ধের অনেক সত্যি ঘটনাই ফুটে উঠেছে।

ভাল লাগল আপনার লেখা। সাবলীল, সুন্দর ও পরিপাটি।

ভাল থাকুন। শুভকামনা নিরন্তর।

২৫ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৩:৩৪

মাদিহা মৌ বলেছেন: ধন্যবাদ। কষ্ট করে ধৈর্য্য নিয়ে এত বড় গল্পটা পড়ার জন্য।

ভালো থাকবেন।

২| ২৫ শে জুন, ২০১৬ সকাল ৯:৫৫

হাসান মাহবুব বলেছেন: অসাধারণ! ব্লগে গল্প অনেকেই লেখে, কিন্তু একটা লেখার জন্যে এত পরিশ্রম করে কজনা?

রহস্য পত্রিকা পড়ি না বহুদিন। খুব খারাপ হয়ে গেছি আমি।

২৫ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৩:৩৮

মাদিহা মৌ বলেছেন: আসলে জানার জন্য বইগুলি পড়েছিলাম। গল্পটা লেখার জন্য আবার রিরিড করতে হয়েছিল অবশ্য।

রহস্যপত্রিকা পড়া আমিও ছেড়ে দিছি। কেন যেন পড়া হয় না। :(

গল্পটা পোস্ট করে খুব হতাশ হয়েছিলাম। আসলে এটা লিখতে সত্যিই খুব পড়াশোনা করতে হয়েছে। কিন্তু কোন রেসপন্স না পেয়ে হতাশা জেঁকে বসেছিল। এতোই বাজে লিখেছি?

তবে আশা ছিল, আর কেউ না পড়লেও হাসান মাহবুব ভাইয়া পড়বে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.