নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জীবন একটা কৌতূহলী যাত্রার নাম- স্রষ্টা, সৃষ্টি, উদ্দেশ্য এবং এই সব কিছুর সত্যতা কে ঘিরে... আর আমি সেই পথের একজন সাধারণ যাত্রী। নিজের জায়গা থেকে সব স্থান, কাল, পাত্রে আপন অস্তিত্বকে কল্পনা করতে ভালোবাসি আর সেই অনুযায়ী প্রত্যেকটা কাজ করে যাই...

মাহফুজ আলআমিন ( Auspicious Fate )

মাহফুজ আলআমিন ( Auspicious Fate ) › বিস্তারিত পোস্টঃ

“স্বাধীনতা এমন ও হয়, বিজয় এমন ও হয়”!

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:০৮

“পূর্ব দিগন্তে, সূর্য উঠেছে- রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল” !
আজ ১৬ ই ডিসেম্বর । ঘুম থেকে উঠেই শুনছি মাইক এ উচ্চস্বরে গান বাজছে । দেশের গান, স্বাধীনতার গান, বিজয়ের গান। বিজয় দিবসকে ঘিরে সারা বাংলাদেশ জুড়েই আজ মহা আয়োজন। প্রতি বছর ই হয়, এবার ও তার ব্যাতিক্রম নয়। স্বাধীনতার ৪৫ বছর। প্রতি বছরের মত এবারো আরও একটা কিছু ঘটবে। সেটা শুধুই আমার ব্যাক্তিগত বা পারিবারিক ঘটনা, বলতে গেলে নিয়ম বলা যেতে পারে। আমরা প্রতি বিজয় দিবসেই দাদুর বাসায় যাই। আর আমার যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে দাদুর মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনা, মানে ঘটনা শোনা। আমার দাদু একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কঠিন মুক্তিযোদ্ধা, বীর বিক্রম উপাধিও আছে দাদুর নামের সাথে! মোঃ আসাদুর রহমান ( বীর বিক্রম )। প্রতি বিজয় দিবসেই দাদুর বাসায় যাওয়া নিপাতনে সিদ্ধ আমাদের পরিবারের জন্য। দাদুর বাসা আমাদের বাসা থেকে ঘণ্টাখানিক দূরের পথ।

হাতমুখ ধুয়ে, নাস্তা শেষ করেই রউনা হলাম বাবা মার সাথে। পৌঁছেই দাদুর রুমে চলে গেলাম আমি। আব্বু আম্মু দাদুর সাথে দেখা করে কুশল বিনিময় করেই পরিবারের অন্যদের সাথে দেখা করতে, কথাবার্তা বলতে অন্যরুম এ চলে গেলেন। আমাকে দেখে দাদু অনেক খুশি হন। আজও তাই, দাদু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসতে বললেন। আমি ও দাদু কে অনেক ভালবাসি। উনার মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে আমার ও অনেক ভালো লাগে।
আমি বললাম, দাদু আজ তাহলে তোমার কোন ঘটনা টা শুনবো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে?

এটা বলাতেই দেখলাম দাদুর চোখের কোনায় সামান্য পানি এসে পড়েছে। চশমার আড়ালে সেই দৃশ্য দেখে আমি বললাম, দাদু তুমি কাঁদছ কেনো? কি হয়েছে বলো?

দাদু চশমা টা খুলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, নারে আকাশ কিছু হয়নি। ও, বলা হয়নি, আমার নাম আকাশ। পরাধীন নয়, স্বাধীন আকাশ, আসলেই কি স্বাধীন?

তখন ই দাদু বললেন, “আজ অনেকদিন পর আমার এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেলো। এমন এক বন্ধু, যে আপন নাড়ির টানে ভুল পথ থেকে সরে এসে সত্যের জন্য লড়াই করে কোন রকম প্রাপ্তি, স্বীকৃতি ছাড়াই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে”!

আমি বললাম, দাদু তোমার সেই বন্ধু কি মুক্তিযোদ্ধা ছিল?

-দাদুভাই, আমার সেই বন্ধুটা একই সাথে পাকিস্তানি হানাদার আর মুক্তিযোদ্ধা দুটাই ছিল।
কিন্তু, কেউ জানেনা তোর এই দাদু ছাড়া যে সে প্রকৃত পক্ষে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিল।
আমি খুব অবাক হলাম দাদুর কথা শুনে! একটা মানুষ কি করে একই সাথে মুক্তিযোদ্ধা আবার পাক-হানাদার হতে পারে!

-দাদু, আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা, খুলে বলবে কি সেই ঘটনা তোমার বন্ধুর?
দাদু একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলা শুরু করলেন। তাহলে শোন আকাশ।

-১৯৭১ সাল, শ্রাবণ মাস চলছে। যুদ্ধ সবে আপন রক্তক্ষয়ী রুপ ধারণ করেছে। আমার বয়স তখন ৩০ এর মতন। মুক্তিবাহিনী একত্রিত হয়ে গেরিলা হামলা চালানো শুরু করেছে পাক- হানাদার বাহিনীর ঘাটি গুলোতে। এমনই একদিন দুপুরে বাইরে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। আমাদের গেরিলা অভিযান শেষে আমাদের রাজাকার রুপী গুপ্তচর কাসেম সংকেত দিলো সব মিলিটারিরা মারা পড়েছে। আমরা গিয়ে নিজেরা দেখে নিশ্চিত হয়ে তাদের যত যুদ্ধসামগ্রী ছিল নিয়ে নিজেদের লুকোনো আস্তানায় ফিরে এলাম। ঐদিনের মত অভিযান শেষে আমি আমার বাড়িতে ফিরে আসি। ঘরে ঢুকেই আমার রাইফেল টা কাপড় দিয়ে পরিস্কার করতে থাকি। আর মনে খুব আনন্দ নিয়ে স্বাধীনতার অনুপ্রেরণা কে গানের আকারে গুন গুন করতে থাকি। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়লো। আমি কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। সারা বাড়ি খালি। আমার বাবা তো অনেক আগেই মারা গেছেন। মা, তোর দাদি, আর তোর বাবার তখন ৫ বছর, আমার ছোট ভাই সহ সবাইকে ইন্ডিয়া তে রেখে আমি এদেশে ফিরে এসে মুক্তিবাহিনী তে যোগ দেই। তাই এই ভরদুপুরে কে এলো বুঝতে পারলাম না। মাজেদা খালা পাশের বাড়ির রুস্তম এর মা, আমাকে এসে সময় মত খানা দিয়ে যান। তিনি তো এখন আসার কথা না, আর আমাদের মুক্তিবাহিনীর কেউ কারো বাড়িতে দেখা করার নিয়ম নেই, যেনো পাকবাহিনী টের পেয়ে না যায়। তাহলে কি পাক বাহিনীর কেউ এলো? আমি দরজার এপাশ থেকেই বললাম, কে ওখানে? বাইরে থেকে শব্দ এলো, ভাই দরজা টা খুললে একটু উপকার হতো। আমি ভাবলাম মুক্তিবাহিনীর কেউ হয়তো বিপদে পড়েছে। তাই দরজা খুলে দিলাম। খুলে দেখি, মাঝবয়সী সুদর্শন একটা ছেলে, গায়ে পুরনো ছেড়া শার্ট আর লুঙ্গি পড়ে বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে আছে। আমি তাকে ঘরে এনে গামছা দিয়ে গা মুছতে দিয়ে বসতে বললাম।

কে তুমি মিয়া? এখানে আসলা কই থেইকা? তোমারে তো এই গ্রামের মনে হইতেসে না!
সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি সাইফ, মানে সাইফুল আলম, মুক্তিবাহিনী। পাশের গ্রাম থেকে পলায়া আসছি, মিলিটারি রা আমাদের গ্রামে হঠাৎ করেই আক্রমণ করসে। আমি কোনরকম জান বাঁচাইয়া এইখানে পলায়া আসছি। আপনি কি মুক্তিবাহিনীর লোক?

আমি বললাম, হ। তুমি কি আমগো লগে যুদ্ধে যোগ দিবার চাও?

-হ্যা, আমি মুক্তিযুদ্ধ করতে চাই। এই দেশের হয়ে, দেশের মানুষের হয়ে হিংস্র, বর্বর, শোষক, ধর্ষক, হত্যাকারী পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই।

-তাহলে, তো ভালোই। এখন থেইকা আমরা দুই ভাই মিললা, একসাথে যুদ্ধ করুম। রেডি থাকো, আজ রাতেই মিশন আসে।

আমি সাইফ কে আমাদের দলের হেড ফজলু ভাই আর অন্য সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। সবাই ওকে কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখলো, ভাবলো আবার হানাদারদের গুপ্তচর নয়তো! প্রথম থেকেই কিছুটা ব্যাতিক্রম মনে হয়েছিলো সাইফ কে। তার কথা বলার ধরণ, আচরণ, ব্যাবহার কেমন যেনো আমাদের সবার চেয়ে ভিন্ন ছিল। কিন্তু ওর সব কিছুতেই মার্জিত একটা ভাব ছিল। এভাবে, সময় যেতে থাকে। আমরা, অনেকগুলো সফল মিশন শেষ করি। সাইফ অনেক বিরত্তের সাথে আমাদের সাথে যুদ্ধ করে। ও মাঝে মাঝে একাই ৮-১০ জন মিলিটারি কে কুপোকাত করে ফেলতো। ওর সাহস আর লড়াই দেখে আমাদের ও অনুপ্রেরণা বেড়ে যেতো। সময়ের সাথে যুদ্ধ তার পরিনতির দিকে এগোচ্ছিলো, আর আমার ও সাইফ এর মাঝে খুব ভালো একটা বন্ধুত্ত তৈরি হয়ে গেলো, যদিও আমাদের বয়সের মাঝে প্রায় ৩/৫ বছরের ব্যাবধান ছিল। আমি মাঝে মাঝে ওর পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইলে ও এড়িয়ে যেতো। আমি ভাবতাম, যুদ্ধে হয়তো ওর পরিবারের সবাই মারা গেছে। তাই আর জোর করতাম না।

তখন যুদ্ধের ৬ মাস মানে সেপ্টেম্বর মাস চলে। একদিন আমি বাইরে থেকে আমাদের ঘাটি তে ফিরে এসে দেখি সাইফ নামাজ এ। ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। আমিও ওর থেকে অনেক অনুপ্রানিত হয়েছি ধর্মীও সব ব্যাপারে। আমি যে এসেছি, ও তা খেয়াল করেনি, আমার তখন আসার কথাও ছিলোনা। আমি ওর পিছন দিকে বসা। নামাজ শেষে ও যখন মোনাজাত করছে, তখন হঠাৎ কানে ভেসে আসলো, “হে আল্লাহ, তুমি আমাকে যেই পথ থেকে সরিয়ে যেই পথে এনেছ, তার জন্য তোমার কাছে অসীম শুকরিয়া। আমার যেই সত্য কেউ জানেনা, একমাত্র তুমি ছাড়া, সেই সত্য গোপন ই রেখো। তুমি ই যখন এই পথে আমাকে আসার, যুদ্ধ করার তৌফিক দিয়েছ, তখন একমাত্র তোমার রহমতেই সফল হতে পারবো আমরা। হে মালিক রহম করো, এই দেশটার উপর”।

তখন আমার সন্দেহ হলো, কি এমন রহস্য যে সাইফ কাউকে বলেনি! এমনকি আমাকেও না! সাইফ নামাজ শেষে পিছনে ফিরেই অনেকটা চমকে উঠলো।

-কি ব্যাপার কখন আসলে, টের ই পেলামনা!

আমি বললাম, “সাইফ, তোর কি এমন লুকানো সত্য আছে, যা তুই ছাড়া কেউ জানেনা? আমার তখন সাইফ এর সবার চেয়ে ব্যাতিক্রম হওয়ার, তার পরিবার সম্পর্কে এড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারগুলো মাথায় ঘুরছিল। সাইফ কিছু বলতে চাইছিলনা। আমি ওকে অনেক জোর করার পর সে বলতে রাজি হয়।
সাইফ বলে, বন্ধু আজ তবে আমি তোকে আমার জীবনের সব রহস্য খুলে বলছি। জানিনা, তুই কিভাবে নিবি তবুও তোকে আমার সবচেয়ে আপন বন্ধু মনে করে বলছি।

-‘আমি একজন পশ্চিম পাকিস্তানি। আমার আসল নাম সাইফ মালিক। তোর সাথে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত একজন অবুঝ পাকিস্তানি মিলিটারি হিসেবেই আমার পরিচয় ছিল। জন্মের পর বুঝ হবার পর থেকে এই দেশে আসা পর্যন্ত নিজেকে একজন পশ্চিম পাকিস্তানি হিসেবেই জেনে মেনে এসেছি।

আমি সাইফ এর কথায় হতভম্ব। কিছুই বুঝতে পারছি না। যে মানুষটা আমার সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করছে, সেই নাকি অবশেষে পাকিস্তানি হানাদার! কিছুই মিলাতে পারছিলাম না আমি। আমি বললাম, ভাই এইসব তুই কি বলছিস? কিছুই তো বুঝতে পারছিনা!

সাইফ বলল, “আমি বুঝতে পারছি তোর মাথায় গণ্ডগোল বাধিয়ে দিয়েছি। এবার তাহলে আরও ২৫ বছর পেছনে যাওয়া যাক, ঘটনার প্রকৃত অবস্থা জানতে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময়, আমার বাবা পশ্চিম পাকিস্তানে চাকরির সুবাদে আমাদের নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। আমার বয়স তখন ১/২ বছর এর মত। আমার জন্ম এই পূর্ব পাকিস্তানেই হয়েছিল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানায়। আমি নিজেকে বড় হয়ে একজন পশ্চিম পাকিস্তানি হিসেবেই চিনে জেনে গড়ে উঠেছি। আমার বাবা মা বাঙালি হওয়ায় তারা আমাকে বাংলা ই শিখিয়েছেন মাতৃভাষা হিসেবে। কিন্তু, কখনো আমাকে বলেননি, আমার জন্ম যে এই পূর্ব পাকিস্তানে। কেনো বলেন নি জানতে পারিনি কখনো। আমার বাবা মারা যান দুই বছর আগে, ৬৯ এ, যখন ৬ দফা দাবি উত্থান করা হয়। আমার মা আর আমি ছাড়া কেউ আপন ছিল না পশ্চিম পাকিস্তানে। সংসারের প্রয়োজনে আমার চাকরির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ছোটবেলা থেকেই মিলিটারি ফোরস্‌ এর প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল আমার। আমি ঐ বছর ই মিলিটারি হিসেবে যোগ দেই। তারপর যখন ২৫ শে মার্চে আমাদের এই পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের জন্য আসতে হয়, তখন আসার আগে আমার মা আমাকে অনেক বারণ করেছিলেন, আমি শুনিনি।

কিন্তু, আমি এই দেশে আসার পর থেকে আমার ধারণা পাল্টাতে থাকে। এই দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের ক্ষমতার অপব্যাবহার, নির্বিচারে তাদের গনহত্যা, চোখের সামনে আমার বাহিনীর লোকদের তাদের মা-বোনদের ধর্ষণ করতে দেখে, ধর্মের দোহাই দিয়ে অবিচারে হিন্দু- মুসলিম সবাইকে হত্যা, লুট এই সব দেখে আমার ভাবোদয় হল, এই বুঝি পশ্চিম পাকিস্তানিদের আসল চরিত্র! তখন নিজের প্রতি নিজের চরম ঘৃণা জন্মে গেলো। আসাদ, তুই বিশ্বাস করবি কিনা জানিনা, এই দেশে আসার পর থেকেই এই দেশের মানুষের প্রতি, এই দেশটার প্রতি আমার এমন মায়া জন্মে গেলো, যেনো মনে হলো আমার এই দেশের হয়েই স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শহীদ হওয়ার কথা। এই দেশের সাথে কি যেনো এক টান আমার ভিতরে সারাক্ষণ কষ্ট দিতেই থাকলো। আর আমি কিনা, পাক-হানাদার বাহিনীর সদস্য! এই দেশের একটা মানুষকেও আমি হত্যা করিনি, আমার দ্বারা হয়নি, বরং আড়ালে এনে আকাশে গুলি করে পালিয়ে যেতে বলেছি। যুদ্ধের ২ মাসের মাথায় আমার মা’র একটা চিঠি আসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। সেই চিঠি তে মা লিখেছিলেন, তার শরীর টা ভালো নেই, আমার জন্ম আর অতিত সকল ইতিহাসের কথা মা সেই চিঠিটাতেই লিখেছেন। আর বলেছেন, নিজের দেশের মানুষকে ভালবাসতে না পারলেও যেনো কাউকে কখনো হত্যা না করি, কষ্ট না দেই। পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার দের আসল চরিত্র, কর্মকাণ্ড আর নিজের সত্যতা জানতে পেরে, সেই ঘৃণা থেকে আমি ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসি। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে সেই সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আপন প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছি। পোশাক বদলে একজন মৃত মুক্তিযোদ্ধার লাশ থেকে কাপড় গুলো নিয়ে পড়ে ফেলে পালিয়ে চলে আসি এই গ্রামে। ভাগ্য আমাকে অবশেষে তোর বাড়ির দরজায় নিয়ে এলো। তখন তোকে সব সত্য বলতে চাইলেও পারতাম না। বললে, কেউ বিশ্বাস করতো ও না, হয়তো তুই ও না। তাই অনেক কিছুই আংশিক সত্য বাকি অনেক কিছুই এড়িয়ে গিয়েছি। এই হলো আমার গোপন সত্য, যা আল্লাহ, আমি আর এখন শুধু তুই ই জানিস।

সাইফ এর সব সত্য জানতে পেরে, গর্বে আমার চোখে পানি চলে আসলো, দেশ প্রেমের কি এক উজ্জ্বল প্রমাণ আমার সামনে, আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। নিজের বিরত্বকে
তখন সাইফ এর ত্যাগ আর বিরত্বের কাছে অনেক তুচ্ছ মনে হচ্ছিলো।

এই টুকু বলে দাদা থামলেন। আমি একমনে এতক্ষণ ধরে দাদুর সেই আপন বন্ধুর গল্প শুনে যাচ্ছি। আমি দাদুকে জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কি হল দাদু? তোমার সেই বন্ধু এখন কোথায়? সে কি বিজয় পর্যন্ত যুদ্ধ করে গেছে? এই দেশে কি তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে?

দাদু চোখ মুছে, আবার বলা শুরু করলেন। নারে আকাশ, সবার ভাগ্যে সব কিছু জুটে না। ভাগ্য মানুষকে অনেকসময় খুব অনাকাঙ্খিত সত্যের মুখোমুখি করায়। যা সে এড়িয়ে যেতে পারেনা, আর আমার বন্ধু তা এড়িয়ে যেতেও চায়নি।

তারপর, আমি সাইফ এর সম্পর্কে সব জেনে গোপন রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চালিয়েই গেলাম। তখন নভেম্বর মাস। কঠিন এক অপারেশন এ আমরা সাতজন একসাথে পাকিস্তানি মিলিটারিদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে ছিলাম। আমি হাতে গুলি খেয়ে নিচে পড়ে যাই, বাকি ৫ সঙ্গিরাও একে একে শহীদ হয়ে যায়। সাইফ তবুও অনবরত গুলি করেই যাচ্ছিল, অবশেষে সব গুলো মিলিটারি মারা পড়ে। সাইফ আমাকে নিয়ে দ্রুত ক্যাম্প এ ফিরে গুলি বের করে সেলাই এর ব্যাবস্থা করে। আমাকে কয়েকদিন বিছানায় পড়ে থাকতে হয়। এদিকে ডিসেম্বর মাস চলে আসে, সাইফ এর কাছে একটা চিঠি আসে ওর মা’র শেষ চিঠি, মৃত্যুপথযাত্রী মা মৃত্যুর আগাম বার্তা চিঠি তে দিয়ে গেছেন। সাইফ অনেকটা চুপচাপ হয়ে পড়লো সেদিন থেকে। এদিকে, চারদিক থেকে খবর আসতে থাকে, বিভিন্ন জেলা স্বাধীন হতে শুরু করেছে, বিভিন্ন দেশ স্বীকৃতি দেয়া শুরু করেছে, ট্রানজিস্টারে সেই খবর শুনতাম, আমরা। এভাবে দেখতে দেখতে অবশেষে কাঙ্খিত সেই ১৬ ই ডিসেম্বর চলে আসে। চারদিকে বিজয়ের উল্লাস চলতে থাকে। তখনো, বিভিন্ন জায়গায়, যেখানে রাজাকার অথবা ২/১ জন মিলিটারি পাওয়া গেলো, তাদের ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হতে লাগলো। আমরা সব মুক্তিবাহিনী আমাদের গ্রামে একসাথে মিলিত হই। সেখানে হঠাৎ করেই একজন এসে সাইফ কে দেখে বলে,

-এই ছেলেটাকে তো আমি চিনি, ও তো একটা মিলিটারি, আমার পরিবারের সবাইকে যখন খুন করা হয়, আমার বোন কে যখন ধর্ষণ করা হয়, তখন এই মিলিটারি কে আমি দেখেছি! এখন শালা মুক্তিবাহিনী সেজে বসে আছিস!

-আমি বলে উঠি, কি আবোল তাবোল বলছ মিয়া? ও আমাদের ই লোক, ওর নাম সাইফ।

তখন সেই লোক টা বলতে থাকে, আমার চোখ কখনো ধোঁকা খেতে পারেনা। অন্য অনেকেও এবার সাইফ এর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে শুরু করেছে, যারা অন্য এলাকাতে গিয়ে যুদ্ধ করেছে। তারাও অনেকে বলতে শুরু করেছে, হ্যা আমরাও ওকে দেখেছি, মিলিটারিদের সাথে। ও মনে হয় গুপ্তচর, দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে তাই পালানোর সুযোগ না পেয়ে এখানে আমাদের আড়ালে লুকাতে চাচ্ছে। সবাই যখন ওর বিরুদ্ধে চলে আসলো, তখন আমি অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম, কেউ বুঝতে চাইলনা, শুনতে চাইলনা, আমাদের দল এর সাথিগুলোও আর বেঁচে নেই, যারা ওর পক্ষে কিছু বলবে!

আমি সাইফ কে বললাম, বলে দে সাইফ, তোর সত্যতা বলে দে। ওরা কেউ বিশ্বাস করতে চাইছেনা! সেই লোকটা বলে উঠে, ও যদি আমাদের ই লোক হয়, তবে বলুক, ওর পরিচয় কি? কোথায় বাড়ি, বাবা মা কে? আত্মীয়স্বজন কোথায় থাকে? সাইফ কিছুই উত্তর দিল না। আমি সাইফ কে বললাম, কিরে বন্ধু, চুপ করে আছিস কেনো? কিছু তো বল, বল, যে তুই
মিলিটারি না, তুই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা! সাইফ তখন মুখ খুললো,

-নিজের পাপের কথা স্বীকার করা যায়, কিন্তু নিজের ভালো কর্মের কথা বললে, তা অহংকারের পর্যায়ে চলে আসে। হ্যা, আমি একজন মিলিটারি, এটাই আমার নির্ধারিত পরিচয় ছিল, সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে যদি আমাকে মরতেও হয়, তবে তাই হোক। হয়তো এটাই প্রকৃতির ইচ্ছা, আল্লাহ’র ইচ্ছা। সাইফ এর মুখে মিলিটারি কথা টা শোনা মাত্রই ঐ লোকটা তার হাতের গুলি দিয়ে সাইফকে একইসাথে ৬ টা গুলি করলো। সাইফ, আমার বন্ধু ৬টা গুলি খেয়েও এতটুকু মৃত্যু ভয়ে শঙ্কিত হলো বলে মনে হলোনা। ও হাসি মুখে ধীরে ধীরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। আমি কানে গুলির শব্দ শুনে আর চোখের সামনে আপন বন্ধুকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, দৌড়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।

সাইফ উঠ, উঠ, না তুই এভাবে মরতে পারিস না, তোর ভাগ্য এতটা নির্দয় হতে পারেনা, তোর প্রাপ্তি এমন হতে পারেনা। কিন্তু, না কোন সাড়া নেই সাইফ এর। অবশেষে আমার কোলেই ও শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো ! চারদিকে বিজয়ের উল্লাস কেমন যেনো বিষাদের রুপ ধারণ করলো। আমি আর কিছুই শুনতে বা দেখতে পেলাম না ! হঠাৎ করেই চারদিক অন্ধকার হয়ে উঠলো। শুধু চোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়তেই লাগলো, পড়তেই লাগলো! আমি পারলাম না আমার বন্ধুকে বাঁচানোর এতটুকু চেষ্টা করতে, আমি পারলাম না, আমি পারলাম না সাইফ, আমাকে ক্ষমা করে দিস বন্ধু! আমার বন্ধুর শহীদ হওয়ার স্বপ্ন অবশেষে সত্যি হয়েছে। কিন্তু, প্রকৃতি এতো নিষ্ঠুর রুপে সেই স্বপ্ন কে সত্যি করবে জানা ছিল না!

আমি দেখলাম, আমার দাদুর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে তো পড়ছেই। সেই পানি লুকানোর বা মুছার প্রয়োজন নেই, দাদু তা করলেন ও না। আমি নিজেও খেয়াল করিনি, আমার চোখেও সেই একইভাবে অঝোরধারায় পানি পড়ছে। আমি তো কাদছিনা। আজ কাদতে হয়না। আজ বিজয় দিবস। আজ আনন্দের দিন। কিন্তু, সেই আনন্দ তো কান্নার পানি ম্লান করতে পারেনা। তার সেই ক্ষমতা নেই। আমি দাদুকে আর কিছু বললাম না, দাদুর কাছে জানতেও চাইলাম না, এরপর কি হলো! শুধু ভাবতেই লাগলাম, কিছু কিছু মানুষ এমনও হয় ! কখনো কখনো প্রাপ্তি এমনও হয় ! কখনো কখনো স্বাধীনতা এমনও হয়! বিজয় এমনও হয় !!

গল্প- “স্বাধীনতা এমন ও হয়, বিজয় এমন ও হয়”!
- মাহফুজ আলআমিন

*****সমাপ্ত*****

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.