নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মঞ্জুর চৌধুরী

আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!

মঞ্জুর চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমাদের গৃহকর্মীগণ

০১ লা মে, ২০১৮ রাত ১০:৩৯

১. নসিরন।

চিটাগং থাকতে আমাদের একটি কাজের মেয়ে ছিল, নসিরন নাম। আমাদের বয়স তখন খুবই ছোট, মাত্রই স্কুলে যাওয়া আসা করতে শুরু করেছি।
মেয়েটি ছিল বরিশালের। আমার এবং আমার বোনের খেলার সঙ্গীর অভাব ছিল না। ষোলোটা ফ্ল্যাটের সবকটা সিনিয়র, জুনিয়র বাচ্চাই তখন আমাদের বন্ধু। তারপরেও নসিরন আমাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল। এবং মেয়েটির ছিল গল্প বলার বিস্ময়কর প্রতিভা।
আর অন্যান্য সবার মতোই সেও আমাদের রূপকথার গল্প শোনাতো, রাজা, রানী, পক্ষীরাজ ঘোড়া, জ্বিন, পরী ইত্যাদি। তবে পুরোটাই সে শোনাতো বর্তমানের প্রেক্ষাপটে। এবং রূপকথার গল্পের সে নিজেও একজন চরিত্র, একজন বনবাসী ছদ্মবেশী রাজকুমারী। তাঁর দুষ্টু চাচা তাঁর বাবা মাকে বন্দি করে তাঁদের রাজ্য দখল করে নিয়েছে, সে এবং তাঁর বোন পালিয়ে বেড়াচ্ছে, এখন আমাদের বাড়িতে তাঁরা আশ্রয় নিয়েছে। একদিন তাঁর ভাই বড় হবে, যুদ্ধে দুষ্টু চাচাকে পরাজিত করবে, এবং তাঁদের রাজ্যোদ্ধার হবে।
মাঝরাতে তাঁদের সাথে দেখা করতে প্রায়ই পরীরা আসে। তাঁরা তাঁদের মা বাবার নানান খবরাখবর এনে দেয়। জ্বিনেরা তাঁদের সেনাবাহিনী তৈরী করছে, অপেক্ষায় আছে তাঁর ভাই বড় হয়ে ওদের নেতৃত্ব দিবে। তাঁদের প্রজারা তাঁদের রাজ্যে ফেরার জন্য অধীর অপেক্ষায় আছে।
আরও নানান গল্প। তাঁদের স্মৃতিকথা। তাঁদের একটি দুধ সাদা ঘোড়া আছে, তার নাম রাজা ঘোড়া। ও কথা দিয়েছে, ওরা নিজেদের রাজ্যে ফিরে গেলে আমাকে এই ঘোড়া উপহার হিসেবে দিবে। এদিকে আমার পছন্দ কালো ঘোড়া। নসিরন আশ্বাস দেয় রাজা ঘোড়াকে একবার দেখলে পৃথিবীর আর কোন ঘোড়াকেই নাকি আমার ভাল লাগবেনা।
আমি তখন স্বপ্ন দেখছি সে ঘোড়া কোথায় রাখবো, কি করবো সেইসব নিয়ে।
পুরাই সুররিয়েলিস্টিক, ম্যাজিক রিয়েলিজম অবস্থা।
এই মেয়ে যদি লেখালেখি শুরু করতো, তাহলে বাংলাদেশ আসলেই একজন জে.কে.রোলিং পেয়ে যেত। আফসোস, আমাদের সম্ভাব্য জে.কে.রোলিং হয়তো এখনও কারোর বাড়ির হাড়ি পাতিল মেজে বেড়ায়।
তাঁর চুরি করার প্রতিভা ছিল বিস্ময়কর।
সে প্রায়ই দোকান থেকে আমাদের লজেন্স, চকলেট এনে দিত। জিজ্ঞেস করলে বলতো দোকানদারের কাছে সে চেয়েছে, এবং দোকানদারও দিয়ে দিয়েছে। আসলে দোকানদারও জানে যে সে রাজকুমারী, তাই তাঁর কাছ থেকে দাম রাখেনি।
কিন্তু আসলে সে দোকানদারকে কথাবার্তায় ব্যস্ত রাখতে রাখতে বয়াম খুলে দিব্যি ওসব সরিয়ে আবার বয়ামের ঢাকনা লাগিয়েও দিত। ব্যাপারটা কিন্তু এতটা সহজ না। সূক্ষ্ম টাইমিংয়ের ব্যাপার আছে। এবং সে একবারও ধরা খায় নি।
অনেকদিন পর নিজের চোখে এই হাতের সাফাই দেখে হা হয়ে গিয়েছিলাম। আসলে সেই বয়সটা এমন ছিল যে, যে যাই বলতো, আমরাও চোখ বুজে বিশ্বাস করে ফেলতাম। অবশ্য বদভ্যাসটা এখনও রয়ে গেছে। এখনও মানুষকে অবিশ্বাস করতে পারিনা। প্রতিবারই বেনিফিট অফ ডাউট দিতেই থাকি।
যাই হোক, নসিরনের সেই চোরাই লজেন্স থেকেই একটা দুইটা আমি আমার কেজি টুর ক্রাশের (যার কথা স্মৃতিকথায় লিখেছি) টেবলে রেখে দিতাম।
মোরাল অফ দ্য স্টোরি: চোরাই মাল উপহার দিয়া নারী পটাইবার চেষ্টা করিলে সেই প্রেম কখনই সফল হইবেনা। বরঞ্চ নিজের কষ্টের টিউশনির পয়সা দিয়া পটাইবার প্রয়াস করিলে একদিন সে আপনার সন্তানের মাতা হইয়া আপনার সংসার আলোকোজ্জ্বল করিবে।

২.

এরপরে জমিলা এবং নেওর আলীর ঘটনা গতকালই বলেছি। জমিলার মধ্যে হয়তো আমি আরেকটা নসিরন খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম, পাইনি বলেই তাঁকে অত্যাচার করতাম। কিংবা হয়তো আসলেই আমি ছোটবেলায় জানোয়ার ছিলাম, কে জানে?
যাই হোক, এর পর আর সেই রকম ইন্টারেস্টিং কোন কাজের লোক আমরা খুঁজে পাইনি। যেগুলো রাখা হতো, বেশিরভাগই চুরিতে ধরা খেয়ে বিদায় নিত। একজনের সাথেতো এক মাসের মতন শীতল স্নায়ুযুদ্ধ চলেছে।
মেয়েটির নাম ভুলে গেছি। কুসুম বা এইরকমই কিছু হবে। আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে আনা হয়েছিল। মেয়েটি একটি কাঁধে ঝুলাবার ব্যাগে করে নিজের জামা কাপড় নিয়ে আমাদের বাড়িতে উঠে এসেছিল।
দেখা গেল, বাড়িতে প্রায়ই ছোটখাটো জিনিস হারিয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগই শো পিস্। একদিন আম্মু গিয়ে তার ব্যাগ খুলল, এবং চিচিং ফাঁক! আলিবাবা আবিষ্কার করলো লুটের মাল সব এই জিপওয়ালা কাপড়ের গুহায় সঞ্চিত আছে।
আম্মু মেয়েটিকে কিছু বললো না, সবগুলো সেই ব্যাগ থেকে বের করে এনে আবারও আগের জায়গায় রেখে দিল। বুদ্ধিমতী হলে মেয়েটি বুঝে যাবে, এবং ভবিষ্যতে আর এমন বোকামি করবে না।
সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, মেয়েটি তারপরেও দমলো না। সে আবারও জিনিসগুলো নিয়ে নিজের ব্যাগের মধ্যেই ভরলো। আম্মু আবারও ব্যাগ থেকে বের করে এনে আগের জায়গায় রেখে দিল। এবং আবারও যখন মেয়েটা একই কাজ করলো, তখন গ্রাম থেকে তার ভাইকে ডাক পাঠানো হলো। নিয়ে যাক। এবং যাবার আগে আগে আবারও তার ব্যাগ থেকে যাবতীয় গুপ্তধন বের করে যার যার আদি নিবাসে প্রতিস্থাপন করা হলো।
মেয়েটা যাবার আগে আম্মুর দিকে তাকিয়ে একটি বাঁকা হাসি দিয়ে বললো, "আমি আবার আসবো।"
এর মানে কী হতে পারে সেটা ভেবে আম্মুর কলিজা শুকিয়ে গেল। হয়তো আরও ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে আসার প্ল্যান তার। অথবা সে স্রেফ এই লুকোচুরি খেলাটা এঞ্জয় করছিল। কে জানে?

৩.

এরপরের মেয়েটির সাথে আমার দেখা হয়নি। আমি ততদিনে ঢাকায় পড়াশোনা করি, এবং মেয়েটি আমাদের বাড়িতে এক সপ্তাহের বেশি ছিলও না।
ছোট মেয়ে, টুকটাক কাজ করার জন্যই তাঁকে আনা হয়েছে। এবং যেই কাজই দেয়া হয়, তাই সে নিষ্ঠার সাথে পালন করে। কোন ফাঁকিবাজি নেই, টিভি ছাড়লেই সব কাজ ফেলে এসে টিভি দেখতে বসে যায় না। যন্ত্রনা কেবল একটাই, গভীর রাতে মেয়েটির কামরা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই কণ্ঠের কথোপকথনের শব্দ ভেসে আসে।
আমার ভাইর তখন এসএসসি পরীক্ষা এগিয়ে আসছে, অনেক রাত জেগে পড়তে হয়। এবং হঠাৎই মেয়েটির খিলখিল হাসির শব্দে বেচারার হৃদপিন্ড খাঁচাছাড়া করে।
মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করা হলে সে নির্বিকারভাবে বলে, "আমি আবার কখন হাসলাম?"
একদিন আম্মু মাছ কুটছিল। বিশাল সাইজের রুই মাছ। এবং হঠাৎ দেখে মেয়েটি লোভাতুর দৃষ্টিতে সেই মাছের দিকে তাকিয়ে আছে। এই দৃষ্টি কোন সাধারণ মানুষের হতেই পারেনা। মেয়েটির চোখ কোটর ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। হাসিটা কেমন যেন পিশাচের মতন। আমার মধ্যবয়সী মা পাঁচ ছয় বছরের সেই ছোট মেয়েটির ভয়ে তখন মাছ কুটা বন্ধ করে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে সমানে আয়াতুল কুরসী পড়তে লাগলেন।
মেয়েটির আত্মীয়কে খবর দেয়া হলো। আত্মীয় তেলতেলে হাসি হেসে বললো, "আপনাদের আসলে আগে বলা হয়নি, মেয়েটির গায়ে খারাপ বাতাস লাগছে। ওর সাথে জ্বিনদের কথাবার্তা হয়। এমনিতে কারোর কোন ক্ষতি করে না।"
আম্মু বললেন, "ক্ষতি না করলে খুবই ভাল। কিন্তু আমরা এই মেয়েকে রাখতে পারবো না। দুঃখিত।"
মেয়েটি হয়তো মানসিকভাবে অসুস্থ। চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল। এবং আমাদের দেশে মানসিক রোগের সেইরকম সুচিকিৎসাও হয়না। এদিকে প্যারাসাইকোলোজি এবং প্যারানরমাল বিষয়ে আমার আগ্রহ সাংঘাতিক, এবং আমি এখন পর্যন্ত একটাও ঘটনার দেখা পেলাম না। এমন একটি ইন্টারেস্টিং কেস আমার বাড়িতে এসেও আমার দেখার সৌভাগ্য হলো না। আফসোস!

৪.

এই বুয়ার নামও ভুলে গেছি। নানীর বাসার বুয়া। আমার নানী নিজের কাজ নিজে করতেন, কিন্তু বয়স হয়ে যাওয়ায় টুকটাক বিষয় যা করতে পারতেন না, সেগুলোর জন্যই তাঁকে রাখা হয়েছিল। বয়স্ক এবং মজার মহিলা। ফাঁকিবাজিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে যেই কাজের কথাই বলা হোক না কেন, সে বলতো আমি জীবনেও করিনাই, শিখায় দিতে হবে।
যেমন, ভাত রান্না হবে, নানী বললেন তুমি চাল ধুয়ে ভাত বসায় দাও।
মহিলা বললো, "আমি জীবনেও গ্যাসের চুলায় রান্ধি নাই।"
"কঠিন কিছু না। একই রকম।"
"তবুও ডর করে।"
"ডরের কিছু নাই। এই যে এইভাবে ঐভাবে করতে হবে।"
"আপনে দেখায়া দ্যান।"
নানী নিজেই পুরোটা রেঁধে দেখিয়ে দিলেন। এরপরদিন আবারও সেই ঢং।
"কালকেই না দেখায় দিলাম?"
"ভুইল্যা গেছি, বয়স হইবার পর কিছু মনে থাকে না।"
আবারও দেখানো হলো। এবং পরদিন আবারও বার্ধক্যজনিত কারনে তিনি ভুলে গেলেন।
সর্বক্ষেত্রে একই জিনিস।
"তুমি গিয়ে কাপড়ে সাবান মাখো, অনেক ময়লা কাপড় জমা হয়ে গেছে।"
"আমি জীবনেও কলের পানিতে কাপড় ধুই নাই, আপনে দেখায়া দ্যান।"
একদিন নানী ধৈর্য্য হারালেন। প্রচন্ড রাগী কণ্ঠে বললেন, "সারাজীবন কী তুমি কোনই কাম করো নাই? জামাই কী বিয়ার পর থেইকা তোমারে কোলে বসায়া খালি চুমা খাইছে? আর কিছুই করতে দেয় নাই?"
নানীর মুখে এমন চুম্মাচাটির কথা শুনে আমরা হতচকিত। বুয়া শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে লজ্জিত স্বরে বলেন, "ছিঃছিঃ নানী, এইসব কী কন?"
মামা আমাদের দিকে তাকিয়ে হতবাক কণ্ঠে বললেন, "তোদের নানী এইটা কী বললো? চুম্মা চাটি? বাহ্! আমাদের আম্মা দেখি বদলায় গেল!"
যাই হোক, মহিলা এরপর দ্রুত সব কাজ শিখে ফেললেন। হয়তো কেবল এইটাই প্রমান করতে যে তাঁর স্বামী তাঁকে আদর সোহাগ বাদেও মাঝেমাঝে অন্যান্য কাজও করতে দিতেন।

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা মে, ২০১৮ রাত ১০:৫৪

রাজীব নুর বলেছেন: পড়লাম।

নাসরিন বরিশালের মেয়ে। বেশ।

০২ রা মে, ২০১৮ রাত ১০:৩৪

মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন: :) নাসরিন না, নসিরন।

২| ০১ লা মে, ২০১৮ রাত ১১:০৩

বিচার মানি তালগাছ আমার বলেছেন: হাসলাম। বর্ণনাগুলো চমৎকার লিখেছেন...

০২ রা মে, ২০১৮ রাত ১০:৩৪

মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন: :) ধন্যবাদ :)

৩| ০১ লা মে, ২০১৮ রাত ১১:৫৬

কবি হাফেজ আহমেদ বলেছেন: ভালো লাগলো।

০২ রা মে, ২০১৮ রাত ১০:৩৯

মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন: ধন্যবাদ :)

৪| ০২ রা মে, ২০১৮ রাত ১২:৩০

কাওসার চৌধুরী বলেছেন: কাজের মেয়ে/মহিলাদের মে দিবসে স্মরণ করেছেন এজন্য ভাল লাগছে। সব কাজের মানুষকে সম্মানের চোখে দেখা উচিৎ।

মঞ্জুর চৌধুরী ভাই, প্রথম পরিচয় তাই শুভেচ্ছা রইলো। আমার ব্লগবাড়ী সময় সুযোগে ঘুরে আসলে খুশি হবে। ধন্যবাদ।

০২ রা মে, ২০১৮ রাত ১০:৩৯

মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন: থাংকস :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.