নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মঞ্জুর চৌধুরী

আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!

মঞ্জুর চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও ক্ষেত্র বিশেষে মন্দ লাগে।
প্রথমে বলি ভাল লাগার দিকগুলো।

আমি ডালাসে থাকি। আমার জীবনে আজ পর্যন্ত সতেরো বছরের বেশি সময় কোন নির্দিষ্ট এলাকায় থাকা হয়নি। এই শহরেই আমার লেখাপড়া, চাকরি, সংসার, বাড়ি, গাড়ি, বাচ্চাদের স্কুল ইত্যাদি। ডালাসে আক্ষরিক অর্থেই আমার শেকড় গজিয়ে গেছে। তবে ডালাস, অস্টিন, হিউস্টোন, সান-আন্তোনিও (টেক্সাসের বড় বড় শহরগুলো) ইত্যাদি শহরগুলো অন্যান্য সাধারণ আমেরিকান বড় শহরগুলোর মতোই। কিন্তু নিউইয়র্কে যেহেতু জনসংখ্যা ও বর্ণবৈচিত্র্য অনেক বেশি, সেখানে গেলে আপনি এক শহরের ভিতরেই বহু দেশ ও জাতির সাথে অথেন্টিকভাবে পরিচিত হয়ে যাবেন। যেমন আমি গিয়ে এইবার যেখানে হোটেল নিলাম (ফ্ল্যাশিং-মেইনস্ট্রিট), এলাকাটাকে প্রথম নজরে শাংহাই বলে ভ্রম হবে। প্রচুর চীনা মানুষের বাস। পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন একটা এলাকা। প্রচুর চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, বেকারি ও গ্রোসারি শপ। আমার হোটেলটা যদিও আমেরিকান চেইন হোটেল, তারপরেও এর ম্যানেজার থেকে শুরু করে রুম সার্ভিস পর্যন্ত সবাই ছিল চৈনিক সভ্যতার নিদর্শন। এবং সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং দিকটা হচ্ছে, আমার এলাকাটা "চায়না টাউনও" না। ওটা আলাদা বিশেষ একটা এলাকা।
এইভাবেই নিউইয়র্কের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মানুষ বছরের পর বছর থাকতে থাকতে আশেপাশের এলাকাকে নিজেদের দেশের মতই করে ফেলেন।
ট্রেনে করে ওদের ম্যানহাটন সিটির অলিতে গলিতে উঁচু ভবন আর অর্থবিত্তের চাকচিক্যে আপনার মাথা চক্কর দিয়ে উঠবে। সে অঞ্চল দেখলে আপনার মনে বিশ্বাস হতে বাধ্য কেন আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ। কিছু পথ গেলেই আপনি প্রবেশ করবেন চায়না টাউনে। দেখবেন ফুটপাথেই বিক্রি হচ্ছে ফলমূল, খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে মাছ। টেক্সাসে যেমন আমরা বন্ধ দোকানে মাছ ও ফলমূল কিনে অভ্যস্ত। টেক্সাসে ফুটপাথের উপর কোন দোকান এখন পর্যন্ত দেখা হয়নি। "চায়না টাউনে" চাইনিজ বেকারিতে রাস্তার দুইপাশ পরিপূর্ণ। কাঁচের ওপাশে গ্রিল্ড হাঁস শোভা পাচ্ছে। বাতাসে চাইনিজ খাবারের গন্ধ। দোকানের সাইনবোর্ডও চীনা বর্ণমালায় লেখা। ফুটপাথ ধরে হেঁটে বেড়ানো লোকজনের বেশিরভাগই চীনা। কিছু সাদা মানুষের দেখা পাবেন, মনে হবে তাঁরা ট্যুরিস্ট। এমনকি এমন বহু স্থানীয় লোকজন পাবেন যারা ইংলিশে কথা বলতে ও বুঝতে পারেন না। তাঁরা এদেশেই থাকেন, কাজকর্ম করেন, বেড়ে ওঠেন। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাঝে মাঝে এনওয়াইপিডির গাড়ি না দেখলে মনে হতে বাধ্য এগুলি নিশ্চই চীনের কোন শহর।
রাস্তার উল্টোদিকেই লিটল ইটালি।
ইটালিয়ান খাবার আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার। ইটালিয়ান পোশাক আমার সবচেয়ে প্রিয় পোশাক। কাজেই ওখানে গেলে আমার মাথা নষ্ট হতে বাধ্য।
ফুটপাথ দখল করে (একমাত্র নিউইয়র্কেই বোধয় "ফুটপাথ দখল" সম্ভব) অথেন্টিক আর রেস্টুরেন্টের চেয়ার টেবল পাতা থাকে। সুন্দরী ইটালিয়ান মেয়েরা কাস্টমার ধরার চেষ্টায় থাকে। সুপুরুষ ওয়েটারদের গডফাদার ছাঁটের চুল, পরিপাটি মার্জিত সাজ, মনে হবে মাইকেল কর্লিওনি নিজে এসেছেন আপনাকে ফুড সার্ভ করতে। আর খাবার? বলার অপেক্ষা রাখেনা। "নিউইয়র্ক স্টাইল পিৎজা" "নিউয়র্ক স্ট্রিপ স্টেক" এগুলি গোটা আমেরিকাতেই বিখ্যাত।
চায়না টাউনের চাইতে এই এলাকার সুবিধা হচ্ছে এরা মোটামুটি হলেও ইংলিশে কথা চালিয়ে যেতে পারবে। যদিও এদের স্থূল রসিকতা নাও বুঝতে পারেন। যেমন এক দোকানের সামনে লেখা "if you're not an italian and taking my parking place, I'll make sure to break your **ing face."
পড়েই আপনি মনে করবেন শালা দোকানদার নিশ্চই মহা রেসিস্ট!
অথবা আরেকটা দোকানের সামনে সাইনবোর্ডে ঝুলছে "শুধুমাত্র ইটালিয়ানদের জন্য।"
যদিও লিটল ইটালি নাম, তবু প্রচুর বাঙালিকে কাজ করতে দেখলাম। আমাদের সার্ভ করা ওয়েটার ছেলেটাও ছিল একজন বাংলাদেশী। মাত্র দেড় বছর হয়েছে আমেরিকা এসেছে, অথচ এরই মাঝে বাংলা ভুলে গেছে। শুরুর দিকে বাংলায় কথা বলতেই চাচ্ছিল না। অবশ্য অনেকেই আছেন, ইংলিশে কথা না বললে ছোট করে দেখেন। অনেকে মানুষকে ছোট করার চেষ্টা করেন ইনকামের ভিত্তিতে। "ওয়েটারি করে? কতই বা কামায়?" - ব্যস, শুরু হয়ে যায় ওর প্রতি দুর্ব্যবহার, ছোটলোকি আচরণ। আমরা বাঙালিরাই বা কি কম বিচিত্র? ছেলেটা প্রথম দেখাতেই বুঝবে কি করে আমি ওর ইংলিশে গ্রামারে ভুল খুঁজতে আসি নাই?

যদিও লিটল ইটালি, লিটল চায়নার মতন "লিটল বাংলাদেশও" আছে তবু আমার কাছে "মিনি বাংলাদেশ" হচ্ছে জ্যাকসন হাইটসের ৭৩ এবং ৩৭ নম্বর রোড ও জ্যামাইকার ১৬৯থ স্ট্রিটগুলো। বাংলাদেশী গ্রোসারি, রেস্টুরেন্ট ও পন্যের দোকান - সেখানে বাংলায় সাইনবোর্ড টানানো, রাস্তাঘাটে সব বাঙালির হাঁটাচলা, রাস্তাঘাটে মাঝে মাঝেই নোংরা আবর্জনা ফেলে রাখা, আমারতো মনে হচ্ছিল আমি সিলেটের জিন্দাবাজারে দাঁড়িয়ে আছি। কারন প্রচুর সিলেটির দেখা পেলাম, যারা একদম খাস সিলেটি ভাষায় কথা বলেন। "হাট বাজারে" মুরগির রোস্ট আমার সিলেটি রোস্টের কথাই মনে করিয়ে দিল। সাথে ইত্যাদিতে সকালের নাস্তায় পরোটা দিয়ে হাঁস ভুনা ছিল অসাধারন! কমসে কম তিন চারজন মানুষ খলিল বিরিয়ানির বিরিয়ানি ও তেহারি ট্রাই করতে বলেছিল, খাওয়া হয়নি। সময় করে উঠতে পারিনি। অথেন্টিক ঢাকাই কাচ্চি খাওয়া হয়না বহুযুগ হয়ে গেছে।
জ্যাকসন হাইটসের দোকানগুলো দেখলে গাউছিয়া মার্কেট বলে ভ্রম হয়। টেক্সাস থেকে কেউ গেলে কল্পনাই করতে পারবেনা এতটুকু জায়গাতেও দোকান হওয়া সম্ভব। অথচ লোকজন দিব্যি পান সিগারেট, মেয়েদের চুড়ি, টিকলি, গয়না, ফোন ফ্যাক্স, কপি মেশিন, ইমিগ্রেশন সার্ভিস ইত্যাদি ব্যবসা করে সংসার চালাচ্ছেন। ফুটপাথে বিক্রি হচ্ছে ধর্মীয় বই, নামাজের টুপি, জায়নামাজ, বাচ্চাদের জন্য প্লাস্টিকের সস্তা খেলনা ইত্যাদি। এবং একটা কোণে পাওয়া গেল অনেকগুলো ফুচকার গাড়ির দোকান। বাংলাদেশী কায়দায় তৈরী ফুচকা! আহ! অমৃত!
"লিটল বাংলাদেশের" পাশের গলিতেই "লিটল ইন্ডিয়া" পেয়ে গেলাম।
বিয়ের পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি, গয়না, মিষ্টি ইত্যাদির দোকানে ঠাসা। পাশের গলিতেই যেখানে সবাই বাংলাদেশী, সেখানে সমানে লোকজন হিন্দিতে কথা বলছেন। কে বলবে এটা আমেরিকা?

নিউইয়র্কের পথে পথে হটডগ, শর্মা স্যান্ডুইচ, রাইস প্ল্যাটারের কার্ট (টংয়ের দোকানের মতন)। সবাই হালাল মাংসের স্যান্ডুইচ, হট ডগ ইত্যাদি বিক্রি করছে। খ্রিষ্টানদের কিছু যায় আসে না মাংসটা হালাল নাকি হারাম। ইহুদিরা এমনিতেও কোশার (ইহুদি ধর্মের "হালাল") ছাড়া খায় না। কাজেই মুসলিম ক্রেতা পেতে হালাল মাংস বিক্রি করাই লাভজনক। দোকানিরা বুদ্ধিমান।
আমেরিকায় এত হালাল দোকান আমার মনে হয়না মিশিগান ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে।
"দা হালাল গাইজ" পৃথিবীখ্যাত একটি রেস্টুরেন্ট চেইন। ম্যানহাটনে গভীর রাতেও ওদের দোকানের সামনে আমাদের ঢাকার খলিলের মাংসের দোকানে যখন ৫৯৫ টাকা কেজি দরে মাংস দেয়, তখন যে ভিড় হয়, তেমন ভিড়। খাবার খেলে বুঝবেন কি এর রহস্য। ওদের দেখাদেখি আরও অনেকেই দোকান খুলে বসেছেন। সেরকম ভিড় না হলেও যার যার সংসার নিশ্চই ঠিকঠাক চলছে।
ব্রুকলিনে চলে যান, মনে হবে ইজরায়েলে চলে এসেছেন। ইহুদি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। যদিও ইজরায়েলের সাথে আদর্শগতভাবে ওদের মতাদর্শ সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশের অনেকেই শুনলে অবাক হবেন যে ইজরায়েল প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা এই স্থানীয় ইহুদিরাও করে থাকেন। ওদের মতে, ইজরায়েল তাওরাত বিরোধী একটি রাষ্ট্র। তাওরাত অনুযায়ী মাসিহা আসার পূর্বে ওদের কোন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার হুকুম নেই। কাজেই জায়ানিস্টরা (ইজরায়েলি) নাস্তিক/সেকুলার/কাফের ইহুদি। ওদেরকে যে সমর্থন করবে, সেও ওদের দলভুক্ত হবে।
আমাদের বাংলাদেশিদের বোঝার সুবিধার্থে, কালকে যদি কোন সন্ত্রাসী জঙ্গি সংগঠন একটি এলাকাকে স্বাধীন ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দাবি করে ওদের নেতাই খলিফা, ওর কাছে আনুগত্য করা পৃথিবীর সব মুসলিমের দায়িত্ব, তখন কি বিশ্বজুড়ে সাধারণ মুসলিমরা মেনে নিবে? ঘটনা এখানেও তাই।
ইহুদি মেয়েদের মাথায় স্কার্ফ দেখবেন, পুরুষদের মাথায় হ্যাট থাকবে, আর দেখবেন লম্বা দাড়ির পাশাপাশি ওদের মাথার দুইপাশের লম্বা জুলফি ঝুলছে। সাবেথের দিন (শনিবারে) গেলে দেখবেন আস্ত এলাকা শুনশান নীরব। এদিনটা ওদের সাপ্তাহিক বন্ধের দিন। এদিন ওরা ঘরে বসে কেবল ইবাদত করে আর বিশ্রাম নেয়। এইদিন দুনিয়ার সাথে ওদের কোন যোগাযোগ থাকে না।
একটা সময়ে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়) এই এলাকার ইহুদিরাই ছিল অতি গরিব সম্প্রদায়, এবং আজকে ওরাই অত্যন্ত ধনী। রহস্য হচ্ছে ওদের "একতা।" একজন ইহুদীর যদি বাড়িতে চালের প্রয়োজন হয়, সে একটি ইহুদি দোকানেই যাবে। সেই চালের ব্যবসায়ীও ইহুদি পাইকারি বিক্রেতার কাছ থেকেই চাল কিনবে। ওর দোকানে ইলেক্ট্রিসিটির কাজ করাতে হলে ইহুদি মিস্ত্রির খোঁজ নিবে। এইভাবেই ওরা একজন আরেকজনকে সাহায্য করে এগিয়ে নিয়ে যায়। এখানে "ইহুদি-নাসারা" ষড়যন্ত্রের কিছু নেই।
নিউইয়র্কের আরেকটি ব্যাপার যা চোখে পড়ে তা হচ্ছে এর জনসংখ্যাকে এরা সহজেই জনশক্তিতে রূপান্তর করে ফেলে। যেমন আগেই বলেছি, বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নানান ভাষার লোক এখানে এসে নতুন জীবন শুরু করেন। এদের অনেকেরই যাত্রা একদম তলানি থেকে শুরু হয়। ফুটপাথে খাবার বিক্রি, চকলেট, লজেন্স, ক্যান্ডি, চিপস ইত্যাদি ফেরি করা দিয়ে তাঁদের আয় রোজগার হয়। কিন্তু নিউইয়র্ক বলেই ওরা সার্ভাইব করে ফেলেন। প্রতি একশোজনের মধ্যে একজনও যদি কাস্টমার পাওয়া যায়, তাতেই তাঁদের খরচ উঠে কিছুটা লাভ উঠে আসে। অন্যান্য শহরে এমন স্বল্প আয়ের মানুষদের এইভাবে টিকে থাকা কঠিন হতো। এর অন্যতম প্রধান কারন ওদের সাবওয়ে সিস্টেম। দুনিয়ায় এত নিখুঁত, এত গোছানো সাবওয়ে খুব সম্ভব লন্ডন ছাড়া আর কোথাও নেই। টেক্সাসে প্রাইভেট গাড়ি ছাড়া আপনাকে পঙ্গু বিবেচনা করা যেতেই পারে। গাড়ি কিনলে ইন্সুরেন্স কিনতে হয়, মেইনটেনেন্স থাকে, থাকে অন্যান্য খরচ। সাবওয়ে সেদিক দিয়ে সবার জন্যই সাশ্রয়ী। কেবল যে গরিব মানুষ সাবওয়ে চড়েন এমনও না, অনেক মধ্যবিত্ত ও ধনী ব্যক্তিও চড়েন। কারন ট্র্যাফিক জ্যামে ঠাসা ও পার্কিং স্পেস না পাওয়া নিউ ইয়র্ক মহানগরীতে সময় বাঁচাতে সাবওয়ের আসলেই কোন বিকল্প নেই।
অনেক প্রশংসা করে ফেললাম। এখন বলি এর কোন কোন দিকগুলো আমার অপছন্দের।
প্রথমত এর শীত। বরফ আমি দুইচোখে দেখতে পারিনা, নিউইয়র্কে এমন কোন শীত পড়ে কিনা জানিনা যে সময়ে বরফ পড়ে না। এক দুই ফুট উঁচু বরফ জমে থাকে, কাজে যাওয়ার আগে শাবল দিয়ে নিজের বাড়ির সামনের ফুটপাথ পরিষ্কার না করে গেলে সিটি থেকে জরিমানা চলে আসে। আর বরফ ছাড়াও ওদের যে শীত পড়ে, হাডসন নদী থেকে ভেসে আসে যে বাতাস, সেটা চামড়ার জ্যাকেট, উলের সোয়েটার ইত্যাদি ভেদ করে একদম শরীরের হাড্ডিতে গিয়ে বিঁধে। শীত সহ্য না হলে নিউইয়র্কে হেমন্ত-শীত-বসন্ত - এই তিন ঋতুতে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ না।
দ্বিতীয়ত ওদের কস্ট অফ লিভিং অনেক হাই। মোটামুটি মধ্যবিত্তের জীবন যাপনেও প্রচুর খাটুনি খাটতে হয়, প্রচুর টাকা কামাতে হয়, বাড়ি ভাড়া বা মর্টগেজ পেমেন্টে প্রচুর টাকা চলে যায়। ভাল এলাকায় মিলিয়ন ডলারেও যে বাড়ি পাওয়া যাবে, সেটাও মনঃপুত হবে না। প্রচুর টাকা খরচ করে বহু পুরানো বাড়ি কিনতে হয়, যার বেসমেন্টে হয়তো ইঁদুরের ঘরবসতি। মিলিওন ডলার খরচ করে যে বাড়ি কিনবো, হয়তো এলাকা পছন্দ হবেনা, নয়তো মন মতন বাগান করার এক চিলতে উঠোন থাকবে না। অন্যান্য স্টেটে ঐ একই টাকায় এক একর জমি কিনে নিজের ইচ্ছে মতন ডিজাইনে বাড়ি বানানো যাবে।
উপরে যে সাবওয়ের প্রশংসা করলাম, সেই সাবওয়েরই অনেক স্টেশনে, এলিভেটরে আপনি মানুষের মূত্রবিসর্জনের গন্ধে বমি করে দিবেন। আপনার বমিও তখন মেঝেতে পড়ে থাকবে, সেই দুর্গন্ধ যুক্ত হবে আগের দুর্গন্ধের সাথে। কেবলমাত্র এই গন্ধ থেকে বাঁচতেই আমি নিউইয়র্ক গেলে গাড়ি ভাড়া করি। এতে প্রচুর টাকা অতিরিক্ত খরচ হয় বটে, কিন্তু শরীর ও মন দুইটাই সুস্থ থাকে।
নিউইয়র্ক শহরে টাকা পয়সা যেমন বেশি, তেমনই অপরাধ প্রবণতাও বেশি। প্রচুর ছোট বড় গ্যাং আছে, আছে ছিঁচকে সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে বড় বড় গডফাদাররা। শহর নিরাপদ রাখতে এনওয়াইপিডির নাভিশ্বাস উঠে যায়, তবু প্রতিদিনই এখানে প্রচুর ক্রাইম ঘটে থাকে।

ভাল মন্দ মিশিয়ে নিউইয়র্ক একটি ইউনিক শহর। আমেরিকা ভ্রমন করে কেউ যদি নিউইয়র্ক ভ্রমন না করেন, তাহলে সেই ভ্রমন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আমেরিকার প্রতিটা স্টেট, প্রতিটা শহরের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে, আমার কাছে "বিগ অ্যাপলের" সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর জনগনের বৈচিত্র্য। এর এয়ারপোর্টেই দেখলাম একদল মুসলিম জামাতে নামাজ পড়ছেন তো পাশেই কিছু অর্থোডক্স ইহুদি বসে মোবাইলে কি কাজ করছিলেন, তো এর পাশেই কিছু আফ্রিকান আমেরিকান মহিলা উঁচু স্বরে নিজেদের মাঝে রসিকতা করছিলেন, আর একটি শ্বেতাঙ্গ পরিবার নিজের বাচ্চা সামলাতে ব্যস্ত....। এই বৈচিত্র্যতাই আমেরিকাকে আজকের আমেরিকা বানিয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের একটি বক্তব্য থেকে বলতেই পারি, "আপনি ফ্রান্সে বাস করতে পারেন, কিন্তু আপনি ফ্রেঞ্চ হবেন না। আপনি জার্মানি, টার্কি বা জাপানে থাকতে পারেন, কিন্তু আপনাকে কেউ জার্মান, তুর্কি বা জাপানি ডাকবে না। কিন্তু যে কেউ, দুনিয়ার যেকোন কোণ থেকে আমেরিকায় এসে বাস করতে পারে, এবং "আমেরিকান" হতে পারে।"
নিউইয়র্ক এর আদর্শতম উদাহরণ।

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৫৯

ইফতেখার ভূইয়া বলেছেন: আপনার লিখাটা পড়ে বেশ ভালো লাগলো। আপনার মতো নিউ ইয়র্কেই আমার বিগত ১৭/১৮ বছর কেটেছে। এই শহরের অলি-গলি মোটামুটি আমার নখ-দর্পনে। কোভিডের সময় অযাচিতভাবে নিউ-ইয়র্কের অনেক রাস্তায় হেঁটে হেঁটে শুধু ভিডিও করেছি আর ইউটিউবে আপলোড দিয়েছি। মূলত এই শহরেই আমার বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, চাকুরি অনেকটাই আপনি যেভাবে লিখলেন। শহরটার প্রতি এক ধরনের অজানা মায়া জন্মে গেছে। ফুটপাত দখলের কথা বলেছেন, বিষয়গুলো আমার কাছে প্রচন্ড রকম তেতো লাগে, এসব দেখে মাঝে-মধ্যে ইচ্ছে করে অন্য কোথাও চলে যাই, কিন্তু যেতে পারি না। সুদূর ঢাকায় বসে আপনার লিখায় নিউ ইয়র্ক দেখতে পেলাম মনে হয়। এর যদি নিউ ইয়র্ক আসেন, চা না খেয়ে যেতে দিচ্ছি না। আমি কিন্তু ফ্ল্যাশিংএর আশে-পাশেই থাকি, বুঝতেই পারছেন :P B-) । ধন্যবাদ।

২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৩

মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন: ডালাস চলে আসেন। :)

২| ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩০

বাকপ্রবাস বলেছেন: অনবদ্য বর্ণনা। মনে হচ্ছে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে আসলাম

২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৩

মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন: ধন্যবাদ!

৩| ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:২৫

শায়মা বলেছেন: ভাইয়া
লেখাট পড়ে নিউইয়র্ক তো দেখেই ফেলললাম বলা চলে।

অস্ট্রেলিয়াতেও এমন বাঙ্গালীপাড়াটাই সবচেয়ে বেশি নোংরা মনে হয়েছে আমার। আর সেখানে গেলে কে বলবে সেটা বাংলাদেশ না। ধানসিড়ি থেকে স্টার কাবাব সবই আছে। একই ভাবে সিডনীতে চায়না মার্কেট এরাবিয়ান মার্কেট ভিন্ন ভিন্ন দেশের জগতে ঢুকে পড়া।

তবে হ্যাঁ লোকজন কম থাকার জন্য কিনা জানিনা রাস্তাঘাট পাতাল ট্রেন মেট্রো সবই ঝকঝকে তকতকে। ঐ সব ভীনদেশী এলাকাগুলোও অনেককক বেশি নোংরা না আর ওসব ছাড়া তো পুরোই ঝকঝকে সিডনী। নিউইয়র্কে সাবওয়ের বর্ননা শুনে তো ভয় পাচ্ছি। আমার বোন রোজ একবার করে বলছে আমেরিকায় ওর কাছে বেড়াতে যেতে সে নাকি আমাকে নিয়ে ডিজনীল্যান্ড নিউইয়র্ক সব ঘুরে বেড়াবে। অনেক অনেক সাধ তার মনে। তবে ভাগ্য ভালো সে তার গাড়ি নিয়ে আমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াবে। কাজেই সাবওয়ে থেকে মনে হয় রক্ষা পাওয়া যাবে তাইনা?


আমিও আমার অস্ট্রেলিয়া ভ্রমন পোস্ট অর্থাৎ রোজ রাতে যেই ডায়েরী লিখে রাখতাম সেসবই একটু কেটেছেটে প্রকাশ করেছি ব্লগে। তোমার এই পোস্ট প্রিয়তে রেখে দিলাম। অনেক অনেক শুভকামনা ভাইয়া। :)

২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৬

মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন: নিউইয়র্কের সাবওয়েও একটি অভিজ্ঞতা। মিস করবেন না। বিশেষ করে গাড়ি নিয়ে ড্রাইভ করলে যখন দেখবেন পার্কিং খুঁজে পাচ্ছেন না, তখন বিরক্তি আসবেই। তাছাড়া ট্রাফিক জ্যামে মন তিক্ত হলেই বুঝবেন সাবওয়েই সময় সাশ্রয়ী। ;)
তবে হ্যা, অবশ্যই নিউইয়র্ক ঘুরবেন, ক্যালিফর্নিয়া ঘুরবেন। ডিজনি আমার ভাল লাগেনি, বেশিই বাচ্চাদের। বরং ইউনিভার্সাল ষ্টুডিও যান, সেখানে বেশি মজা পাবেন।

৪| ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬

ঢাকার লোক বলেছেন: নিউ ইয়র্ক নিয়ে সুন্দর বর্ণনা!
সাবওয়ের অপরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য একটু বেশিই বিরূপ হয়ে গেছে মনে হলো! সব স্টেশনেই সবসময় এমন থাকেনা নিশ্চয়ই।
ভালো করে পড়েছি তার প্রমান, জ্যাকসন হাইটস এর দোকানের সাইজ সংকান্ত বাক্যটিতে "না" শব্দটি মিসিং! সুযোগমতো ঠিক করে দিতে পারেন।

২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৮

মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন: আপনি যদি বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে আসেন, আপনার কাছে সাবওয়ে স্টেশন তেমন নোংরা মনে হবেনা। আপনি যদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থেকে অভ্যস্ত হয়ে যান, তখন নোংরা মনে হবে। নিউইয়র্কে ঝকঝকে তকতকে সাবওয়ে স্টেশন আশা করাটা অন্যায়, কারন প্রতি ঘন্টায় হাজার হাজার মানুষ আসা যাওয়া করে। সাথে হোমলেস, ড্র্যাগ এডিক্টরাতো আছেই।

৫| ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪১

জুন বলেছেন: আমিও বর্তমানে নিউইয়র্কে আছি দিন দশেক হলো। নিরিবিলি ছিমছাম লং আইল্যান্ড এ আপাতত আছি। আপনার বর্ননার মত আমিও জ্যাকসন হাইটস না জ্যামাইকাতে ফুচকা খাইলাম আর যেহেতু ওই এলাকায় গেলাম তাই মান্নানের গ্রসারিতে আমার জাকে বাজার করায় সংগ দিলাম ;)
বাসার চারিদিকে মানে ১০/১৫ মিনিটের ড্রাইভে সমুদ্র সেখানেও দুদিন গেলাম। কিন্ত প্রচন্ড ঠান্ডায় আমার খোলা হাত জমে যাওয়ার অবস্থা :-&
আছি আরও মাসখানেক এর মাঝে অবশ্য ন্যাশভিল যাওয়ার কথা। তার আগে নিউইয়র্কটা ঘুরে ফিরে দেখি।
আপনার বর্ননা কাজে লাগবে।
অনেক ভালোলাগা রইলো।
ব্যাংককের সাবওয়ে ওরা বলে মেট্রো আর স্কাই ট্রেন স্টেশনে আপনি মাটিতে খাবার রেখে খেতে পারবেন এত ঝকঝকে। যদিও এসব জায়গায় খাবার খাওয়া সম্পুর্ন নিষিদ্ধ। দেখলে অবশ্য দেখবেই সাথে সাথে ২ হাজার বাথ জরিমানা। তবে ওরা খুবই নিয়ম মানা একটি জাতি। আর প্রতিটা জিনিস নিজের মনে করে। আর টরেন্টোর সাবওয়েতে আমার ছেলে যেতে ভয় পায় হোমলেস আর ড্রাগ এডিক্টদের জন্য। অনেক কথা বলে ফেললাম। স্যরি :(

৬| ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:০৮

শায়মা বলেছেন: ভাইয়া আমি তো বাচ্চাদেরই টিচার তাই বাচ্চাদের কর্মকান্ডগুলি আমার বেশি ভালো লাগে। :)

৭| ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:০৩

ইফতেখার ভূইয়া বলেছেন: লেখক বলেছেন: ডালাস চলে আসেন।

আমার অফিস টেনেসিতে, খুব সম্ভবত ওদিকটায়ই মুভ করা হতে পারে। অবশ্য এখনোও নিশ্চিত বলতে পারছি না। দেখা যাক। #:-S আবার নিউ ইয়র্ক আসলে চা খেয়ে যেতেই হবে। ধন্যবাদ।

৮| ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫০

আলাপচারী প্রহর বলেছেন: দারুণ্
শুধু ভ্রমণ কাহিনী পড়তেই আসি এই ব্লগে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.