নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মারুফ হোসেন

Tsundoku

মারুফ হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

আন্তন চেকভের ছোটগল্প: কেরানির মৃত্যু

১৯ শে মে, ২০১৮ দুপুর ১২:৩১

চমৎকার এক সন্ধ্যা। স্টলের দ্বিতীয় সারিতে বসে অপেরা গ্লাস দিয়ে ‘দ্য বেলস অভ কর্নেভিল’ দেখছে সুস্থ-সবল দেহের অধিকারী কেরানি ইভান দমিত্রিচ চেরভিয়াকভ। অভিনয় দেখতে-দেখতে তার মনে হচ্ছিল, পৃথিবীতে তার চেয়ে সুখী বুঝি আর কেউ নেই। কিন্তু হঠাৎ...
এই ‘কিন্তু হঠাৎ’ ব্যাপারটা গল্প-কাহিনীতে অহরহ ঘটে। লেখকরা ঠিকই বলেন: মানুষের জীবন অসংখ্য অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর ঘটনায় ভরপুর।
যা-ই হোক, ‘কিন্তু হঠাৎ’ চেরভিয়াকের চেহারাটা কুঁকড়ে গেল, বড়-বড় হয়ে উঠল চোখ দুটো, আটকে এল নিঃশ্বাস...হাত থেকে নামিয়ে রাখল অপেরা গ্লাস। তারপর সামনে ঝুঁকে...অ্যা—হ্যাঁচ্চো!
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, বিকট শব্দ করে হাঁচি দিল লোকটা। হাঁচি দিতে অবশ্য মানা নেই কোন। হাঁচার অধিকার সবারই আছে—সবাই-ই হাঁচি দেয়। কৃষকরা হাঁচে, পুলিস চিফ হাঁচেন, মাঝেসাঝে এমনকী প্রিভি কাউন্সিলররাও হাঁচেন। কাজেই বিন্দুমাত্র বিব্রত বোধ করল না চেরভিয়াকভ। চট করে নাকটা মুছে ফেলল রুমাল দিয়ে। তারপর সভ্য-ভদ্র মানুষ যা করে, ঠিক সেভাবে আশপাশে চোখ বোলাল কারও কোন অসুবিধে হয়েছে কিনা দেখতে। দেখতে পেল, সামনের সিটের বৃদ্ধ হাতের দস্তানা দিয়ে টাক-পড়া তালু এবং ঘাড়টা সযত্নে মুছে কী যেন বলছেন বিড়বিড় করে। বৃদ্ধকে চিনতে পারল চেরভিয়াকভ—পরিবহন অধিদপ্তরের জেনারেল ব্রিঝালভ।
‘ভদ্রলোকের মাথার ওপর হাঁচি দিয়েছি আমি!’ ভাবল চেরভিয়াকভ। ‘উনি অবশ্য আমার বড়কর্তা নন। তবুও, কাজটা খারাপ ভাল হলো না। ওঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়া দরকার।’
একটু কেশে, সামনে ঝুঁকে, জেনারেলের কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল চেরভিয়াকভ। তারপর ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘মাফ করবেন, ইয়োর এক্সিলেন্সি, আপনার মাথার ওপর হেঁচে ফেলেছি...ইচ্ছে করে করিনি...’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, কোন অসুবিধে নেই। আপনি অত বিব্রত হবেন না...’
‘ঈশ্বরের দোহাই, মাফ করবেন আমাকে। কাজটা আমি ইচ্ছে করে করিনি।’
‘আহ্! কী যন্ত্রণা! বসুন তো! শুনতে দিন।’
একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে বোকার মত হাসল চেরভিয়াকভ। তারপর মঞ্চের দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। অভিনয় দেখতে লাগল বটে, কিন্তু কিছুতেই নিজেকে আর সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে ভাবতে পারল না আগের মত। অনুশোচনার আগুনে পুড়তে লাগল সে। বিরতির সময় গিয়ে ঘুর-ঘুর করতে লাগল ব্রিঝালভের আশপাশে। তাপর খানিকক্ষণ ইতস্তত করে, দ্বিধা-সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে, প্রায় বিড়বিড় করে বলতে শুরু করল: ‘আপনার গায়ের ওপর আমি তখন হেঁচে ফেলেছিলাম, ইয়োর এক্সিলেন্সি...মাফ করবেন। ...আমি...মানে...ব্যাপারটা আমি ঠিক ইচ্ছে করে করিনি...’
‘আহ্, ছাড়–ন তো ওসব কথা। ব্যাপারটা তো আমি সেই কখনই ভুলে গেছি। আপনি এখনও ওটা নিয়ে পড়ে আছেন!’ নিচের ঠোঁট বাঁকিয়ে, অধৈর্য ভঙ্গিতে বললেন জেনারেল।
‘ভুলে গেছেন! কিন্তু ওর চোখে তো এখনও রাগ দেখতে পাচ্ছি আমি,’ আপনমনে ভাবল চেরভিয়াকভ। অবিশ্বাস-ভরে তাকিয়ে রইল জেনারেলের দিকে। ‘ভদ্রলোক তো আমার সঙ্গে কথাই বলতে চাইছেন না। নাহ্, ব্যাপারটা ওঁকে বুঝিয়ে বলতেই হবে যে, কাজটা আমি ইচ্ছে করে করিনি... স্বাভাবিকভাবেই ঘটে গেছে ঘটনাটা। নইলে উনি হয়তো ভাববেন, আমি বুঝি থুতুই ফেলতে চাইছিলাম ওঁর গায়ের ওপর। এখন যদি সে-রকম কিছু না-ও ভাবেন, পরে তো ভাবতেও পারেন!...’

বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে নিজের এই অভব্য আচরণের কথা জানাল চেরভিয়াকভ। কিন্তু তার মনে হলো, বউ যেন কথাটাকে খুব একটা গুরুত্ব দিল না। খুব হালকাভাবে নিল যেন ওর কথাটা। প্রথমে অবশ্য ভয় পেয়ে গিয়েছিল একটু। কিন্তু যেই শুনল ব্রিঝালভ ওদের অফিসে কাজ করেন না, অমনি শান্ত হয়ে গেল।
‘তবুও,’ বলল সে, ‘ওঁর কাছে গিয়ে মাফ চাওয়া উচিত তোমার। নইলে উনি হয়তো ভাববেন, লোকজনের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হয় তা-ও জানো না তুমি।’
‘ঠিক বলেছ। মাফ চাইতে তো গিয়েছিলামই। কিন্তু ভদ্রলোক খুব অদ্ভুত ব্যবহার করলেন। কীসব অর্থহীন কথাবার্তা বললেন। আর তাছাড়া তখন কথা বলার মত সময়ও ছিল না।’

পরদিন নতুন একটা ইউনিফর্ম পরল চেরভিয়াকভ। তারপর চুল ছাঁটিয়ে ব্রিঝালভের কাছে গেল ব্যাপারটা খুলে বলতে। জেনারেলের অভ্যর্থনাকক্ষটি তখন সাক্ষাৎপ্রার্থীদের ভিড়ে গিজগিজ করছে। জেনারেল স্বয়ং বসে থেকে মানুষের অনুরোধ-উপরোধ শুনছেন। কয়েকজন আবেদনকারীর সঙ্গে কথা শেষ করেই, চেরভিয়াকভের দিকে চোখ তুলে চাইলেন জেনারেল।
‘কাল, আর্কেডিয়াতে...ঘটনাটা আপনার মনে আছে কিনা, জানি না,’ বলতে শুরু করল কেরানি। ‘আমি হেঁচে ফেলেছিলাম। ...দুর্ঘটনাবশত হেঁচে ফেলেছিলাম আরকী। ভুলে...’
‘আহ্, এসব ছোটখাটো জিনিস এখনও মনে রেখেছেন? হ্যাঁ, বলুন, আপনার জন্যে কী করতে পারি?’ পরের সাক্ষাৎপ্রার্থীর দিকে ফিরে বললেন জেনারেল।
‘ভদ্রলোক তো দেখছি কথাই বলতে চান না!’ ফ্যাকাসে চেহারায় ভাবল চেরভিয়াকভ। ‘তার মানে উনি রেগে আছেন। নাহ্, ব্যাপারটা এভাবে ছেড়ে দেয়া যায় না। ...ব্যাপারটা ওঁকে বুঝিয়ে বলতেই হবে।’
সর্বশেষ সাক্ষাৎপ্রার্থীর সঙ্গে কথা শেষ করে, ভেতরের ঘরে যাবার জন্যে পা বাড়ালেন জেনারেল। অমনি তাঁর পিছু নিল চেরভিয়াকভ। প্রায় বিড়বিড় করে বলতে লাগল: ‘ইয়োর এক্সিলেন্সি, মাফ করবেন। ব্যাপারটা আমাকে খুব পীড়া দিচ্ছে। অনুশোচনায় দগ্ধে যাচ্ছি। তাই আপনাকে আবার বিরক্ত না করে পারছি না। কাজটা আমি ইচ্ছে করে করিনি, স্যর।’
কাঁদ-কাঁদ চেহারায় চেরভিয়াকভের দিকে তাকালেন জেনারেল। হাত নেড়ে চলে যেতে বললেন তাকে। ‘আমাকে নিয়ে তামাশা করছেন, না?’ দরজা দিয়ে ভেতরে চলে যেতে-যেতে বললেন তিনি।
‘তামাশা!’ অবাক হয়ে ভাবল চেরভিয়াকভ। ‘এর মাঝে তো তামাশার কিছু নেই! একজন জেনারেল হয়েও ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না ভদ্রলোক! বেশ, দেমাগি লোকটাকে তাহলে আর মাফ চেয়ে বিরক্ত করব না। জাহান্নামে যাক! ওঁর কাছে আর আসছি না আমি। তারচেয়ে বরং একটা চিঠি লিখে ক্ষমা চেয়ে নেব। খোদার কসম, আর আসছি না আমি মাফ চাইতে।’
এসব সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতেই বাড়ি ফিরল সে। কিন্তু চিঠি আর লেখা হলো তার। আকাশ-পাতাল ভেবেও, কী লিখবে বুঝে উঠতে পারল না। কাজেই, ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পরদিন আবার সশরীরে জেনারেলের কাছে গিয়ে হাজির হলো সে।
‘কাল আপনাকে একটু বিরক্ত করতে হয়েছিল, ইয়োর এক্সিলেন্সি,’ জেনারেল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ওর দিকে চাইতেই বলতে শুরু করল সে। ‘আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করার কোন ইচ্ছেই আমার ছিল না। সেদিন হাঁচি দিয়ে আপনার অসুবিধা ঘটানোর জন্যে মাফ চাইতেই এসেছিলাম। ...তামাশা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও নেই আমার। আপনার সঙ্গে ওরকম ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস কি আমার হবে, বলুন? একবার যদি মানুষকে নিয়ে আমরা ঠাট্টা-তামাশা শুরু করি, তাহলে মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা-ভক্তি-সম্মান বলতে কিছু থাকবে না। নষ্ট হয়ে যাবে মানুষের ওপর মানুষের বিশ্বাস...’
‘বেরোও এখান থেকে! বেরোও বলছি!’ গর্জে উঠলেন জেনারেল। চেহারা নীল হয়েছে রাগে, কাঁপতে শুরু করেছেন থরথর করে।
‘কী বললেন, স্যর?’ আতঙ্কে সিটিয়ে গিয়ে কাঁপতে-কাঁপতে জিজ্ঞেস করল চেরভিয়াকভ। ভয়ে কথা বেরোতে চাইছে না মুখ ফুটে।
‘বেরোও আমার বাড়ি থেকে! এক্ষুণি!’ মেঝেতে পা ঠুকে চেঁচিয়ে উঠলেন জেনারেল।
চেরভিয়াকভের মনে হলো, কীসে যেন কট্ করে কামড় বসিয়েছে ওর পাকস্থলিতে। চোখে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না সে; কান ঝনঝন করছে। দরজার দিকে পিছিয়ে গিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল সে। তারপর কোনমতে টেনে-হিঁচড়ে শরীরটাকে টেনে নিয়ে চলল বাড়িতে। যন্ত্রের মত টলতে-টলতে ঘরে ঢুকে, ইউনিফর্ম খুলে ফেলল গা থেকে। সোফায় শুয়ে পড়ল আচ্ছন্নের মত।
তারপর...সোফায় শুয়েই মরে গেল।

মূল গল্প: দ্য ডেথ অভ আ ক্লার্ক
রুপান্তর: মারুফ হোসেন

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে মে, ২০১৮ দুপুর ১২:৪৩

সনেট কবি বলেছেন: অনুবাদ ভাল হয়েছে।

২৬ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৩:২৬

মারুফ হোসেন বলেছেন: ধন্যবাদ। :)

২| ১৯ শে মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:২১

বিচার মানি তালগাছ আমার বলেছেন: ভালো হয়েছে...

২৬ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৩:২৫

মারুফ হোসেন বলেছেন: ধন্যবাদ। :)

৩| ২০ শে মে, ২০১৮ সকাল ১১:০০

রাজীব নুর বলেছেন: চমৎকার।

২৬ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৩:২৭

মারুফ হোসেন বলেছেন: ধন্যবাদ। :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.