নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মারুফ হোসেন

Tsundoku

মারুফ হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

খুনি (অনুবাদ গল্প)

০৪ ঠা জুন, ২০১৮ বিকাল ৪:১৬

শেষবারের মত সান্ত্বনা দেবার জন্যে দণ্ডিত আসামির সেলে প্রবেশ করলেন জেলখানার যাজক।
‘এখন কেবল একটা জিনিসেই সান্ত্বনা পাব আমি,’ বলল দণ্ডিত। ‘সেটা হচ্ছে, এমন একজনকে আমার জীবনের গল্প বলে যাওয়া, যে পরিপূর্ণ শ্রদ্ধার সাথে গল্পটা শুনবে।’
‘বেশিক্ষণ সময় অবশ্য নেই আমাদের হাতে। শুরু করুন,’ কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন যাজক।
শিরদাঁড়া বেয়ে উঠে আসা শিহরণটা কোনমতে দমিয়ে, বলতে শুরু করল আসামি।
‘সিংহভাগ লোকের বিশ্বাস, সহিংস কৃতকর্মের জন্যেই শাস্তি পাচ্ছি আমি। কিন্তু আসল সত্যি হচ্ছে শিক্ষা ও আচরণে বিশেষত্বের অভাবে আমি আজ খুন না করেও খুনি হিসেবে ফাঁসির দড়ি গলায় পরছি।’
‘বিশেষত্বের অভাব!’ অবাক হয়ে কথাটার পুনরুক্তি করলেন যাজক।
‘হ্যাঁ। আমি যদি বিখ্যাত কোন প্রাণীবিজ্ঞানী কিংবা কবি হতাম, তাহলে নিজের পরিচয় নিয়ে কোন সংকটে পড়তে হত না। বিশেষ করে নিজের পরিচয় প্রমাণ করাটাই যখন জীবন-মরণের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ তাহলে আমাকে দেখামাত্রই চিনতে পারত—পরিচয় প্রমাণ করতে কোন বেগ পেতে হত না আমাকে। কিন্তু সাধারণ শিক্ষাদীক্ষা পাওয়া অতি সাধারণ এক মানুষ আমি। এমন কোন বিশেষ পরিচিতি নেই যে, দু’-চারজন মানুষ দেখা বা নাম শোনামাত্রই চিনে ফেলবে আমাকে। বাগান করা ও ইতিহাসের ব্যাপারে অল্প-বিস্তর জ্ঞান আছে কেবল।’
অস্বস্তিভরে নড়েচড়ে বসলেন যাজক। আসামি এবার কোন্ দিকে এগোবে, ঠাহর করতে পারছেন না।
‘যাক গে, এলাকার ডাক্তারের স্ত্রীর প্রেমে পড়েছিলাম আমি,’ বলে চলেছে আসামি। ‘কিংবা তা-ই ভেবেছিলাম। মেয়েটার চেহারা তেমন আহামরি কিছু ছিল না। ছিল না মাথা ঘুরিয়ে দেবার মত দেহবল্লরীও। তবুও কী বুঝে যে প্রেমে পড়ে গেলাম, এখনও ঠাওরে উঠতে পারি না। একেবারেই সাদাসিধে চেহারার মেয়ে। বিন্দুমাত্র চটক—এমনকী মায়াও নেই চেহারায়। ডাক্তার সাহেব শুনেছিলাম প্রথম দেখায়ই ওর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। বিয়ে করতেও তাই দেরি করেননি। কিন্তু তারপর পুরুষলোকে সবসময় যা করে, তিনিও তা-ই করলেন। আরাধ্য বস্তু অত জলদি পেয়ে যাওয়াতে শিগগিরই মেয়েটার ওপর থেকে মোহ কেটে গেল তাঁর। তারপর বউকে ফেলে অন্য মজলেন নারীতে। মেয়েটা হয়ে পড়ল নিঃসঙ্গ, পরিত্যক্ত। তখনই ওর সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। দু’-একবার কথা হবার পরই ওর প্রেমে পড়ে গেলাম কেন যেন। নিঃসঙ্গ মেয়েটা নিজের প্রতি আমার এই বাড়তি আগ্রহ দেখে তাই খুশিই হয়েছিল। একজন সঙ্গী পেয়েছিল কথা বলার জন্যে। তাই ভাব জমিয়ে ফেলেছিল আমার সঙ্গে। তখন ভেবেছিলাম, ইচ্ছে করেই বুঝি আমাকে একটু বেশি প্রশ্রয় দিচ্ছিল ও। কিন্তু আজ ¯পষ্ট বুঝতে পারছি, আমার মনে যে প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি কোন অনুভূতি থাকতে পারে, তা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি বেচারি। মৃত্যুর আগে কেউ মিথ্যে বলে না। তাই আমার প্রতিটা কথা সত্য বলে জানবেন।’
বিড়বিড় করে আসামির কথায় সায় দিলেন যাজক।
‘যা-ই হোক, এক সন্ধ্যায় ডাক্তার সাহেবের অনুপস্থিতির সুযোগ নিলাম আমি,’ আগের কথা খেই ধরল দণ্ডিত আসামি। ‘প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসলাম ওকে। প্রস্তাবটা পেয়ে প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল মেয়েটা। তারপর প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল। এরপর কাকুতি-মিনতি করতে লাগল চিরতরে সরে যেতে ওর জীবন থেকে। আমার হৃদয় তখন প্রত্যাখ্যানের বেদনায় নীল; তাছাড়া মেয়েটাকে ভালও বেসে ফেলেছি মন থেকে। ওর অনুরোধে রাজি না হয়ে উপায় ছিল না তাই।
‘তবে কীভাবে ওর জীবন থেকে চিরতরে সরে যাব, সে-ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণাও ছিল না আমার। নাটক-উপন্যাসে অমন কাহিনী আমরা আকছারই পড়ি। ওসব কাহিনীতে দেখা যায়, প্রত্যাখ্যাত হয়ে নায়ক হয় ভারতবর্ষে চলে যায়, নয়তো যুদ্ধে যোগ দিয়ে বেপরোয়া বীরত্ব প্রদর্শন করে। তবে আমি নিতান্তই সাদাসিধে মানুষ। তাই আমার বেলায় সেরকম কিছু করার সুযোগ ছিল না। তাই ডাক্তারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে চিন্তা করছিলাম, এখন কী করা উচিত।
‘ও, হ্যাঁ, কেন যেন আরেকটা চিন্তা ঘুর-ঘুর করছিল মাথায়: রাতে ঘুমোতে যাবার আগে টাইমস অ্যাটলাস নামক পৃথিবীর মানচিত্র ও সব অঞ্চলের বর্ণনাসংবলিত বইখানার ওপর চোখ বোলাব ভাবছিলাম আগেরদিন থেকেই। কিন্তু কাজটা আর করা হয়ে ওঠেনি। কেন যে বইটার ওপর একবার চোখ বোলাইনি, সে-কথা ভেবে এখন হাত কামড়াতে ইচ্ছে করে। যাক গে, জায়গামত বলা যাবে সে-কথা। আকাশপাতাল চিন্তা করতে-করতেই হাইওয়েতে উঠে এলাম।
‘হাইওয়েতে উঠেই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম একটা লাশের ওপর।’
গল্পের মোড় ঘুরে যাওয়ায় সাগ্রহে নড়েচড়ে বসলেন যাজক।
‘লাশের গায়ের কাপড় দেখে বুঝতে পারছিলাম লোকটা স্যালভেশন আর্মির ক্যাপ্টেন। কোন গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে পটল তুলেছিল বেচারা। মাথাটা গুঁড়িয়ে গিয়েছিল একেবারে। চেহারা দেখে লোকটার পরিচয় সনাক্ত করার কোন জো ছিল না। কোন মোটরকারের সামনের চাকা উঠিয়ে দিয়েছিল বোধহয় বেচারির মাথার ওপর। খানিকক্ষণ লোকটাকে দেখলাম। তারপর, আচমকা একটা চিন্তা খেলে গেল মাথায়। নিজের পরিচয় লুকিয়ে ফেলে, ডাক্তার সাহেবের স্ত্রীর জীবন থেকে সরে যাবার সুবর্ণ এক সুযোগ পেয়ে গেছি। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে, বহুদূরের দেশে অভিযানে যাবার কোন দরকার নেই। লোকটার সঙ্গে কাপড় বদলাবদলি করে নিলেই চলবে। ব্যস, চুকে গেল সব ঝামেলা। মুছে গেল আমার পরিচয়।
‘ঝটপট মৃত স্যালভেশন আর্মি ক্যাপ্টেনের সঙ্গে বদলে নিলাম নিজের কাপড়। লোকটার গা থেকে কাপড় খুলতে অবশ্য বেগ পেতে হলো বেশ। তারপর বাড়ি ফিরে, ঠেসেঠুসে টাকাপয়সা ভরলাম শার্ট-প্যাণ্টের সবক’টা পকেটে। তারপর বেনামী স্যালভেশনিস্টের পরিচয়ে গেলাম পাশের মার্কেট-টাউনে। ওখানে গিয়ে প্রথমে পেটপুজো করে নিলাম আশ মিটিয়ে। তারপর একটা সস্তা কফি-হাউসে ঘর ভাড়া নিলাম রাত কাটানোর জনে। পরদিন সকালে এক ছোট শহর থেকে আরেক ছোট শহরের উদ্দেশে শুরু হলো আমার উদ্দেশ্যহীন, ইতস্তত ভ্রমণ। কিন্তু ইতিমধ্যেই পরিচয়বদল নিয়ে অনর্থক ভয় পাওয়ায় বিরক্ত ছিলাম নিজের ওপর। অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাড়ল সেই বিরক্তি।
‘যা-ই হোক, অজ্ঞাত ব্যক্তির হাতে নিজের খুন হওয়ার খবর পড়লাম ছোট এক শহরের স্থানীয় পত্রিকায়। প্রথমে খবরটা পড়ে বেশ মজাই পেয়েছিলাম। কিন্তু ফুর্তি-ফুর্তি ভাবটা মিলিয়ে গেল যখন পড়লাম, ঘটনাস্থলে এক ভবঘুরে স্যালভেশনিস্টকে দেখা গেছে ঘুর-ঘুর করতে। তাকেই সন্দেহ করা হচ্ছে খুনি হিসেবে।
‘পুরোপুরি উল্টে গেল ঘটনা। যেটাকে মোটর-দুর্ঘটনা ভেবেছিলাম আমি, সেটি এখন আসলে খুনের মামলা। অতএব প্রকৃত খুনিকে যতক্ষণ খুঁজে পাওয়া না যায়, তার আগে ঘটনাটার সাথে আমার জড়িত হয়ে যাবার ব্যাপারটা পুলিসকে বুঝিয়ে বলতে জান বেরিয়ে যাবে। নিজের আসল পরিচয় অবশ্য দিতে পারতাম। কিন্তু ডাক্তারের স্ত্রীকে না জড়িয়ে মৃতের সাথে কাপড় বদলানোর ঘটনাটা পুলিসকে জানানোর কোন উপায় দেখলাম না। সেক্ষেত্রে তো বেচারির কলঙ্কই রটে যাবে। অথচ ওকে কলঙ্কের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যেই তো এত ঝুট-ঝামেলার আয়োজন। এসব সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতে যখন পাগল হবার দশা, ঠিক তখনই একটা বুদ্ধি এল মাথায়।
অনেকটা অবচেতনভাবেই এল বুদ্ধিটা। অপরাধস্থল থেকে যদ্দূর সম্ভব দূরে সরে যেতে হবে আমাকে। আর যে-কোন মূল্য এই হতচ্ছাড়া স্যালভেশনিস্ট আর্মির ইউনিফর্ম খুলে ফেলতে হবে শরীর থেকে।
‘কিন্তু গোলটা বাধল সেখানেই। কয়েকটা দোকানে ঢুকলাম নতুন কাপড় কিনব বলে। কিন্তু সবক’টা দোকানের মালিকই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে লাগল আমাকে। ওদের দৃষ্টিবাণ সইতে না পেতে একের-পর-এক দোকান বদলে চললাম। কিন্তু সবক’জন দোকানিই কোন-না-কোন অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে গেল আমাকে। কাপড় বেচতে রাজি হলো না আমার কাছে। আগ-পিছু না ভেবে যে-ইউনিফর্ম গায়ে চাপিয়েছিলাম, সেটাই এবার গুরুভার হয়ে চেপে বসল আমার ওপর। কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারলাম না আপদটাকে।’
খানিকক্ষণ চুপ করে রইল দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ‘তারপর বলুন,’ শেষমেশ নীরবতা সইতে না পেরে তাগাদা লাগালেন যাজক।
‘ভাবলাম, পোশাক বদলানোর আগ পর্যন্ত পুলিসের কাছে আত্মসমর্পণ করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তবে যে-ব্যাপারটা ভেবে অবাক হচ্ছিলাম তা হচ্ছে, ওরা এখনও আমাকে গ্রেপ্তার করছে না কেন? যেখানেই যাই, সেখানেই মানুষজন তেরছা দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে আমাকে। একজন আরেকজনের কনুইয়ে খোঁচা মেরে আমাকে দেখিয়ে দেয়। ফিসফিসিয়েÑমাঝেসাঝে এমনকী উঁচু গলায়ও বলাবলি করে যে: ‘এ-ই সেই লোক।’ যেখানেই যাই না কেন, খানিকক্ষণের মধ্যেই লোকজনের ভিড় জমে ওঠে আমাকে দেখার জন্যে। চিড়িয়াখানার জন্তুর মত আমার দিকে চেয়ে থাকে সবাই; গুজুর-গুজুর, ফুসুর-ফাসুর করে নিজেদের মধ্যে। এমনকী খেতে গেলেও রেহাই পাই না এ-অত্যাচারের হাত থেকে। রাজপরিবারের সদস্যরা কেনাকাটা করতে বেরোলে, চারপাশে কৌতূহলী মানুষের অহেতুক ভিড় জমে উঠলে তাদের কেমন লাগে, তখনই বুঝতে পেরেছিলাম।
‘তবে রাজপরিবারের সদস্যদের চারপাশে জমে ওঠা ভিড় আর আমার চারপাশে জমে ওঠা ভিড়ের মধ্যে পার্থক্যটা হচ্ছে: বৈরিতা। আমার আশপাশে জড় হওয়া প্রত্যেকটা মানুষের চোখে দেখতে পেলাম ¯পষ্ট বৈরিতা। একটু বন্ধুত্ব, একটু সহানুভূতির ভাব দেখতে পেলাম না একটা চোখেও।
‘তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বা সাধারণ জনগণÑকেউই আমার চলাফেরা করার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করল না। এর কারণটা জানতে পেরেছি পরে।
‘ওই নির্জন হাইওয়েতে যখন খুনটা হয়, তখন তার পাশের এলাকাতেই কিছু ব্লাড-হাউণ্ডকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল। ওখান থেকে ডজনখানেক পশু নিয়ে এসে লাগিয়ে দেয়া হয় আমাকে খুঁজতে। আমাদের লণ্ডনের সবচেয়ে উৎসাহী পত্রিকাগুলোর একটা ঘোষণা করে, যে-কুকুরটা সবার আগে আমাকে খুঁজে পাবে, ওদের পক্ষ থেকে পুরস্কার দেয়া হবে ওটাকে। তাছাড়াও নিজ-নিজ এলাকার কুকুরের পক্ষে বাজি ধরতে শুরু করল লোকজন। এ-নিয়ে সাজ-সাজ রব পড়ে গেল গোটা লণ্ডনে।
‘প্রায় তেরোটা কাউণ্টিতে ছড়িয়ে পড়ল কুকুরগুলো। ততদিনে আমার অবস্থান মানুষজন, পুলিসের কাছে আর অজানা নেই। কিন্তু ততক্ষণে খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব জেগে উঠেছে গোটা জাতির মধ্যে। কুকুরগুলোকে সুযোগ দিতে চাইছিল সবাই। কোন পদোন্নতিকাক্সক্ষী কনস্টেবল আমাকে ধরার উদ্যোগ করতেই হা-রে-রে করে উঠত সবাই। বলত, “কুকুরগুলোকে একটা সুযোগ দাও।”
‘শেষতক আমাকে গ্রেপ্তার করার ঘটনাটা খুব একটা নাটকীয় হলো না। আসলে, আমি নিজে থেকে এগিয়ে না গেলে কুকুরগুলো আমাকে খেয়ালই করত না।
‘গ্রেপ্তার-নাটক না জমলেও, কুকুরের মালিকরা বেশ হইচই বাধিয়ে দেয়। আমাকে খুঁজে পাওয়ার প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয় যে-কুকুরটা, ওটার মালিক ছিল এক আমেরিকান। সে দাবি করে যে-কুকুর আমাকে প্রথম খুঁজে পেয়েছে, ওটার পূর্বপুরুষ উদবিড়াল। কাজেই ওটা কোনমতেই ব্লাডহাউণ্ড নয়। অথচ খুনিকে ধরার জন্যে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল কেবল ব্লাডহাউণ্ডের জন্যে। যে-প্রাণীর দেহে মোট রক্তের ছয় ভাগের চার ভাগই উদবিড়ালের, তাকে আর যা-ই হোক, ব্লাডহাউণ্ড বলা চলে না কিছুতেই।
‘ঝামেলাটা কীভাবে মিটেছিল তা ভুলে গেছি, তবে ব্যাপারটা যে দারুণ শোরগোল ফেলে দেয় তা মনে আছে বেশ। আটলাণ্টিকের দু’পাড়েই তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল ঘটনাটা। আসল খুনি যে আমি নই, সে-কথা বলে দেয়াটাই পুরো বিতর্কে আমার একমাত্র ভূমিকা। কিন্তু তাতে কোন ফায়দা হলো না। একটা মানুষও বিশ্বাস করল না সে-কথা। অগত্যা নিজের আসল পরিচয় ফাঁস করলাম আমি। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, কেউ বিশ্বাস করল না কথাটা। ভাবল, গা বাঁচানোর জন্যে মিথ্যে গল্প ফেঁদে বসেছি। আমার বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়-স্বজনের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হলাম, যখন দেখলাম ওরাও ভোল পাল্টে ফেলেছে। আমাকে চেনে বলে স্বীকারই করল না একজনও।
‘পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠল, যখন খুন হওয়া লোকটার এক ফুপু আমাাকে তার ভাইপো বলে সনাক্ত করল। মাথায় বোধহয় ঘিলু-টিলু কিছু নেই মহিলার। মহিলা খুব রসিয়ে-রসিয়ে আমার বখে যাওয়ার ও নানা অপকর্মের ঘটনাও শোনাল কর্তৃপক্ষকে।’
‘কিন্তু,’ আসামিকে থামিয়ে দিয়ে বললেন যাজক। ‘আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিশ্চয়ই...’
‘ওই ব্যাপারটাই ঘুরিয়ে দিল সবকিছুর মোড়,’ বলল আসামি। ‘আগেই তো বলেছিলাম শিক্ষাগত কোন বিশেষত্ব নেই আমার। অর্থাৎ নেই কোন বিশেষ বিষয়ের ওপর দখল। এই বিশেষত্বহীনতাই কাল হয়ে দাঁড়াল আমার জন্যে। মৃত স্যালভেশনিস্ট—যাকে খুব একটা গুরুত্ব দিইনি আমি—ছিল স্বল্পশিক্ষিত মানুষ। যাকে বলে সস্তা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে সে। তার এই শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যাপারটা ছিল সর্বজনবিদিত। তাই কোন একটা বিষয়ের ওপর বিশেষ দক্ষতা থাকলেই নিজের আসল পরিচয়টা নিশ্চিত করে ফেলতে পারতাম অনায়াসে। বোঝাতে পারতাম মৃত লোকটার আর আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি আলাদা। দু’জনেই আমরা আলাদা মানুষ।
‘তবুও, নিজের স্বল্প জ্ঞান দিয়েই প্রমাণ করে ফেলতে পারতাম যে আমি সেই লোক নই। কিন্তু ¯্নায়ুচাপ ও ভয়ের কারণে যতটুকু যা জানতাম, ভুলে বসলাম তা-ও। তাই আমার দাবি অনুসারে ওসব জ্ঞানের ওপর যখন পরীক্ষা নেয়া হলো, চাপে ভেঙে পড়লাম আমি। বলতে পারলাম না কিছুই। অল্পবিস্তর ফ্রেঞ্চ যা জানতাম, ভুলে বসলাম তা-ও। এমনকী বৈঁচিফল বা মালীর মত সহজ শব্দের ফ্রেঞ্চ প্রতিশব্দও বলতে পারলাম না।’
ফের অস্বস্তিভরে নিজের আসনে নড়েচড়ে বসলেন যাজক।
‘তারপর এল চূড়ান্ত পরাজয়,’ বলে চলেছে দণ্ডিত। ‘ছোটখাটো একটা বিতর্ক ক্লাব ছিল আমাদের গ্রামে। ডাক্তার সাহেবের স্ত্রীকে কথা দিয়েছিলাম বলকান সঙ্কটের ওপর ছোটখাটো একটা বক্তৃতা দেব সেই ক্লাবে। সেজন্যে তথ্য-উপাত্ত গুছিয়ে চমৎকার একটা বক্তৃতাও খাড়া করে ফেলেছিলাম। এ-কাজ করতে গিয়ে বলকান অঞ্চলের ওপর বিস্তর জ্ঞানলাভ করি। বিজ্ঞ বিচারককে জানালাম যে, ওই এলাকার ওপর বিশেষ দখল রয়েছে আমার।
‘উকিল সাহেব অকস্মাৎ জানতে চান, নবিবাজার স¤পর্কে বিজ্ঞ আদালতকে কিছু বলতে পারব কিনা। সাথে-সাথে আশায় দুলে উঠল মন। অন্তরের গভীর থেকে কিছু একটা বলে উঠল, জায়গাটা সেইণ্ট পিটার্সবার্গ বা বেকার স্ট্রিটে। সামনে তাকিয়ে দেখি, অনেকগুলো উৎসুক চেহারা চেয়ে আছে আমার দিকে, কী উত্তর দিই শোনার জন্যে। চেহারাগুলো দেখতে-দেখতে সঠিক উত্তরটা কী হবে, ভাবতে থাকলাম। শেষতক দ্বিতীয় উত্তরটাই বেছে নিলাম। চট করে বলে দিলাম, জায়গাটা বেকার স্ট্রিটে।
‘উত্তরটা যখন দিয়েছি, ঠিক সেই মুহূর্তেই জেনে গেলাম, হেরে গেছি আমি। বিজ্ঞ আদালত ততক্ষণে বুঝে গেছেন, প্রাচ্যের ব্যাপারে সামান্য খোঁজ-খবরও রাখে যে-ব্যক্তি, সে কখনও নবিবাজারকে বলকান অঞ্চল থেকে তুলে এনে বেকার স্ট্রিটে বসিয়ে দেবার মত বোকামি করবে না। এমন বালখিল্য উত্তর কেবল একজন স্বল্পশিক্ষিত স্যালভেশন আর্মির ক্যাপ্টেনের কাছ থেকেই আশা করা যায়। টাইমস অ্যাটলাস-এর ওপর একবার... মাত্র একবার চোখ বোলালেও বেঁচে যেতে পারত আমার প্রাণটা।
‘যা-ই হোক, স্যালভেশনিস্ট ক্যাপ্টেন—অর্থাৎ আমার বিরুদ্ধে অকুস্থল থেকে পাওয়া প্রমাণগুলো ছিল একেবারে অকাট্য। এবং আমি নিজেও আমার আসল পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছি। ফলে ফাঁসির দড়ি এড়ানোর কোন সুযোগও রইল না। শেষে বিজ্ঞ আদালত বিচারে রায় দিলেন: মানুষ খুনের অপরাধে, মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলে থাকতে হবে আমাকে।
‘আর দশ মিনিট পরই আমার গলায় এঁটে বসবে ফাঁসির দড়ি। আর মৃত্যুদণ্ডটা হবে এমন এক খুনের অপরাধে হিসেবে, যে খুনটা আদতে হয়ইনি। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, নিজেকে খুনের অপরাধে—যে-অপরাধ কখনও হয়িনি, সেই অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলতে হচ্ছে আমাকে।’
শেষ হলো দণ্ডিতের আত্মকাহিনী। নিজের কোয়ার্টারে ফিরলেন যাজক। তার পনেরো মিনিট বাদে, কালো পতাকা টানিয়ে দেয়া হলো জেলখানার টাওয়ারে। ফাঁসি সম্পন্ন হয়েছে।
টেবিলে ব্রেকফাস্ট অপেক্ষা করছে যাজকের জন্যে। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে আগে লাইব্রেরিতে ঢুকলেন তিনি। তারপর খুঁজে-খুঁজে টাইমস অ্যাটলাসখানা বের করলেন বইয়ের তাক থেকে। বলকান উপদ্বীপের অবস্থান বের করলেন ওটার পাতা উল্টে।
‘জেনে রাখা ভাল,’ বইটার ওপর নজর বোলাতে-বোলাতে আপনমনে বললেন ভদ্রলোক। ‘ওরকম ঘটনা যে কখন কার সাথে ঘটে যায় কে বলতে পারে!’

মূল গল্প : সাকি (এইচ. এইচ. মানরো)
রূপান্তর: মারুফ হোসেন


সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতি: ব্রিটিশ লেখক সাকি-র (আসল নাম হেক্টর হিউ মানরো) জন্ম ১৮৭০ সালে, বার্মার আকিয়ুব-এ। ছোটগল্পে তাঁর দক্ষতা বিশেষভাবে স্বীকৃত। আরেক বিশিষ্ট আমেরিকান ছোটগল্পকার ও. হেনরি-র সঙ্গে তাঁর দক্ষতার তুলনা করা হয়। অস্কার ওয়াইল্ড, রুডইয়ার্ড কিপলিং ও লুইস ক্যারলদের দ্বারা প্রভাবিত সাকি নিজে প্রভাবিত করেছেন পি. জি. উডহাউস, এ. এ. মিল্‌নে এবং নোয়েল কাওয়ার্ডদের মত লেখকদের। সাকির গল্পের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সামাজিক নানা অসঙ্গতির প্রতি সূক্ষ্ম হিউমারের মাধ্যমে কশাঘাত। বিশিষ্ট এই ছোটগল্পকার মারা যান ১৯১৬ সালে, এক জার্মান স্নাইপারের গুলিতে।

মন্তব্য ৯ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা জুন, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৭

গিয়াস উদ্দিন লিটন বলেছেন: বুঁদ হয়ে পড়লাম, ভাল লাগলো ।

০৪ ঠা জুন, ২০১৮ রাত ৮:১৫

মারুফ হোসেন বলেছেন: ধন্যবাদ। :)

২| ০৪ ঠা জুন, ২০১৮ বিকাল ৫:০৮

সনেট কবি বলেছেন: গল্প ভাল হয়েছে।

০৪ ঠা জুন, ২০১৮ রাত ৮:১৭

মারুফ হোসেন বলেছেন: ধন্যবাদ। :)

৩| ০৪ ঠা জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৩৩

দপ্তরবিহীন মন্ত্রী বলেছেন: দারুণ হয়েছে। শেষ লাইনটাও দারুণ ছিল...

০৪ ঠা জুন, ২০১৮ রাত ৮:১৬

মারুফ হোসেন বলেছেন: ধন্যবাদ। :)

৪| ০৪ ঠা জুন, ২০১৮ রাত ৮:৫৭

অর্থনীতিবিদ বলেছেন: অসাধারণ গল্প। নিজেকে খুনের অপরাধে নিজেকেই ফাঁসিতে ঝুলতে হচ্ছে। এমন একটা খুন যেটা আদৌ ঘটেইনি। হিউ মানরো আসলেই গুণী লেখক ছিলেন।

৫| ০৪ ঠা জুন, ২০১৮ রাত ৮:৫৭

জাহিদ হাসান মিঠু বলেছেন:

ভাল লাগলো। ধন্যবাদ

৬| ০৫ ই জুন, ২০১৮ সকাল ১০:৩৮

রাজীব নুর বলেছেন: দোষ করলে শাস্তি পেতেই হবে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.