নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মারুফ হোসেন

Tsundoku

মারুফ হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঠগির জবানবন্দি—পর্ব ০৫

১৪ ই মার্চ, ২০১৯ সকাল ৭:১১


[ভারতবর্ষের কুখ্যাত দস্যু সম্প্রদায় ঠগিদের কার্যকলাপ নিয়ে সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে ফিলিপ মিডোয টেলর, ১৮৩৯ সালে, লিখেছিলেন ‘কনফেশন্স অভ আ থাগ’ উপন্যাসটি। সেই বইটির বাংলা অনুবাদ—ঠগির জবানবন্দি—শীঘ্রই প্রকাশিত হচ্ছে সেবা প্রকাশনী থেকে, আমার অনুবাদে। চমৎকার এই বইটির বেশ কিছু পরিমার্জিত অধ্যায় (মূল অনুবাদ বই থেকে কিছুটা কাটছাঁট করে) প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে এই ব্লগে। আজ, পঞ্চম পর্বে, প্রকাশ করা হলো চতুর্থ অধ্যায়ের প্রথমাংশ।](চতুর্থ পর্ব পড়ুন এখানে)

চার—০১
পরদিন ভোরে বাবার সঙ্গে গ্রাম ছাড়লাম। চতুর্থ দিন সকালে পৌঁছুলাম শিওপুরে। এখান থেকেই দল-বেঁধে ‘কাজে’ বেরোয় ঠগিরা। এখানেই ঠগিমন্ত্রে দীক্ষা হবে আমার। টগবগ করে ফুটছিলাম চাপা উত্তেজনায়। কী ধরনের আচার পালন করতে হবে, সে-কথা ভেবে ভয়ও পাচ্ছিলাম খানিকটা।
মঈদিনের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম আমরা। আরও দশজন জমাদার এসে উঠেছিল তার বাড়িতে। খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে তাদেরকে নিয়ে আলোচনায় বসল বাবা। নতুন বছরের কার্যপরিকল্পনা ঠিক হবে এ-সভায়। প্রথমেই সবার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো।
লোকগুলো তাকে যেরকম সম্মান ও শ্রদ্ধা করছে, তা দেখে বুঝতে পারলাম, গোটা দলটার নেতাই বাবা। আমাকেও সসম্মানে স্বাগত জানাল সবাই। বাঘিনী-হত্যার ঘটনায় আমার সম্মান ও গুরুত্ব বেড়ে গেছে সবার কাছে।
দু’দিন পরই বিজয়া দশমীর উৎসব। তাই সেদিন পর্যন্ত স্থগিত করা হলো আমার দীক্ষানুষ্ঠান। কারণ, দশমীর দিনটা ঠগিদের জন্যে সবচেয়ে শুভ। এদিন সবখানে সৈন্যদলের যাত্রা আরম্ভ হয়—ঠগিরাও তাদের বছরের কাজ শুরু করে। বর্ষাকাল বিদেয় নিয়েছে। তাই এখন কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনাও নেই। চমৎকার আবহাওয়ায় আয়েশ করে দূর-যাত্রায় বেরোনো যায়। পথিকেরা দল-বেঁধে বেরিয়েছে দূরের পথ পাড়ি দিতে। আমরাও এই দীর্ঘ ভ্রমণের সুযোগ নিয়ে লুটপাটে নামি।
তাছাড়া, দিনটি আমাদের রক্ষক ও দেবী, ভবানীর পবিত্র দিন। মুসলমান হয়েও হিন্দুদের অনুষ্ঠান বিজয়া দশমীকে পবিত্র বলে মানব কেন, তা বুঝতে পারছিলাম না আমি। তাই সন্দেহ নিরসনের জন্যে গেলাম বাবার কাছে।
‘ব্যাপারটা বোঝার জন্যে আমাদের পেশার স্বর্গীয় উৎপত্তি সম্পর্কে তোকে জানানো দরকার,’ বলল বাবা। ‘আমাদের পেশার উদ্ভব হিন্দু ধর্মবিশ্বাসের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। মুসলমানরা ঠগিবৃত্তি শিখেছে হিন্দুদের কাছ থেকেই।’
‘আশ্চর্য ব্যাপার তো!’ অবাক হয়ে গেলাম আমি। ‘বিধর্মীদের ধর্মের সাথে আমাদের পবিত্র নবীর ধর্মের আবার কী সম্পর্ক?’
‘ঠিকমত হয়তো বোঝাতে পারব না,’ বলল বাবা। ‘তবুও, কয়েকটা কথা বলি। আশা করি, খানিকটা ধারণা পাবি। হিন্দু ধর্ম আমাদের ধর্মের চেয়ে প্রাচীন। এ-ধর্মও যে স্রষ্টারই সৃষ্টি, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই ধর্মে এমন কিছু সত্য বিশ্বাস আছে যা অনুসরণ করলে কোন পাপ হয় না। আমরা, মুসলমানরা, কেবল সেটুকুই গ্রহণ করি। আর তাছাড়া, চাইলেও কিন্তু অন্য ধর্মের লোকেরা পুরোপুরি হিন্দু হতে পারবে না। আগেই তো বলেছি, আল্লাপাক তাঁর গূঢ় উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্যে এই ঠগি সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছেন। যুগের-পর-যুগ ধরে টিকে আছে এ-পেশা। যার নিয়তিতে ঠগিবৃত্তি লেখা আছে, ঠগি সে হবেই। নিয়তির এই লিখন সে কিছুতেই খণ্ডাতে পারবে না। এ-পেশার উৎপত্তি হয়েছে হিন্দুদের হাতে। তাই, যাদের হাতে পেশাটার জন্ম, ওদের সঙ্গে মিলে এ-কাজ করতে কোন পাপ নেই। বুঝেছিস?’
‘হ্যাঁ,’ জবাব দিলাম। ‘কাজটা উচিত কি অনুচিত, সে-কথা জানার জন্যে প্রশ্নটা করিনি আমি। স্রেফ জানার জন্যে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, হিন্দু উৎসবকে মুসলমানরা কী করে স্বীকৃতি দেয় এবং পালন করে?’
‘আমরা কেবল এই দশমীর উৎসবই পালন করি,’ বাবা বলল। ‘কেননা অভিযানে বেরোবার জন্যে বছরের এই সময়টাই সবচেয়ে উপযুক্ত। আর হিন্দু ঠগিরা চিরকালই এই দিনটিকে পরম ভক্তির সাথে পালন করে আসছে। তবে ঠগিদের উৎপত্তির ইতিহাসটা জানলেই গোটা ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝতে পারবি। বুঝতে পারবি, এই সম্প্রদায় কত প্রাচীন এবং সেই প্রাচীনকালে সৃষ্টিকর্তা যে-আদেশ দিয়েছিলেন, তা কতটা নিষ্ঠাভরে পালন করছি আমরা।
‘সৃষ্টির শুরুতে—হিন্দুদের মতে—পরম সত্তা থেকে দুটো শক্তির উৎপত্তি হয়: সৃষ্টি-শক্তি ও বিনাশ-শক্তি। সেই আদি থেকেই এ-দুটো শক্তি পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ও শত্রু। এখনও চলছে সেই বিরোধ। সৃষ্টি-শক্তি এত দ্রুত কাজ করল যে, পৃথিবী শিগগিরই প্রাণীতে ভরে গেল। তার ক্ষিপ্রগতির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারল না ধ্বংস-শক্তি। প্রথমটায় তাকে অবশ্য সৃষ্টি-শক্তির সঙ্গে কুলিয়ে ওঠার ক্ষমতাও দেয়া হয়নি। তবে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে যে-কোন উপায় অবলম্বনের অনুমতি দেয়া হলো।
‘বিনাশ-শক্তির স্ত্রী—যিনি দেবী, ভবানী, কালী ইত্যাদি নামে পরিচিত—একটা মূর্তি গড়লেন। তারপর প্রাণসঞ্চার করলেন সেই মূর্তিতে। এরপর কালী তাঁর কিছু ভক্তকে একত্র করে, তাদের নাম দিলেন ঠগি। এদেরকে শেখালেন ঠগিবিদ্যা। এবং এই বিদ্যার ক্ষমতা প্রমাণ করার জন্যে, আমরা এখন যেভাবে মানুষ খুন করি, ঠিক সেভাবে, নিজের হাতে গড়া মূর্তিটি ধ্বংস করে ফেললেন। ঠগিদের ভীষণ চতুর ও ধূর্ত বানিয়ে দিলেন, যাতে মানুষকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে হত্যা করতে কোন অসুবিধে না হয়।
‘তারপর পৃথিবীর নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে দেয়া হলো ঠগিদের। দেবী তাদেরকে বলে দিলেন, মানুষ হত্যা করে যে ধন-সম্পদ লুট করবে, তা ওদের পুরস্কার। মৃতদেহ লুকানোর জন্যে ওদেরকে কোন দুশ্চিন্তা করতে হবে না। সে-কাজের ভার নিলেন স্বয়ং দেবী।
‘যুগের-পর-যুগ কেটে গেল এভাবে। মানুষের তৈরি আইনের হাত থেকে ভক্তদের রক্ষা করে চললেন কালী। ভক্তরাও তাঁর প্রতি বিশ^স্ত ছিল। কিন্তু পৃথিবীর অবনতির সঙ্গে-সঙ্গে পচন ধরল ঠগি সমাজেও। শেষমেশ একদল দুঃসাহসী ও কৌতূহলী ঠগি এক পথিককে মারার পর ঠিক করল—পুরনো প্রথা অনুসারে লাশটা ফেলে চলে না গিয়ে—ওটার ওপর নজর রাখবে। দেখবে, কী করে ওটাকে লুকান দেবী। পথের পাশে, ঝোপের ভেতরে লুকিয়ে রইল ওরা দেবীর আগমনের প্রতীক্ষায়। কিন্তু সামান্য মানুষ কি আর দেবতার চোখকে ফাঁকি দিতে পারে?
‘ফলে যা হবার হলো তা-ই। কালীর কাছে ধরা পড়ে গেল ওরা। ওদের কাছে ডাকলেন তিনি। তাঁর রুদ্রমূর্তি দেখে, আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে-কাঁপতে পালানোর চেষ্টা করল লোকগুলো। কিন্তু দেবী ওদের ধরে ফেললেন। তারপর এই অপকর্মের জন্যে ইচ্ছেমত শাপ-শাপান্ত করে বললেন: “আমাকে যারা এই রূপে দেখে, তারা সঙ্গে-সঙ্গে মারা যায়। তবে এবারের মত তোদের ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু আজ থেকে তোদেরকে আর রক্ষা করব না আমি। এখন থেকে তোরা নিজে মৃতদেহ লুকানোর ব্যবস্থা করবি। সবসময় লুকিয়েও রাখতে পারবি না। মাঝে-মধ্যে মানুষের হাতে ধরা পড়ে সাজাও পাবি। তবে তোদের বুদ্ধি আর চাতুর্য থাকবে আগের মতই। ভবিষ্যতে আমি কেবল নানারকম চিহ্ন আর ইঙ্গিত দেখিয়ে তোদের পরিচালনা করব। আমার এই অভিশাপ পৃথিবী ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত বইতে হবে তোদেরকে।”
‘এই বলে দেবী অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তবে তিনি কখনও আমাদের সাহায্য করা বন্ধ করেননি। সেই থেকে আমাদের খুন করে লুকিয়ে রাখা মৃতদেহ মাঝে-মধ্যে লোকের নজরে পড়ে যায়; কখনও-কখনও এক-আধজন ঠগি ধরাও পড়ে। কিন্তু আমার ঠগিজীবনে অমন ঘটনা কখনও নিজে চাক্ষুষ করিনি। এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যারা দেবীর সঙ্কেত বা বিসর্জন উৎসব অবহেলা বা কোন অপরাধ করেছে, শাস্তি হিসেবে একমাত্র তারাই ধরা পড়েছে। অতএব, বুঝতেই পারছিস, যুগ-যুগ ধরে আমাদের পথ দেখাচ্ছে, রক্ষা করছে যে-শক্তি, সেই শক্তির বিধি-বিধান মেনে চলা কত জরুরি। কিছুতেই এসব বিধি-বিধান পরিবর্তন করা যাবে না। বদলালেই পড়তে হবে দেবীর কোপানলে।
‘আর আমরা, মুসলমানরা কিন্তু আমাদের নবীর নিয়ম-কানুন ঠিকই মেনে চলি। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। আমাদের সব ধর্মীয় নিয়ম পালন করি যথাযথভাবে। কোন মূর্তির পুজো করি না। নিজের ধর্মপালন ছাড়া ঠগি হিসেবে যুগ-যুগ ধরে যা করে আসছি, তা কিন্তু আজ নতুন করছি না। আমাদের পূর্বপুরুষেরা যেদিন ভারতবর্ষ দখল করেছেন, সেদিন থেকেই করে আসছি। এসব কাজ যদি স্রষ্টার পছন্দ না হত, তবে তিনি নিশ্চয়ই রুষ্ট হয়ে আমাদের ওপর গজব নাজিল করতেন। পদে-পদে কঠিন বিপদে ফেলতেন আমাদের। বানচাল করে দিতেন আমাদের ঠগিবৃত্তির সব পরিকল্পনা। এতদিনে আমাদের ঠগি সম্প্রদায় থেকে বেরিয়ে যেতে হত। বাদ দিতে হত হিন্দুদের সঙ্গে সবধরনের ওঠা-বসা।’
‘এবার সব বুঝেছি, বাবা,’ বললাম আমি। ‘সত্যিই বলেছ তুমি—আমরা আসলেই স্রষ্টার বিশেষ ভালবাসায় আশীর্বাদপুষ্ট। প্রাচীনকাল থেকে যুগ-যুগ ধরে যেসব রীতিনীতি, আচার চলে আসছে, সেসবের যৌক্তিকতার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা সত্যিই ভীষণ পাপকাজ। মৌলানার দেয়া শিক্ষার কারণেই হিন্দুদের ধর্মহীন ও নীচুজাত ভাবতাম আমি। এখন বুঝতে পারছি, মৌলানা হয় মূর্খ, নয়তো ধর্মান্ধ।’
‘এর বেশি কিছু বলতে চাই না আমি,’ বলল বাবা। ‘তবে জেনে রাখ্, উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গেই কাজ করতে হবে তোকে। ওদের সঙ্গে ওঠ-বস করতে হবে সারাক্ষণ। কয়েকদিন মিশলেই বুঝতে পারবি, মুসলমানদের চেয়ে কোন অংশেই কম বিশ্বস্ত, কম বন্ধুত্বপরায়ণ নয় ওরা।’
দশমীর দিনে শুরু হলো ঠগি হিসেবে আমার দীক্ষা গ্রহণের অনুষ্ঠান। প্রথমে গোসল করে বিশুদ্ধ নতুন কাপড় পরলাম। তারপর গুরু বা আধ্যাত্মিক নির্দেশক হিসেবে বাবা আমার হাত ধরে দীক্ষা গ্রহণের স্থানে নিয়ে চলল। একটা কামরায় ঢুকল আমাকে নিয়ে। কামরার মাঝখানে পাতা একটা পরিষ্কার, সাদা বিছানায় বসে আছেন ঠগি-নেতারা। এঁদের সঙ্গে আগেই দেখা হয়েছে আমার। তাঁদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করল, আমাকে ঠগি ও ভ্রাতৃসংঘের সদস্য হিসেবে মেনে নিতে রাজি আছেন কিনা তাঁরা। সমস্বরে জবাব দিলেন সবাই, ‘হ্যাঁ, রাজি আছি।’
এবার একটা উন্মুক্ত উঠোনে নিয়ে যাওয়া হলো আমাকে। নেতারাও এলেন সঙ্গে। উঠোনে এসে দুই হাত মোনাজাতের ভঙ্গিতে আকাশে তুলল বাবা। তারপর উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বলতে লাগল:
‘বিশ্বমাতা, হে মা ভবানী!
দাস হয়ে গাই তব স্তুতিবাণী,
শ্রীচরণে দাও এই নবীনেরে ঠাঁই—
পূর্বাভাসের দিব্য জ্ঞাপনে
তব মহিমাই চাই।’


খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। শেষে আমাদের মাথার ওপর, একটা গাছ থেকে এক প্যাঁচা ডেকে উঠল উচ্চস্বরে।
‘জয় ভবানী!’ একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন সবাই।
বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সুখবর, বাপ, সঙ্কেত খুবই ভাল। এরচেয়ে শুভ সঙ্কেত আর হয় না। এমন ইঙ্গিত পাব, ভাবতেও পারিনি আমরা। তোর দীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। ঠগি সমাজে তোকে ঠাঁই দিয়েছেন মা কালী।’
আবার সেই কামরায় ফিরে গেলাম। তারপর ছোট একটা খন্তা ধরিয়ে দেয়া হলো আমার হাতে। ছোট এই খন্তাটাই আমাদের পেশার পবিত্র চিহ্ন। আমার ডান হাতে একটা রুমাল, তার ওপর খন্তা। এরপর খন্তাটা বুক পর্যন্ত উঁচিয়ে ধরে, ভয়ানক এক শপথ পড়ানো হলো আমাকে। এবার বাম হাতটা ওপরে তুলে আরও একবার পড়ানো হলো শপথটা। যে-দেবীর কাছে উৎসর্গ করতে যাচ্ছি নিজেকে, শপথ করানো হলো সেই দেবীর নামে। তারপর হাতে পবিত্র কোরআন ধরে আবার পড়লাম সেই শপথ। এরপর খেতে দেয়া হলো খানিকটা ‘পবিত্র গুড়’। অবশেষে সম্পূর্ণ হলো ঠগি হিসেবে আমার অভিষেক। মা কালীর পক্ষ থেকে শুভ ইঙ্গিত পাবার জন্যে অভিনন্দন আমাকে জানাল সবাই। তারপর বাবা আমার উদ্দেশে বলল:
‘বাছা, স্রষ্টার সৃষ্ট সবচেয়ে প্রাচীন ও মহৎ পেশাটি আজ গ্রহণ করলি। বিশ্বস্ত, সাহসী ও থাকার শপথ নিয়েছিস তুই। শপথ করেছিস আমাদের গুপ্তরহস্য কারও কাছে ফাঁস করবি না। শপথ নিয়েছিস, ছলে-বলে-কৌশলে, যে-করেই হোক যাকে হাতের মুঠোয় পাবি, তাকেই হত্যা করবি। কেবল যাদের হত্যা করা আমাদের পেশায় নিষেধ, তাদের কোনমতেই হত্যা করবি না। কয়েকটি নির্দিষ্ট গোত্রের ওপর আমাদের কোন ক্ষমতা দেয়া হয়নি। এদেরকে হত্যা করার কোন অধিকার আমাদের নেই। তাদেরকে হত্যা করলেও, সেই বলি গ্রহণ করেন না দেবী। এই সম্প্রদায়গুলো হচ্ছে: ধোপা, ভাট, শিখ, নানকশাহী, মুদারি ফকির, নাচিয়ে, গায়ক, ভাঙ্গি, তেলি, লোহার, বুরেশ, পঙ্গু ও কুষ্ঠরোগী। এরা ছাড়া গোটা মানবজাতিকেই হত্যা করার অধিকার আছে তোর। নরহত্যার যতরকমের উপায় আছে, সবগুলো অবলম্বন করবি সুযোগ পেলেই। তবে সবসময় দেবীর ইঙ্গিতের ওপর নির্ভর করবি। এই ইঙ্গিতই আমাদের পরিচালনা করে। আর কিছু বলার নেই আমার। তুই এখন একজন ঠগি। এখন থেকে এ-পেশায় যেসব দক্ষতা অর্জন করতে হবে, ওসব তোকে শেখাবেন আমাদের গুরু। তিনিই সবকিছু শিখিয়ে-পড়িয়ে দেবেন তোকে।’
‘এ-ই যথেষ্ট,’ বললাম আমি। ‘এখন থেকে আমৃত্যু তোমাদের একজন আমি। দয়া করে শিগগিরই নিজের নিষ্ঠা প্রমাণ করবার মত কাজ দাও আমাকে।’
এভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঠগি হলাম আমি। বাবা যদি এই দলের নেতা না হত, তবে একজন নিম্নপদস্থ সদস্য হিসেবে শুরু হত আমার ঠগিজীবন। তারপর নিষ্ঠা, দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতা প্রদর্শন করেই কেবল ধাপে-ধাপে উঁচু পদ লাভ করতে পারতাম। তাতে লেগে যেত বহু বছর। আর এখন বাপের কল্যাণে জায়গা পেয়ে গেলাম উঁচু পদে। বাবা অবসর নিলেই, দলপতি হিসেবে তার জায়গা নেব আমি।
যা-ই হোক, এবার ঠগি-নেতারা কেন জড় হয়েছে তা বলি। বুদ্ধিটা বাবার। তার ও আরও দু’জন দল-নেতার (তাদের একজন হুসেন) অধীনে বড় একটা দল রাজপথ ধরে যাবে দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত। ওখান থেকে নাগপুর অবধি গিয়ে, বাবা একটা দল নিয়ে এগোবে হায়দ্রাবাদের দিকে। বাকি দল দুটোর একটা প্রথমে যাবে আওরঙ্গবাদ, ওখান থেকে খান্দেহ, বোরহানপুর, ইন্দোর হয়ে শিওপুরে ফিরবে। বাকি দলটাও আওরঙ্গবাদ পর্যন্ত যাবে। তবে ওখান থেকে চলে যাবে পুনা। ওখান থেকে সম্ভব হলে সুরাট—তারপর বাড়ি ফেরা। তবে ততদিন পর্যন্ত মৌসুম থাকলে, বোরহানপুর হয়ে বাড়ি ফিরবে। সবশেষে, আগামী বর্ষার শুরুতে আবার শিওপুরে একত্র হব আমরা।
কেউ আপত্তি করল না এ-প্রস্তাবে। দক্ষিণ দিকে বহুদিন যাওয়া হয় না। তাই এদিকে এবার লাভ হবে বেশি। বাকি দলগুলো বেনারস, সওগর, নর্মদার আশপাশেই ঘোরাঘুরি করবে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবে, আগে থেকে কিছু ঠিক করা থাকবে না ওদের কার্যবিধি।
এর ক’দিন পরই যাত্রা আরম্ভ করলাম আমরা। আমাদের দলে ষাটজন ঠগি, হুসেনের দলে পঁয়তাল্লিশজন, গাউস খান নামক আরেক জমাদারের দলে তিরিশজন। সবমিলিয়ে একশো পঁয়ত্রিশজন।
যাত্রা শুরুর আগে মা কালীর ইশারা জেনে নেয়া দরকার। দেবীর ইঙ্গিত ছাড়া ছোট-বড় কোন কাজেই হাত দেবার উপায় নেই।
যাত্রার দিন সকালে সবকিছুর ব্যবস্থা করা হলো ঠিকমত। তারপর গ্রাম থেকে খানিকটা তফাতে, রাস্তার পাশের ছোট্ট একচিলতে খোলা জায়গায় গেলাম আমরা। বদ্রিনাথ নামের এক লোক ছিল আমাদের দলে। সে ছিল ভীষণ বুদ্ধিমান লোক। সে-ই এসব আচার অনুষ্ঠান পরিচালনা করে। আমাদের পবিত্র খন্তা হাতে চলেছে সে। খন্তাটা আগেই পবিত্র করে রাখা হয়েছিল। বাবা ও আরও তিনজন জমাদার চলেছে বদ্রিনাথের পিছু-পিছু। সবগুলো দলের নেতা হিসেবে, পানিভর্তি একটা ঘটি নিয়ে চলেছে বাবা। ঘটির মুখে দড়ি বাঁধা। সেই দড়িটি দাঁতে কামড়ে ধরে, ডান পাশ দিয়ে নিয়ে চলেছে বাবা। ঘটিখানা পড়ে যাবার মানে হলো, ভয়াবহ অশুভ সঙ্কেত; সমূহ বিপদের সম্ভাবনা। সে-বছর বা এর পরের বছর তার মৃত্যু অনিবার্য।

(চলবে...)
পুনশ্চ ১: চূড়ান্ত সম্পাদিত অনুবাদটি এখানে প্রকাশ করা হয়নি, তাই কিঞ্চিৎ ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে। সেজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
পুনশ্চ ২: অনুবাদটি উৎসর্গ করা হয়েছে বাংলা থ্রিলার সাহিত্যের নক্ষত্র, কাজী আনোয়ার হোসেন-কে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই মার্চ, ২০১৯ সকাল ৭:৪২

রাজীব নুর বলেছেন: পড়ি আর আফসোস হয়।

২| ১৪ ই মার্চ, ২০১৯ সকাল ৯:৫৯

নয়া পাঠক বলেছেন: কমেন্টের উত্তর দেওয়ার সময় নেই তাই আর পোষ্ট বিষয়ে কোন মন্তব্য করলাম না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.