নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ব্লগার মাসুদ

ব্লগার মাসুদ

ব্লগার মাসুদ

ব্লগার মাসুদ

ব্লগার মাসুদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শ্রীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর সামগ্রি (পল্লী সমাজ পর্ব ৩ )

০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:০১


অ্যাঁ ক্ষীরমোহন কৈ সে ত বার করলে না বাপু ? বিস্মিত রমেশের মুখের পানে চাহিয়া দীননাথ কহিল খেয়েছিলুম বটে রাধানগরের বোসেদের বাড়িতে। আজও যেন মুখে লেগে রয়েচে। বললে বিশ্বাস করবে না বাবাজী ক্ষীরমোহন খেতে আমি বড্ড ভালোবাসি । রমেশ হাসিয়া একটুখানি ঘাড় নাড়িল । কথাটা বিশ্বাস করা তাহার কাছে অত্যন্ত কঠিন বলিয়া মনে হইল না । রাখাল কি কাজে বাহিরে যাইতেছিল রমেশ তাহাকে ডাকিয়া কহিল ভেতরে বোধ করি আচায্যিমশাই আছেন যা ত রাখাল কিছু ক্ষীরমোহন খেতে আমি বড্ড ভালোবাসি । রমেশ হাসিয়া একটুখানি ঘাড় নাড়িল । কথাটা বিশ্বাস করা তাহার কাছে অত্যন্ত কঠিন বলিয়া মনে হইল না । রাখাল কি কাজে বাহিরে যাইতেছিল রমেশ তাহাকে ডাকিয়া কহিল ভেতরে বোধ করি আচায্যিমশাই আছেন যা ত রাখাল কিছু ক্ষীরমোহন তাকে আনতে বলে আয় দেখি । সন্ধ্যা বোধ করি উত্তীর্ণ হইয়াছে । তথাপি ব্রাহ্মণেরা ক্ষীরমোহনের আশায় উৎসুক হইয়া বসিয়া আছেন । রাখাল ফিরিয়া বলিল আজ আর ভাড়ারের চাবি খোলা হবে না বাবু । রমেশ মনে মনে বিরক্ত হইল । কহিল বল গে আমি আনতে বলচি ।

গোবিন্দ গাঙ্গুলী রমেশের অসন্তোষ লক্ষ্য করিয়া চোখ ঘুরাইয়া কহিল দেখলে দীনুদা ভৈরবের আক্কেল ? এ যে দেখি মায়ের চেয়ে মাসির বেশি দরদ । সেই জন্যই আমি বলি সে কি বলে তাহা না শুনিয়া রাখাল বলিয়া উঠিল আচায্যিমশাই কি করবেন ? ও বাড়ি থেকে গিন্নীমা এসে ভাড়ার বন্ধ করেছেন যে ধর্মদাস এবং গোবিন্দ উভয়ে চমকিয়া উঠিল কে বড়গিন্নী ? রমেশ সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল জ্যাঠাইমা এসেছেন ? আজ্ঞে হা তিনি এসেই ছোট বড় দুই ভাড়ারই তালাবন্ধ করে ফেলেছেন । বিস্ময়ে আনন্দে রমেশ দ্বিতীয় কথাটি না বলিয়া দ্রুতপদে ভিতরে চলিয়া গেল ।
জ্যাঠাইমা ডাক শুনিয়া বিশ্বেশ্বরী ভাড়ার ঘর হইতে বাহিরে আসিলেন । বেণীর বয়সের সঙ্গে তুলনা করিলে তাহার জননীর বয়স পঞ্চাশের কম হওয়া উচিত নয় কিন্তু দেখিলে কিছুতেই চল্লিশের বেশি বলিয়া মনে হয় না । রমেশ নির্নিমেষ চক্ষে চাহিয়া রহিল । আজও সেই কাচা সোনার বর্ণ । একদিন যে রূপের খ্যাতি এ অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিল আজও সেই অনিন্দ্য সৌন্দর্য তাহার নিটোল পরিপূর্ণ দেহটিকে বর্জন করিয়া দূরে যাইতে পারে নাই । মাথার চুলগুলি ছোট করিয়া ছাটা সুমুখেই দুই একগাছি কুঞ্চিত হইয়া কপালের উপর পড়িয়াছে । চিবুক কপোল ওষ্ঠাধর ললাট সবগুলি যেন কোন বড় শিল্পীর বহু যত্নের বহু সাধনার ফল। সবচেয়ে আশ্চর্য তাহার দুইটি চক্ষুর দৃষ্টি । সেদিকে ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিলে সমস্ত অন্তঃকরণ যেন মোহাবিষ্ট হইয়া আসিতে থাকে ।
এই জ্যাঠাইমা রমেশকে এবং বিশেষ করিয়া তাহার পরলোকগতা জননীকে এক সময় বড় ভালবাসিতেন। বধূ বয়সে যখন ছেলেরা হয় নাই শাশুড়ি-ননদের যন্ত্রণায় লুকাইয়া বসিয়া এই দুটি জায়ে যখন একযোগে চোখের জল ফেলিতেন তখন এই স্নেহের প্রথম গ্রন্থিবন্ধন হয় । তার পরে গৃহবিচ্ছেদ মামলা মোকদ্দমা পৃথক হওয়া কত রকমের ঝড়-ঝাপটা এই দুইটি সংসারের উপর দিয়া বহিয়া গিয়াছে বিবাদের উত্তাপে বাধন শিথিল হইয়াছে কিন্তু একেবারে বিচ্ছিন্ন হইতে পারে নাই । বহুবর্ষ পরে সেই ছোটবৌয়ের ভাড়ার ঘরে ঢুকিয়া তাহারই হাতে সাজানো এই সমস্ত বহু পুরাতন হাঁড়ি-কলসির পানে চাহিয়া জ্যাঠাইমার চোখ দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতেছিল । রমেশের আহ্বানে যখন তিনি চোখ মুছিয়া বাহির হইয়া আসিলেন তখন সেই দুটি আরক্ত আর্দ্র চক্ষু পল্লবের পানে চাহিয়া রমেশ ক্ষণকালের জন্য বিস্ময়াপন্ন হইয়া রহিল । জ্যাঠাইমা তাহা টের পাইলেন । তাহাতেই বোধ করি এই সদ্য পিতৃহীন রমেশের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতেই তাহার বুকের ভিতরটা যেভাবে হাহাকার করিয়া উঠিল তাহার লেশমাত্র তিনি বাইরে প্রকাশ পাইতে দিলেন না । বরং একটুখানি হাসিয়া বলিলেন চিনতে পারিস রমেশ ? জবাব দিতে গিয়া রমেশের ঠোট কাপিয়া গেল । মা মারা গেলে যতদিন না সে মামার বাড়ি গিয়াছিল ততদিন এই জ্যাঠাইমা তাহাকে বুকে করিয়া রাখিয়াছিলেন এবং কিছুতে ছাড়িতে চাহেন নাই । সেও মনে পড়িল এবং এও মনে হইল সেদিন ও-বাড়িতে গেলে জ্যাঠাইমা বাড়ি নাই বলিয়া দেখা পর্যন্ত করেন নাই । তার পর রমাদের বাড়িতে বেণীর সাক্ষাতে এবং অসাক্ষাতে তাহার মাসির নিরতিশয় কঠিন তিরস্কারে সে নিশ্চয় বুঝিয়া আসিয়াছিল এ গ্রামে আপনার বলিতে তাহার আর কেহ নাই। বিশ্বেশ্বরী রমেশের মুখের প্রতি মুহূর্তকাল চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন ছি বাবা এ সময়ে শক্ত হ’তে হয় । তাহার কণ্ঠস্বরে কোমলতার আভাসমাত্র যেন ছিল না । রমেশ নিজেকে সামলাইয়া ফেলিল । সে বুঝিল যেখানে অভিমানের কোন মর্যাদা নাই সেখানে অভিমান প্রকাশ পাওয়ার মত বিড়ম্বনা সংসারে অল্পই আছে । কহিল শক্ত আমি হয়েচি জ্যাঠাইমা । তাই যা পারতুম নিজেই করতুম কেন তুমি আবার এলে ? জ্যাঠাইমা হাসিলেন । কহিলেন তুই ত আমাকে ডেকে আনিস নি রমেশ যে তোকে তার কৈফিয়ত দেব ? তা শোন বলি ।

কাজ কর্ম হবার আগে আর আমি ভাড়ার থেকে খাবার টাবার কোন জিনিস বার হতে দেব না যাবার সময় ভাড়ারের চাবি তোর হাতেই দিয়ে যাব আবার কাল এসে তোর হাত থেকেই নেব । আর কারু হাতে দিস্‌নি যেন। হা রে, সেদিন তোর বড়দার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ? প্রশ্ন করিয়াই জ্যাঠাইমার মুখের উপর একটা উদ্বেগের ছায়া আসিয়া পড়িয়াছিল রমেশ স্পষ্ট দেখিতে পাইল তাহার এই কথায় সেই ভাবটা যেন কাটিয়া গিয়া মুখখানি প্রসন্ন হইয়া উঠিল । হাসিমুখে সস্নেহে অনুযোগের কণ্ঠে বলিলেন আ আমার কপাল! এই বুঝি ? হাঁ রে দেখা হয়নি বলে আর যেতে নেই ? আমি জানি রে সে তোদের উপর সন্তুষ্ট নয় কিন্তু তোর কাজ ত তোর করা চাই। যা একবার ভাল করে বল গে যা রমেশ সে বড় ভাই তার কাছে হেট হতে তোর কোন লজ্জা নেই । তা ছাড়া এটা মানুষের এমনি দুঃসময় বাবা যে কোন লোকের হাতেপায়ে ধরে মিটমাট করে নিতেও লজ্জা নেই । লক্ষ্মীমানিক আমার যা একবার এখন বোধ হয় সে বাড়িতেই আছে । রমেশ চুপ করিয়া রহিল । এই আগ্রহাতিশয্যের হেতুও তাহার কাছে সুস্পষ্ট হইল না মন হইতে সংশয়ও ঘুচিল না । বিশ্বেশ্বরী আরও কাছে সরিয়া আসিয়া মৃদুস্বরে কহিলেন বাইরে যারা বসে আছেন তাদের আমি তোর চেয়ে ঢের বেশি জানি। তাদের কথা শুনিস নে । আয় আমার সঙ্গে তোর বড়দার কাছে একবার যাবি চল । রমেশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল না জ্যাঠাইমা সে হয় না । আর বাইরে যারা বসে আছেন তারা যাই হোন তারাই আমার সকলের চেয়ে আপনার । সে আরও কি কি বলতে যাইতেছিল কিন্তু হঠাৎ জ্যাঠাইমার মুখের প্রতি লক্ষ্য করিয়া সে মহাবিস্ময়ে চুপ করিল। তাহার মনে হইল জ্যাঠাইমার মুখখানি যেন সহসা চারিদিকের সন্ধ্যার চেয়েও বেশি মলিন হইয়া গেল । খানিক পরে তিনি একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন আচ্ছা তবে তাই। যখন তার কাছে যাওয়া হতেই পারবে না তখন আর সে নিয়ে কথা কয়ে কি হবে । যা হোক তুই কিছু ভাবিস নি বাবা কিছুই আটকাবে না । আমি আবার খুব ভোরেই আসবো । বলিয়া বিশ্বেশ্বরী তাহার দাসীকে ডাকিয়া লইয়া খিড়কির দ্বার দিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেলেন বেণীর সহিত রমেশের ইতিমধ্যে দেখা হইয়া যে একটা কিছু হইয়া গিয়াছে তাহা তিনি বুঝিলেন । তিনি যে পথে গেলেন সেই দিকে চাহিয়া কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাড়াইয়া থাকিয়া রমেশ ম্লানমুখে যখন বাহিরে আসিল তখন গোবিন্দ ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিল বাবাজী বড়গিন্নী এসেছিলেন না ?

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:০৬

আমি বন্দি বলেছেন: খুব ভালো সংগ্রহ ধন্যবাদ

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:২২

ব্লগার মাসুদ বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে ।

২| ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ভোর ৫:৫২

কালের সময় বলেছেন: ভালো সামগ্রী । শেয়ারে ধন্যবাদ ।

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:২৩

ব্লগার মাসুদ বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.