নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ব্লগার মাসুদ

ব্লগার মাসুদ

ব্লগার মাসুদ

ব্লগার মাসুদ

ব্লগার মাসুদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শ্রীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর সামগ্রি (পল্লী সমাজ পর্ব ৪ )

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:১৯


রমেশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল হাঁ । শুনলুম ভাঁড়ার বন্ধ করে চাবি নিয়ে গেলেন না ? রমেশ তেমনি মাথা নাড়িয়া জবাব দিল। কারণ অবশেষে কি মনে করিয়া তিনি যাইবার সময় ভাড়ারের চাবি নিজেই লইয়া গিয়াছিলেন । গোবিন্দ কহিল দেখলে ধর্মদাসদা যা বলেচি তাই। বলি মতলবটা বুঝলে বাবাজী ? রমেশ মনে মনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইল । কিন্তু নিজের নিরুপায় অবস্থা স্মরণ করিয়া সহ্য করিয়া চুপ করিয়া রহিল। দরিদ্র দীনু ভট্‌চায তখনও যায় নাই । কারণ তাহার বুদ্ধিসুদ্ধি ছিল না । ছেলেমেয়ে লইয়া যাহার দয়ায় পেট ভরিয়া সন্দেশ খাইতে পাইয়াছিল তাহাকে আন্তরিক দুটা আশীর্বাদ না করিয়া সকলের সম্মুখে উচ্চকণ্ঠে তাহার সাত পুরুষের স্তব স্তুতি না করিয়া আর ঘরে ফিরিতে পারিতেছিল না । সে ব্রাহ্মণ নিরীহভাবে বলিয়া ফেলিল এ মতলব বোঝা আর শক্ত কি ভায়া । তালাবন্ধ করে চাবি নিয়ে গেছেন তার মানে ভাড়ার আর কারো হাতে না পড়ে । তিনি সমস্তই ত জানেন । গোবিন্দ বিরক্ত হইয়াছিল । নির্বোধের কথায় জ্বলিয়া উঠিয়া তাহাকে একটা ধমক দিয়া কহিল, বোঝো না সোঝো না তুমি কথা কও কেন বল ত ? তুমি এ সব ব্যাপারের কি বোঝো যে মানে করতে এসেচ ? ধমক খাইয়া দীনুর নির্বুদ্ধিতা আরও বাড়িয়া গেল । সেও উষ্ণ হইয়া জবাব দিল আরে এতে বোঝাবুঝিটা আছে কোনখানে ? শুনচ না গিন্নীমা স্বয়ং এসে ভাঁড়ার বন্ধ করে চাবি নিয়ে গেছেন ? এতে কথা কইবে আবার কে ? গোবিন্দ আগুন হইয়া কহিল ঘরে যাও না ভট্‌চায। যে জন্যে ছুটে এসেছিলে গুষ্টিবর্গ মিলে খেলে বাঁধলে আর কেন ? ক্ষীরমোহন পরশু খেও আজ আর হবে না । এখন যাও আমাদের ঢের কাজ আছে ।

দীনু লজ্জিত ও সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল। রমেশ ততোধিক কুণ্ঠিত ও ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল । গোবিন্দ আরও কি বলিতে যাইতেছিল কিন্তু সহসা রমেশের শান্ত অথচ কঠিন কন্ঠস্বরে থামিয়া গেল আপনার হল কি গাঙ্গুলীমশাই ? যাকে তাকে এমন খামকা অপমান করচেন কেন ? গোবিন্দ ভর্ৎসিত হইয়া প্রথমটা বিস্মিত হইল। কিন্তু পরক্ষণেই শুষ্কহাসি হাসিয়া বলিল অপমান আবার কাকে করলুম বাবাজী ? ভাল ওকেই জিজ্ঞাসা করে দেখ না সত্যি কথাটি বলেচি কি না ? ও ডালে ডালে বেড়ায় ত আমি পাতায় পাতায় ফিরি যে দেখলে ধর্মদাসদা দীনে বামনার আস্পর্ধা ? আচ্ছা ধর্মদাসদা কি দেখিল তা সেই জানে কিন্তু রমেশ লোকটার নির্লজ্জতা ও স্পর্ধা দেখিয়া অবাক হইয়া গেল । তখন দীনু রমেশের দিকে চাহিয়া নিজেই বলিল না বাবা গোবিন্দ সত্যকথাই বলেচে । আমি বড় গরীব সে কথা সবাই জানে । ওদের মত আমার জমি জমা চাষ বাস কিছুই নেই । একরকম চেয়ে চিন্তে ভিক্ষে সিক্ষে করেই আমাদের দিন চলে । ভাল জিনিস ছেলে পিলেদের কিনে খাওয়াবার ক্ষমতা ত ভগবান দেননি তাই বড় ঘরে কাজকর্ম হলে ওরা খেয়ে বাঁচে।

কিন্তু মনে করো না বাবা তারিণীদাদা বেঁচে থাকতে তিনি আমাদের খাওয়াতে বড় ভালবাসতেন। তাই আমি তোমাকে নিশ্চয় বলচি বাবা, আমরা যে আশ মিটিয়ে খেয়ে গেলুম তিনি ওপর থেকে দেখে খুশিই হয়েচেন । হঠাৎ দীনুর গম্ভীর শুষ্ক চোখ দুটা জলে ভরিয়া উঠিয়া টপটপ করিয়া দুফোটা সকলের সুমুখেই ঝরিয়া পড়িল । রমেশ মুখ ফিরিয়া দাড়াইল। দীনু তাহার মলিন ও শতচ্ছিন্ন উত্তরীয়প্রান্তে অশ্রু মুছিয়া ফেলিয়া বলিল শুধু আমিই নই বাবা । এদিকে আমার মত দুঃখী গরীব যে যেখানে আছে তারিণীদার কাছে হাত পেতে কেউ কখনো অমনি ফেরেনি। সে কথা কে আর জানে বল ? তার ডান হাতের দান বা হাতটাও টের পেত না যে । আর তোমাদের জ্বালাতন করব না । নে মা খেঁদি ওঠ হরিধন চল বাবা ঘরে যাই আবার কাল সকালে আসব আর কি বলব বাবা রমেশ বাপের মত হও দীর্ঘজীবী হও । রমেশ তাহার সঙ্গে আসিয়া আর্দ্রকন্ঠে কহিল ভটচায্যিমশাই এই দুটো তিনটে দিন আমার ওপর দয়া রাখবেন । আর বলতে সঙ্কোচ হয় কিন্তু এ বাড়িতে হরিধনের মায়ের যদি পায়ের ধুলো পড়ে ত ভাগ্য বলে মনে করব ।

ভটচায্যিমশায় ব্যস্ত হইয়া নিজের দুই হাতের মধ্যে রমেশের দুই হাত চাপিয়া ধরিয়া কাঁদ কাঁদ হইয়া বলিল আমি বড় দুঃখী বাবা রমেশ আমাকে এমন করে বললে যে লজ্জায় মরে যাই । ছেলেমেয়ে সঙ্গে করিয়া বৃদ্ধ ধীরে ধীরে চলিয়া গেল । রমেশ ফিরিয়া আসিয়া মুহূর্তের জন্য নিজের রূঢ় কথা স্মরণ করিয়া গাঙ্গুলীমশায়কে কিছু বলিবার চেষ্টা করিতেই সে থামাইয়া দিয়া উদ্দীপ্ত হইয়া বলিয়া উঠিল এ যে আমার নিজের কাজ রমেশ তুমি না ডাকলেও যে আমাকে নিজে এসেই সমস্ত করতে হত। তাই ত এসেছি ধর্মদাসদা আর আমি দুই ভায়ে ত তোমার ডাকবার অপেক্ষা রাখিনি বাবা । ধর্মদাস এইমাত্র তামাক খাইয়া কাসিতেছিল । লাঠিতে ভর দিয়া দাঁড়াইয়া কাসির ধমকে চোখ মুখ রাঙ্গা করিয়া হাত ঘুরাইয়া বলিল বলি শোন রমেশ আমরা বেণী ঘোষাল নই । আমাদের জন্মের ঠিক আছে । তাহার কুৎসিত কথায় রমেশ চমকিয়া উঠিল কিন্তু রাগ করিল না । এই অত্যল্প সময়ের মধ্যেই সে বুঝিয়াছিল ইহারা শিক্ষা ও অভ্যাসের দোষে অসঙ্কোচে কতবড় গর্হিত কথা যে উচ্চারণ করে তাহা জানেও না ।

জ্যাঠাইমার সস্নেহ অনুরোধে এবং তাঁহার ব্যথিত মুখ মনে করিয়া রমেশ ভিতরে ভিতরে পীড়া অনুভব করিতেছিল । সকলে প্রস্থান করিলে সে বড়দার কাছে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইল । বেণীর চণ্ডীমণ্ডপের বাহিরে আসিয়া যখন উপস্থিত হইল তখন রাত্রি আটটা । ভিতরে যেন একটা লড়াই চলিতেছে । গোবিন্দ গাঙ্গুলীর হাঁকাহাঁটিকাই সবচেয়ে বেশি । বাহির হইতেই তাহার কানে গেল গোবিন্দ বাজি রাখিয়া বলিতেছে এ যদি না দুদিনে উচ্ছন্ন যায় ত আমার গোবিন্দ গাঙ্গুলী নাম তোমরা বদলে রেখো বেণীবাবু । নবাবী কাণ্ডকারখানা শুনলে ত ? তারিণী ঘোষাল সিকি পয়সা রেখে মরেনি তা ত জানি তবে এত কেন ? হাতে থাকে কর না থাকে বিষয় বন্ধক দিয়ে কে কবে ঘটা করে বাপের ছাদ্দ করে তা ত কখন শুনিনি বাবা । আমি তোমাকে নিশ্চয় বলচি বেণীমাধববাবু এ ছোঁড়া নন্দীদের গদি থেকে অন্তত তিনঢি হাজার টাকা দেনা করেচে । বেণী উৎসাহিত হইয়া কহিল তা হলে কথাটা ত বার করে নিতে হচ্ছে গোবিন্দখুড়ো ? গোবিন্দ স্বর মৃদু করিয়া বলিল সবুর কর না বাবাজী । একবার ভাল করে ঢুকতেই দাও না তার পরে বাইরে দাঁড়িয়ে কে ও ? এ কি রমেশ বাবাজী ? আমরা থাকতে এত রাত্তিরে তুমি কেন বাবা ?

রমেশ সে কথার জবাব না দিয়া অগ্রসর হইয়া আসিয়া বলিল বড়দা আপনার কাছেই এলুম । বেণী থতমত খাইয়া জবাব দিতে পারিল না । গোবিন্দ তৎক্ষণাৎ কহিল আসবে বৈ কি বাবা একশ বার আসবে । এ ত তোমারই বাড়ি । আর বড়ভাই পিতৃতুল্য । তাই ত আমরা বেণীবাবুকে বলতে এসেছি বেণীবাবু তারিণীদার সঙ্গে মনোমালিন্য তার সঙ্গেই যাক—আর কেন ? তোমরা দুভাই এক হও আমরা দেখে চোখ জুড়োই কি বল হালদারমামা ? ও কি দাড়িয়ে রইলে যে বাবা কে আছিস রে একখানা কম্বলের আসন টাসন পেতে দে না রে । না বেণীবাবু তুমি বড়ভাই তুমিই সব। তুমি আলাদা হয়ে থাকলে চলবে না । তা ছাড়া বড়গিন্নীঠাকরুন যখন স্বয়ং গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন তখন বেণী চমকাইয়া উঠিল মা গিয়েছিলেন । এই চমকটা লক্ষ্য করিয়া গোবিন্দ মনে মনে খুশি হইল । কিন্তু বাহিরে সে ভাব গোপন করিয়া নিতান্ত ভালমানুষের মত খবরটা ফলাও করিয়া বলিতে লাগিল, শুধু যাওয়া কেন ভাড়ার টাড়ার করা কর্ম যা কিছু তিনিই ত করচেন। আর তিনি না করলে করবেই বা কে ?

সকলেই চুপ করিয়া রহিল। গোবিন্দ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিল না গাঁয়ের মধ্যে বড়গিন্নীঠাকরুনের মত মানুষ কি আর আছে ? না হবে কেন ? না বেণীবাবু সামনে বললে খোশামোদ করা হবে কিন্তু যে যাই বলুক গাঁয়ে যদি লক্ষ্মী থাকেন ত সে তোমার মা । এমন মা কি কারু হয় ? বলিয়া পুনশ্চ একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া গম্ভীর হইয়া রহিলেন । বেণী অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া অস্ফুটে কহিল আচ্ছা । গোবিন্দ চাপিয়া ধরিল শুধু আচ্ছা নয় বেণীবাবু যেতে হবে করতে হবে সমস্ত ভার তোমার উপরে । ভাল কথা সবাই আপনারা ত উপস্থিত আছেন নেমন্তন্নটা কি রকম করা হবে ? একটা ফর্দ করে ফেলা হোক না কেন ? কি বল রমেশ বাবাজী ? ঠিক কথা কি না হালদারমামা ? ধর্মদাসদা চুপ করে রইলে কেন ? কাকে বলতে হবে, কাকে বাদ দিতে হবে জান ত সব ।

রমেশ উঠিয়া দাড়াইয়া সহজ বিনীতকন্ঠে বলিল বড়দা একবার পায়ের ধুলো যদি দিতে পারেন বেণী গম্ভীর হইয়া কহিল মা যখন গেছেন তখন আমার যাওয়া না যাওয়া কি বল গোবিন্দখুড়ো ?
গোবিন্দ কথা কহিবার পূর্বেই রমেশ বলিল আপনাকে আমি পীড়াপীড়ি করতে চাইনে বড়দা যদি অসুবিধা না হয় একবার দেখে শুনে আসবেন । বেণী চুপ করিয়া রহিল। গোবিন্দ কি একটা বলিবার চেষ্টা করিতেই রমেশ উঠিয়া চলিয়া গেল। তখন গোবিন্দ বাহিরের দিকে গলা বাড়াইয়া দেখিয়া ফিস্ফিস করিয়া বলিল দেখলে বেণীবাবু কথার ভাবখানা । বেণী অন্যমনস্ক হইয়া কি ভাবিতেছিল কথা কহিল না । পথে চলিতে চলিতে গোবিন্দর কথাগুলো মনে করিয়া রমেশের সমস্ত মন ঘৃণায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। সে অর্ধেক পথ হইতে ফিরিয়া আসিয়া সেই রাত্রেই আবার বেণী ঘোষালের বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করিল । চণ্ডীমণ্ডপের মধ্যে তখন তর্ক কোলাহল উদ্দাম হইয়া উঠিয়াছিল কিন্তু সে শুনিতেও তাহার প্রবৃত্তি হইল না । সোজা ভিতরে প্রবেশ করিয়া রমেশ ডাকিল জ্যাঠাইমা জ্যাঠাইমা তাহার ঘরের সুমুখের বারান্দায় অন্ধকারে চুপ করিয়া বসিয়া ছিলেন এত রাত্রে রমেশের গলা শুনিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন । রমেশ ? কেন রে ?



মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ২:১৪

আমি মিন্টু বলেছেন: দুপুরে পড়ছিলাম বিদুৎ চলে যাওয়ায় মন্তব্য করতে পারিনি ।
ভালো লাগলো ।

১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ভোর ৬:৫৪

ব্লগার মাসুদ বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই ।

২| ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৫৬

এহসান সাবির বলেছেন: ঈদের শুভেচ্ছা।
ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।
শুভ কামনা রইল।

০২ রা অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১:১৮

ব্লগার মাসুদ বলেছেন: ধন্যবাদ সাবির ভাই । শুভ কামনা রইল ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.