নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ব্লগার মাসুদ

ব্লগার মাসুদ

ব্লগার মাসুদ

ব্লগার মাসুদ

ব্লগার মাসুদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শ্রীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর সামগ্রি (পল্লী সমাজ পর্ব ৭ )

২৪ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১০:৪১



শ্রীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর লেখা পল্লী-সমাজ পর্ব ১

শ্রীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর সামগ্রি (পল্লী সমাজ পর্ব ২)

শ্রীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর সামগ্রি (পল্লী সমাজ পর্ব ৩ )

শ্রীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর সামগ্রি (পল্লী সমাজ পর্ব ৪ )
শ্রীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর সামগ্রি (পল্লী সমাজ পর্ব ৫ )

শ্রীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর সামগ্রি (পল্লী সমাজ পর্ব ৬ )

এ পাড়ার একমাত্র মধু পালের মুদির দোকান নদীর পথে হাটের একধারে । দশ বার দিন হইয়া গেল অথচ সে বাকী দশ টাকা লইয়া যায নাই বলিয়া রমেশ কি মনে করিয়া নিজেই একদিন সকালবেলা দোকানের উদ্দেশে বাহির হইয়া পড়িল । মধু পাল মহাসমাদর করিয়া ছোটবাবুকে বারান্দার উপর মোড়া পাতিয়া বসাইল এবং ছোট বাবুর আসিবার হেতু শুনিয়া গভীর আশ্চর্য্যে অবাক হইয়া গেল। যে ধারে সে উপযাচক হইয়া ঘর বহিয়া ঋণশোধ করিতে আসে তাহা মধু পাল এতটা বয়সে কখন চোখে ত দেখেই নাই কানেও শোনে নাই । কথায় কথায় অনেক কথা হইল । মধু কহিল দোকান কেমন করে চলবে বাবু ? দু আনা চার আনা একটাকা পাচসিকে করে প্রায় পঞ্চাশ ষাট টাকা বাকী পড়ে গেছে । এই দিয়ে যাচ্চি বলে দু মাসেও আদায় হবার যো নেই । এ কি বাডুয্যে মশাই যে কবে এলেন ?

প্রাতপেন্নাম হই । বাডুয্যে মশায়ের বা হাতে একটা গাড়ু পায়ের নখে গোড়ালিতে কাদার দাগ কানে পৈতা জড়ানো ডানহাতে কচুপাতায় মোড়া চারিটি কুচোচিংড়ি । তিনি ফোস করিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন কাল রাত্তিরে এলুম তামাক থা দিকি মধু বলিয়া গাড়ু রাখিয়া হাতের চিংড়ি মেলিয়া ধরিয়া বলিলেন সৈরুবি জেলেনীর আক্কেল দেখলি মধু খপ করে হাতটা আমার ধরে ফেললে ? কালেকালে কি হল বল দেখি রে এই কি এক পয়সার চিংড়ি ? বামুনকে ঠকিয়ে ককাল খাবি মাগী উচ্ছন্ন যেতে হবে না ?

মধু বিস্ময় প্রকাশ করিয়া কহিল হাত ধরে ফেললে আপনার ? ক্রুদ্ধ বাডুয্যে মশাই একবার চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া উত্তেজিত হইয়া কহিলেন আড়াইটা পয়সা শুধু বাকী তাই বলে খামকা হাটশুদ্ধ লোকের সামনে হাত ধরবে আমার ? কে না দেখলে বল। মাঠ থেকে বসে এসে গাড়ুটি মেজে নদীতে হাত পা ধুয়ে মনে করলুম হাটটা একবার ঘুরে যাই মাগী এক চুবড়ি মাছ নিয়ে বসে আমাকে স্বছন্দে বললে কি না কিছুই নেই ঠাকুর যা ছিল সব উঠে গেছে । আরে আমার চোখে ধুলো দিতে পারিস ? ডালাটা ফস ক'রে হাতটা চেপে ধরে ফেললে তোর এই আড়াইটা আর আজকার এক্টা এই সাড়ে তিনটে পয়সা নিয়ে আমি গা ছেড়ে পালাব ? কি বলিস মধু ?

মধু সায় দিয়া কহিল তাও কি হয় । তবে তাই বল না গাঁয়ে কি শাসন আছে ? নইলে ষষ্ঠে জেলের খোপা নাপতে বন্ধ করে চাল কেটে তুলে দেওয়া যায় না হঠাত রমেশের প্রতি চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন বাবুটি কে মধু ? মধু সগর্ব্বে কহিল আমাদের ছোটবাবুর ছেলে যে সেদিনের দশ টাকা বাকী ছিল বলে নিজে বাড়ী বয়ে দিতে এসেচেন । বাডুয্যে মশাই কুচোচিংড়ি অভিযোগ তুলিয়া দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিলেন হ্যাঁ রমেশ বাবাজী ? বেঁচে থাক বাবা হাঁ । এসে শুনলুম একটা কাজের মত কাজ করেচ বটে । এমন খাওয়া দাওয়া এ অঞ্চলে কখনও হয় নি । কিন্তু বড় দুঃখ রইল চোখে দেখতে পেলুম না । পাঁচ শালার ধাপ্পায় পড়ে কলকাতায় চাকুরি করতে গিয়ে হাড়ীর হাল । আরে ছি সেখানে মানুষ থাকতে পারে । রমেশ এই লোকটার মুখের দিকে চুপ করিয়া চাহিয়া রহিল । কিন্তু দোকান শুদ্ধ সকলে তাহার কলিকাতা প্রবাসের ইতিহাস শুনিবার জন্য মহাকৌতূহলী হইয়া উঠিল । তামাক সাজিয়া মধু দোকানি বাড়ুয্যের হাতে হুকাটা তুলিয়া দিয়া প্রশ্ন করিল তার পরে ? একটু চাকরি বাকরি হয়েছিল ত ? হবে না ? এ কি ধান দিয়ে লেখাপড়া শেখা আমার ? হলে হবে কি সেখানে কে থাকতে পারে বল যেমন ধুয়া তেমনি কাদা । বাইরে বেরিয়ে গাড়ীঘোড়া চাপা না পড়ে যদি ঘরে ফিরতে পারিস তো জানবি তোর বাপের পুণ্যি মধু কখনও কলিকাতায় যায় নাই । মেদিনীপুর সহরটা একবার সাক্ষ্য দিতে গিয়া দেখিয়া আসিয়াছিল মাত্র । সে ভারি আশ্চর্য্য হইয়া কহিল বলেন কি বাড়ুয্যে ঈষৎ হাসিয়া কহিল তোর রমেশ বাবুকে জিজ্ঞাসা কর না সত্যি না মিথ্যে । না মধু খেতে না পাই বুকে হাত দিয়ে ঘরে পড়ে মরে থাকব । সে ভাল কিন্তু বিদেশ যাবার নামটি যেন কেউ আমার কাছে আর না করে । বললে বিশ্বেস করবিনে সেখানে শুষ্ণি কলমি শাক চালতা আমড়া খোড় মোচা পর্য্যন্ত কিনে খেতে হয় পারবি খেতে এই একটি মাস না খেয়ে খেয়ে যেন ইদুরটি হয়ে গেচি দিবারাত্রি পেট ফুট ফাট করে বুকজ্বালা করে প্রাণ আইঢাই করে পালিয়ে এসে তবে হাঁফ ছেড়ে বাচি । না বাবা নিজের গায়ে বসে জোটে একবেলা একসন্ধ্যে খাবো না জোটে ছেলেমেয়ের হাত ধরে ভিক্ষে করব বামুনের ছেলের তাতে কিছু আর লজ্জার কথা নেই কিন্তু মা লক্ষী মাথায় থাকুন বিদেশ কেউ যেন না যায় ।

তাহার কাহিনী শুনিয়া সকলে যখন সভয়ে নির্ব্বাক হইয়া গেছে তখন বাড়ুয্যে উঠিয়া আসিয়া মধুর তেলের ভাড়ের ভিতর উখড়ি ডুবাইয়া একছটাকে তেল বা হাতের তেলোয় লইয়া অর্দ্ধেরকটা দুই নাক ও দুই কানের গর্ত্তে ঢালিয়া দিয়া বাকিটা মাথায় মাখিয়া ফেলিলেন ও কহিলেন । বেলা হয়ে গেল অমনি ডুবটা দিয়ে একেবারে ঘরে যাই এক পরসার নুন সে সেখি মধু পয়সাটা বিকেলবেলা দিয়ে যাবো । আবার বিকেলবেলা বলিয়া মধু অপ্রসন্নমুখে নুণ দিতে তাহার দোকানে উঠিল । বাড়ুয্যে গলা বাড়াইয়া দেখিয়া বিস্ময় বিরক্তির স্বরে কহিয়া উঠিল তোরা সব হলি কি মধু ?

এ যে গালে চড় মেরে পয়সা নিস দেখি ? বলিয়া আগাইয়া আসিয়া নিজেই এক খামচা নুন তুলিয়া ঠোঙায় দিয়া সেটা টানিয়া লইলেন । গাড়ু হাতে করিয়া রমেশের প্রতি চাহিয়া মৃদু হাসিয়া বলিলেন ঐ তো একই পথ চল না বাবাজী গল্প করতে করতে যাই । চলুন বলিয়া রমেশ উঠিয়া দাড়াইল । মধু দোকানি অনতিদূরে দাড়াইয়া করুণ কন্ঠে কহিল বাড়ুয্যে মশাই সেই ময়দার পয়সা পাচ আনা কি অমনি বাড়ুয্যে রাগিয়া উঠিল হা কিরে মধু দুবেলা চোখো চোখি হবে তোদের কি চোখের চামড়া পর্য্যন্ত নেই ? পাঁচ ব্যাটাবেটির মতলবে কলকাতায় যাওয়া আসা করতে পাচপাচটা টাকা আমার জলে গেল আর এই তোদের তাগাদা করবার সময় হল । কারো সর্ব্বনাশ কারো পোষ মাস দেখলে বাবা রমেশ এদের ব্যাভারটা একবার দেখলে ? মধু এতটুকু হইয়া গিয়া অস্ফুট বলিতে গেল অনেক দিনের হলেই বা অনেক দিনের ? এমন করে সবাই মিলে পিছনে লাগলে ত আর গায়ে বাস করা যায় না বলিয়া বাড়ুয্যে একরকম রাগ করিয়াই নিজের জিনিসপত্র লইয়া চলিয়া গেলেন । রমেশ ফিরিয়া আসিয়া বাড়ি ঢুকিতেই এক ভদ্রলোক শশব্যস্তে হাতের হুকাটা একপাশে রাখিয়া দিয়া একেবারে পায়ের কাছে আসিয়া তাহাকে প্রণাম করিল। উঠিয়া কহিল আমি বনমালী পাড়ুই আপনাদের ইস্কুলের হেডমাস্টার । দুদিন এসে সাক্ষাৎ পাইনি তাই বলি রমেশ সমাদর করিয়া পাড়ুইমহাশয়কে চেয়ারে বসাইতে গেল কিন্তু সে সসম্ভ্রমে দাড়াইয়া রহিল । সে কহিল আজ্ঞে আমি যে আপনার ভৃত্য ।

লোকটা বয়সে প্রাচীন এবং আর যাই হোক একটা বিদ্যালয়ের শিক্ষক । তাহার এই অতিবিনীত কুণ্ঠিত ব্যবহারে রমেশের মনের মধ্যে একটা অশ্রদ্ধার ভাব জাগিয়া উঠিল । সে কিছুতেই আসনগ্রহণে স্বীকৃত হইল না খাড়া দাড়াইয়া নিজের বক্তব্য কহিল । এদিকের মধ্যে এই একটা অতি ছোটরকমের ইস্কুল মুখুয্যে ও ঘোষালদের যত্নে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল । প্রায় ত্রিশ চল্লিশ জন ছাত্র পড়ে । দুই তিন ক্রোশ দূর হইতেও কেহ কেহ আসে । যৎকিঞ্চিৎ গভর্নমেন্ট সাহায্য আছে তথাপি ইস্কুল আর চলিতে চাহিতেছে না ছেলেবয়সে এই বিদ্যালয়ে রমেশও কিছুদিন পড়িয়াছিল তাহার স্মরণ হইল । পাড়ুইমহাশয় জানাইল যে চাল ছাওয়া না হইলে আগামী বর্ষায় বিদ্যালয়ের ভিতর আর কেহ বসিতে পারিবে না । কিন্তু সে নাহয় পরে চিন্তা করিলে চলিবে উপস্থিত প্রধান দুর্ভাবনা হইতেছে যে তিন মাস হইতে শিক্ষকেরা কেহ মাহিনা পায় নাই সুতরাং ঘরের খাইয়া বন্যমহিষ তাড়াইয়া বেড়াইতে আর কেহ পারিতেছে না ।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১১:২৫

তারছেড়া লিমন বলেছেন: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর দত্তা যতবার পড়েছি ছাত্রজীবনে ততবার মনে হয় পাঠ্যবইও ততবার পড়িনি।।

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ ভোর ৫:২২

ব্লগার মাসুদ বলেছেন: ধন্যবাদ লিমন ভাই ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.