নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

অনাথ

৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১:১৯

দুই হাঁটু এক জায়গা করে তার ওপর থুতনি আর হাতদুটো পায়ের পাতার কাছে রেখে আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে বাঁশের চাঙায় বসে আছে টুকু। আজহারের দোকানের সামনের চাঙা। মুদি দোকান, কিন্তু চা-ও বিক্রি করে আজহার। আজহারের দোকানের পাশেই জাহাঙ্গীরের হোটেল। তার ওপাশে দিলীপের সেলুন, তারপর একটি লেডিস টেইলার্স। তিন রাস্তার মোড়ে এই চারটি মাত্র দোকান।

মাঝ বয়সী হেমন্ত। কিন্তু সন্ধ্যার পরপরই অন্ধকারের সাথে সাথে শীতও পাত পেতে বসে। মোড়ের এই দোকানগুলো ছাড়াও পূর্বদিকে সামান্য দূরে একটি গার্মেন্টস কারখানার ঝকঝকে আলো এসে পড়ে রাস্তার ওপর। এছাড়া চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পশ্চিমদিকে খানিকটা দূরে একটা শুটিং বাড়ী, ওখানে নাটক-সিনেমার শুটিং হয়, রাতে অভিনয়শিল্পীসহ পুরো শুটিং ইউনিট থাকে। চারদিকে উঁচু দেয়াল তোলা। সদর গেটে একটি বাতি জ্বলে। তার আলো এখান থেকে দেখা যায় না। এছাড়া সীমানা প্রাচীরের ভেতরের বাগান, পুকুরঘাট, ঘরগুলির সামনে অনেকগুলো বাতি জ্বলে। কিন্তু সে আলো বাইরে আসে না, দেয়ালে আটকে যায়। রাতে শুটিং শেষে হই হুল্লোরের শব্দ ভেসে আসে পথ চলতি মানুষের কানে। জড়ানো ভারী গলার গালাগালি, লাস্যময়ী হাসি, ঠাট্টা-তামাশার শব্দ ইট-সিমেন্টের দেয়াল আটকে রাখতে পারে না। এখানেও ভেসে আসে সে-সব। এখানকার লোকেদের মধ্যে তা নিয়ে আলোচনা হয়। টুকু গম্ভীর মুখে সে-সব গল্প শোনে। তার মনোভাব মুখের অভিব্যক্তিতে বোঝা যায় না।

রাস্তার অন্ধকার ছিঁড়ে-ফুঁড়ে একজন লোক এসে আটটা বেনসন সিগারেট চায় আজহারের কাছে। টুকু লোকটার দিকে তাকায়। গম্ভীর মুখ, তীক্ষ্ণ চাহনী। যেন তীক্ষ্ণ চোখে লোকটার ভেতরের যতো অলি-গলি সব পড়ে ফেলছে! আজহার আটটা সিগারেট গুনে একটা খালি প্যাকেটে ঢুকিয়ে লোকটার হাতে দিতেই টুকু মুখ ফিরিয়ে নিজের মধ্যে ডুব দেয়। সামনে-পিছনে দুলে দুলে ডান হাতের আঙুলের কড় গুনতে থাক, ‘এক, দুই, তিন,.....।’

ঠিক তখনই লোকটা একটা সিগারেট ধরিয়ে ডান দিকে মুখ ঘুরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। ধোঁয়ার ঝাঁপটা এসে লাগে টুকুর নাকে-মুখে। আঙুল স্থির। গণনা থেমে যায় চার এ। বিরক্ত টুকু চোখ-মুখ খিঁচিয়ে, কপাল কুঁচকে তাকায় লোকটার দিকে। ভাংতি টাকাটা নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে আবার অন্ধকারে মিলিয়ে যায় লোকটা। লোকটার গমন পথের দিক থেকে টুকুর মুখ ফিরিয়ে আনার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, লোকটা অতি তুচ্ছ! সে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে!

আবার সচল হয় তার আঙুল, ‘পাঁচ, ছয়, সাত, আট।’

তখনই হেঁচকা টানে তাকে হাত ধরে চাঙা থেকে টেনে নামায় আবিদা। তারপর অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করে মা-ছেলে।

খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হয় পাঁচ বছরের টুকুকে। চোখের পাতায় ঘুম লেগে থাকে। খুলতে চায় না চোখের পাতা। ভাতের হাঁড়িটা মাটির উনুন থেকে নামিয়ে আবিদা তাকে ডাকতে ডাকতে গোসলে যায়। গোসল থেকে ফিরে এসে আবিদা দেখে টুকু ঘুমিয়েই আছে। তখন পিঠের উপর দেয় দুটো থাপ্পড়। ধড়মড় করে উঠে বসে টুকু। গম্ভীর মুখে মাজন দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে হারুনদের টিউবয়েলের দিকে যায়। মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসে মায়ের সাথে।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ময়লা চিরুনীটা হাতে নিয়ে আঁঠালো চুলে চিরুনীর দাঁত বসায় টুকু।

‘তাড়াতাড়ি কর নবাবের বাচ্চা।’ বলেই আবিদা আঙুলের ডগায় একটু পেট্রোলিয়াম জেলি নেয়। বামহাতে টুকুর ঘাড়টা ধরে ডান হাত চালায় টুকুর খসখসে মুখে। ঘাড় ধরেই ধাক্কা মেরে বলে, ‘যা, বাইর হ।’

ঘরে তালা লাগায় আবিদা। তারপর দুপুরের খাবারের বাটি রাখা ব্যাগটা মাটি থেকে ডান হাতে নিয়ে বাম হাতে টুকুর হাতটা ধরে স্যান্ডেলে পটাত পটাত শব্দ করতে করতে রাস্তায় বের হয়।

গার্মেন্টসে চাকরি করে আবিদা। রোজ সকালে টুকুর হাত ধরে বের হয় সে। বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে পুবাইলে গার্মেন্টস। টুকুকে নিয়ে সকালে পায়ে হেঁটে গার্মেন্টসে যায়, আবার রাতে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরে আসে। তার স্বামী নজিবর বছর দেড়েক আগে দালালের মাধ্যমে ট্রলারে করে রওনা হয় মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু যাবার পর থেকে আজ পর্যন্ত তার কোনো খবর নেই। বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও জানে না আবিদা।

বাড়িতে আর কোনো লোকজন না থাকায় আবিদা কাজে যাবার সময় টুকুকে সঙ্গে নিয়ে যায়। গার্মেন্টসের কাছে আজহারের দোকানের সামনের চাঙায় বসিয়ে রাখে। ব্যাগের মধ্যে যে দুটো প্লাস্টিকের বাটিতে দুপুরের জন্য খাবার নিয়ে আসে। তার একটা আবিদার নিজের, আরেকটা টুকুর জন্য। টুকুর খাবারের বাটিটা আজহারের দোকানে রেখে যায়। দুপুরে আজহার বাটিটা দেয় টুকুকে।

চাঙায় বসে থাকে টুকু। সারাদিনে কতো রকম লোকজন আসে দোকানে। তারা চাঙায় বসে চা-সিগারেট খায়। দুটো গাল গল্প করে, আবার চলে যায়। টুকু গম্ভীর মুখে তাদেরকে দেখে। কখনও কখনও জাহাঙ্গীরের হোটলে ঢুঁ মারে। সস্তা হোটেল। পরোটা, চা, সিঙ্গারা, পুড়ি আর দুপুরে সস্তায় ভাত পাওয়া যায়। জাহাঙ্গীরের হোটেলে ছোট্ট একটা টিভি আছে। সারাদিন বাংলা সিনেমা চালিয়ে রাখে জাহাঙ্গীর। সিনেমা দেখার লোভেই মাঝে মাঝে জাহাঙ্গীরের হোটেলের বেঞ্চে গিয়ে বসে টুকু। বাংলা সিনেমা দেখে। হোটেলে লোকজনের ভিড় হলেই জাহাঙ্গীর তাড়া দেয়, ‘যা ভাগ!’

আবার মাঝে মাঝে তাকে ফরমায়েশও খাটায় জাহাঙ্গীর, ‘টুকু দুই জগ পানি আইন্যা দে তো।’ অথবা ‘এক গিলাস পানি দে তো ভাইজানরে।’

টুকু ফরমায়েশ খাটে। যাতে জাহাঙ্গীরের কাছে ভাল থাকা যায়। তাড়িয়ে না দেয়। তাহলে অনেকক্ষণ সিনেমা দেখতে পারবে সে। জগতের এই কদাকার চতুরতার দিকটি এই বয়সেই বুঝে গেছে টুকু। আবার জাহাঙ্গীরের মেজাজ ভাল থাকলে কখনও কখনও মাছি ভন ভন করা একটা ঠাণ্ডা সিঙ্গারা কিংবা পুরিও জোটে টুকুর কপালে। সিঙ্গারায় দাঁত বসাতে বসাতে টুকু আবার এসে বসে চাঙায়।

মাঝে মাঝে শুটিংয়ের লোকজন আসে এখানে। নাটক-সিনেমার অভিনয়শিল্পীরা এসে চা-সিগারেট খায়। নিজেদের মধ্যে গল্প করে। আবার চলে যায়। টুকু তাদের দিকে গম্ভীর চোখে তাকিয়ে থাকে। কোনো উচ্ছাস নেই তার। মুখের অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন হয় না। শুধু একবার সে অবাক হয়েছিল একজন অভিনেত্রীকে সিগারেট খেতে দেখে। টুকু আগে থেকেই চিনতো সেই অভিনেত্রীকে। একটা নাটকে মাজা ভাঙা বুড়ি সেজেছিল। অথচ বয়স বেশি না। টুকু কপাল কুঁচকে, ঠোঁট ছুঁছোলো করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সিগারেট খাওয়া দেখেছিল। তারপর পরক্ষণেই আবার গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল সে।

সারাদিনে বলতে গেলে টুকু একেবারেই হাসে না। যেন সে হাসতে জানে না। মা তাকে এখানে ফেলে ঢুকে যায় গার্মেন্টসে। সারাদিনে আর মায়ের দেখা পায় না। কোনো শাসন নেই, বাঁধন নেই। আদর-স্নেহ নেই। উড়ো খইয়ের মতো দিন কাঁটে তার। জীবনের এই কঠিন রুঢ় বাস্তবতা যেন তার সবটুকু হাসি কেড়ে নিয়ে এতোটুকুন মুখে দিয়ে গেছে পাথুরে গাম্ভীর্য।

অপরিচিত কোনো মানুষ টুকুকে বিস্কুট, চকলেট কিংবা কোনো কিছু দিলে সে নেয় না। জোরাজুরি করলে উঠে একদিকে হাঁটা দেয়। আবার কখনও কখনও নিজেই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আজহারের দোকানের বিস্কুটের বয়ামের দিকে। কাঁচের ভেতরের চকলেটের দিকে। কাঁচের বাইরে থেকে সে চকলেটে হাত বোলায়। জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটে। চকলেটের প্যাকেটের গায়ের কার্টুনের ছবির দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে আসে তার শিশুসুলভ আচরণ। কার্টুনের ছবির দিকে তাকিয়ে জিভ ভ্যাঙায়। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ভয় দেখায়। ব্যাঙ্গ করে। চড় দেখায়। আবার আদরও করে।

‘এই, যা চুপ কইরা বয়!’

আজহারের ধমক খেয়ে ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যায় টুকু। চুপ করে বসে থাকে চাঙায়। আঙুল দিয়ে চাঙার বাঁশে আঁকি-বুকি করতে থাকে আর থেকে থেকে চকলেটের প্যাকেটের গায়ের কার্টুনের দিকে তাকায়।

দুপুরে আজহারের কাছ থেকে খাবারের বাটিটা নিয়ে ভাত খায়। টিউবয়েল থেকে বাটিটা ধুয়ে এনে তৈলাক্ত বাটিটা আজহারের দোকানের একপাশে রেখে আবার চাঙার ওপর বসে টুকু। ভাত খাওয়ার পর শরীরটা ভারী হয়। মাথা ভারী হয়ে আসে। ঝিমুনি আসে। বুজে আসে চোখের পাতা। ছোট্ট শরীরটা ঘুম চায়। বসে বসে ঝিমুতে থাকে সে।

রোজকার মতো আজও বসে ঝিমোচ্ছে টুকু। কয়েকজন অভিনয়শিল্পী আসে আজহারের দোকানে। টুকুর ঝিমুনি কাটে আজহারের ধমকে, ‘এই হইরা বয়, ওনাগো বইতে দে।’

টুকু উঠে দাঁড়িয়ে থাকে একপাশে। শিল্পীদের দিকে তাকায়। কাউকে সে চিনতে পারে, কাউকে পারে না। চা-সিগারেট খায় তারা। একজন জিজ্ঞাসা করে তাকে, ‘নাম কী তোর?’

টুকু গম্ভীর মুখে কপাল কুঁচকে তাকায় প্রশ্নকারীর দিকে। পুনরায় একই প্রশ্ন, ‘তোর নাম কী?’
‘টুকু।’ নিচুস্বরে টুকুর জড়ানো উচ্চারণ ।
‘কী?’
‘টুকু।’ একই ভাবে বলে সে।
‘শুকু?’
‘টুকু।’ একটু জোর দিয়ে বলে।
এবার বুঝতে পারে প্রশ্নকারী, ‘ও টুকু।’
মাথা নাড়ে টুকু।

একজন একটা বিস্কুট এগিয়ে দেয় টুকুর দিকে। টুকু দু-দিকে মাথা নাড়ে।
লোকটা আবার বলে, ‘নে নে খা।’

টুকু গম্ভীর মুখে একই ভাবে মাথা নেড়ে উত্তর দিকের রাস্তা ধরে হাঁটা দেয়। একবারও পিছন ফিরে তাকায় না।

স্কুল মাঠের একপাশে গাছের নিচে এসে দাঁড়ায় টুকু। মেহগনি গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে। চোখের পাতা আবার ভারী হয়। ঝিমুনি আসে। চোখ বুজে হারিয়ে যায় টুকু।

বেশ কিছুক্ষণ পর টুকু সজাগ হয় পায়ের পাতায় সুরসুরি আর গরম বাতাস অনুভব করে। চোখ খুলে তাকায় সামনে। একটি ছাগলের বাচ্চা তার পায়ের পাতা চাটছে। বাচ্চাটি চার পায়ে দাঁড়িয়ে টলছে। বোধ হয় দু-তিনদিনের বাচ্চা। সামান্য দূরে মা ছাগলটি ঘাস খাচ্ছে। অন্য একটি বাচ্চা মায়ের পিছন পিছন টলতে টলতে হাঁটছে আর ঘাস শুকছে। টুকু একটি ঘাসের ডগা ছিঁড়ে বাচ্চাটির মুখের কাছে ধরে। বাচ্চাটি ঘাসের ডগাটি শুকে কামড়ে মুখের মধ্যে নেবার চেষ্টা করে।

টুকু বলে, ‘খা, খা।’

তারপর বাচ্চাটি ঘাসের ডগা ছেড়ে টুকুর হাতের আঙুল চাটতে থাকে। টুকু আঙুল বাড়িয়ে দেয়। একটার পর একটা আঙুল চাটতে থাকে বাচ্চাটি। টুকুও বেশ মজা পায়। সে আস্তে আস্তে আঙুল সরিয়ে আনে আর বাচ্চাটি এগোতে এগোতে তার কোলের কাছে চলে আসে। আনমনে হাসতে থাকে টুকু। আজকের দিনে এই প্রথম হাসি তার।

‘খেলবি টুকু?’
তার বয়সী একটি ছেলে তাকে প্রশ্ন করে। সঙ্গে আরো কয়েকটি ছেলে। বিকেলে ওরা মাঠের একপাশে ক্রিকেট খেলে। আর পুরো মাঠ দখল করে খেলে বড়রা। স’মিল থেকে থেকে কুড়িয়ে আনা এক টুকরো কাঠ দিয়ে ব্যাট বানিয়ে খেলে ওরা। টুকু মাঝে মাঝেই খেলে ওদের সাথে।

‘খ্যালবো।’
বলেই ছাগলের বাচ্চাটির মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে উঠে দৌড় দেয়।

সন্ধ্যায় আবার দোকানের চাঙায় এসে বসে টুকু। এতোক্ষণ খেলার মাঠে দৌড়-ঝাঁপ করছিল। এখন এসে চাঙায় বসতেই খিদেয় পেটটা চিন চিন করতে শুরু করেছে। সেই সাথে শীতও কামড় বসাচ্ছে শরীরে। হাফ প্যান্ট পরা। গায়ে একটা পাতলা তেল চিটচিটে সোয়েটার। কুয়াশা পড়েছে আজ বেশ, সাথে উত্তর দিক থেকে আসা হালকা বাতাস। টুকু চাঙায় বসে বয়ামের বিস্কুট আর কাঁচের বাক্সের চকলেটের দিকে তাকিয়ে থাকে কপাল কুঁচকে, ছুঁছোলো মুখে।

তারপর খিদেটা যখন একেবারেই অসহ্য বোধ হয়, তখন উঠে গিয়ে জাহাঙ্গীরের হোটেলে ঢুকে একটা বেঞ্চে বসে। টিভিতে বাংলা সিনেমা হচ্ছে। সে একবার টিভির দিকে তাকায় আরেকবার ফুরিয়ে আসা সিঙ্গারা আর পুরির দিকে তাকায়। বিকেলে ভাজা সিঙ্গারা আর পুরি। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কয়েকটা মাছি ভন ভন করছে। অন্ধকার নামলে খরিদ্দার কমে আসে। দু-চারজন গল্পবাজ লোক অবশ্য আছে। তারা চা-সিগারেট খাচ্ছে আর রাজনীতির জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। ওসব গল্প টুকুর ছোট মাথায় ঢোকে না। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ঠান্ডা, মাছি ভনভন করা সিঙ্গারা-পুরির দিকে। কিন্তু আজ জাহাঙ্গীরের বেচা-বিক্রি হয়তো ভাল হয়নি। মেজাজটা ভাল নেই। সে টুকুকে খেয়ালই করে না। হোটেলের কাজের ছেলেটাকে ধমকায় টেবিলে চা দেবার সময় কাপ থেকে চা ফেলার জন্য। টুকু ঘাপটি মেরে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষে তাকে দেখে যদি হোটেল থেকে বের করে দেয় জাহাঙ্গীর!

পেটের ভেতর মোচড় মারছে। মনে হচ্ছে নাড়ি-ভুড়ি সব যুদ্ধ শুরু করেছে। জাহাঙ্গীরের দিকে তাকায় টুকু। এক খরিদ্দারের কাছ থেকে টাকা রাখছে জাহাঙ্গীর। সে আস্তে আস্তে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালে। পুরো গ্লাস পানি খায়। তারপর আরো হাফ গ্লাস। পেটের যুদ্ধটা এখন একটু কমেছে। একটা ঢেঁকুর তুলে আবার টিভি দেখতে থাকে।

দেড় গ্লাস পানি খেয়ে পেটের খিদে একেবারে মরে যায়নি। একজন খরিদ্দার এসে অবশিষ্ট সিঙ্গারা আর পুড়িগুলো নিয়ে যায়। আর আশা নেই। তাই টিভিতে চোখ রাখে। কিন্তু টিভির দিকে চোখ থাকলেও মনে মনে অপেক্ষা করতে থাকে মায়ের জন্য।

টুকু মুখের মধ্যে বুড়ো আঙুল ঢুকিয়ে চাটে বলে গার্মেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে মাঝে মাঝেই টুকুর গালে থাপ্পড় মারে আবিদা। ছেলে মানুষ, আঙুল চাটা অস্বাভাবিক নয়। তবু আবিদা তাকে থাপ্পড় মারে। আবিদা সারাদিন কারখানায় যন্ত্রের সাথে তাল মিলিয়ে, যন্ত্রের মতো কাজ করে সমস্ত আবেগ-অনুভূতি বিসর্জন দিয়ে। বকাঝকা খায়। মনটা হয়তো খিটখিটে হয়ে থাকে। তাই হয়তো কারখানা থেকে বেরিয়ে ছেলেকে আঙুল চাটা দেখলেই থাপ্পড় মারে। নিজের ছেলেকে মেরে জ্বালা জুড়ায়।

হঠাৎ পূর্বদিক থেকে হইচই আর চিৎকারের শব্দ ভেসে আসে। কেউ একজন চিৎকার করে বলে, ‘আগুন! আগুন! আগুন লাগছে!’

হোটেলের ভেতরের সবাই কান খাড়া করে। কয়েকজন দৌড়ে বের হয়ে যায়। আজহারের গলা পাওয়া যায়, ‘কারখানায় আগুন লাগছে।’

টুকু হোটেল থেকে বের হয়ে অন্য সবার সাথে গার্মেন্ট কারখানার সদর গেটের কাছের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। ভেতর থেকে চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। যারা বেরিয়ে এসেছে তারাও কান্নাকাটি করছে। মুহূর্তের মধ্যে অনেক লোকের ভিড় জমে যায় কারখানার সামনের রাস্তায়। গার্মেন্টের মেয়েরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। মানুষের কান্না, চিৎকার, হই-হট্টগোলের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে টুকুর কান্না জড়ানো আর্ত চিৎকার, ‘আম্মা, আম্মা...।’

টুকু নাকের পানি, চোখের পানি সোয়েটারের হাতায় মোছে আর গার্মেন্ট থেকে বেরিয়ে আসা নারীদের ভিড়ে তার মাকে খুঁজতে থাকে। মানুষের ভিড়ের ফাঁক গলে, ছোট্ট দুই হাতে মানুষকে ঠেলে সে খুঁজে চলেছে তার মাকে। অনেক খুঁজেও যখন আর মাকে পায় না, হয়রান হয়ে যায়, বুকের হাপর ঘন ঘন ওঠা-নামা করতে থাকে। তখন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে সে।

কোলাহলরত মানুষের ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে আগুনের আভায় ক্ষণে ক্ষণে আলোকিত হতে থাকে টুকুর অশ্রুস্নাত মুখমণ্ডল। সেই আলোতেই পড়া যায় টুকুর চোখের হাহাকার। টুকু অসহায় চোখে আগুনের লেলিহান শিখার মধ্যে মায়ের মুখচ্ছবি দেখতে দেখতে কাঁদতেই থাকে, ‘আম্মা....আম্মা....!’


দক্ষিণ পাইকপাড়া, মিরপুর।
ডিসেম্বর, ২০১২।


















মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১:৫০

টাইটান ১ বলেছেন: টাচি। স্টোরি টেলিং অসাধারণ।

২| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১২:০৭

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ। শুভকামনা রইলো।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.