নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মন্ত্রক

আমি আমার দেশের জন্যে

মন্ত্রক › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিএনপির মিশন ইমপসিবল

২৩ শে মে, ২০১৭ সকাল ১১:১৩

আন্দোলন-সংগ্রাম, সভা-সমাবেশহীন বিএনপি প্রায় এক দশক ধরে বেকার। মাঝে হিট অ্যান্ড রান পলিসির আত্মঘাতী যে পেট্রল-আন্দোলন হয়েছিল, তা-ও মূলত তাদের জোটের প্রধান মিত্র মার্সেনারি হিসেবে প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছে। বিএনপির বেকার হওয়ার পেছনে সরকারের যেমন অবদান আছে, তেমনি বিএনপির কর্মবিমুখতাও কম দায়ী নয়। একাধিকবার কর্মসূচি দিয়েও বিএনপি রাস্তায় নামেনি। রাজনৈতিকভাবে কর্মব্যস্ত হতে ও ঝিমিয়ে পড়া দলকে চাঙ্গা করতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা সাংগঠনিক জেলায় যে সফর শুরু করেছেন, তা-ও ভেস্তে যেতে বসেছে। বিভিন্ন জেলায় দলের ভেতর কোন্দল আবার স্পষ্ট হচ্ছে। স্থানীয় নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে সংঘর্ষ-বিভেদে জড়াচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে দলীয় কর্মিসভায় নেতাকর্মীরা চেয়ার ছোড়াছুড়ি, ভাঙচুর, হাতাহাতি ও বিশৃঙ্খলায় লিপ্ত হচ্ছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া ভিশন ২০৩০ প্রকাশ করলেন। রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোর অংশ হিসেবে এবং নির্বাচনে জয়লাভের কৌশল হিসেবে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার পর রূপকল্প প্রকাশ করে থাকে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের এখনো বছর দেড়েকেরও বেশি সময় বাকি বলেই প্রতীয়মান হয়। নির্বাচনের এত আগে রূপকল্প প্রকাশ সে হিসেবে ব্যতিক্রমী ঘটনা বটে।
ভিশন ২০৩০ প্রকাশের অনেক আগে থেকেই এ বিষয়ে পত্রপত্রিকা কিছুটা সরগরম ছিল। রূপকল্পের কিছু বিষয় নিয়ে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মতপার্থক্যের কথাও শোনা যাচ্ছিল। যাহোক, ভিশন ২০৩০ প্রকাশের আগে আমি যুবসমাজের বেশ কয়েকজনের প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করেছিলাম। বেশির ভাগই এ ব্যাপারে তাদের অনাগ্রহ ও নির্লিপ্ততা প্রকাশ করেছে। এর কারণ হতে পারে রাজনীতির প্রতি তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলা কিংবা তাদের স্বপ্ন, আশা, মেধা, মনন ব্যাপকভাবে ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার তথা ভার্চুয়াল জগতের দখলে চলে যাওয়া। দু-চারজন আকার-ইঙ্গিতে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে তার মোদ্দাকথা হলো, এক ভিশন থেকে আরেক ভিশনের পার্থক্য, এক সিনেমার গল্প থেকে আরেক সিনেমার গল্পের মতো পার্থক্য, যা আগে থেকেই অনুমেয়। সিনেমার গল্পে পাত্র-পাত্রীর নাম, পেশা কিংবা নায়ক-নায়িকা পরিবর্তন হলেও গল্পটা একই। নায়ক বা নায়িকার একজন ধনী, সম্ভ্রান্ত পরিবারের হবে, অন্যজন হবে গরিব ঘরের সন্তান। রাস্তায় কোথাও ধাক্কা লেগে বা অন্য কোনোভাবে দুজনের মধ্যে পরিচয়, প্রেম হবে। ধনী মা-বাবা (সিনেমার ভাষায়) ছোটলোকের সন্তানের সঙ্গে প্রেমকে মেনে নিতে চাইবে না। ভিলেন নায়িকাকে পছন্দ করবে। ভিলেন-নায়ক মারামারি হবে। প্রথমে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহূত হবে। এক রিভলবার থেকে বুলেট রিলোড ছাড়াই শখানেক গুলি বের হবে। নায়ক ডান দিকে গুলি করবে; কিন্তু বাঁ দিকের মানুষ মারা যাবে। একপর্যায়ে নায়ক, ভিলেন দুজনেরই গুলি শেষ হয়ে যাবে। এবার হাত দিয়ে মারামারি হবে। এরই মধ্যে ধনী বাবা নিজের ভুল বুঝতে পেরে নায়ক-নায়িকার প্রেমকে স্বীকার করে নিতে লড়াইয়ের ময়দানে ছুটে আসবে। ভিলেন পড়ে থাকা অস্ত্র তুলে নিয়ে ধনী বাবাকে গুলি করবে। বাবা মারা যাওয়ার আগে নায়ক-নায়িকার হাত মিলিয়ে দেবে। সিনেমা খতম। যুবসমাজের কয়েকজন আমাকে বলেছে, রাজনৈতিক দলের ভিশনও এমনই।
ভিশন ২০৩০ প্রকাশের পর প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একে নকল ভিশন বলে আখ্যায়িত করেছেন। কেউ কেউ মজা করে একে কপি-পেস্ট ভিশন বলছে। অনেকে আবার একে উচ্চাভিলাষী বলেও বিবেচনা করছে। রূপকল্পে কল্পনা-স্বপ্ন থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হচ্ছে কতটা উচ্চাভিলাষী হওয়া বাস্তবসম্মত! অতি উচ্চাভিলাষী হলে ভিশন বাস্তবায়নের মিশন ইমপসিবল হবে সন্দেহ নেই। ভিশন ২০৩০-এ মোট ৩৭টি দফায় ২৫৬টি বিষয়ে বিএনপি ভবিষ্যতে কী করবে সে পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। আমি সেখান থেকে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আমার মূল্যায়ন তুলে ধরছি।
এক. বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর একক নির্বাহী ক্ষমতা সংসদীয় সরকারের আবরণে একটি স্বৈরচারী একনায়কতান্ত্রিক শাসনের জন্ম দেওয়ায় বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বিদ্যমান অবস্থার অবসানকল্পে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা হবে বলে ভিশনে উল্লেখ করা হয়েছে। খুবই প্রশংসনীয় স্বপ্ন। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম (আগে ঘর, তবে তো পর)। বিএনপির গঠনতন্ত্রে সব ক্ষমতা বাংলাদেশের সংবিধানের থেকেও স্বৈরাচারীভাবে চেয়ারপারসনের হাতে কুক্ষিগত আছে। বিএনপি নিজ গঠনতন্ত্র সংশোধন করে ক্ষমতার ভারসাম্য আনলে ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধান সংশোধন করবে, এ আশ্বাসে জনগণ ভরসা পেত। প্রমাণ দেখাতে চাইলে আগে দলের সংবিধান শোধরাতে হবে। কথায় বলে, Example is better than precept. উপদেশ অপেক্ষা দৃষ্টান্তে ভালো শিক্ষা হয়।
দুই. বিএনপি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের কথা দাবি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। নিরপেক্ষ সরকার না থাকায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো রূপরেখা রূপকল্পে না থাকা ও এ বিষয়ে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলা বিএনপির প্রস্তুতিহীনতার ইঙ্গিত দেয়। তেমনি এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তনের উল্লেখ করে এ বিষয়েও আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে ভিশনে উল্লেখ করা হয়। আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দরকার থাকলে তা না করে তাড়াহুড়া করে ভিশন প্রকাশের যুক্তি কী?
তিন. ভিশনে শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষিত বেকারদের ভাতা দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়। দেশের বেকারদের সংখ্যা নিয়ে পরিসংখ্যানে গরমিল আছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বেকারের সংখ্যা তিন কোটি। ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতক পাস লোকই বেকার। আরেক পরিসংখ্যান বলছে, শিক্ষিত বেকার হচ্ছে দুই কোটি ২০ লাখ। যদি ধরে নিই দুই কোটি বেকার আছে এবং তাদের মাসে দুই হাজার টাকা করে বেকার ভাতা দেওয়া হবে, তাহলে মাসে চার হাজার কোটি টাকা এবং বছরে ৪৮ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এ খাতে এত টাকা জোগান দেওয়া কি সম্ভব?
চার. শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষা খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ ব্যয় করা হবে এবং ডিগ্রিমুখীর পরিবর্তে জীবনমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করতে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হবে বলে ভিশনে স্বপ্ন দেখানো হয়েছে। আমরা আমজনতা এমন স্বপ্নই তো চাই। ২০১৬ সালে আমাদের জিডিপি ছিল ২২১ বিলিয়ন ডলার, যার ৫ শতাংশ হলো ১১.০৫ বিলিয়ন ডলার। প্রশ্ন হচ্ছে, এত বিশাল অর্থ শিক্ষা খাতে ব্যয় করতে হলে অনুৎপাদনশীল খাত যথা জনপ্রশাসন, সামরিক খাতে ব্যয় কর্তন করতে হবে। এটা সম্ভব হবে কি? তদুপরি ভিশনে সামরিক বাহিনীর আরো আধুনিকায়নের কথা উল্লেখ রয়েছে, যা বাজেট কর্তন করে সম্ভব নয়।
পাঁচ. বর্তমান পুলিশ প্রশাসনের কর্মকাণ্ড নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বাংলাদেশ পুলিশকে দলীয় প্রভাবমুক্ত থেকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা হয়েছে রূপকল্পে। ভিশনে উল্লেখ করা হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা হবে এবং পুলিশের ওপর বিচার বিভাগীয় তদারকির মাধ্যমে জবাবদিহি ও কল্যাণমূলক জনপ্রশাসন গড়ে তোলা হবে। পুলিশ প্রশাসন যেকোনো সরকারের জন্য অত্যন্ত লোভনীয় প্রতিষ্ঠান। প্রেমিক-প্রেমিকা, এমনকি স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে ছাড়তে পারে; কিন্তু সরকার-পুলিশ মাখামাখির মহব্বত এক দেহ-এক প্রাণ, যা কোনোভাবেই তালাকযোগ্য নয়। পুলিশ প্রশাসনকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা খুবই চ্যালেঞ্জিং বিষয়। মুখের কথায় সম্ভব নয়। কিভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হবে তার কোনো রূপরেখা রূপকল্পে নেই। কাজেই ভিশনের এ বিষয়টি ওষ্ঠসেবা বৈ আর কিছু নয়। বিচার বিভাগ ফৌজদারি মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে; কিন্তু ভিশনে সাধারণভাবে পুলিশের ওপর বিচার বিভাগীয় তদারকির মাধ্যমে যে জবাবদিহির কথা বলা হয়েছে, তা ক্ষমতার পৃথক্করণ নীতির পরিপন্থী।
ছয়. মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের সঠিক তালিকা করার ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের সঠিক তালিকা করবে বলে ভিশনে উল্লেখ করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যে মূল্যায়ন করা হয়, শহীদদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না দাবি করে বিএনপি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে একটি সঠিক তালিকা প্রণয়ন করবে এবং তাঁদের যথাযথ মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করবে। শহীদদের মূল্যায়ন করতে হলে যাদের কারণে তাঁরা শহীদ হয়েছেন সেই গণহত্যাকারী, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে বিএনপি কী করবে সে বিষয়ে ভিশন ২০৩০-এ কোনো ভিশন নেই।
সাত. রামপাল বিদ্যুেকন্দ্রবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি সমর্থন প্রদান ও সোচ্চার হলেও ভিশনে রামপাল শব্দটা পর্যন্তও নেই।
আমরা ঘুমিয়ে যে স্বপ্ন দেখি, সে জন্য কোনো অর্থ লাগে না, স্বপ্নের কথা কারো কাছে প্রকাশের পর তা বাস্তবায়িত না হলে তার জন্য জবাবদিহি করতে হয় না। অনেক সময় স্বপ্ন অসম্পূর্ণ থাকতেই ঘুম ভেঙে যায়। রাজনৈতিক দলের ভিশন তো ব্যক্তির স্বপ্নের মতো নয়। এতে পূর্ণাঙ্গতা যেমন থাকতে হবে, তেমনি বাস্তবায়নযোগ্যও হতে হবে। বিএনপির ভিশন ২০৩০-এর কিছু ভিশন অসম্পূর্ণ আর কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ ভিশনের মিশন ইমপসিবল বলে প্রতীয়মান হয়। ভিশন ২০৩০-কে আরো আবেদনময়ী করে তুলতে বেশ কিছু সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন দরকার।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.