নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মন্ত্রক

আমি আমার দেশের জন্যে

মন্ত্রক › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিএনপির ২০৩০ এবং অতীত

৩০ শে মে, ২০১৭ সকাল ১১:২৪

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার দলের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য তুলে ধরেছেন। তার এই উদ্যোগ আশাব্যঞ্জক। কেননা এর মাধ্যমে দেশকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপির প্রত্যয় তুলে ধরা হয়েছে। এখানে জটিলতাটা হলো, বিএনপির নেত্রী এবং তার দলের লোকেরা যেটাকে ভবিষ্যতের ঘোষণা বলে মনে করছেন সেখানে খুব সতর্কভাবেই অতীতের নানা বিষয় সূ²ভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় আমাদের মতো মানুষ যারা ধারাবাহিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের আদর্শে বিশ্বাস করে এসেছে, তাদের জন্য অনেক কিছুই ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। এসব দুঃস্বপ্ন এসেছে, আপনারা যদি স্মরণ করতে পারেন, বিএনপি দলটির প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশের প্রথম সামরিক স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। ক্ষমতায় থাকার সময় তার দল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সুমহান আদর্শগুলোর নিষ্ঠুর ব্যবচ্ছেদ করেছে।
তবে এরপরও আমরা অভিযোগ করব না। যদি বিএনপি এখন তাদের অতীতের ভুলগুলো শুধরে নিতে রাজি থাকে তবে আমরা তাদের এ উদ্যোগকে আনন্দচিত্তে স্বাগত জানাব। আমাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় আদর্শগুলোকে সামনে নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি যদি এগিয়ে যেতে চায় তবে তারা অবশ্যই স্বাগত। তবে খালেদা জিয়া তার বক্তব্যে এমন কোনো কিছু বলেননি যা দেখে মনে হয়, তারা জাতির কাছে তাদের অতীতের ভুলগুলো তুলে ধরতে আগ্রহী। তাদের ভেতর কোনো অনুতাপের বিষয়ও চোখে পড়েনি। এটা আসলে একটা উদ্বেগের কারণ। কেউ এমন দাবি করছে না যে, এখন দেশের পরিস্থিতি যা তা খুবই ভালো। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত, এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত আছে। জাতীয় রাজনীতিতে হেফাজতের মতো দলের অনুপ্রবেশ নিয়ে আমরা শঙ্কিত। এ ধরনের ঘটনার একটি ইতিবাচক দিক হলো, রাজনীতিতে এমন মধ্যযুগীয় শক্তির অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে পুরো জাতি সোচ্চার হয়েছে। আমরা সরকারকে চাপে রেখেছি। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতা ব্যবহারের কর্তৃত্বের মতো বিষয়ে অপশক্তিরা যেন প্রভাব বিস্তার করতে না পারে সে নীতির ব্যাপারে আমরা শক্ত অবস্থানে রয়েছি।
আমরা সতর্ক নাগরিক। আর আমাদের এই সতর্কতা বিএনপির ভিশন-২০৩০ সম্পর্কেও রয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাবনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্র বর্তমান রাজনৈতিক দোলাচলে আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিতভাবেই তার মত তুলে ধরতে পারেন। কিন্তু আমরা যদি অতীতের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাব এক করুণ অধ্যায়। কীভাবে বিএনপি আমলে, জেনারেল জিয়া ও খালেদা জিয়ার সময় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং এর প্রতিটি প্রতীককে অবমাননা করা হয়েছে। এখন এটা বিশ্বাস করা খুব শক্ত যে, সেই বিএনপিই এখন আবার আমাদের সংবিধানের মৌলধারা ধর্মনিরেপক্ষতা এবং সমাজতন্ত্রকে সম্মান জানাবে। কয়েক দশক ধরে যে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের’ যে ডঙ্কা বাজিয়েছেন সেখান থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারায় ফিরে আসবে, এটা বিশ্বাস করাটাও শক্ত।
বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ খুবই উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে এবং অযাচিতভাবে আমাদের বাঙালি সমাজকে বিভক্ত করেছে। এর মাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। এই জাতি এবং পুরো উপমহাদেশের জন্য এক বিপর্যয় বয়ে আনা সেই মুসলিম লিগ এবং মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের অন্য রূপ এই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ অস্বীকৃতি আছে এই তথাকথিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মধ্যে। গত শতকের ১৯৬০ ও ৭০- এর দশকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ নির্মাণের যে ইতিহাস রচিত হয়েছিল এর মাধ্যমে তা ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। আমাদের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল একটি অন্ধকার অধ্যায়। সেই অন্ধকারের নাম ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’। এই জাতীয়তাবাদে বঙ্গবন্ধুর কোনো স্থান নেই, মুজিবনগর সরকার সেখানে উপেক্ষিত, বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সেখানে ভূলুণ্ঠিত। ওই কথিত জাতীয়তাবাদ এ দেশের স্থানীয় শত্রুদের (পাকিস্তানি হানাদারদের এ দেশীয় সহযোগীরা) জন্য জাতীয় রাজনীতিতে ফিরে আসার দ্বার খুলে দিয়েছে। আর তারা এটা করেছে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি দলটির হাত ধরে।
এখন বিএনপির চেয়ারপারসন সমাজের সব স্তরের মানুষকে নিয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজ নির্মাণের কথা তুুলে ধরেছেন তার দলের ভিশনে। ঘুরে-ফিরে সেই পুরনো কথাতেই আসতে হয়। আমরা এ দেশের বাঙালিরা ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন করেছি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়েছি। আমাদের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, মধুসূদন, শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক- এরা সবাই বাঙালি। আমাদের গান ও কবিতা বাংলাতে লেখা। এসব কোনো বিষয়ই খালেদা জিয়াকে বোধহয় স্পর্শ করে না। ১৯৭১ সালের আগে আইয়ুব শাহীর আমলে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনায় পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। এর আদল ঠিক বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মতো। এই দুই জাতীয়তাবাদই বাঙালি সংস্কৃতির মূলে কুঠারাঘাতের শামিল।
খালেদা জিয়ার এই ভিশনের মূল কথা এবার পরিষ্কার হওয়া গেছে। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের পক্ষে খন্দকার আব্দুল হামিদ ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের’ নামে আমাদের বিভেদ সৃষ্টিকারী যে জাতীয়তাবাদের উল্লেখ শুরু করেছিলেন, আজ এই ভিশন ২০৩০-এর মাধ্যমে তা আরো এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এই ভিশনের মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের যে কথা দলটি বলেছে, সেটি তাই এক ভ্রান্ত ধারণা বই অন্য কিছু নয়। আমাদের পরের বিবেচ্য বিষয়টি হচ্ছে- একটি উদার গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বিষয়ে বিএনপির ঘোষিত আরেকটি লক্ষ্য, যেখানে সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শেই উদার রাজনৈতিক চর্চা দেখা যায়। সরকারে থাকুক বা বিরোধী দলে, বিএনপি সব সময়ই উদার নৈতিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ১৯৭১ সালের একটি আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় বাধা সৃষ্টি করেছিল বিএনপি। জিয়ার আমলে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন থেকে শুরু করে পাকিস্তানপন্থীদের মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়ার মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সব আদর্শ স্বামীর মতোই লালন করে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা এবং সংসদের মধ্যে একটি ভারসাম্য চান। এটা ভালো। তিনি জাতীয় সংসদের উচ্চ কক্ষের কথা বিবেচনার জন্য বলেছেন। আমাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার এই প্রস্তাবকেও গুরুত্ব সহকারে নেয়া উচিত। সংবিধানে গণভোটের যে বিধান আছে তা প্রয়োগের কথা বলেছেন। তার এই ধারণার সঙ্গেও কেউ পুরোপুরি দ্বিমত পোষণ করতে পারবেন না। সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি সাধারণ নির্বাচনের আহ্বানে আছে প্রকৃত ওয়েস্টমিনিস্টার সরকারের চর্চার প্রতিফলন। সরকারি হিসাব সংক্রান্ত কমিটি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত কমিটি বিরোধী দলের হাতে রাখার প্রস্তাবও প্রশংসনীয়।
তারপরও এমন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র আছে যেখানে খালেদা জিয়া এবং তার দলকে খুব পরিষ্কারভাবে বলতে হবে যে, এসব ক্ষেত্রে অতীতে তারা যে ভুল করেছিলেন সেগুলোর পুনরাবৃত্তি হবে না। বৈদেশিক নীতির বিষয়ে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর শান্তি বিনষ্টের কারণ হবে না বাংলাদেশ। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে এমন সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে আমাদের যে সুখ্যাতি ছিল, বিএনপির অতীত এমন অনেক রেকর্ডই আছে যার ফলে আমাদের সেই খ্যাতি নষ্ট হয়েছে। এটা বাংলাদেশের জন্য সত্যিই খুব দুঃখজনক। বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় বাংলাদেশ উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশে থেকে তারা ওই অঞ্চলে গিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। খালেদা জিয়া বলেছেন, কোনো বিদেশি রাষ্ট্রকে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে বা দেশে সমস্যা সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না। তার এই বক্তব্য আমাদের স্বস্তি দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি এবং তার জোট সঙ্গীদের সহায়তায় অতীতে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বাংলাদেশে তৎপরতা চালিয়েছে সে সন্দেহ রয়েই যায়।
বিএনপির চেয়ারপারসন সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদ দৃঢ়ভাবে মোকাবেলায় তার শক্ত অবস্থানের কথা তুলে ধরেছেন। তার এই ওপর আস্থা রাখা যেত যদি তারা ২০০৪ এবং ২০০৫ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশে সংঘটিত ভয়াবহ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কথা স্বীকার কিংবা এতে জড়িতদের বিচারের ক্ষেত্রে অক্ষমতা এবং অনিচ্ছার জন্য অনুশোচনা করতেন। বিএনপির এই ভিশন ২০৩০ একটি দৃষ্টিভঙ্গিতে অবশ্যই প্রশংসনীয়। এখানে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডের একটি ইঙ্গিত আছে। অতীতে ক্ষমতায় ছিল এবং ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসতে চায় এমন একটি দলের জন্য এটি খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের ভবিষ্যতের এসব ভাবনা আরো গ্রহণযোগ্য হবে যখন বিএনপির নেত্রী জাতির কাছে কিছু বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যা তুলে ধরবেন। তিনি কি ব্যাখ্যা করবেন তার এবং তার স্বামীর সরকারের আমলে কেন কুখ্যাত ইমডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, কেন বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের বিচার না করে বরং তাদের বিদেশে বাংলাদেশের ক‚টনীতিক হিসেবে পাঠানো হয়েছিল, জামায়াতে ইসলামীকে অবাধে রাজনীতি করতে দিয়ে জাতিকে কেন বিমূঢ় করা হলো আর কেনই বা ক্ষমতাসীনদের প্রণোদনায় চলা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি দেশকে দীর্ঘ সময় ধরে গ্রাস করেছিল।
খালেদা জিয়া এবং তার দলের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার ক্ষেত্রে ভিশন ২০৩০ একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু সত্যিই যদি তারা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে চান, তারা যদি সত্যিকারের একটি উদার গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ করতে চান তবে তাদের আরো বেশি কিছু করতে হবে। এ জন্য তাদের তীক্ষè অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে এবং নীতির পুনর্বিবেচনা ও এ ক্ষেত্রে নতুন ধারণা সৃষ্টি করে বহুদূর এগোতে হবে। লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে এসব বিষয় তাদের আমলে নেয়া জরুরি।
সৈয়দ বদরুল আহসান : দ্য এশিয়ান এজ পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.