নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
উৎপল কুমার বসুর কবিতাকে আমি গান বলি— তবে তার গান বাণী প্রধান নয়, সুর প্রধান। তার কবিতা জল-তরঙ্গের সুরলহরি। কখন কোন প্রাগগৈতিহাসিক যুগে মানবাত্মার বিরহ মিলনের যে অবিনশ্বর গান শুরু হয়েছিল; উৎপল তার হৃদয় বীণায় সেই গানের সুর বাজাতে চেষ্টা করেছেন।
লক্ষ কোটি বছর ধরে মানবের যে যাত্রা, যা অতীত থেকে আরো অতীত হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানের মানুষ কেবল সেই বীণার সুর ছড়িয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে। অতীত থেকে ভেসে আসছে সেই সুরের মহাতরঙ্গ। কানপাতলেই আমরা শুনতে পারি একটি সুরের মহাতরঙ্গ কিভাবে আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
এলিয়ট বলতেন ‘সঙ্গীতের মতোই কবিতাতেও থিমের পুনরাবৃত্ত ব্যবহার স্বাভাবিক। বিভিন্ন দলের বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে একটি থিমের বিকাশ ঘটে এবং তা কিছুটা তুলনীয় কাব্যের সম্ভাবনার সঙ্গে— কবিতাতেও রয়েছে পরিবর্তনের সম্ভাবনা এবং তা সিম্ফনি বা কোয়াটার্টের বিভিন্ন মুভমেন্টের সঙ্গে তুলনীয়— বিষয়বস্তুর বৈপরীত্যময় সজ্জারও রয়েছে সম্ভাবনা।’ উৎপল কাব্যে সেই সুরের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছেন। কবি সম্বন্ধে যে সহজাত শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে উৎপলের কাব্যেও সুরের বিকাশ ঘটেছে সেই সহজাত ভঙ্গিতে। সঙ্গীতের বাইরেও একটি নৃত্যের ভঙ্গি রয়েছে উৎপলের কবিতায়। আমাদের অলক্ষে বিশ্বভ্রমা— যে নৃত্যের তালে আন্দোলিত হচ্ছে তিনি তার ছন্দ আয়ত্তের চেষ্টা করেছেন।
রাত্রির জোয়ারে লেগে নুয়ে পড়ে সৈকততৃণ
এখন রেখেছি মদ নৃত্যপর মদের গেলাসে
উঠেছি নক্ষত্রহীন গম্বুজে ও সমুদ্রবাতাসে
দূর হতে দেখা যায় অপসর হেমন্তের দিনও
উৎপলের কবিতা স্যুররিয়ালিস্টিক নয় তবু কোথায় যেন অর্থের দুর্বোধ্যতা তাড়া করে। হয়তো পরিণামে অর্থও থাকে না। তবে ভালোলাগা থাকে পুরোটাই। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে ভাষার নবঅর্জিত শক্তির সংগঠন, যুক্তিবাদের বিসর্জন, আবেগের সমর্থন, মানুষের বহিরাঙ্গ অপেক্ষা অর্থাৎ তার মন-রহস্যকে গুরুত্বারোপ ছিল সুররিয়োলিজমের মুখ্য উদ্দেশ্য। সে দিক বিবেচনায় উৎপল বসুর কতিতাতেও অপার রহস্যময়তার প্রকাশ ঘটেছে। এ সময়টিই ছিল উৎপল বসুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। জীবনের অসারতা, অর্থহীনতা ও আশাহীনতা তার কাছে অর্থময় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আপাত অর্থহীনতায় হয়ে উঠেছিল তার সমকাল। যদিও সেই সত্য আজ অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত; অনেক বেশি অর্থহীন। এত সব কিছুর পরেও উৎপল বসু রোমান্টিক মনস্বকতা এড়াতে পারেন না। তার কবিসত্তার মধ্যে চতুর তস্করের মতো লুকিয়ে থাকে অলীক স্বপ্নচারী প্রবল পুরুষ। রহস্যময় জগতে যার অধিষ্ঠান। বিশ্ব পরিম-লের জ্ঞাত এবং অজ্ঞাত মানব এবং মানবেতর সব কিছু নিয়েই উৎপল বসু একক হয়ে ওঠেন। উৎপল বসুর কবিতায় একক সমকাল ও বস্তুনিচয় অনুপস্থিত।
আসলে মৃত্যুও নয় প্রাকৃতিক দৈব অনুরোধ।
যাদের সঙ্কেতে আমি যথাযথ সব কাজ ফেলে
যাবো দূর শূন্যপথে— তারা কেমন বান্ধব বলো
কিংবা
যেখানে সুদীর্ঘ রাত ওড়ে নীল গন্ধের রুমালে
যেখানে জলের মতো পরিসর অফুন্ত বায়ু
ধুয়ে দেয় বনস্থলী, বালুতট— দীর্ণ হাহাকার
উৎপল বসুর কবিতায় একক পুরুষলিঙ্গতা আমাদের স্পর্শ করে না। নারী ও পুরুষের সামষ্টিক চেতনার সমন্বয়ে ‘আমি’ ও ‘তুমি’ হয়ে ওঠে পরমপুরুষ। যে পুরুষ বসে থাকে অনন্ত রূপ নগরে। সেই নগরের দিকে উৎপলের যাত্রার অকুতি। রূপনগরের ধূলোয় সবার নাম লেখা আছে। অবশ্য তার রূপনগরের অবস্থান আকাশ কিংবা ধূলায় নয় মহাকালের সীমানায়। বস্তুগত সত্যতা তার কবিতায় অনুপস্থিত হলেও রয়েছে অতিসত্যের পটভূমি। তবে বাস্তবতার আঘাতে তার স্বপ্নচারিতা ভেঙে খান-খান হয়ে যায়।
হে সত্তা হেমন্তলীন, পাতার ঔরসে
নির্বেদ শূন্যতায় ঝরে যাওয়া ত্যক্ত বিপুলতা,
পাটল খড়ের স্তূপ, অপরাহ্ন হতে টানা মেদুর কম্বল,
হে সত্তা, কুয়াশালীন, খিন্ন প্রাণীর মর্মে পৌঁছে দাও ভাষা—
উদ্বেল আখের বনে, বার্লিক্ষেতে, যবের কিনারে,
তরঙ্গশাসিত তটে, কাপ্তানের বাইনোকুলারে,
শত্রুজাহাজে, পণ্যে, অন্ধকারে গুপ্ত আর্মাডায়
হে সূর্য আলোবিন্দু, একই সঙ্গে প্রসারিত করো
তোমার জ্যোতির থাবা— ক্ষুধা ও চম্বুন।
উৎপল বসু কবিতার টোটালিটিকে মেনে চলেন না। সামপ্্রতিক বাংলা পোস্ট-মর্ডান কবিতার চরিত্র বিবেচনায় উৎপলের মধ্যে রয়েছে সর্বাগ্রে সর্বাধিক বৈশিষ্ট্যসমূহ। উৎপলের কবিতা ক্লোজ এন্ডেড নয়— ওপেন এন্ডেড। যে কোথাও থেকে তার কবিতা শুরু হতে পারে, যে কোথাও হতে পারে তার পরিসমাপ্তি। যে কারণে তার কবিতা নামের পাশাপাশি গাণিতিক সিরিয়ালে প্রকাশিত হয়েছে বেশি।
উৎপলের কবিতার কোনো একটি চরণ কিংবা চরণ সমষ্টি আলাদা করে দেখা যায় না। তার সব বাক্য এবং সব চরণ হয়ে উঠে কবিতা। সম্পূর্ণতর কবিতা। এই কারণে যে তিনি যা লেখেন তা কখনো গদ্যে লেখা সম্ভব নয়। ছন্দের দাস না হয়েও তিনি এমন এক কৌশল প্রয়োগ করেছেন যেখানে সবটায় হয়ে উঠেছে কবিতা।
তোমাদের বাড়ি বড় দূরে। তারই আগে বহু বাদুড়ের
বিধ্বস্ত ফলের দেশ পার হয়ে এনেছি খবর
কোনোখানে, কোনো রাজ্যে এত শস্য হয়েছে পরের
কেবলই ঈর্ষা হলো, সন্দেহ, রগড়—
উৎপল পাঠককে সহজেই নিয়ে যেতে পারেন সত্তার গভীরে। অন্তঃপ্রকৃতি এবং বহির্বিশ্বের বিভিন্ন উপাদান নিয়ে তার কাব্য জগৎ নির্মিত হয়েছে। জীবনের সব জটিল বিক্ষোভ, কষ্ট ও সংবেদনা তার কবিতায় স্থিত ও স্মিত ভাষা পেয়েছে। জীবনের পরম নিস্পৃহতা ও পরম দ্রষ্টব্য তার কবিতায় ধরা পড়েছে। তার কবিতার ভেতরে ভেতরে ঢুকে পড়েছে স্বদেশ চেতনা ও প্রকৃতি চেতনা।
উৎপলের কবিতা কখনো বস্তুগত সত্যের পারম্পার্য গ্রন্থিত করা যায় না। তার কবিতার সত্য লুকিয়ে থাকে আরো গভীর গভীরতর রহস্যময় চৈতন্যে।
উৎপলের কবিতায় সঙ্গীত, চিত্রকল্প ও শব্দ প্রয়োগের কুশলতা ধরা পড়েছে। উৎপলকে দুর্বোধ্য না বলে পরিশ্রমী ও বুদ্ধিদীপ্ত বলা শ্রেয়। তিনি কথা বলেন খুব পরিচিত শব্দে কিন্তু অপরিচিত ভাষায়।
উৎপলের কবিতায় আপাত অর্থহীনতার মধ্যেও রয়েছে দেশকাল ও মহাকালের ইতিহাস; মূলত জীবনানন্দ দাশ যাকে বলতেন ‘মহাকালের সময় চেতনা।’ মানুষের বেঁচে থাকা পুনর্জন্মবাদ ও সমকালের কাহিনীর বিস্তার ও বিকাশ তার কবিতায় ধরা পড়েছে।
উৎপলের কবিতা উঠে এসেছে বেদনার মুদ্রা ও গভীর গভীরতর অনুভূতি। যে কারণে তার কবিতা হয়ে উঠেছে প্রবল ইতিহাস চেতনা। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’র উৎসর্গ পত্রেই লিখেছেন—
পাবে আমাকেও। বাদার জঙ্গলে
এক পতুর্গিজ অশ্বতর তোমাকে দেখাবে
আমি ও হেঁতাল কাটা ও-পশুর মাংসে বিঁধে আছি।
লৌহকণার গান শুনে যাও। শ্বেতকণিকার ক্ষিপ্ত নৃশংসতা শোনো।
বিষ— যা চোখ নেই, বৃদ্ধি আছে, খসে পড়া আছে,
নেই ত্বক, শুধু ঝুলন্ত প্রদর আছে, পুঁজ আছে,
—একে নমস্কার করো।
কিংবা নীলকুঠি কবিতায়
জামের বনের মধ্যে আমি এক চিরস্মরণীয়
বাঘের হলুদ ছোপে সাথীহারা সন্তান বাঘের
ঘোরাফেরা দেখি পুরনো জামের বনে আমি শুধু মানুষের
শোভাযাত্রা দেখেছি শৈশবে। সে সব জামের বন আর আর উপদ্রবহীন নয়।
তবে অর্থের দিক দিয়ে জীবনানন্দের চেয়ে বিষ্ণু-দের সঙ্গে উৎপলে মানস-সাজুয্য বেশি। আপাত অর্থহীনতা মূলত আমাদের উপলব্ধিজাত সমস্যা। তার চেতনাসমূহ যেভাবে ধরা দেয় তা সমন্বিত হতে হয়তো আমাদের কাছে সময় নিয়ে থাকবে। তবে একজন পরিশ্রমি পাঠক একদিন উৎপলের কবিতা আবিষ্কার করতে পারবেন। এ কথাও ঠিক আবিষ্কারের নয়, অনুভবের। তাছাড়া আগেই বলা হয়েছে উৎপলের কবিতা বাণী নয় সুর প্রধান। বাণীর মাহাত্ম্য আমাদের কাছে ধরা না দিলেও সুরের আনন্দ আমাদের বঞ্চিত করে না। তবে বিষ্ণু দে-র যাত্রা ছিল নিঃসঙ্গ হৃদয় থেকে জনসমুদ্রে আর উৎপল জনসমুদ্র থেকে নিঃসঙ্গ হৃদয়ের দিকে।
জীবনানন্দ দাশ যে গভীর কবিতা রচনার সূচনা করেছিলেন পঞ্চাশ ও তার পরবর্তীকালের প্রধান কবিরা কখনো প্রত্যক্ষ এবং কখনো পরোক্ষভাবে সে পথ মাড়িয়ে গেছেন। এমনকি শক্তি, বিনয়, শামসুর রাহমান থেকে শুরু করে আজকের জয় পর্যন্ত সে পথে হেঁটে গেছে প্রত্যক্ষ বিক্রমে। কিন্তু উৎপলের যাত্রা অনেক বেশি গোপন লুকানো। উৎপল বসুর কবিতায় আছে একই সঙ্গে বিমুগ্ধ ও হতবুদ্ধি করার ক্ষমতা।
শঙ্খ ঘোষ অবশ্য উৎপল বসু’র বাণীহীনতাকে সন্দেহের চোখে দেখেছেন, ‘কিছু না বলা উদ্ভাসের কিছু উদাহরণ আছে হয়তো শক্তির কবিতায়, আর উৎপলের পুরী সিরিজে। কিন্তু এই উদ্ভাস নিয়ে যে খুব বেশি দিন থাকা যায়, মন তা মানতে চায় না। এ রকম ভাবনার পিছনে কি কাজ করে মালার্মের কোনো ইঙ্গত? মালার্মের শুদ্ধতম কবিতায় কবিকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে বক্তার আসন থেকে..’
লোরকার কবিতায় যে ভাবে আন্দালুশিয়ার ঘন সবুজ বনানী প্রকৃতি ও জীবনের সরল বিস্তার ঘটেছিল। তেমনি উৎপলের কবিতায় :
নির্জন বালির বুকে পড়ে থাকা নৌকাগুলি তোমাদের জানে
তাদের ছায়ায় বসে গান করো সারাদিন হৃদয়পণ্যের
কখনো নেমেছে ঢেউ-এ, নীলিমায় ম্লানে,
উঠেছে শীর্ণ ধোঁয়া তোমাদের দারিদ্র্যঅন্নের।
উৎপলের কবিতায় বিষয়হীনতা একটি বিষয়-শৈলি নির্মাণ করেছে। কিন্তু সেই বিষয় পরিচয় প্রজ্ঞাপনের আগেই অপর কোনো বিষয় তাকে খণ্ডিত করে দেয়। এ দিক দিয়ে বাংলা কবিতা ক্ষেত্রে উৎপল একা এবং একক। উত্তর কিংবা সমকালে তিনি কারো কাব্য ক্ষেত্রে প্রবেশ করেননি কিংবা এখন পর্যন্ত কেউ তাঁর স্বাতন্ত্র্য ছুঁতে পারেনি। তার মৃত্যু তার কবিতাকে খুব দ্রুত মুছে দিতে পারবে বলে মনে হয় না।
Utpal Basu
জন্ম : ৩ আগস্ট ১৯৩৯ । মৃত্যু : ৩ অক্টোবর ২০১৫
©somewhere in net ltd.
১| ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:০৫
বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: অনেক গভীর আর বিশ্লেষনাত্বক লেখা। আপাতত চোখ বুলিয়ে গেলাম!