নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মরে গেলে মেঘ হতো যমুনার জল...

ঘরেও নহে পারেও নহে,যে জন আছে মাঝখানে...............

আব্দুল্লাহ আল মুক্তািদর

'If Stavrogin believes,he does not think he believes. If he does not believe ,he does not think he does not believe.'-The Possesed

আব্দুল্লাহ আল মুক্তািদর › বিস্তারিত পোস্টঃ

কেবল সাদায় আর কালোয় দারুণ রঙিন দীপাবলি

১৩ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ৮:৩২



কোন একটা অঞ্চলের ভাষাও হতে পারে সার্বজনীন। কোন একজন নির্দিষ্ট মানুষের গল্পও হতে পারে হাজার জনের। স্বপ্ন দেখার মতোন অতি মানবিক, আবহমান একটা ব্যাপারকে 'রোশনাই বিউটি পার্লার' গল্পের অংশ হিসেবে যেমন অনন্য মনে হয়, একজন বঞ্চিতের চির-আকাঙ্ক্ষার একান্ত প্রকাশ বলে মনে হয়; একই সাথে এই স্বপ্ন, আঞ্চলিকতা আর নিজের জীবনের গল্প বলা একক চরিত্রটিকে সহজেই নিয়ে যাওয়া যায় সমস্ত নির্দিষ্টতার বাইরে। যেখানে একজন সবাই হয়ে ওঠে, সবাইমিলে গড়ে ওঠে একজন।দীপাবলি নামের উম্মে ফারহানার বইয়ে গল্পের সংখ্যা বারো। এর মধ্যে 'রোশনাই বিউটি পার্লার' আর 'ময়নার মা' শুরু থেকে শেষ ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা। কিন্তু আঞ্চলিক ভাষা বলতেই, আমরা যে ধরণের সীমাবদ্ধতা বুঝি, এই গল্পগুলিতে তা পাওয়া যাবে না। বরং একধরণের সাবলীল প্রকাশ, গল্পগুলোকে উদার করেছে। একজনের মনের ভাষায় হাজার মনের কথার মতোন।
'এহকদিন ঘুম পাতলা অইয়া গেলে বুঝবার পারি, এইডা স্বপ্ন, ট্যার পাই যে আমি আসলে ঘুমাইতেছিলাম, কিন্তু স্বপ্নডা ভাঙ্গে না। আমি চোখ মুইঞ্জা দ্যাখতেই থাহি, দ্যাখতেই থাহি।'
………………………………………………………………………………………………………………
উম্মে ফারহানা রচিত গল্পগ্রন্হ দীপাবলি । প্রচ্ছদ: কাজী রুবায়েত ইসলাম। প্রকাশক: জাহদিুল হক চৌধুরী রাজীব, চৈতন্য প্রকাশন, সিলেট । ফেব্রুয়ারি ২০১৬। ৮৮ পৃষ্ঠা । ১৬০ টাকা ।
………………………………………………………………………………………………………………
অন্য গল্পগুলোর মধ্যে আলাদা হয়ে ফুটে আছে 'লক্সলি হল'। শুরু থেকে শেষ এমন এক বুনটে গাঁথা, যার কোন অন্যথা হতে পারত না। যেভাবে, যেই শব্দে, যেই বাক্য-অভিব্যক্তিতে গল্পটি এগিয়েছে, এর অন্যরকম কিছু হলে গল্পটি যেন ঠিক দাঁড়াত না। গল্পে সচরাচর আমাদের যে শব্দগুলোকে পরিত্যাজ্য মনে হয় সেই শব্দ এসেছে অতি সহজ ভঙ্গি নিয়ে। ইংরেজি ভাষার শব্দ এসেছে বহুবার অথচ একবারও আরোপিত মনে হয় নাই। প্রধান কথক তার সমস্ত গোপনকে প্রকাশ করেছে এতো অবলীলায় যে গল্পটি যখন শেষ হয়, তথাকথিত গোপন শব্দগুলোকে আর গোপন মনে হয় না।
'এখন আমার প্যান্টি আর চোখ দুইই ভেজা। আর মাথায় ঘুরছে লক্সলি হলের ওপর না দেওয়া লেকচারের শুরুর কথাটা, 'ইট'স অল আবাউট আনরিকুইটেড লাভ''
'মেজোখালা' গল্পের মেজোখালার মতোন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র উপস্হিত অতি ক্ষুদ্র সময়ের জন্যে। বিধবা এই নারী স্বপ্নে দেখলেন তাঁর মৃত স্বামী আবার বিয়ে করেছে। একটা অতি ঘরোয়া বাস্তব গল্পও মাত্র খানিকক্ষণের জন্যে অতি/অধি-বাস্তব হয়ে ওঠে। সত্য মৃত্যুকে যেন মেজোখালা বিশ্বাস করতে পারছেন না। স্বপ্নকে সত্যির চেয়ে অতি সত্যি ভেবে হাইমাউ করে কাঁদছেন। আবার 'বান্ধবী' গল্পটি আদতে চেতনাপ্রবাহের মতো। একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ার মন, শরীর, ক্যাম্পাসজীবন, প্রেম ঘিরে লেখা। ক্যাম্পাসমুখী এক বাসযাত্রায় গল্পের শুরু। বাস ক্যাম্পাসে এসে পৌঁছুলে এর শেষ। এর মাঝে মনে পড়ে এলেমেলো স্মৃতি, ছড়ানো ছিটানো বাস্তব জীবন। আর গল্পের একটা সামান্য উক্তি পরম অসামান্যতায় সুন্দরের চিরাচরিত ধারণা থেকে বের করে আনে। 'সভ্য', 'সুন্দরে'র অন্য রূপ, অন্য মানবিক অনুভূতি।
'আমি ওকে বলতে পারলাম না যে ওর ব্রণওয়ালা মুখ, উঁচু দাঁত, ছোট স্তনের বুকই আমার অনেক ভালো লাগে।'
'রংবাজ' নামের গল্প এক তরুণের গল্প। ভাদ্র মাসের আকাশ মাথায় নিয়ে মফস্বলের পথ ধরে হেঁটে চলে সে। 'রংবিতান' নামে শহরে সবচেয়ে নামকরা রঙের দোকান তার বাবার। আমরা একে একে তার গল্প খুঁজে পাই। মায়ের আদরের গল্প, বাবার পরকীয়ার গল্প, তার ধীরে ধীরে রংবাজ হয়ে ওঠার গল্প। একটা মেয়ে ভুল রং ফেরত দিতে আসে তার দোকানে, তাকে খানিক ভালো লাগার গল্প। টাকা ধার নিতে আসা বন্ধুর গল্প। বাবার অতি পরিচিত বেশ্যাখানায় ঢুঁ মারার গল্প।
' কি যে সব সারাক্ষণ গিজগিজ করতে থাকে মাথার মধ্যে- রেখা, প্যাটার্ন, রং, রঙের শেড- ঘুলিয়ে যাওয়া, মিলেমিশে যাওয়া, পালটে যাওয়া, আবছায়া রঙের আলোআঁধারি- চোখের পাপড়িতেও যে রং থাকে আর নখের আকৃতিতেও থাকে বিভিন্নতা- কখনোই জানা ছিল না তার। কি-ই বা সে জানে জগতে? দেলুদেরকে দেড়গজ দূরত্বে অনুসরণ করতে করতে হঠাৎই তার মনে পরে যায় বাবার কথা- স্কুলের প্রথমদিন, জীবনেও প্রথম ও শেষবারের মতন কঠিন মার খেয়েছিল সে- “আইজ তর রংবাজি আমি ছুডায়াম”।'
রঙের খেলা, রঙের ঘোর, রংময় মলিন জীবন। মাত্র আঠারো বছরের অথচ অতি ভারী রঙেভেজা পরিস্রান্ত জীবন নিয়ে সে ঘোর বিকেলে, আকাশের দিকে না তাকিয়ে হেঁটে চলে যায়। মন-মলিন হেঁটে জীবনে প্রথমবারের মতোন 'লালরঙের পৃথিবীতে' প্রবেশ করে। রং আসলে সবসময় রঙিন হয় না। আমরা জানতে পারি রুবেল নামের তরুণটি রংবাজ হয়ে সমস্ত রং আসলে ভুলে যায়। তার সাদামাটা, গভীর, রঙহীন পরিচয় আমাদের জন্য ফেলে রেখে সাদাকালো অক্ষরে ভেসে চলে যায়-
'লতিফা বেগমের রোগাভোগা ছেলে রুবেল।
রংবিতানের মালিক রশীদ মিয়ার বড় ছেলে রুবেল।'
এইভাবে অতি সার্থক ভঙ্গিতে শেষ হয় রুবেলের গল্প। কিন্তু 'ময়নার মা' আর 'বাইরের আলো' গল্প দু'টির শেষ নিয়ে ভাবার প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয়। নামগল্পটির ক্ষেত্রে ইংরেজি তাত্ত্বিক শব্দগুলোকে সাবলীল মনে হয়নি। '২০৩ গল্পটি চমৎকার ভাবে শেষ হলেও, ভিতরের বুনট অতোটা শক্ত মনে হয়নি।
গল্পকারের কাছে আশা বা হতাশার কথা বলা অন্যায়। ভালো গল্পের দায়বদ্ধতা অন্য জায়গায়। মানুষকে আকাঙ্ক্ষিত গল্প শোনানো বা অনাকাঙ্ক্ষিত বা নতুনকিছু দিয়ে চমক দেওয়ার চেয়েও আমি বিশ্বাস করি গল্পের ছবি বা চরিত্রকে নানা ভাবে আবিষ্কার করতে পারাটা জরুরী। যাপিত, নিত্য জীবন হোক বা অযাপিত স্বপ্ন বা জাদুর জগত হোক --- একজন সফল গল্পকার গল্পকে যখন তুলে ধরেন তিনি ছবি আর চরিত্রকে সব থেকে বেশি ভালোবাসেন। লেখক, পাঠক দুইই মৃত। কেবল বেঁচে থাকে কথার পরে কথা, অজস্র অফুরান ছবি আর নানা ধরণের চরিত্র।
মৃত গল্পকার আর মৃত পাঠক এই সমস্ত কিছু চোখ ভরে দেখে, ভালেবাসে , ঘৃণা করে, আবেগ-অনুভূতি রাগ-হাসি জানায়। ছবিগুলো তবু এতো অবিকল অমলিন থেকে যায়, চরিত্রগুলো তবু বদলায় না। 'লক্সলি হলে'র মনভোলা শিক্ষক, 'রংবাজে'র উন্মাতাল সব রং, সাগরের ঢেউয়ে ভেসে জ্বলে থাকা 'রোশনাই বিউটি পার্লার'- এই সমস্ত খুব বাস্তব কল্পনাকে বদলানোর সাধ্য আর উম্মে ফারহানার নাই।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.