নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মরে গেলে মেঘ হতো যমুনার জল...

ঘরেও নহে পারেও নহে,যে জন আছে মাঝখানে...............

আব্দুল্লাহ আল মুক্তািদর

'If Stavrogin believes,he does not think he believes. If he does not believe ,he does not think he does not believe.'-The Possesed

আব্দুল্লাহ আল মুক্তািদর › বিস্তারিত পোস্টঃ

কবি: চির অচেনা আত্মপ্রতিকৃতি

১২ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১১:৫৯



'কর্মেই তোমার অধিকার, কর্মফলে কখনও তোমার অধিকার নাই| '

এই শহরে এখন বহু মানুষ একলা বাস করে। বারান্দায় বসে তারা ভাঙা ভাঙা আকাশ দেখে। কাজে বাইরে যায়। আর বাকি সময়টা সঙ্গীহীন ঘরজুড়ে পড়ে থাকে। এই একলা থাকায় না আছে সুখ না আছে হতাশা। তবে এদের মাঝেই একজন আছে যাঁর একলা জীবনজুড়ে সীমাহীন আনন্দ আর দীর্ঘ বিষাদ একঘরে, একসাথে বাস করে। তিনিই হয়তো বর্তমানে জগতের সবচেয়ে সফল একাকিত্বের দাবিদার। আর তাঁর নিজের মতে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যর্থ কবি।

তখন বয়স বিশ। দুই হাজার দশ সাল।

প্রথম কবিতা ছাপার সুখ নিয়ে কবি ছুটলেন সমুদ্রের পানে। রাজধানী থেকে হাজার মাইল দূরে নীল-সুনীল অনন্ত জলের সাগর। তার ওপার নাই। নদীর মতোন মায়া নাই, আবেগ নাই । কেবল আকাশের সাথে পাল্লা দিয়ে অখণ্ড জলরাশি নিদারুণ দাঁড়িয়ে আছে। যেন প্রথম কবিতা ছাপা হওয়ার মতোন আনন্দ অতি তুচ্ছ। কবির মন খারাপ হয়ে গেল। তখন তো আর চিঠির যুগ নাই। অন্তর্জালের রমরমা যুগ। মানুষ আর কাউকে কখনও চিঠি লিখে না। কবির হঠাৎ প্রথম প্রেমের প্রথম চিঠির প্রতিটা অক্ষর মনে পড়ে গেল। প্রেমিক কিশোর মন হারানো দশক থেকে ফিরে এসে ঘাড়ে চাপল ভূতের মতোন। এক তীব্র আবেগ সশব্দ সমুদ্র আরও উত্তাল করে বইতে লাগল। চিঠি তাঁকে লিখতেই হবে।

সকালে সমুদ্র পাড়ের প্রায় লোকহীন পোস্টাফিসে গিয়ে ডজনকয়েক খাম কিনলেন। হলুদ রঙের খামগুলো নিয়ে হোটেলের কক্ষে ফেরার খানিক পরেই লিখে ফেললেন এক দীর্ঘ চিঠি। কিন্তু কাকে উদ্দেশ করে পোস্ট করবেন খুঁজে পেলেন না। তবু নিজের ঠিকানা প্রেরকের ঘরে লিখে অজানা প্রাপকের চিঠিটা খামে ভরে রাখলেন সযত্নে। প্রতিদিন লিখতে থাকলেন এভাবে। রাজধানীতে ফিরে আরও দীর্ঘ দীর্ঘ চিঠি লিখে গোপনে তুলে রাখলেন। চিঠি লেখার নেশা এমন হয় তা তিনি আগে কোনদিন জানতেন না।

আটদিনের দিন, ভরা সন্ধ্যায় আবার টেবিলে বসলেন। হাতে কলম। ডাইরি-ছেঁড়া কাগজ সামনে। হঠাৎ চোখ পড়ল একটা আসমানি রঙের খামের উপর। অতি মনোহর অক্ষরে তাঁর নিজের নাম ঠিকানা লেখা আছে তার গায়ে। তারিখ আছে। পোস্টাফিসের সিল আছে। কিন্তু প্রেরকের কোন নাম-উদ্দেশ নাই। সিল থেকে ঠিকানা উদ্ধারের চেষ্টা করেও ভীষণ ব্যর্থ হলেন। লিখতে যাওয়া প্রতিদিনের চিঠি ভুলে, কবি এই নাম পরিচয়হীন পত্র খুলে মেলে ধরলেন নিজের অবাক-নির্বাক চক্ষুজোড়ার সামনে।

'কবি,
তোমার সাত সাতটা চিঠি আমি পড়েছি এই সপ্তাহ ধরে। তুমি মন প্রাণ খুলে লিখেছ।খুবই সুখপাঠ্য। তবু তোমার উচ্ছ্বাস আর উদ্বেগ দুইই আমার কাছে অবান্তর লেগেছে। কবিতা নিয়ে আনন্দ বা আক্ষেপ কোনটারই অধিকার তোমার বা তোমাদের নেই। বড় অস্পষ্ট এক সময়ে তুমি জন্মেছ। বড় ঘোলা এক দশকের শুরুতে তুমি কবিতা-পথে যাত্রা করেছ। আগামী দশটি বছর তুমি লিখবে। তোমার সাথে লিখবে কম-বেশি তোমার বয়েসী আরও সহস্র কবি। আরেকটি নতুন দশক শুরু হলেই সবাই দু'টি ধারায় ভাগ হয়ে যাবে। অথবা তোমরা বিভক্ত হয়েই আছ। তুমি কোন দলে পড়বে আমি জানাতে চাইনা। কারণ হয় তোমার দম্ভ বাড়বে নয় হতাশা।'

সাতদিন পর আরেকটা চিঠি

'কবি,
গত সাত চিঠিতে কেবল একটি প্রশ্নই ঘুরেফিরে করে গেছ। দু'টি দল বলতে আমি কী বুঝিয়েছি তা না জানলেই কি নয়? তুমি কোন দলের জানতে চেওনা। কবিরা ভবিষ্যতদ্রষ্টা এই ধারণা বরাবার ভুল ছিল। বরং যারা স্বার্থপরের মতোন জীবনভর আপন আগামীর খোঁজ করে যায়, তাদের আগামী কখনও আর আসেনা।'

তবু কবি নিজের ভবিষ্যত জানার জন্যে দিন দিন আরও বেশি ব্যকুল হয়ে উঠলেন। প্রতিটি সন্ধ্যায় দীর্ঘ দীর্ঘ চিঠি লিখে যাচ্ছেন। নামহীন ঠিকানায়।

'কবি,
এই দশকের কবি তোমরা । কিন্তু সময় তো তোমাদের ধরে রাখতে চায় না। সে ছেড়ে চলে যায়। এই দশক চলে যাবে দূরে, শুন্যতায়। আরেক নতুন যুগ আসবে নতুন মাস, দিন, বছর নিয়ে। তোমাদের সকলেই সেই নতুন দশক, যুগের কাছে আশ্রয় খুঁজে যাবে। সবাই পাবে না। যারা পাবে তুমি তাদের দলের হতে পারো নয়তো যারা পাবে না তাদের দলের। এর বেশি জানতে চেও না।'


কবির বয়স বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে চিঠির স্তূপ। ঘরের মেঝে থেকে ছাদ- জমতে থাকে প্রতিদিনের আবেগ আর জিজ্ঞাসা ভরা পত্র আর পত্র। প্রাপকের ঠিকানাহীন। স্ট্যাম্প নাই , পোস্টাফিসেও পৌঁছায় না তবু উত্তরের প্রত্যাশা গাঢ় থেকে গাঢ় হয় প্রতি রাতে। সারাদিন এ গলি ও গলি ঘুরে রাতজুড়ে কেবল পত্র লেখা আর উত্তরের সীমাহীন ধৈর্যময় প্রতীক্ষা।

এবং এই শহরের সবচেয়ে একলা মানুষ তিনি। হয়তো দুনিয়ায় সবচেয়ে সফল একাকীত্বের দাবিদার।।


মাঝবয়েসী কবি হঠাৎ একদিন শহর ছেড়ে ছুটলেন পাহাড় আর সমুদ্রে । দিন -মাস গত হলে, এতদিন এক মহাপূর্ণিমায় কবির মরে যাবার সাধ হল খুব। তিনি হয়তো মরেও গেলেন। সমস্ত সন্ধ্যা সেদিন তিনি গান গেয়ে কাটালেন। পাহাড় ছুঁয়ে হাঁটলেন খানিকক্ষণ। সামনে সমুদ্র, পিছনে পাহাড়। নিজেকে সবচেয়ে তুচ্ছ মনে হল। নিজের মৃত্যুকে মনে হল তাঁর চেয়েও তুচ্ছ। রাতের মধ্যেখানে তিনি ঘুমহীন চোখ মেলে আকাশ দেখলেন। দেখতে লাগলেন। তাঁর নিজের লেখা সমস্ত চিঠিরা সেদিন আকাশে মেঘ। ভরা পূর্ণিমার আলোয় সেইসব মেঘেরা বারবার হারিয়ে যাচ্ছে।


পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যর্থ সেই কবি মরে গেলে আমরা জানতে পারলাম প্রতিদিন চিঠি আকারে হাজার-লক্ষ কবিতা লিখে রেখে গেছেন তিনি। তাঁর ঘরে কবিতারা জমতে জমতে পাহাড় হয়ে গেছে। তিনি ভাবতেন চিঠি লিখছেন। অথচ সেসব লেখা কোনভাবেই পত্র হয়ে ওঠে নাই। তিনি এতো বেশি কবি ছিলেন যে, কবিতা ভিন্ন কোন কিছু কোনদিন লিখতে জানেন নাই।

সেই সমস্ত পত্র নামের দারুণ কবিতা আজ আমাদের পরম পাঠ্য।




ছবি: পাবলো পিকাসো

মন্তব্য ০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.