নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মন এক বড় মহাজন

মনের কথা ব্লগে বলে ফেলুন,নয়তো মনে কথার বদহজম হবে

মুনযুর-ই-মুর্শিদ

মুনযুর-ই-মুর্শিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

সেই এক জমিদার

০৩ রা মে, ২০১৩ রাত ১১:৪২

রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬)-এর বিপুল সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল দেনার দায়ে। সে সব সম্পত্তির মধ্যে ছিল- নুরনগর পরগনা, হুগলির মৌজা আয়মা হরিপুর (ম-লঘাট), পাবনার পত্তনী তালুক তরফ চাপড়ি, রংপুরে স্বরূপপুর, যশোরে মহম্মদশাহি ও অন্যান্য এলাকা, ত্রিপুরা রাজ্যের কমলপুর মহকুমার জমিদারি ও মেদিনীপুরের জমিদারি। রক্ষা পেয়েছিল শুধু ওড়িশা এবং পূর্ববঙ্গের পাবনা জেলার ইউসুফশাহী পরগনার ডিহি সাজাদপুর (পূর্ব নাম : সাহাজাদপুর, বর্তমানে শাহজাদপুর), রাজশাহী জেলার কালীগ্রাম পরগনা (সদর : পতিসর) ও কুষ্টিয়া জেলার বিরাহিম পরগনা (সদর : শিলাইদহ)-এর জমিদারি। তাঁর পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) শেষ উইল করেন ১৮৯৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। সে অনুযায়ী ওড়িশার জমিদারি পান তাঁর তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৪-১৮৮৪); দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ পান শিলাইদহ (প্রাচীন নাম খোরশেদপুর), শাহজাদপুর ও পতিসরের জমিদারি। উইলে জমিদারির আয় থেকে ব্যয় বরাদ্দ করা হয় এভাবে-

ছোট ভাই নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৯-১৮৫৮)-এর স্ত্রী ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীকে মাসে ১০০০ টাকা,

পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ১২৫০ টাকা,

সোমেন্দ্রনাথকে ২০০ টাকা,

রবীন্দ্রনাথকে ২০০ টাকা,

বীরেন্দ্রনাথকে ১০০ টাকা, তাঁর স্ত্রী প্রফুল্লময়ীকে ১০০ টাকা, তাঁর পুত্রবধূ সাহানা দেবীকে ১০০ টাকা,

কন্যা সৌদামিনী দেবীকে ২৫ টাকা, তাঁর জামাতা সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়কে ৫০ টাকা,

কন্যা শরৎকুমারী দেবীকে ২০০ টাকা,

স্বর্ণকুমারী দেবীকে ১০০ টাকা,

বর্ণকুমারী দেবীকে ১০০ টাকা,

আদি ব্রাহ্মসমাজকে ২০০ টাকা,

শান্তিনিকেতন ট্রাস্টকে ৩০০ টাকা,

দেবসেবার জন্য ২০০ টাকা,

পৌত্র দ্বিপেন্দ্রনাথকে ৫০০ টাকা।

মাসে এই বিপুল অর্থ যোগানোর জন্য দায়বদ্ধ ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ।

১৯১২ সালে দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর হিস্যার এক-তৃতীয়াংশ বছরে ৪৪,০০০ টাকার বিনিময়ে ইজারা পাট্টা দেন সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের কাছে। সিভিল সার্ভিসের চাকরিসূত্রে সত্যেন্দ্রনাথ থাকতেন বাংলার বাইরে। কাজেই বছরে ৯৭,৪০০ টাকার জন্য দায়ী রইলেন রবীন্দ্রনাথই। এছাড়া জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ব্যয় ও জমিদারি পরিচালনার জন্য বছরে কমপক্ষে খরচ হতো কমপক্ষে দুই লাখ টাকা। আর তিন জমিদারির সদর খাজনা দিতে হতো ৫০,০০০ টাকা। শিলাইদহের সদর খাজনা ছিল ১৬,৯০২ টাকা।

জমিদারি কাজকর্মের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের ওপর পূর্ণ আস্থা ছিল দেবেন্দ্রনাথের। তবুও ১৮৯০ সাল থেকে পুরো পাঁচটি বছর জমিদারি তদারকের দায়িত্ব দিয়ে তাঁকে তিনি সরেজমিন প্রশিক্ষণ দেন এ বিষয়ে। ১৮৯৬ সালের ৮ আগস্ট পাওয়ার অব এ্যাটর্নির মাধ্যমে সমগ্র সম্পত্তির সর্বময় কর্তৃত্ব রবীন্দ্রনাথের ওপর ছেড়ে দেন দেবেন্দ্রনাথ।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “দেবেন্দ্রনাথের বয়স হচ্ছে; তিনি দেখলেন, রবিকে কোনও কাজের মধ্যে টানতে না পারলে আর চলবে না। জমিদারির কাজকর্ম কাউকে তো দেখতেই হবে। বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ দার্শনিক মানুষ, বৈষয়িক কাজের পক্ষে অযোগ্য। কর্তব্যবোধে জমিদারির কাজ দেখতে গিয়ে দান করে, খাজনা মওকুফ করে, লোকসান ঘটিয়ে ফিরে আসেন। সত্যেন্দ্রনাথ সরকারি কাজে দূরে থাকেন; ছুটিতে আসেন ক’দিনের জন্য, তাঁর পক্ষে জমিদারি তদারক সম্ভব নয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিঃসন্তান- সংসারের কাজে তাঁর আঁট কম- ভোগ করবে কে? হেমেন্দ্রনাথ গতায়ু; বীরেন্দ্রনাথ ও সোমেন্দ্রনাথ বায়ুরোগগ্রস্ত। সুতরাং পুত্রদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া জমিদারি দেখার মতো আর কেউ নেই।” (‘রবীন্দ্রজীবনকথা’)

১৮৯০ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৭ বছর জমিদার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বহন করেছেন পৈতৃক সূত্রে পাওয়া গুরুভার। তাঁর প্রজাদের বেশির ভাগই মুসলমান কৃষক। তাদের কাছে তিনি ছিলেন সম্ভ্রম, শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ের ‘জমিদার বাবু’ বা ‘জমিদার মশাই’।

রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, কৃষিতে উন্নতি ছাড়া তাঁর হতদরিদ্র প্রজাদের জীবনে উন্নতি ঘটবে না, তাঁর জমিদারি বা দেশেরও উন্নতি হবে না। তাই জমিদারিতে চালু করেছিলেন ম-লিপ্রথা, সালিশী, হিতৈষীসভা প্রভৃতি ব্যবস্থা। নোবেল প্রাইজের এক লাখ ২০ হাজার টাকা জমা রেখেছিলেন পতিসরের এগ্রিকালচারাল ব্যাংকে। তাঁর কৃষক প্রজারা স্বল্প সুদে ঋণ পেতেন ওই ব্যাংক থেকে। এতে মুসলমান কৃষকরা উপকৃত হলেও হিন্দু সুদ-ব্যবসায়ী ‘সাহা’রা ক্ষেপে যায় রবীন্দ্রনাথের ওপর। তারা নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে জমিদারির বিরুদ্ধে। এই সূত্রেই রবীন্দ্র-সাহিত্যের সমালোচনায় এ প্রসঙ্গটি আসে যে, হিন্দু সমাজের নানা দোষ-ত্রুটি তুলে ধরলেও মুসলমান সমাজের মন্দ কিছু দেখতে পাননি তিনি। অথচ তাদের সমাজেও অনেক কিছু আছে সমালোচনাযোগ্য। তাঁর মুসলমান প্রজারা অসন্তুষ্ট হোকÑ তা চাননি বলে সে সব সমালোচনা করেননি তিনি। এ ধরনের অভিযোগ আরও ছিল রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে।

সাধারণ প্রজাদের ধারণা ছিল, দেশের অন্য দশজন জমিদারের মতোই হবেন তাদের জমিদার বাবু। দান-ধ্যান করবেন, ‘আমলাদের হাতে তামাক খাবেন’, দু’চার দিন আনন্দ-উৎসব করবেন কাছারিতে, তারপর ফিরে যাবেন কলকাতায়। কিন্তু এ জমিদার বাবু অন্যরকম। দান-খয়রাত করেন না, খাজনা নিয়ে চাপ দেন না, আমলারাই বরং পান থেকে চুন খসলে চাকরি হারানোর ভয়ে থর-থর কাঁপে তাঁর নামে! এ অবস্থায় নানা ক্ষেত্রে বিরোধিতা শুরু করে ক্ষুব্ধ আমলারা। আর যাদের স্বার্থ রক্ষা করতে উদ্যোগী হন রবীন্দ্রনাথ সেই অজ্ঞ গরিব চাষিরাও ভুল বুঝে যোগ দেয় তাদের পক্ষে। তিনি হতে চেয়েছিলেন প্রজাদের অভিভাবক। “তাঁর উদ্দেশ্য ছিল প্রজাদের স্বাবলম্বী করা, আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ করা এবং ভূমিলক্ষ্মীর আরাধনায় জয়যুক্ত করা।” তবে জমিদারি ছিল এজমালি, তাঁর একার নয়। কাজেই পারিবারিক দায়িত্ব ছিল সবার আগে। “দয়া-দাক্ষিণ্য দেখিয়ে সংসারের ভাঁড়ার শূন্য করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না।”

তবে ব্যাপক অপপ্রচার, বিরোধিতা সত্ত্বেও দমেননি রবীন্দ্রনাথ। প্রজারা যাতে অল্প জমিতে অধিক ফসল উৎপাদন করতে পারে এজন্য কৃষি ল্যাবরেটরি স্থাপন করেছিলেন তিনি। বাস্তবায়িত করেছিলেন সমবায় নীতি। প্রজাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন নিজ খরচায়। জমিদারিতে পুণ্যাহ সভায় আসন বণ্টনে তুলে দিয়েছিলেন জাতিভেদ প্রথা। হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমানদের বসিয়েছিলেন সমান মর্যাদায়। তখন এর ঘোর প্রতিবাদ করেছে অনেক জাত্যাভিমানী হিন্দু।

প্রজাদের কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন রবীন্দ্রনাথ। মাঝেমধ্যে একাই বেরিয়ে পড়তেন প্রজাদের কথা শুনতে। তাদের কাছ থেকে শুনেছেন আমলাদের অত্যাচারের কথা, বিশ্বাসও করেছেন সে সব কথা। সতর্ক করার পর একই ভুল করলে বরখাস্ত করেছেন অত্যাচারী আমলাদের।

১৮৯৫ সালে কুষ্টিয়ায় টেগোর অ্যান্ড কোং চালু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। চাষিদের ধান, পাট ও ভুসিমাল কিনে বাজারে বিক্রি করতো এ কোম্পানি। তাঁরা আখ মাড়াইয়ের কলও বসিয়েছিলেন কুষ্টিয়ায়। ম্যানেজার টাকা চুরি করে পালিয়ে যাওয়ায় ব্যবসা ছাড়তে বাধ্য হন রবীন্দ্রনাথ। সেই সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ৭০-৮০ হাজার টাকা ঋণের দায়ে। পরে নামমাত্র খাজনায় ওই ব্যবসা দান করেন এক কর্মচারীকে। ওই ব্যবসা থেকে কর্মচারীটি পরে হয়েছিলেন অঢেল অর্থবিত্তের অধিকারী।

জমিদারির সেরেস্তার কাজে গোড়া থেকেই আধুনিক ব্যবস্থা চালু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জমা ওয়াশিল কাগজের পরিবর্তে ছিল কার্ড ইনডেক্স প্রথা। শিলাইদহ সদর কাছারির সহকারী মুন্সী শচীন্দ্রনাথ অধিকারী লিখেছেন :

... জমিদারি ব্যবস্থার আদায় তহশিল জরিপ জমাবন্দি মামলা-মোকদ্দমা জমিজমা বন্দোবস্ত, হিসাবপত্র ও শাসন-সংরক্ষণ প্রভৃতির ব্যাপারে বিধিবদ্ধ নিয়মাবলী প্রণয়ন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

কোন সময়ে কোন নতুন ফসল চাষ করতে হবে, তার প্রকরণ কি, সার কি প্রভৃতি বিবরণ খুব সহজ ভাষায় ছাপিয়ে সার্কুলারের মতো বিলি করা হতো।

প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের মধ্যে জমিদারির আয়-ব্যয়ের বরাদ্দ তৈরি হতো, তাতে জমিদারির আয়-ব্যয়ের বিবরণ থাকতো। ওই একই সময়ে কাছারির কর্মচারীদের মাসিক বেতন, নিয়োগ, বেতন বৃদ্ধি, সদর-মফস্বলে যাতায়াত, খোরাকির হার, বার্ষিক পার্বণীর বিবরণ অনুমোদন করতেন রবীন্দ্রনাথ নিজে। পার্বণীর টাকা দেয়া হতো পুজোর ছুটিতে। এসব কাজের পর আষাঢ়ের কোনও শুভ দিনে অনুষ্ঠিত হতো সদর শুভ পুণ্যাহ।

বার্ষিক কত মুনাফা, কত কিস্তিতে খাজনা দিতে হবে, মফস্বলের ডিহিদারদের কত খাজনা দিতে হবে প্রভৃতির হিসাব ছিল।

আশ্বিন ও চৈত্র মাসে এলাকার জলবায়ু, স্বাস্থ্য, ফসলের বিবরণসহ আর্থিক অবস্থার প্রশাসনিক রিপোর্ট দিতে হতো। খাজনা, সেলামি খাতের রেয়াতের বিবরণও দিতে হতো।

প্রত্যেক স্বত্বের মামলা দায়ের করার আগে বিবরণ পাঠিয়ে রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন নিতে হতো। একইভাবে অনুমোদন নিতে হতো কর্মচারী নিয়োগ, বরখাস্ত প্রভৃতি ক্ষেত্রে যথাযথ বিবরণ পেশ করে।

আমলাদের কোনও কাজের বা বিচার-সালিশের বিরুদ্ধে জমিদার বাবুর কাছে আপিল করতে পারতো প্রজারা। এর বিচারও হতো।

রবীন্দ্রনাথের বেশির ভাগ ছিল প্রজা মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও জমিদারিতে তারা পেতো শুধু বরকন্দাজের কাজ। হিন্দুরা করতো আমলার কাজ। এ নিয়ে সৃষ্ট ক্ষোভ দূর করতে আমিন, মহুরি, তহশিলদার প্রভৃতি পদে শিক্ষিত মুসলমান প্রজাদের নিয়োগ করেন রবীন্দ্রনাথ। এতে হিন্দু আমলা ও প্রজারা ক্ষুব্ধ হয়ে প্রাত্যহিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটাতে থাকে নানাভাবে। তখন বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে শিক্ষিত হিন্দু যুবকদের নিয়ে এসে বিভিন্ন পদে নিয়োগ করেন তিনি। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জগদানন্দ রায়, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জানকী রায়, ভূপেশ রায়, চন্দ্রময় সান্যাল, কালীমোহন ঘোষ, অতুল সেন প্রমুখ পরবর্তীকালের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব।

প্রজাদের বিদ্যাচর্চার জন্য শিক্ষালয় স্থাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ, শরীরচর্চার জন্যও চালু করেছিলেন লাঠিখেলাসহ বিভিন্ন খেলাধুলা। রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব লাঠিয়াল মেছের সরদার দায়িত্ব পেয়েছিলেন শিলাইদহ গ্রামের উৎসাহীদের লাঠিখেলা শেখানোর। গ্রামীণ শিল্প ও বিনোদনচর্চাকে উৎসাহ দিতে ১৯০২ সালে চালু করেছিলেন স্থানীয় দেবী কাত্যায়নীর পূজা ও পক্ষকালব্যাপী মেলা। রবীন্দ্রনাথ রাখীবন্ধন উৎসবেরও সূত্রপাত ঘটান শিলাইদহে।

শচীন্দ্রনাথ অধিকারী লিখেছেন, পল্লী উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথের প্রধান কর্মধারা ছিল তিনটি : হাতে কলমে কৃষি শিক্ষা, আদর্শ গ্রাম তৈরি ও ব্রতী বালক গঠন। বিদ্যালয় স্থাপন, শরীরচর্চা, জঙ্গল সাফ, জনস্বাস্থ্যের উন্নতি প্রভৃতিও ছিল কর্মধারার অঙ্গ। এছাড়া গ্রামের মানচিত্র, নদীনালা প্রভৃতির নকশাও তৈরি করতে হতো। শিলাইদহের নিকটবর্তী লাহিনী মৌজায় স্থাপন করা হয় আদর্শ গ্রাম। রেলপথ ও নদীর ধারে বাজার বসিয়ে বিভিন্ন পল্লীর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের ছক তৈরি করেন রবীন্দ্রনাথ। গৃহস্থ, চাকুরে, চাষি, তাঁতি, কুমোর ও জেলেদের জন্য করা হয় পৃথক-পৃথক প্লট। এ নিয়ে বিবাদ বাধে নলডাঙ্গার রাজাদের সঙ্গে। শুরু হয় মামলা। রেষারেষি তীব্র রূপ ধারণ করে, এক পর্যায়ে আগুন লাগানো হয় লাহিনী বাজারে। শেষে বাধ্য হয়ে পরিকল্পনা ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথের জন্য ভাতা বরাদ্দ ছিল ২০০ টাকা, জমিদারি কাজের জন্য আর পেতেন ১০০ টাকা। এই মাত্র ৩০০ টাকায় পাঁচ পুত্র-কন্যাসহ সাতজনের সংসার চালাতেন জমিদার-পতœী মৃণালিনী দেবী। এছাড়া ছেলেমেয়েদের গৃহশিক্ষক, অতিথি আপ্যায়ন, স্বামী ও সন্তানদের বই কেনা প্রভৃতির খরচ তো ছিলই। কলকাতা থেকে আত্মীয়-স্বজনও এসে থাকতেন প্রায়ই। এস্টেটের দারোয়ান, গ্রামের কাজের মহিলা, দূরের কর্মচারীদেরও ছিল মেসবাড়ি।

পুত্র রথীন্দ্রনাথের কাছে লেখা এক চিঠিতে জমিদার হিসেবে নিজেকে প্রজাদের রক্তে বেঁচে থাকা ‘প্যারাসাইট’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ রকম বেঁচে থাকাকে সহজ মনে মেনে নিতে পারেননি তিনি। এ নিয়ে তাঁর সংবেদনশীল মনে প্রশ্ন জেগেছে বার-বার। কিন্তু পরিবারের এজমালি সম্পত্তি প্রজাদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়ার অধিকার ছিল না তাঁর।

শাহজাদপুর, শিলাইদহ ও পতিসরÑ এই তিন জমিদারিতেই রবীন্দ্রনাথের প্রজাদের বেশির ভাগ ছিলেন হতদরিদ্র মুসলমান। একবার এক বৃদ্ধ মুসলমান প্রজা প্রণাম করে নজরানা দেয়ার সময় আপত্তি করেছিলেন তিনি। তখন ওই দরিদ্র প্রজা বলেছিলেন, আমরা না দিলে খাবি কি?

নাটোরের রানী ভবানীর জমিদারির ইউসুফশাহি পরগনার ডিহি শাহজাদপুর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর কিনেছিলেন ১৩ টাকা ১০ আনায়। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়, ১৮৯৭ সালে ভাগ হয় ঠাকুর পরিবারের যৌথ জমিদারি। ডিহি শাহজাদপুর পড়ে মেজ ভাই গিরীন্দ্রনাথের ভাগে। তিনি মারা গেলে এ জমিদারি পান গগনেন্দ্র ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফলে শাহজাদপুরের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয় রবীন্দ্রনাথের। ভাগাভাগি হওয়ার আগে জমিদারি দেখাশোনা করতে রবীন্দ্রনাথ এখানে এসেছিলেন ১৮৯০ সালের ২০শে জানুয়ারি। আর জমিদারি সংক্রান্ত হুকুমনামায় তাঁর শেষ হুকুমের তারিখ দেখা যায় ১৮৯৭ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি।

শাহজাদপুরের জমিদারি মাত্র বছর সাতেক দেখাশোনা করলেও এই জনপদের মানুষের প্রতি গভীর ভালবাসা জন্ম নিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের মনে। তাই সম্পর্ক ছিন্ন হলেও, কয়েক মাস পরে, অপর জমিদারি পতিসরে যাওয়ার পথে এখানে আবার এসেছিলেন তিনি। তখন লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত গানটি, “ভালবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখিও- তোমার মনের মন্দিরে ...।

The daily janakantha

NobelPrize.Org

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.