নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার প্রিয় কিছু পাপের কাছে আমি বন্দি হয়ে আছি

নাভিদ কায়সার রায়ান

তৃতীয় ধরণের পাগল হল সেয়ানা পাগল। এটা সবচেয়ে কঠিন ধরণের পাগলামি। এই পাগল কি সুস্থ না অসুস্থ সেটা বোঝা খুব কঠিন। যখন সে পাগলামি করছে তখন তার কাজকারবার হবে সুস্থ মানুষের মতো। জটিল সব যুক্তি দিয়ে সে তার পাগলামি প্রতিষ্ঠিত করবে। আবার যখন সে সুস্থ থাকবে তখন তার চিন্তা ভাবনা হবে পাগলের মতো। অফিসে এবং বাসায় নিয়মিত ভাবে আমি এই পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে ভালোই লাগে। শুধু মাঝে মধ্যে আমার মাথার মধ্যে জ্যোৎস্না ঢুকে পড়ে। তখন খুব অস্থির লাগে। কেন লাগে জানি না। আপনারা কেউ কি জানেন?

নাভিদ কায়সার রায়ান › বিস্তারিত পোস্টঃ

সমুদ্রযাত্রা (৪)

১৫ ই জুন, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৪৭

আগের পর্বঃ সমুদ্রযাত্রা (৩) Click This Link



(৬) দারুচিনি দ্বীপ







প্রায় আড়াইশ বছর আগে একদল আরব নাবিক প্রথম পা ফেলেছিল এই দ্বীপে। আরব নাবিকেরা সম্ভবত খুব তাড়াহুড়ায় ছিল। তারা সংক্ষেপে এর নাম রেখেছিল “জাজিরা” অর্থাৎ দ্বীপ। ভাল করে চারপাশে তাকালে হয়ত অন্য কোন নাম মাথায় আসত। এত সুন্দর একটা জায়গার নাম রাখলি শুধু দ্বীপ? আগে পিছে কোন কিছু যোগ করা গেল না?

স্থানীয় লোকজন একসময় জাজিরাকেই নিজেদের মত করে পাল্টে জিঞ্জিরা ডাকা শুরু করল। লোকালরা আরবদের মত অত ভ্যাবদা ছিল না। দ্বীপে এসে প্রথম যেটা তাদের চোখে পড়ল তা হল সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য নারকেল গাছ। তাদের কাছে জিঞ্জিরা হয়ে গেল নারিকেল জিঞ্জিরা।

এলাকায় এরপর এলো ইংরেজরা। ইংরেজরা অভিজাত জাতি। এইসব জিঞ্জিরা ফিঞ্জিরা ফালতু নাম তারা ঝেড়ে ফেলল। ব্রিটিশ আমলে জিঞ্জিরার নাম পালটে দেয়া হয়। নতুন নাম রাখা হয় প্রাদেশিক রাজ্যপাল সেইন্ট মার্টিনের নামে, “সেইন্ট মার্টিন আইল্যান্ড”।

নারিকেল জিঞ্জিরার আরেকটি স্থানীয় নাম দারুচিনি দ্বীপ। কি চমৎকার নাম! অথচ আমরা দারুচিনি দ্বীপকে ব্রিটিশ আমলে দেয়া নামেই ডাকতে পছন্দ করি। কারন টা কি? আমার মনে হয় দীর্ঘদিন গোলামী করার ফলে আমরা ভেতরে ভেতরে গোলাম রয়ে গেছি।

আমি একাই নেতাজীর সাথে বকবক করছিলাম, এই যেমন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা পুরো বাঙ্গালী জাতিকে মেরে ধরে, বেইজ্জত করে গেল। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কাপুরুষচিত, ঘৃণ্য আর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের নজির নাই। নুন্যতম মানবিকতা থাকলেও পাকিস্তানের উচিৎ ছিল এসবের জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়া। তারা এইসব গায়েই মাখায়নি। তারপরও আমরা লজ্জার মাথা খেয়ে ওদের অনুরোধ করেছিলাম, “ভাই, যা হওয়ার হয়ে গেছে। মাফ-টাফ চেয়ে ওই চ্যাপ্টার ক্লোজ করে আসেন সামনে এগিয়ে যাই।” আমাদের অনুরোধে ওরা থোরাই কেয়ার করে। ভাবটা এমন, “ক্ষমা? সেটা আবার কি? খায় না মাথায় দেয়? গোলামের কাছে কেউ ক্ষমা চায় নাকি?”

এর চাইতে বড় অপমান আর কি হতে পারে? গোলাম জাতির অপমান গায়ে লাগে না। আমাদের ও লাগেনি। আজো দেখি সব ভুলে আমরা পাকিস্তান ক্রিকেট দল খেলায় জিতলে আমোদিত হই। হারলেও আবার দুঃখই পাই। পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সৌভাগ্য আমাকে লজ্জিত করে। দেশ ছাড়তে হলেও গোলামদের মধ্য থেকে কিছু নির্ভেজাল সাপোর্টার ওরা বিনা পয়সায় পেয়ে গেছে।

আবিদ খেলাধুলার ভক্ত। খেলার মধ্যে রাজনীতি আনায় আবিদ বলল, “খেলার মধ্যে এসব টেনে আনার মানে কি?”

আমার কাছেও পাল্টা যুক্তি আছে- “ওরা তো আমাদের কাছে ক্ষমা চায় নি। ক্ষমা না চাইলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ায়? ওরা তাহলে ভাবে যে, যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী যেভাবে ঘর থেকে টেনে এনে মেয়েদের কষ্ট দিয়েছিল সেটা তাহলে ঠিক ছিল।”

জবাব নাই। জবাব থাকার কথাও না।

“ধুর শালা! তোদের রাজনীতির কথাবার্তা আমাদের একদম ভাল লাগছে না।” ফুয়াদ হাত নেড়ে জানায়। “এসব কথা বাদ দে। অন্য কিছু বল।”

“হ্যাঁ। ঠিক কথা।” সেতু সায় দিল, “ একটা গান গা দোওও...স্ত...ভাল্লাগবে!”

গান আর গাইতে হল না। দূর থেকে হই হুই শব্দ শোনা গেল। বুঝলাম, আমাদের সাথের শয়তানেরাই। উত্তেজিত দলটা মুহূর্তেই কাছে চলে এল। কাছাকাছি এসে হাপাতে হাপাতে জুয়েল জানাল, “ নেতাজী, পাইসি!”

“কি পাইলি?”

জুয়েল জামার পেছন থেকে কালো একটা বোতল বের করে বলল, “ রামম!!”

“পারফেক্ট!” নেতাজীর বিরাট শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। গল্প করতে করতে কখন যেন বালিতেই শুয়ে পড়েছিল। তড়াক করে শোয়া থেকে এক লাফে দাঁড়িয়ে উঠে বলল “সাবাস! কিন্তু টাকা পেলি কোথায়?”

“কি যে কন নেতাজী!” জুয়েল রহস্য জমিয়ে রাখে। অত উত্তর দেবার সময় নেই। এটারই অভাব ছিল। ছেলেপেলে আজকাল জ্ঞানী হয়ে গেছে। কখন কি লাগবে কিভাবে যেন বুঝে যায়! জনগনের চাহিদা অনুযায়ী যথেষ্ট সরবরাহ আছে। পার্টি চলবে সারারাত! আর কি লাগে!

পাগলা পানি খানিকটা পেটে যেতেই খেলা শুরু হয়ে গেল। খাওয়া শুরু করার আগে সুমন আর মুণ্ডু ভাই কিছু কাঠ খড় দিয়ে আগুন জ্বালিয়েছিল। আমরা সেই আগুনকে মাঝে রেখে হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করে উদ্দাম নৃত্য শুরু করলাম। কি যে একটা আনন্দ জীবনে! হাসতে হাসতে সবার পেট ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে। কেন হাসছি জানি না। ক্লান্ত হয়ে কেউ কেউ আগুনের পাশে শুয়ে পড়ল । কোথাও কোন বাধা নেই, কোন চিন্তা নেই, কিচ্ছু নেই। চারপাশে শুধুই আনন্দ। খেতে জঘন্য হলেও পাগলা পানির মজাই অন্য রকম। হাত-পা-মাথা কোথাও কোন নিয়ন্ত্রন থাকে না। যেন আকাশে মেঘের মত ভেসে বেড়াচ্ছি!

কাবুর কাঁধে ভর দিয়ে বালির উপর ভেসেই বেরাচ্ছিলাম। আমিও শেষ, কাবুও তথাস্তু।

“কাবুউ...”

“উমম...?”

“কেমন যেন লাগছে দো...ও...ও...স্ত!”

“হ্যাঁ! আমি আর তুই মাতাআআল হয়ে গেছি!”

“মাতাল হলি ক্যান দোস্ত? কি এত দুঃখ তোর মনে? বল দো...ও...ও...স্ত!” সেতুর মত সুর করে বললাম।

কাবু খুন খুন করে কান্নার ভঙ্গি করে, “আমার মনে অনেক দুঃখ দো...ও...ও...স্ত!”

“তোর সব দুঃখের কথা আমাকে বল। সব আমি দূর করে দেব।” আবার সুর করে বলি, “একবার শুধু আমাকে বঅঅঅল দো...ও...ও...স্ত!”

কাবু আমার কাঁধে মাথা রেখে কান্নার ভঙ্গি করতে করতে বলল, “এখানে আসার সময় ঘুরতে যাওয়া নিয়ে সনির সাথে ঝগড়া হয়েছে। সনি এর পর থেকে আর আমার ফোন ধরছে না! আঁ আঁ আঁ!”

আমি কাবুর মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিলাম, “ দুঃখ করিস না দো...ও...ও...স্ত। মেয়েরা এমনি হয়। ওরা সব নির্দয় আর পাষণ্ড! তোর মত একটা শিশুর সাথে এরকম করতে পারল? ছি!”

কাবুর কান্নার বেগ আরও বাড়তে থাকে! কান্না শুধু চেহারাতেই, চোখে পানির ছিটা ফোটা নাই। আমি আলতো করে কাবুকে আগুনের পাশে একটা খালি বোতল সহ বসিয়ে দিলাম। কাবু মনের দুঃখে বিড়বিড় করতে করতে খালি বোতলই খেতে লাগল। আহারে বেচারা!

কাবুকে বসিয়ে রেখে অন্য একটা বোতল থেকে আমি আরও কয়েক ঢোক খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিলাম। নাচানাচি করে সবাই ক্লান্ত! আগুনের পাশেই অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমাক। আসল কথা শান্তি। বালির উপর শুয়ে যদি শান্তি আসে তাহলে বিছানার কি দরকার?

দূরে কাদের যেন দেখা যাচ্ছে। মনে হয় নেতাজী আর আবিদ। বাকিদের কোথাও দেখতে পেলাম না। ভাবলাম একটু চারপাশে ঘুরে বেড়াই। কে কি করছে দেখা দরকার। নিজেকে একজন পরিব্রাজক হিসেবে কল্পনা করতে ভাল লাগছে। পরিব্রাজক “ইবনে বতুতা”র মত ইবনে নাভিদ কায়সার বতুতা। নাহ, হল না। নাভিদ কায়সার - দি ইবনে বতুতা। হ্যাঁ! এবার ঠিক আছে। যাক, মাথায় একটা বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে। নেতাজীর সাথে একটু চিন্তা ভাবনা শেয়ার করা দরকার।

নেতাজীর কাছাকাছি পৌঁছে তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।

“কিরে, এভাবে পড়ে গেলি কেন?” আমাকে ধরে বসাতে বসাতে আবিদ জিজ্ঞেস করল।

এইটা একটা প্রশ্ন হল? এত্তগুলা খেয়েছি, পড়ব না?

বললাম, “কে যেন পা ধরে টান দিল!”

“তোর পা ধরে কে টান দিবে?” আবারো জিজ্ঞেস করে আবিদ। “আশেপাশে তো কেউ নেই।”

আবারো প্রশ্ন। অসহ্য! আমি ওর কথার আর জবাব দেই না। অপেক্ষা করুক।

অন্তু আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে আছে। মুখে মৃদু হাসির আভাস। অন্তুর সাথে আবিদ ছাড়াও জান্নাত, সামি, তন্ময় আর মামুন আছে। আমি অন্তুকে জিজ্ঞেস করলাম,

-“নেতাজী, হইসে?”

উত্তরে হাসির কাছাকাছি অদ্ভুত একটা আওয়াজ আসল, “হেহ হেএএএএএ...”

-“কিছু বলেন নেতাজী?”

-“ভাল লাগছে, খুউউউব ভাল লাগছেএএএএ!”

-“নেতাজী, একটা জিনিষ মাথায় আসল।”

-“বলে ফেল।”

-“আচ্ছা নেতাজী, ভালবাসা কি? What is love?

“ভালবাসা” নেতাজীর প্রিয় সাবজেক্ট। বিভিন্ন দুর্বল মুহূর্তে নেতাজি ভালবাসা সংক্রান্ত কথাবার্তা শূনতে আমার খুব ভাল লাগে। আমার প্রশ্ন শুনে ধীরে ধীরে নেতাজীর চোখ খুলল।

-What is love?

-জী নেতাজি, Love. L…..O…..V……E , Love.

-Love is like a bird.

আরে খাইসে! নেতাজি তো আজকে অনেক উঁচু লেভেলে চলে গেছে! আমি নড়ে চড়ে বসলাম।

-Bird, মানে পক্ষী?

-হ্যাঁ! তুই এসব বুঝবি না।

-আমি বুঝবো না? আমার তো গার্লফ্রেন্ড আছে নেতাজি। আমি যদি ভালবাসা না বুঝি তাইলে চলে?

-আরে, গাধা। এইজন্যই তো বললাম, তুই বুঝবি না। ভালবাসাকে পাখির মত মনে করতে হবে। Like a bird in the sky.

তরল অবস্থায় নেতাজী বাংলায় কথা বলতে পারে না। কথা চলে সব ইংলিশে। সব কথা বোঝা যায় না। কিছু আন্দাজ করে নিতে হয়। যেমন Like a bird in the sky না বলে অন্তু Like a fly in the sky বলে ফেলেছিল। আমি শুদ্ধ করে লিখলাম। নেতাজী সম্মানিত মানুষ। উল্টাপাল্টা লিখলে তার সম্মানহানি হতে পারে।

নেতাজী শুরু করল, “Like a bird in the sky. And set the bird free. If it comes back it’s yours, if it doesn’t then it never was.”

“ধুর! পাখি ছেড়ে দিলে তো উড়ে চলে যাবে। ভালবাসা উড়ে গেলে লাভ কি? মাতাল শালা। হা হা হা!!” আবিদ হাসতে হাসতে বালির উপর গড়াগড়ি খায়।

এই জন্যই তোর কিছু হইল না। ভালবাসা চিনতে হলে তাকে ছেড়ে দিতে হবে। যদি সে ফিরে আসে তাহলেই সেটা সত্যিকারের ভালবাসা।

আমার মনে আবার প্রশ্ন আসল, “ আচ্ছা নেতাজী, ধরেন আমি যদি পাখিরে ঘুমের ওষুধ খাওয়ার তার পর ছাড়ি?”

আমার প্রশ্ন শুনে আবিদ আবার গড়াগড়ি খায়। “পাখিরে ঘুমের ওষুধ খাওয়াবি? হা হা হা, হি হি হি।

নেতাজিকে একটু চিন্তিত মনে হয়।

তুই পাখিরে ঘুমের ওষুধ খাওয়াবি?

আরে না! তবে সবার তো বিশ্বাস নাই। কেউ যদি খাওয়ায়, তাহলে ব্যপারটা কি হবে সেটা একটু ভেবে দেখা দরকার না? পাখির দিকটাও তো আমাদের ভেবে দেখা দরকার। অবলা প্রাণী।

তুই কি ফাইজলামি করিস আমার সাথে?

হাত পা নেড়ে বললাম, নাআআআহ! কখনো না! মনে একটা প্রশ্ন আসল তাই জিজ্ঞেস করলাম।

আর কোন প্রশ্ন আছে?

ইয়ে, কিভাবে বলি। ছিল, আর একটা প্রশ্ন ছিল।

কি?

ধরেন, আপনি ছাড়ার পর পাখিরে অন্য কেউ বন্দী করল। এখন, পাখির তো আপনার কাছে ফেরত আসার ইচ্ছা। কিন্তু উপায় নাই। আপনিও জানেন না পাখি কোথায়। সেইক্ষেত্রে তো পাখি না ছাড়াই ভাল।

তুই যা আমার সামনে থেকে।

আর অপেক্ষা করা ঠিক না। জুতা এসে পরতে পারে। প্রত্যাখ্যাত হয়ে আমি হোটেলে ফিরে এলাম। মনটা খুব খারাপ। জগতে কেউ আমারে বুঝল না।

হোটেলে ফিরে মন আর খারাপ থাকল না। রাজর্ষি, সেতু, সমীর, ফুয়াদ সহ আরও কে কে যেন ডাব চুরি করে এনেছে। ম্যানেজারের কাছ থেকে দা নিয়ে এসে ডাব কেটে খাওয়া হচ্ছে। বিশাল হৈচৈ। ডাব খেয়ে রাত প্রায় দুইটার দিকে আমরা ঘুমাতে গেলাম।







(৭) ফেরা







কথা ছিল, ভোরে ঘুম থেকে উঠে সুর্যোদয় দেখব। রাজর্ষি ছাড়া সেই ভাগ্য কারো হল না। সবার ঘুমই ভাঙল নয়টা-দশটায়, তাও রাজর্ষির ডাকে। রাজর্ষি জানাল, নাস্তা রেডি।

আমাদের আবার ফেরার সময় হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি করতে পারলে ছেঁড়াদ্বীপটা দেখে আসতে পারব। সবাইকে ঘুম থেকে ওঠাতে খুব কষ্ট হল। দীপনকে তুলতেই পারলাম না। আমরা যে কয়জন ঘুম থেকে উঠেছি তারাই নাস্তা করলাম।

সবাই ঘুম থেকে না উঠলে যাওয়া যাচ্ছে না বলে আমরা আবার বিচ দেখতে বের হলাম।ম্যানেজার জানাল এখন জোয়ার চলছে। পানিতে নামা যাবে।

হোটেল থেকে বাইরে এসে সকাল সকাল আবারো একটা ধাক্কা খেলাম। দারুচিনি দ্বীপ এত সুন্দর! আমরা যখন এসে পৌঁছেছি তখন বুঝতে পারিনি যে সমুদ্রের পানি নীল। কক্সবাজারের পানি একদম ঘোলা আর কালো। এখানকার পানি কাঁচের মত স্বচ্ছ আর নীল।



আকাশটাও পরিস্কার থাকায় মনে হচ্ছে কোন ছবির দিকে তাকিয়ে আছি। রাতে জোয়ার ভাটার কারনে পানিতে নামতে পারিনি। এবার আর কোন বাধা নেই। আমরা সবাই পানিতে ঝাপিয়ে পড়লাম। উফ! কি যে ভাল লাগছিল! পানি এত আরামদায়ক আর ঠাণ্ডা! গরমের কষ্ট সব ধুয়ে গেল। সাঁতার জানিনা বলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পানির খুব গভীরে যেতে পারছি না। একটু গভীরে গিয়ে শরীরটা স্রোতে একটু ভাসিয়ে দিলেই জোয়ারের টানে আবার আমাকে তীরে ফিরিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। আরামের চোটে মনে হচ্ছিল মরে যাই। এত সুখ আর সহ্য হচ্ছে না।



বাকিরা ঘুম থেকে উঠে আমাদের সাথে যোগ দিল। পানিতে আরও খানিকক্ষণ দাপাদাপি করলাম। আমাদের সাথে আবার ফুটবল ছিল। গোসল করে খেললাম। অন্তুর নামে নেতা গ্রুপ আর সজীবের নামে বাড়া গ্রুপে আমরা ভাগ হয়ে নিলাম। খুব উত্তেজনা পুর্ন খেলা গোল শুন্য ড্র হল। খেলা শেষে দেখা গেল আসলে পুরো খেলায় কোন গোল পোস্টই ছিল না। যার স্যান্ডেল দিয়ে গোলপোস্ট বানানো হয়েছিল, সে খেলা শেষ হবার আগেই স্যান্ডেল নিয়ে চলে গেছে।

দুপুরে আর হোটেলে খেলাম না। দ্বীপের ভেতরে একটা ভাল খাওয়ার দোকান ছিল। আমরা সেখানেই গেলাম। মেনুতে ছিল, বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ, বিশাল সব গলদা চিংড়ি আর বনমোরগ। আমরা সব কয়টা আইটেমই চেখে দেখলাম। খাবার অত্যন্ত সুস্বাদু ছিল।

ভরপেট খেয়ে আমরা হোটেলে ফিরলাম। ঠিক হল দুপুরেই আমরা রওনা দিব। এই ফাঁকে দশ জনের একটা গ্রুপ গেল ছেঁড়া দ্বীপ দেখে আসতে।

ঘণ্টা খানেক পর গোছগাছ শেষ করে আমরা জেটিতে গিয়ে দেখি কক্সবাজারে হোটেলের সেই তিনটা মেয়ে আর তাদের ফ্যামিলি। ওরা একটা স্পীড বোট ভাড়া করেছে। ভাল করে দেখার আগেই ওরা হুশ করে চলে গেল।

আমরা আফসোস করতে করতে ট্রলারে উঠলাম। যারা ছেঁড়া দ্বীপে গিয়েছিল তারা এখনও আসেনি। মাঝি খুব তাড়াহুড়া করছিল। এত তাড়াহুড়া করছে কেন প্রশ্ন করাতে যে জবাব পেলাম তাতে আমাদের গলা শুকিয়ে গেল। সমুদ্রে নাকি নিম্নচাপ দেখা দিয়েছে। সমুদ্রের অবস্থা খুব খারাপ।

তাহলে? এই অবস্থায় যাওয়া কি ঠিক হবে? আমরা বরং আজকে থেকে আগামিকাল যাই।

মাঝি বলল, জলোচ্ছ্বাস হলে সেইন্ট মারটিনও ডুবে যায়। এখানে থেকেও লাভ নাই।

এত ভাল একটা ট্যুরের শেষে এমন একটা বিপদে পরে সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এর মধ্যে বাকিরাও ফিরে এল। যা ডিসিশন নেয়ার এখনি নিতে হবে। বেশির ভাগই রওনা দেয়ার পক্ষে। আমরা আর দেরী না করে যাত্রা শুরু করলাম।



সেদিন সমুদ্রের যে চেহারা আমি দেখেছিলাম সেটা বর্ণনা করা সম্ভব না। সমুদ্র আমাদের নৌকাটাকে এক মুহূর্তে ঢেউয়ের চূড়ায় তুলে ফেলছে আবার পর মুহূর্তে Roller Coster এর মত সাঁই করে ঢেউয়ের চূড়া থেকে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসছে। নামার সময় পেটের ভেতর কেমন যেন একটা অনুভুতি হয়। আর মনে হয় পায়ের নিচে মাটি নেই। ট্রলার যখন ঢেউয়ের চূড়ায় তখন আমি একবার পানির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মনে হল আমরা পানি থেকে প্রায় পঞ্চাশ ফুট উপরে ভেসে আছি! সেখান থেকে ঢেউয়ের গা বেয়ে নৌকাটা ঝপাং করে পানিতে এসে পড়ল। চারপাশ থেকে ছিটকে আসা পানি আমাদের পুরোপুরি ভিজিয়ে দিল। একবার ভাবলাম নৌকাটা বোধহয় ডুবেই যাবে।

পুরোটা পথ আমরা বন্ধুরা একজন আরেক জনকে ধরে আল্লাহ্‌র নাম নিচ্ছিলাম আর নিজেদের সাহস দিচ্ছিলাম যে সব ঠিক হয়ে যাবে। এর মধ্যেও তন্ময় তওবা করল, জীবনে আর হারাম কিছু খাবে না। আবিদ অঙ্গীকার করল, সব মেয়েদের বোনের মত দেখবে আর কখনো মেয়েদের দিকে বদ নজর দিবে না।

কিভাবে টেকনাফ পৌছালাম জানি না।

তখন সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। এতবড় একটা দুর্্যোেগ পার হয়ে সবাই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। শরীর আর চলছে না। খানিকটা জিরিয়ে নেবার জন্য আমরা একটা রেস্টুরেন্টে বসলাম।

সেইন্ট মার্টিনে নেটওয়ার্ক ছিল না বলে এতক্ষণ সবার ফোন বন্ধ ছিল। ফোন চালু করার পর প্রথম কল আসল অন্তুর মোবাইলে।ফোন করেছে আমাদের এক বড় ভাই। যিনি ক্যাম্পাসে একটি রাজনৈতিক দলের অনেক বড় নেতা। ফোন করে শুধু একটা কথাই বললেন,

“তোরা জানে বাঁচতে চাইলে আমার ক্যাম্পাসে আর পা দিবি না।”

কথা শুনে আমরা সবাই হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমরা কি করেছি? যদিও ওরা অনেকদিন ধরে আমাদের অনুরোধ করছিল রাজনীতিতে নাম লেখাতে। আমরা প্রতিবারই ভদ্রভাবে না করে দিয়েছি। আরে ভাই, আমরা রাজনীতির কি বুঝি? সেই “না” করার জন্যই কি আজকের এই অবস্থা?

ঘটনা কি জানার জন্য ক্যাম্পাসে ফোন করে শুনলাম অবস্থা ভয়াবহ। আমাদের বিছানা, বালিশ, খাতাপত্র সব তছনছ করে রুমের বাইরে ফেলে দিয়েছে ওরা। যারা প্রতিবাদ করেছিল তারা মার খেয়ে হাসপাতালে, কেউবা পালিয়েছে। গুন্ডা বাহিনী ক্যাম্পাস পাহারা দিচ্ছে। সবাই আমাদের মানা করে দিল ফেরত যেতে।

ঘটনা শুনে সবাই ভয় পেলেও সাহস হারালাম না। সবার মুখে একটাই কথা – “মরেই তো যাচ্ছিলাম। ক্যাম্পাসে গেলে যদি মেরে ফেলে, তো ফেলবে। এর চাইতে বেশী কিছু তো আর করতে পারবে না?”

আমাদের কিছু করার নেই। আমাদের ফিরতেই হবে।



পরবর্তী পর্বঃ বাঁধ ভাঙার আওয়াজ (৫) Click This Link

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.