নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার প্রিয় কিছু পাপের কাছে আমি বন্দি হয়ে আছি

নাভিদ কায়সার রায়ান

তৃতীয় ধরণের পাগল হল সেয়ানা পাগল। এটা সবচেয়ে কঠিন ধরণের পাগলামি। এই পাগল কি সুস্থ না অসুস্থ সেটা বোঝা খুব কঠিন। যখন সে পাগলামি করছে তখন তার কাজকারবার হবে সুস্থ মানুষের মতো। জটিল সব যুক্তি দিয়ে সে তার পাগলামি প্রতিষ্ঠিত করবে। আবার যখন সে সুস্থ থাকবে তখন তার চিন্তা ভাবনা হবে পাগলের মতো। অফিসে এবং বাসায় নিয়মিত ভাবে আমি এই পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে ভালোই লাগে। শুধু মাঝে মধ্যে আমার মাথার মধ্যে জ্যোৎস্না ঢুকে পড়ে। তখন খুব অস্থির লাগে। কেন লাগে জানি না। আপনারা কেউ কি জানেন?

নাভিদ কায়সার রায়ান › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাঁধ ভাঙার আওয়াজ (৫)

১৭ ই জুন, ২০১৩ রাত ১২:০৮

আগের পর্বঃ সমুদ্রযাত্রা (৪) Click This Link





বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের

ছাত্র সংগঠনের একটি করে শাখা থাকে। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস চালায়। আবার বি.এন.পি. থাকলে রাজত্ব করে ছাত্রদল। নামে আলাদা হলেও কাজে-কর্মে-চরিত্রে এরা জমজ ভাই। অনেকটা রাক্ষস আর খোক্কসের মত। তবে এরা “এক জঙ্গলে এক বাঘ” পদ্ধতিতে বিশ্বাসী। ক্ষমতার পালা বদলের সময় এক দল আরেক দলকে মেরে পিটে বের করে দেয়। অনেকে বাঁচার জন্য মুচলেকা দিয়ে দল পাল্টে নতুন দলে নাম লেখায়। যারা গোঁ ধরে বসে থাকে তাদের কপালে থাকে হকি স্টিক আর রডের বাড়ি।

সময়টা খুব খারাপ যায় তখন। চারদিকে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। হুটহাট মারামারি লেগে যায়। একদিন আমরা সবাই ক্লাস শেষে হলে ফেরার পথে দেখলাম একটা ছেলেকে ধোলাই দিয়ে আধমরা করে ফেলে রেখেছে। দূর থেকে দেখে চেনা যায় না। ভয়ে কাছেও যাওয়া যাচ্ছে না। পরে শুনলাম ছেলেটা আমাদেরই ক্লাসমেট। সরাসরি রাজনীতি করত না। তবে যাদের হাতে সে মার খেয়েছে তাদের প্রতিপক্ষের বড় ভাইদের সাথে শুরু থেকেই ওর সখ্যতা ছিল। প্রথম দিকে এসব দেখতে ভয় লাগত। পরে গা সয়া হয়ে গেছে। ঝামেলা এড়ানোর জন্য কোন বড় ভাইয়ের কাছেই যেতাম না। নিজেরা নিজেরা থাকতাম। কারো আগেও না পিছেও না।

ক্যাম্পাসে এরা অন্যদের অর্থাৎ সাধারন ছাত্রদের থেকে আলাদা থাকে। আলাদা থাকার কারনও আছে। রাজনীতি করার কারনে এরা দৃশ্যমান কিছু কিছু ক্ষেত্রে আলাদা সুবিধা পায়। যেমন ক্যান্টিনে তাদের আলাদা বসার জায়গা আছে। ইউনিভার্সিটির বাসে তাদের জন্য সিট নির্দিষ্ট করা আছে, অন্যদের মত ধাক্কা ধাক্কি করে উঠতে হয় না। আমার মত সাধারন ছাত্রের কাছে এটাই অনেক বড় কিছু।

এরকমই একবার ইউনিভার্সিটির বাসে করে ক্যাম্পাসে ফিরছি। আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রামের মূল শহর থেকে প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ক্যাম্পাসে ফেরত যাবার সময় আমরা বলতাম “জঙ্গলে” যাচ্ছি। আর এদিক আসার সময় বলতাম শহর যাচ্ছি। ঢাকা থেকে এখানে এসে, শুরুতে শহর বলতে কেমন যেন লজ্জা লাগত। মনে মনে ভাবতাম, লোকজন তো গ্রাম থেকে শহরে যায়। আমি কি গ্রামে থাকি নাকি? আমাদের ক্যাম্পাসটা আসলেই যে একটা জঙ্গল ছিল সেটা পরে বুঝেছিলাম।

যাই হোক, সেদিন রাতেও আমরা জঙ্গলে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে আমরা দল বেঁধে শহরে যেতাম। সেদিন আমরা দশ-বারোজন ঘোরাঘুরি করার উদ্দেশ্যে সকাল সকাল শহরে এসেছি। দুপুরে হোটেল জামানে ভরপেট খেয়ে, গিয়েছিলাম ফয়েজ লেক। ভাল খাওয়াদাওয়া আর ঘোরাঘুরি করে মেজাজ খুব ফুরফুরে। বাসে উঠেই আমরা যথারীতি একেবারে পেছনের সিট দখল করে হৈচৈ শুরু করলাম। তখন মাত্র ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। বাসার কোন শাসন নেই। আকাজ কুকাজ কি করছি সেটা দেখার কেউ নেই। ইচ্ছা মত বিড়ি-সিগারেট খাও মানা করার কেউ নেই। কী শান্তি! বদমাইশি করার উন্মুক্ত পরিবেশ পেয়ে আমি একদম দিশেহারা হয়ে গেলাম। সারাক্ষণই আমার মাথা থেকে দুনিয়ার বিটলামি বুদ্ধি বের হতে থাকল। আর আমার বন্ধুরা তাতে নির্দ্বিধায় সায় দিয়ে গেল। আর বন্ধুও পেয়েছিলাম একেকটা! সাক্ষাৎ ইবলিসের খালাত ভাই।

বাস কিছু দূর যাবার পর পেছনের গেটে দাঁড়ানো এক বড় ভাই আমাকে ডাক দিলেন,

“অ্যাই ছেলে শুনে যাও।”

আমি লেজ নাড়াতে নাড়াতে কাছে গিয়ে বললাম, “জী ভাইয়া?”

“ফার্স্ট ইয়ার?”

“জী ভাইয়া!”

“কোন ডিপার্টমেন্ট?”

“সিভিল”

“বাসে যে বড় ভাইরা আছে, দেখেতে পাচ্ছো না?”

“দেখতে পাচ্ছি ভাইয়া।”

মৃদু ধমকে বললেন, “তাহলে এত হুড়োহুড়ি করছ কেন?”

“আর হবে না ভাইয়া।”

ক্ষমা প্রার্থনায় কাজ হল না। বড় ভাই আরও জোরে ধমকে উঠেলেন, “বাসে বড় ভাইরা থাকতে সিটে বসেছ কেন? ভদ্রতা জান না?”

কথাটা বলে বুকে একটা ধাক্কা দিলেন। আমার তখন জান যায় যায় অবস্থা। কি করব বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম। কি করেছি এটা আমি? কি দরকার ছিল সিটে বসার? আম্মার কথাই ঠিক, অতিরিক্ত বাড় বেড়েছে আমার। ধরা কে সরা জ্ঞান করতে গিয়েই এই অবস্থা হয়েছে আমার। Shit man!

বড় ভাই তখনও রাগে ফুসছেন। আমি বুঝলাম না। এত রাগে যাবার মত কি করলাম। “ফার্স্ট ইয়ার সব সময় দাঁড়িয়ে যায়। পাশে বড় ভাইরা দাঁড়িয়ে আছে আর তোমরা সিটে বসে ফুর্তি করছ! বেয়াদব কোথাকার!”

কথাটা বলে উনি কসে থাপ্পড় মারার জন্য হাত তুললেন। আরেক বড় ভাই তাকে আটকালেন।

“ছেড়ে দে। পোলাপান।”

“কিসের পোলাপান? এই ব্যাচের যে কয়টা ভর্তি হয়েছে, মেয়ে গুলা বাদে সব কয়টা ছেলে বেয়াদব। বড় ভাই সামনে দিয়ে হেঁটে যায় আর সালাম না দিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে।”

কথা শুনে আমি মনে মনে একটা গালি দিলাম , “শালা লুচ্চা কোথাকার!” আড় চোখে দেখলাম, আশেপাশে আরও কয়েকজন সিনিয়র ভাই এই কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলেন। ভয়ের কথা।

“সবার সামনে সিগারেট খায়। চিমনির মত ভক ভক করে ধোঁয়া ছাড়ে। আবার বাসে উঠেও মাস্তানি!? আজকে ওদের মাস্তানি ছুটায় দিতে হবে।”

আমার বন্ধুরা এতক্ষণ আমার দুরাবস্থা দেখে হৈচৈ থামিয়ে একদম চুপ মেরে গেছে। হুমকি ধামকি শুনে কিছুটা ভয়ও পেয়েছে। ভয় কাটিয়ে সামনে এসে কিছু বলতে সাহস করে উঠতে পারছে না। আবার চোখের সামনে আমাকে এরকম অসহায় অবস্থায় দেখতে হচ্ছে – সেটাও সহ্য করতে পারছে না।

একসময় আমার অসীম সাহসী বন্ধু সজীব একাই সামনে এগিয়ে এল।

“ভাইয়া, এবারের মত মাফ করে দেন। আর হবে না।”

“তুই তাহলে এই গ্রুপের লিডার? অপেক্ষা কর। ক্যাম্পাসে গিয়ে তোদের শায়েস্তা করা হবে।”

আমি আর সজীব অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে রইলাম। অজানা বিপদের আশঙ্কায় আমার বাকি বন্ধুরা নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল।

বাস থামল ক্যান্টিনের সামনে। সবার সাথে সাথে আমরাও নামলাম। একবার ভাবলাম দৌড় দেই। আজকের রাতটা বাইরে কাটাবো। ভোরে প্রথম বাসে করে ঢাকা। এখানে আর না।

সবাই ভেবেছিল ঝড়টা আমার আর সজীবের উপর দিয়েই যাবে। কিন্তু তা হল না। পাঁচ-ছয়জন ভাইয়া আমাদের সব কয়টাকে ঘাড়ে ধরে ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে ক্যান্টিনে ঢুকাল। ফুয়াদের বড় ভাই মর্তুজা তখন ফোর্থ ইয়ারে পড়েন। মর্তুজা ভাইয়ের কারনে ফুয়াদকে ছেড়ে দেয়া হল। ও কিছুক্ষণ থেকে চেষ্টা করল আমাদের ছাড়ানোর। ব্যর্থ হয়ে গুলির বেগে ছুটল মর্তুজা ভাইকে ডেকে আনতে।

ভেতরে আমাদের লাইন দিয়ে দাঁড় করানো হল। নিজেদের তখন চোরের মত লাগছিল। এরকম হেনস্থা হতে হবে কে জানত! লজ্জা আর অপমানে সবার চোখে পানিছল ছল করছে। লাইনে সবার সামনে সজীব, তার পেছনে আমি।

“খুব মাস্তান না?”

বলে হঠাৎ শুরু হল এলোপাথাড়ি চড় থাপ্পড়! আমরা কোন রকমে হাত দিয়ে মার ঠেকানোর চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। এর মধ্যে সজীব কি যেন বলে ওঠায় বেশীর ভাগ মার ওর ওপর দিয়েই গেল। বন্ধুকে এই বিপদে কোন রকম সাহায্য করতে না পেরে বুকে বড় ব্যাথা লেগেছিল সেদিন।

মনের ঝাল মিটেয়ে ওরা আমাদের একসময় ছেড়ে দিল। সাবধান করে দিল, আমাদের আর কখনো যেন কোন ধরনের বেয়াদবি করতে না দেখা যায়।

আমরা মাথা নিচু করে হোস্টেলে ফিরে এলাম।

শোকে-দুঃখে, লজ্জায় আর অপমানে রাতে আমরা কিছুই খেলাম না।

ঘটনাটা হয়ত খুব ছোট্ট কিন্তু এই ছোট্ট ঘটনার সূত্র ধরেই পরবর্তীতে আমাদের পরিচয় হয় ছাত্র-রাজনীতির সাথে।

সেদিন আমরা বুঝেছিলাম যে জীবনে শুধু অস্তিত্ব থাকলেই হয় না, ক্ষমতাও থাকতে হয়।



পরবর্তী পর্বঃ পূর্ব কথন (৬) Click This Link



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.